10-10-2021, 09:00 AM
এইভাবেই দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে শারদীয়া চলে এলো। মহালয়া হয়ে গেছে। আজ পঞ্চমী। কলের কলকাতা নববধূ রুপে সেজে উঠেছে। কলেজ টিউশন ছুটি হয়ে গেছে এক সপ্তাহ আগে। সবার নতুন জামা কাপড়ও কেনা হয়ে গেছে। ষষ্ঠীর আর একদিন বাকি। ষষ্ঠীর সকালেই তো মা আসবে সোসাইটিতে । সোসাইটির কমিউনিটি হল , প্যান্ডেল সব প্রায় তৈরি , শুধু মায়ের অপেক্ষা।
বিকাল পাঁচটার দিকে আকাশদের ফ্ল্যাটে কলিংবেল বেজে উঠতে স্নেহা দেবী গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলে তিনি একমুহূর্ত স্থির হয়ে গেলেন। দরজার ওপারে তিলোত্তমা দাঁড়িয়ে আছে দেড় বছরের অজয়কে কোলে নিয়ে। আগের থেকে একটু বেশিই মুটিয়ে গেছে যেন ।
ননদ কে চুপচাপ থাকতে দেখে আকাশের মামী হেসে বলে উঠলেন “ ভিতরে আসতে বলবে না ! „
স্নেহা দেবীর তখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কাটেনি। তিনি চুপচাপ চৌকাঠ থেকে সরে দাঁড়ালেন। আকাশের মা দরজা থেকে সরে দাঁড়াতে তিলোত্তমা লিভিংরুমে ঢুকে পড়লো। তারপর লিভিংরুমের চারিদিকে দেখতে দেখতে বললো “ এই প্রথম এলাম তোমাদের বাড়িতে। কলকাতাতে এসেছিলাম প্রায় পনের বছর আগে......
আকাশের মামীর কথা শেষ হওয়ার আগেই আকাশের মামা দুটো সুটকেস হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মুখে তার সংকোচ এবং কিছুটা অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। এবার স্নেহা দেবী ভাইকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন । প্রায় গর্জিয়ে উঠলেন “ তুই এখানে এসছিস কেন ? তোর কেউ নেই এখানে । „
“ দিদি প্লিজ ওকে ক্ষমা করে দাও । এই নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক অশান্তি হয়েছে । „ স্বামীর হয়ে তিলোত্তমাই ক্ষমা চেয়ে নিল ।
“ তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে তা জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। „ ভাইয়ের বউকে বেশ রাগী স্বরে কথাটা বলে নিজের ভাইয়ের দিকে ফিরে আকাশের মা বললেন “ চলে যা এখান থেকে । আমি তোর মুখ দেখতে চাই না। তোর জন্য মা কতো কষ্ট পেয়েছিল সেটা ভেবেই আমার বুক কেঁপে উঠছে। তোর এখানে কেউ নেই , যে ছিল সে এখন বেঁচে নেই .......
ননদের রাগ কমছে না দেখে তিলোত্তমা একটা ফন্দি বার করলো “ কিন্তু অজয়ের তো আছে । „ বলে অজয়কে ননদের কোলে তুলে দিলেন।
নারী হৃদয় এক শিশুকে তার কোলে পেলে তার হৃদয় আরও বেশি কোমল হয়ে ওঠে। তিলোত্তমা অজয়কে ননদের কোলে দিতেই দুটো ঘটনা ঘটলো । এতক্ষণ ধরে অজয় আকাশের মাকে রেগে রেগে কথা বলতে শুনছিল তাই যখনই তিলোত্তমা তাকে আকাশের মায়ের কোলে দিয়ে দিল তখনই সে ভ্যা করে “ মা „ বলে কেঁদে ফেললো । এদিকে নিজের একমাত্র ভাইপোকে কাঁদতে দেখে আকাশের মায়ের রাগ গলে জল হয়ে গেল “ ওলে বাবালে কাঁদে না , কাঁদে না , কিছু হয়নি ! এইতো মা । দেখো দাড়িয়ে আছে । „ বলে অজয়কে তিলোত্তমার কোলে তুলে দিতে গেলেন।
অজয় কাঁদলেও এবং স্নেহা দেবী অজয় কে তিলোত্তমার কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও অজয়কে কোলে নেওয়ার বিন্দুমাত্র উৎসাহ তিলোত্তমার মধ্যে দেখা গেল না। সে আকাশের মামার দিকে বড়ো বড়ো চোখ বার করে কিছু একটা ইশারা করলো। স্ত্রীর চোখের ইশারা বুঝতে পেরে আকাশের মামা মাথা নিচু করেই বললো “ আমায় ক্ষমা করে দে দিদি । মা আমায় ডেকে ছিল আমি জানি। আমাদের এখানে আসা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু পুজার আগেই দিল্লিতে একটা কাজ পরে গেল তাই বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল . .......
