03-10-2021, 08:51 PM
অপ্রাপ্তি প্রাপ্তি,,,,,,,
অফিসে মাস ছয়েক আগে জয়েন করেছিল রিনিতা। বছর আঠাশের প্রাণচঞ্চল, সদা হাস্য ,স্মার্ট, সুন্দরী এই তরুণীর সাহচর্যে নিজেকে ধন্য মনে করত সুমিত। ঠিক এমন একটি আধুনিকা মেয়েই সে চেয়েছিল। রিনিতার সঙ্গ ভীষণভাবে উপভোগ করত সুমিত।
রিনিতাকে বিয়ে করার কথাও ভেবেছিল কিন্তু মা হঠাৎ দিব্যি টিব্যি দিয়ে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করল।
বিয়ের পর থেকে অবশ্য বেলার দিক থেকে স্বামী সেবায় কোন ত্রুটি ছিল না । ঘরের সমস্ত কাজ একা হাতে করে বেলা। অন্যান্য বউদের মত শাড়ি গয়নার প্রতি লোভ নেই। সুমিতের প্রতি তার নির্ভরতাও অসীম। কিন্তু তবুু সুমিতের মনে হয় , জোর করে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বেলাকে।
সুমিত মনে করত, বেলা যেহেতু রূপসী নয় উপরন্তু গরীব ঘরের মেয়ে তাই তার কাছে এমন সুদর্শন, উপার্জনশীল পাত্র তো আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো, আর সে যা যা করে তা তার কর্তব্যের মধ্যেই পরে।
বেলা আধুনিকা নয়, নিতান্তই ঘোর সংসারী একটা মেয়ে, নিত্য পূজা , শাঁখা, সিঁদুর , শাড়ি এসবের বাইরে নিজেকে ভাবতেও পারে না । কিন্তু এসব সুমিতের কাছে ভীষণভাবে ব্যাকডেটেড মনে হয়। ঘরোয়া স্ত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ অনুভব করে না সে।
বেলা বিয়ের পর পর অনেক চেষ্টা করছে সুমিতের মনের নাগাল পাওয়ার কিন্তু বার বার ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে। রাতের পর রাত বেলা বালিশ চেপে কেঁদেছে কিন্তু সুমিত একবারের জন্যও ফিরে দেখে নি , হঠাৎ হঠাৎ যখন নিজের প্রয়োজন হয়েছে তখন কাছে এসেছে কিন্তু সেটাও খুব কম । অবশ্য ঝগড়া ঝাটি করে না সুমিত , নিজের জগত নিয়েই ব্যস্ত সে।
নামে মাত্র বিবাহিত জীবন কিন্তু সুখি দাম্পত্য কদাচ নয়। কোথাও যেন একটা ছন্দ পতন রয়েই গেছে।
বিয়ের একবছরের মাথায় হঠাৎ মায়ের শরীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে বেলাকে মাসখানেকের জন্য গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছিল সুমিত।
সেই সময়ই রিনিতার সাথে ঘনিষ্ঠতা মাত্রা ছাড়ায়।
ভালোলাগাটা যে একতরফা নয় তা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল সুমিত । একটা সময়ের পর রিনিতা নিজেই ধরা দিয়েছিল আর সুমিতও ভেসে গিয়েছিল প্রেম জোয়ারে।
রিনিতা ভীষণ খোলামেলা এবং ওপেন মাইন্ডেড মেয়ে। সুমিত যে বিবাহিত সে সম্পর্কেও তার মাথা ব্যাথা নেই, শরীর নিয়েও শূচিবায়ুগ্রস্থতা একেবারেই নেই, স্ত্রীর অবর্তমানে দুটি শরীর কাছে আসতেও বেশি সময় নেয় নি। সুমিতের বিবাহিত জীবনের অপূর্ণতা দূর হয়ে গিয়েছিল রিনিতার দুরন্ত আবেগের জোয়ারে।
বাড়ি থেকে একমাসের আগেই বেলা ফিরে এসেছিল অবশ্য ফিরে এসেছিল বললে ভুল হবে মা জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিল ছেলের অসুবিধার কথা ভেবে।
তারপর থেকে বেলা লক্ষ্য করছিল সুমিত যেন আরো বদলে গেছে। সুমিত বেশিরভাগ দিন পাশের ঘরে শোয়, গভীর রাত অবধি ফোনেই নিবিষ্ট থাকে।
বেলা তার শান্ত স্বভাব বজায় রেখেই কয়েকবার জানতে চেয়েছে তার স্ত্রীর কর্তব্যে কোন ঘাটতি আছে কিনা। সুমিতের কাছে একটাই উত্তর ছিল অফিসে কাজের ভীষণ চাপ।
অনুনয় বিনয় করেও কোন লাভ হয় নি সুমিত পাকাপাকি ভাবেই বিছানা আলাদা করে নিয়েছিল।
ছয়মাসের বেশি হয়ে গিয়েছিল রিনিতার সাথে সুমিতের সম্পর্কের, অফিসে সারাদিন একসাথে থেকে তারপর একসাথে বাইরে সময় কাটিয়ে কোন কোন দিন ডিনার সেরে বাড়িতে ফেরে সুমিত।
বেলারও ধীরে ধীরে এসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম খাওয়ার নিয়ে বসে থাকত , দেরী হওয়ার কারণ জানতে চাইত এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করে না, খাবার ঢেকে রেখে শুয়ে পড়ে।
সুমিতও কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করছে বেলা সব বিষয়েই কেমন যেন উদাসীন । এখন কোন কিছুতেই যেন কিছু আসে যায় না ওর। আগের মত মুখ ভার করে থাকাটাও উধাও, নিজেতেই নিজে বেশ আনন্দেই থাকে, আগের মত সময় দেওয়া নিয়ে চোখে বন্যা নামে না। রাত করে ঘরে ঢুকলেই আগের মত কৈফিয়ৎ দিতে হয় না। রাতে পাশের ঘর থেকে জল খেতে এলে প্রায়শঃই সুমিত দেখতে পায় বেলাও মোবাইলে মনঃসংযোগ করে আছে। গান শুনছে বা গেম খেলছে।
যা করছে করুক আমার জীবনে হস্তক্ষেপ না করলেই হল মনে মনে ভাবে সুমিত। আর তাছাড়া সংসার যখন ঠিক ঠাক সামলাচ্ছে , সেবা যত্নেরও যখন ত্রুটি নেই তখন থাক যেমন খুশি। সকাল থেকেই শরীরটা ভালো নেই সুমিতের , জ্বর জ্বর ভাব। বিছানায় শুয়েই রান্না ঘরে বেলার ব্যস্ততার আওয়াজ পাচ্ছিল। তাড়াহুড়ো করবার দরকার নেই আজ অফিস যাব না। গলাটা যথাসম্ভব চড়িয়ে বলল সুমিত।