আকাশের মা ভাইয়ের অজুহাতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই আকাশ ঘরে ঢুকলো । আকাশ নিচে প্যান্ডেলের সাজগোজ দেখছিল । এখন ঘরে ফিরেই এই নতুন মুখ দেখে দাড়িয়ে পড়লো। এদিকে আকাশের মামা মামিও এই 5'4 ইঞ্চির ছেলেটাকে চিনতে পারলো না। কিন্তু তিলোত্তমা আন্দাজ করে আকাশকে চিনতে পারলো “ এ মা ! কতো বড়ো হয়ে গেছো তুমি । মুম্বাইতে যখন তোমাকে দেখেছিলাম তখন তুমি এইটুকু ছিলে। কেমন আছো ? চিনতে পেরেছো আমাদের ? „
মুম্বাইয়ের কথা আসতে আকাশ আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো। মামার বিয়ের সময় মুম্বাইতে সে গিয়েছিল । তার মানে এরা দুজন মামা মামি। আর ওই তো মায়ের কোলে অজয়। বাবার ফোনে একবার এর ফটো দেখেছিলাম। দিদিমা একবার এর ফটো দেখিয়ে বলেছিলেন “ তোর মামাতো ভাই । „ আজকে চিনতে পারার পর আকাশ হেসে জবাব দিল “ মামা মামি । আমি ভালো আছি আর তুমি ? „
“ আমিও ভালো আছি। এখন কোন ক্লাসে পড়ো তুমি ? „
“ এখন ক্লাস এইট। „ বলে আরও একটু হেসে ব্যাস্ত হওয়ার ভান করে আকাশ বললো “ তোমরা বসো না ! দাঁড়িয়ে আছো কেন ? „
এই প্রথম কেউ অভ্যর্থনা করলো এবং বসতেও বললো । আকাশের কথায় মামা আর মামি সোফায় বসে পড়লো। এদিকে অজয় পিসির আদরে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। স্নেহা দেবী অজয়ের সাথে খেলতে খেলতেই অজয়ের মা বাবার উদ্দেশ্যে বললেন “ তোরা এতদূর থেকে এসছিস আগে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর কথা বলবি। „
কিছুক্ষন পর সন্ধ্যা পড়লেই আকাশের বাবা অফিস থেকে ফিরে এলেন। স্নেহা দেবী আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই অতিথিদের জন্য তিনি পাঠার মাংস কিনে নিয়ে এলেন। আকাশের বাবা ফ্ল্যাটে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন “ কেমন আছো তোমরা ? „
স্নেহাংশু বললো “ আমরা ভালো আছি জামাইবাবু। আপনি কেমন আছেন ? „
“ আমি তো ভালোই আছি। শেষমেশ তোমরা এলে ভালো লাগলো। কিন্তু আসতে একটু বেশি দেরি করে ফেললে। „ বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন আকাশের বাবা।
কথাটা কি জন্য বলা হয়েছে সেটা আকাশের মামা মামি দুজনেই বুঝতে পারলো। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। কি আর বলবেন ! একজন মৃত্যুর আগে তার নাতি আর ছেলেকে দেখতে চেয়েছিলেন। সেই আশাটা পূরন করতে পারে নি এরা। এরপর আর কি বলার থাকতে পারে।
রাতে মাংস ভাত খাওয়ার সময় শুভাশীষ বাবু বললেন “ তা তোমার প্ল্যান কি ? মানে কলকাতায় এসছো ঘুরবে টুরবে তো নাকি ? „
“ অবশ্যই। কলকাতায় এসে ঠাকুর দেখবো না তা কি হয় ! ভাবছি কবে যাবো ! „ মুখের গ্রাসটা শেষ করে বললো তিলোত্তমা
“ আজ এসছো। কাল রেস্ট নিয়ে সপ্তমীর দিন যেও । „
“ তোমাদেরকেও যেতে হবে কিন্তু । „ মিষ্টি স্বরে আবদারটা করেই ফেললো তিলোত্তমা
“ না , না । আমার এখানে কাজ আছে আর স্নেহাও কাল থেকে পুজার কাজে ব্যাস্ত হয়ে যাবে। তুমি আকাশকে নিয়ে যাও। „
“ আমি । „ অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো আকাশ। মামা মামি হলেও এরা অচেনা মানুষ। ঠিক ভাবে কখনো কথাই হয়নি। আর এদের সাথে ঠাকুর দেখতে বার হলে একটা অস্বাচ্ছন্দ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হবে।
“ হ্যাঁ তুমি। কেন ? মামা মামির সাথে যেতে অসুবিধা আছে ! „ ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললো তিলোত্তমা
“ না , তা ঠিক নয়। আমি আসলে সুচি আর সুমিদি দের সাথে পুজায় ঘুরি । „
“ সুচি সুমি ! „ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো তিলোত্তমা।
“ ওই আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে । „
“ তাহলে ওদেরকেও নিয়ে নাও । „
পরের দিন সকাল হতেই আকাশ সুচি-সুমির ঘরে উপস্থিত হলো। ঘরে ঢুকেই সে ঘোষণা করলো “ কালকে মামা মামির সাথে ঠাকুর দেখতে যাবো। তোকেও যেতে হবে । „
“ তুই তোর মামা মামির সাথে যাবি। আমি যাবো কেন ? „
“ দেখ , তোর পায় পড়ি। আমাকে বাঁচা। ওদের সাথে গেলে আমার একা একা লাগবে । „ এরপর আর সুচি কিছু বললো না। নিরবতা সম্মতির লক্ষন মেনে নিয়ে আকাশ সুমির দিকে ফিরে বললো “ তোমাকেও যেতে হবে কিন্তু । „
“ আমাকে কেন টানছিস এরমধ্যে ! „ বলে উঠলো সুমি।
আকাশ নাক কুঁচকে কোন শব্দ না করে ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বললো প্লিজ প্লিজ প্লিজ। আকাশের এইরকম আচরণ দেখে সুমি হা হা করে হেসে উঠলো।
বেলার দিকে সোসাইটিতে মা আসার সময় তিলোত্তমা সুচি আর সুমির সাথে পরিচয় করলো। নানা ধরনের প্রশ্নের উত্তরের আদানপ্রদান চলতে লাগলো। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর তিলোত্তমা বললো “ কালকে আমরা ঠাকুর দেখতে যাচ্ছি। তোমাদেরও যেতে হবে কিন্তু । „
অজয়কে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে সুচি দুই গালে টোল ফেলে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে হ্যাঁ বলে দিল ।