বাসনকোসনের যা আওয়াজ হচ্ছে তাতে কথাটা কানে গেলে হয়। ব্যস্ত হয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল বেলা। সুমিতকে প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা ছুটি নিতে দেখেনি বেলা, নিশ্চয়ই শরীর ভালো না। কি হয়েছে তোমার ? শরীর খারাপ নাকি? মাথায় হাত দিয়েই চমকে ওঠে বেলা, একি জ্বর এসেছে তো! দাড়াও থার্মোমিটারটা নিয়ে আসি। দ্রুত পদে পাশের ঘরে ছোটে বেলা।
সুমিত আড় চোখে ভাইব্রেশনে থাকা ফোনটার দিকে তাকায় । পাঁচটা মিসডকল, ফোনটা হাতে নিয়ে নেট অন করতেই পরপর কয়েকটা মেসেজ রিনিতার। রোজ সকালে উঠেই সুপ্রভাত জানায় সুমিত আজ ব্যতিক্রম দেখে রিনিতা ভীষণ ভাবে চিন্তিত,
প্রত্যেকটা মেসেজেই তার প্রতিফলন। বেলাকে আসতে দেখে সুমিত ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দিল।
বেলা যত্ন সহকারে সুমিতের মাথাটা একহাতে তুলে ধরে থার্মোমিটারটা মুখে পুরে দিল।
সুমিত বেলাকে দেখছিল, মুখখানি ঘর্মাক্ত, চুলগুলো চুড়ো করে ওপরে বাঁধা। নাইটিতে তেল হলুদের ছাপ, সম্ভবতঃ মাছ ভাজছিল, কেমন একটা আঁশটে গন্ধ, মুগ্ধতা আসা দূরের কথা, বেশিক্ষন তাকানো যায় না , জানালার দিকে মুখ ফেরাল সুমিত।
মর্ডান শিক্ষিতা রিনিতার সাথে কোনভাবেই মেলানো যায় না বেলাকে। নাহ্ খুব বেশি জ্বর নেই একশো মত ।
হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বেলা।
সুমিত একটু আশ্চর্য হল মাত্র একশো জ্বর তবে শরীরটা এমন লাগছে কেন? পুরো শরীর ব্যথা , ভীষন একটা অস্বস্তি, ঢোক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে। ফোনটা আবার ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলল। তোমার ফোনটা বাজছে, অফিসের বোধহয়। হুম, তুমি আদা, গোলমরিচ দিয়ে এককাপ চা করে আন তো গলাটা ব্যাথা করছে। বেলা চলে যেতেই ফোনটা ধরে সুমিত।
-হ্যালো! কি ব্যাপার তোমার সকাল থেকে ফোন করছি।অফিসেও এলে না?
রিনিতার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরে সুমিতের মুখে হাসি ফোটে।
শরীরটা ভালো নেই রিনি। কেন কি হল আবার! গা মাথা ভীষণ ব্যাথা, হালকা জ্বরও আছে। আমাদের যে আজ সিসি তে যাওয়ার কথা ছিল! একটা প্যারাসিটামল খেয়ে চলে এস না প্লিজ অভিমানী আদুরে গলায় রিনিতা আবদার করে।
-আজ না সোনাই, আর একদিন যাব। এখন রাখি কেমন। চাপা গলায় কথাগুলো বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে তাকায় সুমিত। ওকে টেক কেয়ার, লাভ ইউ। বেলা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-বিকেলে একবার ডাক্তার দেখাবে? মাকে কি ফোন করে জানাব? মাকে জানানোর কি আছে? কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। অসহিষ্ণুতার সাথে কথা কটি বলে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সুমিত।
বেলা কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
সেদিন রাত থেকেই জ্বরটা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল, একশো তিন জ্বরে রীতিমতো কাহিল হয়ে পড়েছিল সুমিত, গায়ে লাল লাল দানা মত উঠেছে, বেলা আর দেরী করে নি ঐ রাতেই সুমিতের অফিস কলিগ অলোককে ফোন করে ডেকে এনে ডাক্তারের কাছে ছুটেছিল। ডাক্তার বলেছিলেন চিকেন পক্স।
টানা পনের দিন বিছানায় ছিল সুমিত, মশারির নীচে এক একটা দিন দুর্বিষহ ছিল , বেলার অক্লান্ত পরিশ্রমে একটু তাড়াতাড়িই বিদায় নিয়েছে পক্স। খুব বেশি দানা ওঠে নি কিন্তু কি যে অসহ্য যন্ত্রণা!
আজ নিম পাতা ফোটানো জলে স্নান করে বাইরের বারান্দায় এসে বসেছে সুমিত। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে দিনগুলো। ঘোর লাগা চোখে একটাই মুখ ভাসছিল সুমিতের সেটা রিনিতার, কিন্তু মাঝেই সেই মুখটা আদল বদলে বেলার মুখ হয়ে যাচ্ছিল। শরীর ভীষণ দুর্বল। বেলা টেম্পারেচারটা দেখে নিয়ে বলল, নাহ্ জ্বর নেই একেবারে।
তারপর ওষুধ আর জলের গ্লাস এগিয়ে দিল।
খেয়ে নাও ।বাধ্য ছেলের মত ওষুধটা খেয়ে নিল সুমিত। গত কয়েকটা দিন ঠায় জেগে বেলা। কটা দিন যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে বেলার ওপর দিয়ে। কিন্তু নির্বিকার মুখে স্বামীর সেবা করে গেছে। আমি স্নানে যাচ্ছি, তুমি বেশিক্ষণ বাইরে হাওয়ায় বসো না।
বেলা শাশুড়ি মাকে ডাকার কথা বলেছিল কিন্তু এরকম একটা সংক্রমক রোগের মাঝে মাকে ডাকতে চায় নি সুমিত। আর আশ্চর্যের বিষয় রিনিতা তার অসুস্থতার কথা শুনে একবারও দেখতে আসে নি। ফোন করলেও হ্যাঁ হু করে উত্তর দিয়েছে আর তারপর তুমি এত কথা বলো না বিশ্রাম নাও বলে ফোন কেটে দিয়েছে। সুমিত মনে মনে হেসেছে বড্ড ভীতু মেয়েটা ফোনেও কি সংক্রমণ হয় নাকি!