সপ্তমীর দিন বিকাল পড়তেই আকাশ আর আকাশের মামা পাঞ্জাবী পড়ে আকাশের বাবার জাগুয়ারের পাশে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় আধঘণ্টা পর আকাশের মামি তারপর সুচি আর সুমি নিচে নেমে এলো। আকাশের মামি একটা হলুদ রঙের গাউন পড়েছে , সুমি পড়েছে সবুজ রঙের শাড়ি আর সুচি পড়েছে আকাশি রঙের একটা শাড়ি। সুচির সাজগোজ দেখে তিলোত্তমা বললো “ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে । তোমার ফিগারটাও একদম নায়িকাদের মতো । খুব মানিয়েছে শাড়িটা । „
নায়িকাদের মতো শুনেই আকাশ ফিক করে হেসে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো “ নায়িকা ! „
আকাশের ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দেখে সুচি আকাশের দিকে কটমটিয়ে তাকালো। আকাশ বুঝলো এখন যদি রেগে গিয়ে সুচি যেতে রাজি না হয় তাহলে তো এখন মাঝ গঙ্গায় হাবুডুবু খাবে ! তাই সুচির রাগ কমানোর জন্য বললো “ ও কিন্তু খুব ভালো নাচে। কালকে আমাদের এখানে প্রতিযোগিতায় হবে তখন দেখো ওর নাচ। „
আকাশের মুখে প্রশংসা শুনে সুচি শান্ত হলো। তারপর পাঁচ জন আর পুচকে অজয় মিলে কলকাতা শহরে ঠাকুর দেখতে বার হলো। রাস্তায় যেতে যেতে তিলোত্তমা সুচিকে বললো “ তুমি কোন ডায়েট করো ? „
সুচি মাথা নেড়ে না বলে দিল। ডায়েটের কথা শুনে আকাশ মুচকি হাসি হাসতে হাসতে ভাবলো ---- ‘ ডায়েট ! এর খাওয়া দেখলে কুম্ভকর্ণ ও লজ্জা পেয়ে যাবে ! আর এ করবে ডায়েট। ‚ আকাশের হাসি সুচি দেখতে পেল না। কারন পিছনের সিটে আকাশ আর সুচির মাঝখানে সুমি বসেছে ।
এদিকে তিলোত্তমা আরও বলে চললো “ আমাদের সোসাইটির বাইরেই একটা Gym আছে। ওখানে প্রোফেসনাল ট্রেনার ট্রেনিং করায়। বিভিন্ন হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকারা আসে। ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রেনিং করে শুধু তোমার মতো ফিগার পাওয়ার জন্য। „
বাচ্চা নিয়ে ঘোরা যায় না। চার পাঁচটা প্যান্ডেলে ঘুরে কিছু খেয়ে অজয়ের কান্নার জন্য তাদের ফিরে আসতে হলো।
পরের দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিলোত্তমা সুচির নাচ দেখে খুব প্রশংসা করলো। বিজয়া দশমীতে তিলোত্তমা আকাশের মা আর সুচির মায়ের সাথে সিঁদুর খেলে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে সবাইকে বলে গেল “ এবার থেকে নিয়মিত আসবো কিন্তু। „ সুচি - আকাশ, আকাশের মা সোসাইটির গেট পর্যন্ত এসে তাদের ট্যাক্সিতে তুলে বিদায় দিলেন।
ট্যাক্সিতে যেতে যেতে এতদিনে মনের ভিতর চেপে রাখা কথাটা বলেই ফেললো তিলোত্তমা “ আকাশের বাবাকে দেখে বোঝাই যায় না উনি কোটি টাকা কামান। দেখে তো মনে হয় কোন বেসরকারি কোম্পানির সামান্য কর্মচারী। সত্যিই কি কোটি টাকা আয় হয় ওনার !
স্ত্রীর কথায় হো হো করে হেসে আকাশের মামা বললো “ ঠিক এই কারনেই বাবা আর মা জামাইবাবুকে এতোটা পছন্দ করতো। শুধু ওই জাগুয়ার গাড়িটা দেখে মনে হয় উনি ধনী। তাছাড়া কোন জাকজমক নেই , শখ আহ্লাদ নেই , আমোদ নেই , বিলাসিতা নেই। একদম সাদামাটা আর খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন জামাইবাবু। „
পুজার ছুটি শেষ হওয়ার পর সুচি একটু ভয় ভয়ে কোচিং গেলো কারন সে ছুটির আগে বেশ কিছুদিন টিউশন ছুটি করেছিল। টিউশনে গিয়ে স্যারকে বেশ খোশমেজাজে দেখলো সুচি । স্যার বললেন “ যারা যারা পুজার ছুটির আগে কামাই করেছো তারা গৌরবের কাছ থেকে নোটস নিয়ে নাও। „
বিকাল পাঁচটার দিকে আকাশদের ফ্ল্যাটে কলিংবেল বেজে উঠতে স্নেহা দেবী গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলে তিনি একমুহূর্ত স্থির হয়ে গেলেন। দরজার ওপারে তিলোত্তমা দাঁড়িয়ে আছে দেড় বছরের অজয়কে কোলে নিয়ে। আগের থেকে একটু বেশিই মুটিয়ে গেছে যেন ।
ননদ কে চুপচাপ থাকতে দেখে আকাশের মামী হেসে বলে উঠলেন “ ভিতরে আসতে বলবে না ! „
স্নেহা দেবীর তখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কাটেনি। তিনি চুপচাপ চৌকাঠ থেকে সরে দাঁড়ালেন। আকাশের মা দরজা থেকে সরে দাঁড়াতে তিলোত্তমা লিভিংরুমে ঢুকে পড়লো। তারপর লিভিংরুমের চারিদিকে দেখতে দেখতে বললো “ এই প্রথম এলাম তোমাদের বাড়িতে। কলকাতাতে এসেছিলাম প্রায় পনের বছর আগে......
আকাশের মামীর কথা শেষ হওয়ার আগেই আকাশের মামা দুটো সুটকেস হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মুখে তার সংকোচ এবং কিছুটা অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। এবার স্নেহা দেবী ভাইকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন । প্রায় গর্জিয়ে উঠলেন “ তুই এখানে এসছিস কেন ? তোর কেউ নেই এখানে । „
“ দিদি প্লিজ ওকে ক্ষমা করে দাও । এই নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক অশান্তি হয়েছে । „ স্বামীর হয়ে তিলোত্তমাই ক্ষমা চেয়ে নিল ।
“ তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে তা জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। „ ভাইয়ের বউকে বেশ রাগী স্বরে কথাটা বলে নিজের ভাইয়ের দিকে ফিরে আকাশের মা বললেন “ চলে যা এখান থেকে । আমি তোর মুখ দেখতে চাই না। তোর জন্য মা কতো কষ্ট পেয়েছিল সেটা ভেবেই আমার বুক কেঁপে উঠছে। তোর এখানে কেউ নেই , যে ছিল সে এখন বেঁচে নেই .......
ননদের রাগ কমছে না দেখে তিলোত্তমা একটা ফন্দি বার করলো “ কিন্তু অজয়ের তো আছে । „ বলে অজয়কে ননদের কোলে তুলে দিলেন।
নারী হৃদয় এক শিশুকে তার কোলে পেলে তার হৃদয় আরও বেশি কোমল হয়ে ওঠে। তিলোত্তমা অজয়কে ননদের কোলে দিতেই দুটো ঘটনা ঘটলো । এতক্ষণ ধরে অজয় আকাশের মাকে রেগে রেগে কথা বলতে শুনছিল তাই যখনই তিলোত্তমা তাকে আকাশের মায়ের কোলে দিয়ে দিল তখনই সে ভ্যা করে “ মা „ বলে কেঁদে ফেললো । এদিকে নিজের একমাত্র ভাইপোকে কাঁদতে দেখে আকাশের মায়ের রাগ গলে জল হয়ে গেল “ ওলে বাবালে কাঁদে না , কাঁদে না , কিছু হয়নি ! এইতো মা । দেখো দাড়িয়ে আছে । „ বলে অজয়কে তিলোত্তমার কোলে তুলে দিতে গেলেন।
অজয় কাঁদলেও এবং স্নেহা দেবী অজয় কে তিলোত্তমার কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও অজয়কে কোলে নেওয়ার বিন্দুমাত্র উৎসাহ তিলোত্তমার মধ্যে দেখা গেল না। সে আকাশের মামার দিকে বড়ো বড়ো চোখ বার করে কিছু একটা ইশারা করলো। স্ত্রীর চোখের ইশারা বুঝতে পেরে আকাশের মামা মাথা নিচু করেই বললো “ আমায় ক্ষমা করে দে দিদি । মা আমায় ডেকে ছিল আমি জানি। আমাদের এখানে আসা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু পুজার আগেই দিল্লিতে একটা কাজ পরে গেল তাই বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল . .......