ঘরে ডুকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সুমিত।
বেলা স্নান সেরে আয়নার সামনে বসে আলতো হাতে চুলের জট ছাড়াচ্ছিল, আড় চোখে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘোরের মধ্যে এ কয়েকদিন রিনিতা নাম ধরে ডাকছিলে তুমি।
চমকে ওঠে সুমিত।
রিনিতা!
-হ্যাঁ রিনিতা তোমার অফিসেই তো চাকরী করে, অলোকদার কাছে শুনেছি। ফোনে তো ওর সাথেই কথা বল তাই না ? ফেসবুকে ছবি দেখেছি মিষ্টি দেখতে। সুমিতের মুখে কথা সরছিল না, আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ না মানে একটা প্রজেক্টের কাজ করছিলাম একসাথে…..
বেলা নির্বিকার মুখে বলল, ও। আমি তোমার খাবারটা দিয়ে যাচ্ছি , অনেক দেরী হয়ে গেছে বৃহস্পতিবারের পুজো আজ। সুমিত ঠিক বুঝতে পারছিল না , ঘোরের মধ্যে আর কি কিছু বলেছে! অলোক কি সব বলে দিয়েছে? দীর্ঘদিনের অবহেলা সহ্য করার পর স্বামীর মুখে অন্য আরেক মেয়ের নাম শোনার পরও এত স্বাভাবিক সাউন্ড করেছে কেন বেলা ! মাথাটা কাজ করছিল না সুমিতের।
খাবারটা দিয়ে বেলা পুজোর ঘরে চলে গেছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে অলোকের নাম্বার ডায়েল করল সুমিত। হ্যালো অলোক হ্যাঁ বল শরীর কেমন আছ। মাচ বেটার নাউ। নেক্সট মানডে জয়েন করব, আচ্ছা তুই কি বেলাকে রিনিতার কথা কিছু বলেছিস? ঝাঁঝালো কন্ঠে ডিরেক্ট প্রশ্ন ছোড়ে সুমিত।
বৌদি একদিন জিজ্ঞেস করছিল রিনিতা নামের কেউ আমাদের অফিসে চাকরি করে কিনা, তাই বলেছি করে। এর বেশি কিছুই বলি নি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সুমিত। অফিসে অনেকেই ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ করে কিন্তু সবটাই জানে একটু বেশি ঘনিষ্ঠ বন্ধু অলোক।
-রিনিতা কেমন আছে? কেন ফোন বা ওয়াটস অ্যাপে কথা হয় নি? একটু তীর্যক সুরে কথা ছুড়ে দেয় অলোক। হয়েছে কিন্তু সেভাবে না । ওয়াটস অ্যাপেও মেসেজ পেন্ডিং। একটা কথা বলব সুমিত এখনও সময় আছে সরে আয়, আগেও বলেছি তোকে বৌদি ভীষণ ভালো মানুষ ওনাকে ঠকাস না। তোর লেকচার শোনার সময় নেই আমার রাখ।
-রাখছি একটা কথা শোন ইদানিং বসের সাথে তোর রিনিতার খুব ঘনিষ্ঠতা চলছে। অফিসে এলেই টের পাবি। টেক কেয়ার, বাই।
ফোনটা কেটে গেল।
স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সুমিত তারপর
দ্রুত রিনিতার নম্বর ডায়েল করল। একবার দুবার তিনবার ফোন রিং হয়ে গেল চতুর্থ বার ফোন রিসিভ হল, অত্যন্ত বিরক্তির সাথে ও প্রান্তে আওয়াজ এল
এত বার ফোন করছ কেন? আই অ্যাম বিজি রাইট নাউ, পরে কল করছি। কথার এমন তিক্ততা সুমিত আশা করে নি তবু শান্ত ভাবে বলল, অনেক দিন তোমার সাথে দেখা হয় নি, ভাবছিলাম আজ যদি…
-আজ আমি ভীষণ বিজি নট পসিবল, বাই দি ওয়ে তোমার তো পক্স হয়েছিল বাড়ি থেকে বেড়িও না আরো আট দশ দিন। আই অ্যাম কম্পিটলি কিয়োর নাউ । হোয়াই আর ইউ অ্যাভোয়েডিং মি রিনি?
একপ্রকার আর্তনাদ করে ওঠে সুমিত। লুক সুমিত আমি ভীষণ ব্যস্ত আর কতবার বলব ফোন রাখ। যবে থেকে অসুস্থ হয়েছি কতবার খোঁজ নিয়েছ? কিসের এত ব্যস্ততা? একটা টেক্সট পর্যন্ত কর নি ,একবারও দেখতে পর্যন্ত আসলে না এই তোমার ভালোবাসা?
-শোন ঐ পক্স রোগের রুগী দেখতে গিয়ে কি নিজে রোগ বাঁধিয়ে ফিরব! আর ভালোবাসার কথা তো একেবারেই বলো না কিসের ভালোবাসা? দুজনে একসাথে কিছু ভালো সময় কাটিয়েছি দ্যাট সেট।
বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে ছিল সুমিত। কি বললে? রিনিতা এবার হেসে ওঠে, তুমি বড় ছেলে মানুষ সুমিত, এত উত্তেজিত হয়ো না, টেক ইট ইজি, শরীর ভালো নেই তোমার। সুমিতের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে,
-তার মানে যা শুনেছি সব সত্যি? বসের সাথে…. ছিঃ!! আমি তোমার জন্য কি না করেছি।
যা করেছ তার পরিবর্তে অনেক পেয়েছ। আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য ওকে ডিভোর্স দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম , ডিভোর্সের কাগজটা পর্যন্ত তুমি দেখেছ। আর এখন কিনা তুমি এসব বলছো….