আকাশের মা ভাইয়ের অজুহাতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই আকাশ ঘরে ঢুকলো । আকাশ নিচে প্যান্ডেলের সাজগোজ দেখছিল । এখন ঘরে ফিরেই এই নতুন মুখ দেখে দাড়িয়ে পড়লো। এদিকে আকাশের মামা মামিও এই 5'4 ইঞ্চির ছেলেটাকে চিনতে পারলো না। কিন্তু তিলোত্তমা আন্দাজ করে আকাশকে চিনতে পারলো “ এ মা ! কতো বড়ো হয়ে গেছো তুমি । মুম্বাইতে যখন তোমাকে দেখেছিলাম তখন তুমি এইটুকু ছিলে। কেমন আছো ? চিনতে পেরেছো আমাদের ? „
মুম্বাইয়ের কথা আসতে আকাশ আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো। মামার বিয়ের সময় মুম্বাইতে সে গিয়েছিল । তার মানে এরা দুজন মামা মামি। আর ওই তো মায়ের কোলে অজয়। বাবার ফোনে একবার এর ফটো দেখেছিলাম। দিদিমা একবার এর ফটো দেখিয়ে বলেছিলেন “ তোর মামাতো ভাই । „ আজকে চিনতে পারার পর আকাশ হেসে জবাব দিল “ মামা মামি । আমি ভালো আছি আর তুমি ? „
“ আমিও ভালো আছি। এখন কোন ক্লাসে পড়ো তুমি ? „
“ এখন ক্লাস এইট। „ বলে আরও একটু হেসে ব্যাস্ত হওয়ার ভান করে আকাশ বললো “ তোমরা বসো না ! দাঁড়িয়ে আছো কেন ? „
এই প্রথম কেউ অভ্যর্থনা করলো এবং বসতেও বললো । আকাশের কথায় মামা আর মামি সোফায় বসে পড়লো। এদিকে অজয় পিসির আদরে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। স্নেহা দেবী অজয়ের সাথে খেলতে খেলতেই অজয়ের মা বাবার উদ্দেশ্যে বললেন “ তোরা এতদূর থেকে এসছিস আগে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর কথা বলবি। „
কিছুক্ষন পর সন্ধ্যা পড়লেই আকাশের বাবা অফিস থেকে ফিরে এলেন। স্নেহা দেবী আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই অতিথিদের জন্য তিনি পাঠার মাংস কিনে নিয়ে এলেন। আকাশের বাবা ফ্ল্যাটে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন “ কেমন আছো তোমরা ? „
স্নেহাংশু বললো “ আমরা ভালো আছি জামাইবাবু। আপনি কেমন আছেন ? „
“ আমি তো ভালোই আছি। শেষমেশ তোমরা এলে ভালো লাগলো। কিন্তু আসতে একটু বেশি দেরি করে ফেললে। „ বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন আকাশের বাবা।
কথাটা কি জন্য বলা হয়েছে সেটা আকাশের মামা মামি দুজনেই বুঝতে পারলো। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। কি আর বলবেন ! একজন মৃত্যুর আগে তার নাতি আর ছেলেকে দেখতে চেয়েছিলেন। সেই আশাটা পূরন করতে পারে নি এরা। এরপর আর কি বলার থাকতে পারে।
রাতে মাংস ভাত খাওয়ার সময় শুভাশীষ বাবু বললেন “ তা তোমার প্ল্যান কি ? মানে কলকাতায় এসছো ঘুরবে টুরবে তো নাকি ? „
“ অবশ্যই। কলকাতায় এসে ঠাকুর দেখবো না তা কি হয় ! ভাবছি কবে যাবো ! „ মুখের গ্রাসটা শেষ করে বললো তিলোত্তমা
“ আজ এসছো। কাল রেস্ট নিয়ে সপ্তমীর দিন যেও । „
“ তোমাদেরকেও যেতে হবে কিন্তু । „ মিষ্টি স্বরে আবদারটা করেই ফেললো তিলোত্তমা
“ না , না । আমার এখানে কাজ আছে আর স্নেহাও কাল থেকে পুজার কাজে ব্যাস্ত হয়ে যাবে। তুমি আকাশকে নিয়ে যাও। „
“ আমি । „ অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো আকাশ। মামা মামি হলেও এরা অচেনা মানুষ। ঠিক ভাবে কখনো কথাই হয়নি। আর এদের সাথে ঠাকুর দেখতে বার হলে একটা অস্বাচ্ছন্দ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হবে।
“ হ্যাঁ তুমি। কেন ? মামা মামির সাথে যেতে অসুবিধা আছে ! „ ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললো তিলোত্তমা
“ না , তা ঠিক নয়। আমি আসলে সুচি আর সুমিদি দের সাথে পুজায় ঘুরি । „
“ সুচি সুমি ! „ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো তিলোত্তমা।
“ ওই আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে । „
“ তাহলে ওদেরকেও নিয়ে নাও । „
পরের দিন সকাল হতেই আকাশ সুচি-সুমির ঘরে উপস্থিত হলো। ঘরে ঢুকেই সে ঘোষণা করলো “ কালকে মামা মামির সাথে ঠাকুর দেখতে যাবো। তোকেও যেতে হবে । „
“ তুই তোর মামা মামির সাথে যাবি। আমি যাবো কেন ? „
“ দেখ , তোর পায় পড়ি। আমাকে বাঁচা। ওদের সাথে গেলে আমার একা একা লাগবে । „ এরপর আর সুচি কিছু বললো না। নিরবতা সম্মতির লক্ষন মেনে নিয়ে আকাশ সুমির দিকে ফিরে বললো “ তোমাকেও যেতে হবে কিন্তু । „
“ আমাকে কেন টানছিস এরমধ্যে ! „ বলে উঠলো সুমি।
আকাশ নাক কুঁচকে কোন শব্দ না করে ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বললো প্লিজ প্লিজ প্লিজ। আকাশের এইরকম আচরণ দেখে সুমি হা হা করে হেসে উঠলো।
বেলার দিকে সোসাইটিতে মা আসার সময় তিলোত্তমা সুচি আর সুমির সাথে পরিচয় করলো। নানা ধরনের প্রশ্নের উত্তরের আদানপ্রদান চলতে লাগলো। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর তিলোত্তমা বললো “ কালকে আমরা ঠাকুর দেখতে যাচ্ছি। তোমাদেরও যেতে হবে কিন্তু । „
অজয়কে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে সুচি দুই গালে টোল ফেলে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে হ্যাঁ বলে দিল ।
সপ্তমীর দিন বিকাল পড়তেই আকাশ আর আকাশের মামা পাঞ্জাবী পড়ে আকাশের বাবার জাগুয়ারের পাশে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় আধঘণ্টা পর আকাশের মামি তারপর সুচি আর সুমি নিচে নেমে এলো। আকাশের মামি একটা হলুদ রঙের গাউন পড়েছে , সুমি পড়েছে সবুজ রঙের শাড়ি আর সুচি পড়েছে আকাশি রঙের একটা শাড়ি। সুচির সাজগোজ দেখে তিলোত্তমা বললো “ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে । তোমার ফিগারটাও একদম নায়িকাদের মতো । খুব মানিয়েছে শাড়িটা । „
নায়িকাদের মতো শুনেই আকাশ ফিক করে হেসে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো “ নায়িকা ! „