কঁকিয়ে ওঠে সুমিত। আমি বলেছিলাম তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা? তুমি তোমার ইচ্ছায় ডিসিশন নিয়েছো। খুব স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলছিল রিনিতা।
সুমিত এবার চেঁচিয়ে ওঠে ,
-তাহলে এতদিন আমাদের মধ্যে যা ছিল তা কি ছিল ?
জাস্ট টাইম পাস আর কিছুই না । ইউ আর নট মাই টাইপ। আমার টার্গেট ছিল মিঃ রক্ষিত । তোমার সাথে মেলামেশা দেখে তিনি জেলাস হয়েছেন অ্যান্ড দেন হি প্রপোসড মি।তোমার লজ্জা করছে না রিনিতা এসব বলতে। ওপাশ থেকে অট্টহাসি শোনা গেল। টেক ইট ইজি সুমিত। সুমিত এবার ভগ্ন কন্ঠে বলে,
-মিঃ রক্ষিতের কি এমন আছে যা আমার নেই। আমি মিঃ রক্ষিতের থেকে অনেক বেশি হ্যান্ডসাম, গুড লুকিং, ইউ অলওয়েজ এপ্রিশিয়েট মি রিনি। তুমি যখন যা চেয়েছ তাই দিয়েছি , কেন আমার সাথে এমন করছ তুমি ?
-গ্রো আপ ডিয়ার, নাটক করো না, বসের সাথে তোমার তুলনা? তুমি নিজেকে কি ভাবো সুমিত!
বিরক্তি ঝরে পরল রিনিতার কথায়। লুক, এত কথা বলে লাভ নেই যা হয়েছিল দুজনের সম্মতিতে হয়েছিল এখন আর তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই ,পারলে আমাকে ভুলে যেও।
দাঁতে দাঁত পিষে সুমিত ফোনটা শক্ত করে ধরে।
-ভুলে যাব? আই উইল এক্সপোজ ইউ, ব্লাডি…. চুপ ! আর একটা কথা বললে… হিসহিসিয়ে উঠল রিনিতা
আমি চাইলে সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্ট'-এর অভিযোগ আনতে পারি তোমার বিরুদ্ধে জান? আর তুমি কি মনে কর বস কিছু জানে না ? সব জেনেই সে আমাকে কাছে টেনেছে। রাইট নাউ আমরা লিভ টুগেদার করছি।
আর হ্যাঁ আর একটা কথা তোমার চাকরিটা আদৌ থাকবে কিনা সেটা চিন্তা কর।
ফোনটা কেটে দিল রিনিতা। ফোনটা ধরে বিহ্বলের মত দাঁড়িয়ে ছিল সুমিত। উলুধ্বনি ঘন্টা ধ্বনিতে চমক ভাঙ্গল। ধীরপদে ঘরে ডুকে দুর্বল শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিল। একটু পর ঠাকুর ঘর থেকে বেলা বেড়িয়ে এসে সুমিতের মাথায় পুজোর ফুল ছুঁইয়ে হাতে প্রসাদ দিল।
ক্লান্ত ক্লিষ্ট মুখটা নিষ্পলক চোখে দেখছিল সুমিত, বেলার এত মধুময় ,সমাহিত রূপ আগে চোখে পড়েনি।
বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল সুমিতকে , টেবিলে খাবারটার দিকে চোখ পড়তে বেলা বলল, কী হল এখনো খাও নি !
সুমিতের ভেতরটা কষ্টে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল, তুমিও তো খাও নি, একসাথেই খাব। অবাক চোখে সুমিতের দিকে একটু ক্ষণ তাকিয়ে মৃদু হেসে বেলা বলল ,
-শেষ কবে একসাথে খেয়েছি মনে পড়ে ? বিয়ের দিন তাই না? সুমিতের সত্যিই কিছু বলার ছিল না।
স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বসো আমি একটু পর বসছি।
কোন রকমে অল্প কিছু খেয়ে উঠে পড়ে সুমিত।রিনিতার জন্য কি না করছে , প্রতি মাসে গাদা গুচ্ছের শপিং করেছে রিনিতা আর বিল ভরেছে সুমিত। এমনকি দুজনে একসাথে থাকবে বলে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ফিক্স ডিপোজিট ভেঙে লক্ষাধিক টাকা দিয়েছে রিনিতাকে।
মাথাটা দপ দপ করছিল সুমিতের। এভাবে ঠকাল রিনিতা! অপমানে , অনুশোচনায় সুমিতের মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। সুমিত নির্ঘুম , মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ, পাশের ঘরে বেলা ঘুমোচ্ছিল, ধীরে ধীরে পা ফেলে বিছানার পাশে গিয়ে বসল সুমিত । বিছানাটা একটু নড়ে উঠতেই বেলা পাশ ফিরল,
কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল সুমিতের দিকে তারপর বলল,
-কিছু চাই?
সুমিত নিচুস্বরে বলল ,
আজকের রাতটা এখানে শোবো ।
বিস্ময়ের চোখে তাকালো বেলা,
এই ঘরে শোবে কেন?
ঘুম আসছে না আমার ।
বেলার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আজ এতদিন পরে সুমিত তার কাছে এসেছে।
কিছু না বলে পাশ ফিরে শুলো বেলা ।
সুমিতের সমস্ত মন জুড়ে একটা চরম অস্থিরতা ,
প্রত্যাখ্যানের অপমানে সারা শরীর জ্বলছিল।
কল্পনার চোখে রিনিতাকে বসের সাথে দেখতে পাচ্ছিল সুমিত, শরীরের অভ্যন্তরে অবদমিত ইচ্ছাগুলো দ্রুত যেন জেগে উঠছিল একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা, একটা তীব্র আশ্লেষে জাপটে ধরল বেলাকে।
ভীষণভাবে চমকে উঠে তড়িৎ গতিতে সোজা উঠে বসল বেলা। কি হচ্ছে! আজ তোমাকে চাই আমার ।
সুমিতকে এক ঝটকায় দূরে ঠেলে দেয় বেলা,
আমার বিনা অনুমতিতে আমাকে ছোঁবে না তুমি।
নিজের স্ত্রীকে ছোঁয়ার জন্য অনুমতি দরকার ? ঘর্মাক্ত মুখটা বীভৎস দেখাচ্ছিলো সুমিতের। হ্যাঁ দরকার ! এতদিন কোথায় ছিলে তুমি! আজ হঠাৎ কি হল?
তীব্র কন্ঠে বলল বেলা। সারা মন জুড়ে একটা অসহ্য যন্ত্রণা যে মানুষটার জন্য প্রতি রাতে বেলা অপেক্ষা করেছে সে মানুষটা আজ তার কাছে আসতে চাইছে!
উত্তেজিত গলায় সুমিত বলল, কাছে এসো। বেলা খাট থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তারপর স্থির দৃষ্টিতে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা চিঠি লিখে রেখেছিলাম ভেবেছিলাম সেটা দিয়ে কাল সকালে চলে যাব কিন্তু ভালোই হলো সামনাসামনি কথাগুলো বলে যাওয়াই ভালো।
সুমিত ঠিক বুঝতে পারছিল না বেলা কি বলছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কি বলছ? শান্ত দৃষ্টি মেলে ধীরে ধীরে বেলা বলল, তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ, তোমার মাকে ফোন করে দিয়েছি কালই হয়তো উনি এসে পড়বেন। আমি ভোরেই চলে যাব।
- মাকে ফোন করেছো কেন ? আর তুমি কোথায় যাবে?
প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে সুমিত। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি কাল। অসহ্য বিস্ময়ে অমিত বলল, চলে যাচ্ছো মানে? জীবনের সাথে অনেক লড়াই করলাম কিন্তু এখন নিজেকে মুক্তি দেওয়ার সময় এসেছে । কি বলতে চাইছ ? একপ্রকার ফুঁসে উঠলো সুমিত।
বিছানার তল থেকে ডিভোর্সের পেপারটা বের করলো বেলা। এটা ওয়ারড্রবে পেয়েছিলাম । সাইন করে দিয়েছি দেখে নাও। সুমিতের মুখ থেকে কথা সরছিল না নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সেদিন যখন তুমি অসুস্থ হলে তখন ওয়ারড্রব থেকে টাকা বের করতে গিয়ে ডিভোর্স লেটারটা দেখলাম।
অসুস্থ অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে আমার বিবেকে বেঁধেছিল, তুমি এখন সুস্থ আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারি। রিনিতাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এস।
বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সুমিত। নিজের সর্বনাশটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। বেলা তুমি ভুল বুঝছ। মৃদু হাসি ফুটে উঠল বেলার মুখে, ভুল বুঝছি!! তোমার সাথে আমার সংসার জীবনে পথচলার প্রায় দুটো বছর পার হয়ে গেছে, প্রথমদিকে জানো খুব চেষ্টা করতাম তোমার মন পেতে কিন্তু দেখলাম তোমার মনের নাগাল পাওয়া অত সহজ নয়, কোনদিনই তুমি তোমার মনের মত মানুষকে খুঁজে পাওনি আমার মধ্যে। কিন্তু আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম সেকথা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।
আকুলভাবে সুমিত বলল, সে কথা আমি অস্বীকার করছি না বেলা। একটা ভগ্ন গলায় বেলা বলে চলেছিল, গরিব ঘরের মা মরা মেয়ে আমি তোমাকে আশ্রয় করেই বাঁচতে চেয়েছিলাম। বারবার ভিক্ষুকের মতো তোমার কাছে গিয়েছি শুধু এতটুকু আর্তি আমাকে নাও কিন্তু অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিয়েছ, একটা মেয়ের কাছে এটা যে কত লজ্জার তা যদি বুঝতে!
তীব্র যন্ত্রণায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বেলার ভেতর থেকে। সুমিত মাথা নীচু করে বসেছিল। আমার জন্য তোমার চোখে বিন্দুমাত্র মুগ্ধতা কখনো দেখিনি , আমি জানি আমি সুন্দর নই কিন্তু আমারও তো মন আছে আমারও কিছু ইচ্ছে আছে কিন্তু সেসব তুমি কোনদিনই বোঝার চেষ্টা করনি।
তাও মেনে নিয়েছিলাম জানো ভাবতাম ঠিক একদিন তোমার মন পাবো কিন্তু পোড়া কপালি আমি তোমার মন পাওয়া তো দূরের কথা সামান্য করুণাটুকুও পাই নি কোনদিন।
স্খলিত গলায় সুমিত বলল,
- একটা কি সুযোগ দেবে না আমায়?
বেলা বলে চলেছিল এক নাগাড়ে,
-প্রতিদিন যখন তুমি অন্য ঘরে গিয়ে শুয়ে পরতে আমি রাত জেগে অপেক্ষা করতাম এই হয়ত তুমি আসবে, অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতাম খোলা দরজার দিকে এক সময় চোখে জল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম তাতে অবশ্য তোমার কিছু আসতো বা যেত না।
তোমার মায়ের ওখান থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝেই তোমার জামা কাপড়ে লিপস্টিকের দাগ দেখতে পেতাম। রেষ্টুরেন্টের বিল, শপিংমলের বিল কোন কিছুই দৃষ্টি এড়ায় নি। বুঝতে পারছিলাম সব তাই সবসময় সবরকম ভাবে তোমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু একটা সময়ে বুঝলাম যে যেতে চায় তাকে জোর করে বেঁধে রাখা যায় না। তবু কোথাও যেন একটা আশা ছিল তুমি ভুল বুঝে হয়তো বা ফিরে আসবে ।
সুমিত আকুলভাবে বেলার হাতটা চেপে ধরে,
- সব কিছু ভুলিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করা যায় না ? আমি ভুল করেছিলাম এ ভুল আর হবে না বিশ্বাস করো।
স্থির দৃষ্টিতে তাকালো বেলা ,
-আমাকে একটা কথার জবাব দেবে ? আমি যদি কোন ছেলের সাথে রাত কাটিয়ে এসে তোমাকে বলতাম ক্ষমা করে দিতে , তুমি আবার ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে আমাকে?