আকাশের ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দেখে সুচি আকাশের দিকে কটমটিয়ে তাকালো। আকাশ বুঝলো এখন যদি রেগে গিয়ে সুচি যেতে রাজি না হয় তাহলে তো এখন মাঝ গঙ্গায় হাবুডুবু খাবে ! তাই সুচির রাগ কমানোর জন্য বললো “ ও কিন্তু খুব ভালো নাচে। কালকে আমাদের এখানে প্রতিযোগিতায় হবে তখন দেখো ওর নাচ। „
আকাশের মুখে প্রশংসা শুনে সুচি শান্ত হলো। তারপর পাঁচ জন আর পুচকে অজয় মিলে কলকাতা শহরে ঠাকুর দেখতে বার হলো। রাস্তায় যেতে যেতে তিলোত্তমা সুচিকে বললো “ তুমি কোন ডায়েট করো ? „
সুচি মাথা নেড়ে না বলে দিল। ডায়েটের কথা শুনে আকাশ মুচকি হাসি হাসতে হাসতে ভাবলো ---- ‘ ডায়েট ! এর খাওয়া দেখলে কুম্ভকর্ণ ও লজ্জা পেয়ে যাবে ! আর এ করবে ডায়েট। ‚ আকাশের হাসি সুচি দেখতে পেল না। কারন পিছনের সিটে আকাশ আর সুচির মাঝখানে সুমি বসেছে ।
এদিকে তিলোত্তমা আরও বলে চললো “ আমাদের সোসাইটির বাইরেই একটা Gym আছে। ওখানে প্রোফেসনাল ট্রেনার ট্রেনিং করায়। বিভিন্ন হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকারা আসে। ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রেনিং করে শুধু তোমার মতো ফিগার পাওয়ার জন্য। „
বাচ্চা নিয়ে ঘোরা যায় না। চার পাঁচটা প্যান্ডেলে ঘুরে কিছু খেয়ে অজয়ের কান্নার জন্য তাদের ফিরে আসতে হলো।
পরের দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিলোত্তমা সুচির নাচ দেখে খুব প্রশংসা করলো। বিজয়া দশমীতে তিলোত্তমা আকাশের মা আর সুচির মায়ের সাথে সিঁদুর খেলে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে সবাইকে বলে গেল “ এবার থেকে নিয়মিত আসবো কিন্তু। „ সুচি - আকাশ, আকাশের মা সোসাইটির গেট পর্যন্ত এসে তাদের ট্যাক্সিতে তুলে বিদায় দিলেন।
ট্যাক্সিতে যেতে যেতে এতদিনে মনের ভিতর চেপে রাখা কথাটা বলেই ফেললো তিলোত্তমা “ আকাশের বাবাকে দেখে বোঝাই যায় না উনি কোটি টাকা কামান। দেখে তো মনে হয় কোন বেসরকারি কোম্পানির সামান্য কর্মচারী। সত্যিই কি কোটি টাকা আয় হয় ওনার !
স্ত্রীর কথায় হো হো করে হেসে আকাশের মামা বললো “ ঠিক এই কারনেই বাবা আর মা জামাইবাবুকে এতোটা পছন্দ করতো। শুধু ওই জাগুয়ার গাড়িটা দেখে মনে হয় উনি ধনী। তাছাড়া কোন জাকজমক নেই , শখ আহ্লাদ নেই , আমোদ নেই , বিলাসিতা নেই। একদম সাদামাটা আর খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন জামাইবাবু। „
পুজার ছুটি শেষ হওয়ার পর সুচি একটু ভয় ভয়ে কোচিং গেলো কারন সে ছুটির আগে বেশ কিছুদিন টিউশন ছুটি করেছিল। টিউশনে গিয়ে স্যারকে বেশ খোশমেজাজে দেখলো সুচি । স্যার বললেন “ যারা যারা পুজার ছুটির আগে কামাই করেছো তারা গৌরবের কাছ থেকে নোটস নিয়ে নাও। „