- বেলা রিনিতা আমার জীবনে নেই ও ছেড়ে গেছে আমাকে, প্লিজ তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা।
কঁকিয়ে ওঠে সুমিত।
- কিন্তু এখন আমিও যে এখন অন্য পথে হাঁটছি সুমিত , আমার জীবনেও অন্য কেউ এসেছে ।
বিষ্ফোরিত চোখে সুমিত চেঁচিয়ে উঠল
- মানে!!
বেলার বিক্ষুব্ধ কন্ঠে তখন প্রগলভতা,
- আজ সব জানিয়েই বিদায় নেব তোমার কাছ থেকে , তোমার কাছ থেকে দিনের পর দিন অবহেলা পেয়ে যখন সুইসাইড করার কথা ভাবছিলাম, তখন হঠাৎ একদিন ফেসবুকে আমাদের গ্রামের ছেলে শেখরকে খুঁজে পেলাম।
শেখর আমাকে জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়। শেখর না থাকলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না আমার মধ্যেও সৌন্দর্য্য আছে , আমাকেও কেউ পাগলের মত ভালবাসতে পারে, ও নতুন করে আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছিল।
নিমিষেই সুমিতের চোখটা জ্বলে ওঠে, তীব্র রাগে ফেটে পড়ে বলে,
-এতক্ষন ভাবছিলাম সব দোষ আমার আর তলে তলে তুমিও ছিঃ।
বেলার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
-আমিও রক্তমাংসের মানুষ সুমিত আমারও মন আছে, ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে। তবে তোমার মত আমি প্রেমে ভেসে গিয়ে তাকে বিছানায় টেনে আনিনি।
- ও প্রতি রাতে তুমি তাহলে তার সাথেই ব্যস্ত থাকতে ।
ঘেন্নায় মুখ বিকৃত করল সুমিত।
-হ্যাঁ থাকতাম। তোমার একটু সময়ের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি আমি কিন্তু তোমার কাছে আমার জন্য কোন সময় ছিল না আসলে কখনো তুমি আমাকে নিজের যোগ্য বলেই মনে করনি। বাড়ির একটা ফার্নিচারের সাথে আমার কোন পার্থক্য ছিল কি?
শেখরের সাথে কথা বলে একটু মনের শান্তি অন্তত খুঁজে পেতাম।
সুমিতের তীব্র ঘৃনা মেশানো গলায় বলল,
-নষ্ট মেয়ে মানুষ!
চোখ থেকে আগুন ঝরে পড়ল বেলার,
-তুমি করলে সেটা দোষের নয় কারন তুমি তো পুরুষ মানুষ! তোমার বেলায় সাত খুন মাফ আর আমি করলে নষ্ট মেয়ে মানুষ!!
-তোমাদের মত পুরুষরা বিবাহিত স্ত্রীদের টেকেন ফর গ্রান্টেড হিসেবে নিয়ে নেয় ,অবলীলায় অবৈধ সম্পর্কে জড়ায়, সে সম্পর্ক টিকলে ভালো কথা নইলে ঘরে স্ত্রী তো আছেই তাই না ??
তীব্র বিদ্বেষ ঝরে পরলো বেলার কণ্ঠ দিয়ে।
সুমিত চোয়াল শক্ত করে বলল ,
- এবার তুমি বাড়াবাড়ি করছ।
বেলা এবার শান্ত ভাবে বলল,
-তুমি কি মনে করো সুমিত দিনের পর দিন তুমি যা খুশি করে যাবে আর আমি তোমার অপেক্ষাতেই সারা জীবন কাটিয়ে দেবো আর কখন তুমি একটু ভালোবাসার ভিক্ষা দিতে আসবে তার প্রতীক্ষা করব? জীবনে কিছু না পেয়েও সুখী সুখী ভাব করে সারাটা জীবন আমি কাটাতে চাই না সুমিত।
সুমিতের মুখখানা এবার রক্ত শূন্য বিবর্ণ দেখাচ্ছিল।
বেলার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
- এভাবে তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না মা এলে মাকে কি বলব আমি?
বেলা সুমিতের হাতটা ছাড়িয়ে বলল,
-যা সত্যি তাই বলবে । আর একটা কথা রিনিতা ছেড়ে চলে গেল বলেই এখন তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছ । কিন্তু দুদিন বাদে আর এক রিনিতা আসবে না কে বলতে পারে!
সুমিতের এবার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছিল,
-তুমি ভুল করছ বেলা। প্লিজ আর একবার ভাব।
হাতের শাঁখা পলাগুলো খুলতে খুলতে বেলা বলল,
- শেখরের বাঁ হাত এক্সিডেন্টে কাটা পড়েছিল তাই ইচ্ছে থাকলেও সে তার ভালোবাসার কথাটা আমার বাবাকে বলতে পারে নি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে বিয়েও করে নি। শেখর তোমার মত সুদর্শন নয় অত বড় চাকরিও করে না সামান্য একটা স্টেশনারী দোকান আছে ওর । দুবেলার ভাতটুকু আর অপরিসীম ভালোবাসা অন্তত দিতে পারবে ।
ভোর হয়ে এসেছিল, বেলার ফোনটা বেজে উঠল,
-হ্যাঁ একটু দাঁড়াও শেখর আসছি।
শেখর নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমি আসি , আর একটা অনুরোধ তোমার কাছে মায়ের কাছে সব সত্যি গুলো বলো, উনি ঠিক বুঝবেন। আর ভালো থাকার চেষ্টা করো।
(সমাপ্ত)
K. K. Roy
অফিসে মাস ছয়েক আগে জয়েন করেছিল রিনিতা। বছর আঠাশের প্রাণচঞ্চল, সদা হাস্য ,স্মার্ট, সুন্দরী এই তরুণীর সাহচর্যে নিজেকে ধন্য মনে করত সুমিত। ঠিক এমন একটি আধুনিকা মেয়েই সে চেয়েছিল। রিনিতার সঙ্গ ভীষণভাবে উপভোগ করত সুমিত।
রিনিতাকে বিয়ে করার কথাও ভেবেছিল কিন্তু মা হঠাৎ দিব্যি টিব্যি দিয়ে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করল।
বিয়ের পর থেকে অবশ্য বেলার দিক থেকে স্বামী সেবায় কোন ত্রুটি ছিল না । ঘরের সমস্ত কাজ একা হাতে করে বেলা। অন্যান্য বউদের মত শাড়ি গয়নার প্রতি লোভ নেই। সুমিতের প্রতি তার নির্ভরতাও অসীম। কিন্তু তবুু সুমিতের মনে হয় , জোর করে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বেলাকে।
সুমিত মনে করত, বেলা যেহেতু রূপসী নয় উপরন্তু গরীব ঘরের মেয়ে তাই তার কাছে এমন সুদর্শন, উপার্জনশীল পাত্র তো আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো, আর সে যা যা করে তা তার কর্তব্যের মধ্যেই পরে।
বেলা আধুনিকা নয়, নিতান্তই ঘোর সংসারী একটা মেয়ে, নিত্য পূজা , শাঁখা, সিঁদুর , শাড়ি এসবের বাইরে নিজেকে ভাবতেও পারে না । কিন্তু এসব সুমিতের কাছে ভীষণভাবে ব্যাকডেটেড মনে হয়। ঘরোয়া স্ত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ অনুভব করে না সে।
বেলা বিয়ের পর পর অনেক চেষ্টা করছে সুমিতের মনের নাগাল পাওয়ার কিন্তু বার বার ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে। রাতের পর রাত বেলা বালিশ চেপে কেঁদেছে কিন্তু সুমিত একবারের জন্যও ফিরে দেখে নি , হঠাৎ হঠাৎ যখন নিজের প্রয়োজন হয়েছে তখন কাছে এসেছে কিন্তু সেটাও খুব কম । অবশ্য ঝগড়া ঝাটি করে না সুমিত , নিজের জগত নিয়েই ব্যস্ত সে।
নামে মাত্র বিবাহিত জীবন কিন্তু সুখি দাম্পত্য কদাচ নয়। কোথাও যেন একটা ছন্দ পতন রয়েই গেছে।
বিয়ের একবছরের মাথায় হঠাৎ মায়ের শরীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে বেলাকে মাসখানেকের জন্য গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছিল সুমিত।
সেই সময়ই রিনিতার সাথে ঘনিষ্ঠতা মাত্রা ছাড়ায়।
ভালোলাগাটা যে একতরফা নয় তা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল সুমিত । একটা সময়ের পর রিনিতা নিজেই ধরা দিয়েছিল আর সুমিতও ভেসে গিয়েছিল প্রেম জোয়ারে।
রিনিতা ভীষণ খোলামেলা এবং ওপেন মাইন্ডেড মেয়ে। সুমিত যে বিবাহিত সে সম্পর্কেও তার মাথা ব্যাথা নেই, শরীর নিয়েও শূচিবায়ুগ্রস্থতা একেবারেই নেই, স্ত্রীর অবর্তমানে দুটি শরীর কাছে আসতেও বেশি সময় নেয় নি। সুমিতের বিবাহিত জীবনের অপূর্ণতা দূর হয়ে গিয়েছিল রিনিতার দুরন্ত আবেগের জোয়ারে।
বাড়ি থেকে একমাসের আগেই বেলা ফিরে এসেছিল অবশ্য ফিরে এসেছিল বললে ভুল হবে মা জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিল ছেলের অসুবিধার কথা ভেবে।
তারপর থেকে বেলা লক্ষ্য করছিল সুমিত যেন আরো বদলে গেছে। সুমিত বেশিরভাগ দিন পাশের ঘরে শোয়, গভীর রাত অবধি ফোনেই নিবিষ্ট থাকে।
বেলা তার শান্ত স্বভাব বজায় রেখেই কয়েকবার জানতে চেয়েছে তার স্ত্রীর কর্তব্যে কোন ঘাটতি আছে কিনা। সুমিতের কাছে একটাই উত্তর ছিল অফিসে কাজের ভীষণ চাপ।
অনুনয় বিনয় করেও কোন লাভ হয় নি সুমিত পাকাপাকি ভাবেই বিছানা আলাদা করে নিয়েছিল।
ছয়মাসের বেশি হয়ে গিয়েছিল রিনিতার সাথে সুমিতের সম্পর্কের, অফিসে সারাদিন একসাথে থেকে তারপর একসাথে বাইরে সময় কাটিয়ে কোন কোন দিন ডিনার সেরে বাড়িতে ফেরে সুমিত।
বেলারও ধীরে ধীরে এসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম খাওয়ার নিয়ে বসে থাকত , দেরী হওয়ার কারণ জানতে চাইত এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করে না, খাবার ঢেকে রেখে শুয়ে পড়ে।
সুমিতও কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করছে বেলা সব বিষয়েই কেমন যেন উদাসীন । এখন কোন কিছুতেই যেন কিছু আসে যায় না ওর। আগের মত মুখ ভার করে থাকাটাও উধাও, নিজেতেই নিজে বেশ আনন্দেই থাকে, আগের মত সময় দেওয়া নিয়ে চোখে বন্যা নামে না। রাত করে ঘরে ঢুকলেই আগের মত কৈফিয়ৎ দিতে হয় না। রাতে পাশের ঘর থেকে জল খেতে এলে প্রায়শঃই সুমিত দেখতে পায় বেলাও মোবাইলে মনঃসংযোগ করে আছে। গান শুনছে বা গেম খেলছে।
যা করছে করুক আমার জীবনে হস্তক্ষেপ না করলেই হল মনে মনে ভাবে সুমিত। আর তাছাড়া সংসার যখন ঠিক ঠাক সামলাচ্ছে , সেবা যত্নেরও যখন ত্রুটি নেই তখন থাক যেমন খুশি। সকাল থেকেই শরীরটা ভালো নেই সুমিতের , জ্বর জ্বর ভাব। বিছানায় শুয়েই রান্না ঘরে বেলার ব্যস্ততার আওয়াজ পাচ্ছিল। তাড়াহুড়ো করবার দরকার নেই আজ অফিস যাব না। গলাটা যথাসম্ভব চড়িয়ে বলল সুমিত।
বাসনকোসনের যা আওয়াজ হচ্ছে তাতে কথাটা কানে গেলে হয়। ব্যস্ত হয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল বেলা। সুমিতকে প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা ছুটি নিতে দেখেনি বেলা, নিশ্চয়ই শরীর ভালো না। কি হয়েছে তোমার ? শরীর খারাপ নাকি? মাথায় হাত দিয়েই চমকে ওঠে বেলা, একি জ্বর এসেছে তো! দাড়াও থার্মোমিটারটা নিয়ে আসি। দ্রুত পদে পাশের ঘরে ছোটে বেলা।
সুমিত আড় চোখে ভাইব্রেশনে থাকা ফোনটার দিকে তাকায় । পাঁচটা মিসডকল, ফোনটা হাতে নিয়ে নেট অন করতেই পরপর কয়েকটা মেসেজ রিনিতার। রোজ সকালে উঠেই সুপ্রভাত জানায় সুমিত আজ ব্যতিক্রম দেখে রিনিতা ভীষণ ভাবে চিন্তিত,
প্রত্যেকটা মেসেজেই তার প্রতিফলন। বেলাকে আসতে দেখে সুমিত ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দিল।
বেলা যত্ন সহকারে সুমিতের মাথাটা একহাতে তুলে ধরে থার্মোমিটারটা মুখে পুরে দিল।
সুমিত বেলাকে দেখছিল, মুখখানি ঘর্মাক্ত, চুলগুলো চুড়ো করে ওপরে বাঁধা। নাইটিতে তেল হলুদের ছাপ, সম্ভবতঃ মাছ ভাজছিল, কেমন একটা আঁশটে গন্ধ, মুগ্ধতা আসা দূরের কথা, বেশিক্ষন তাকানো যায় না , জানালার দিকে মুখ ফেরাল সুমিত।
মর্ডান শিক্ষিতা রিনিতার সাথে কোনভাবেই মেলানো যায় না বেলাকে। নাহ্ খুব বেশি জ্বর নেই একশো মত ।
হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বেলা।
সুমিত একটু আশ্চর্য হল মাত্র একশো জ্বর তবে শরীরটা এমন লাগছে কেন? পুরো শরীর ব্যথা , ভীষন একটা অস্বস্তি, ঢোক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে। ফোনটা আবার ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলল। তোমার ফোনটা বাজছে, অফিসের বোধহয়। হুম, তুমি আদা, গোলমরিচ দিয়ে এককাপ চা করে আন তো গলাটা ব্যাথা করছে। বেলা চলে যেতেই ফোনটা ধরে সুমিত।
-হ্যালো! কি ব্যাপার তোমার সকাল থেকে ফোন করছি।অফিসেও এলে না?
রিনিতার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরে সুমিতের মুখে হাসি ফোটে।
শরীরটা ভালো নেই রিনি। কেন কি হল আবার! গা মাথা ভীষণ ব্যাথা, হালকা জ্বরও আছে। আমাদের যে আজ সিসি তে যাওয়ার কথা ছিল! একটা প্যারাসিটামল খেয়ে চলে এস না প্লিজ অভিমানী আদুরে গলায় রিনিতা আবদার করে।
-আজ না সোনাই, আর একদিন যাব। এখন রাখি কেমন। চাপা গলায় কথাগুলো বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে তাকায় সুমিত। ওকে টেক কেয়ার, লাভ ইউ। বেলা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-বিকেলে একবার ডাক্তার দেখাবে? মাকে কি ফোন করে জানাব? মাকে জানানোর কি আছে? কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। অসহিষ্ণুতার সাথে কথা কটি বলে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সুমিত।
বেলা কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
সেদিন রাত থেকেই জ্বরটা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল, একশো তিন জ্বরে রীতিমতো কাহিল হয়ে পড়েছিল সুমিত, গায়ে লাল লাল দানা মত উঠেছে, বেলা আর দেরী করে নি ঐ রাতেই সুমিতের অফিস কলিগ অলোককে ফোন করে ডেকে এনে ডাক্তারের কাছে ছুটেছিল। ডাক্তার বলেছিলেন চিকেন পক্স।
টানা পনের দিন বিছানায় ছিল সুমিত, মশারির নীচে এক একটা দিন দুর্বিষহ ছিল , বেলার অক্লান্ত পরিশ্রমে একটু তাড়াতাড়িই বিদায় নিয়েছে পক্স। খুব বেশি দানা ওঠে নি কিন্তু কি যে অসহ্য যন্ত্রণা!
আজ নিম পাতা ফোটানো জলে স্নান করে বাইরের বারান্দায় এসে বসেছে সুমিত। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে দিনগুলো। ঘোর লাগা চোখে একটাই মুখ ভাসছিল সুমিতের সেটা রিনিতার, কিন্তু মাঝেই সেই মুখটা আদল বদলে বেলার মুখ হয়ে যাচ্ছিল। শরীর ভীষণ দুর্বল। বেলা টেম্পারেচারটা দেখে নিয়ে বলল, নাহ্ জ্বর নেই একেবারে।
তারপর ওষুধ আর জলের গ্লাস এগিয়ে দিল।
খেয়ে নাও ।বাধ্য ছেলের মত ওষুধটা খেয়ে নিল সুমিত। গত কয়েকটা দিন ঠায় জেগে বেলা। কটা দিন যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে বেলার ওপর দিয়ে। কিন্তু নির্বিকার মুখে স্বামীর সেবা করে গেছে। আমি স্নানে যাচ্ছি, তুমি বেশিক্ষণ বাইরে হাওয়ায় বসো না।
বেলা শাশুড়ি মাকে ডাকার কথা বলেছিল কিন্তু এরকম একটা সংক্রমক রোগের মাঝে মাকে ডাকতে চায় নি সুমিত। আর আশ্চর্যের বিষয় রিনিতা তার অসুস্থতার কথা শুনে একবারও দেখতে আসে নি। ফোন করলেও হ্যাঁ হু করে উত্তর দিয়েছে আর তারপর তুমি এত কথা বলো না বিশ্রাম নাও বলে ফোন কেটে দিয়েছে। সুমিত মনে মনে হেসেছে বড্ড ভীতু মেয়েটা ফোনেও কি সংক্রমণ হয় নাকি!
ঘরে ডুকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সুমিত।
বেলা স্নান সেরে আয়নার সামনে বসে আলতো হাতে চুলের জট ছাড়াচ্ছিল, আড় চোখে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘোরের মধ্যে এ কয়েকদিন রিনিতা নাম ধরে ডাকছিলে তুমি।
চমকে ওঠে সুমিত।
রিনিতা!
-হ্যাঁ রিনিতা তোমার অফিসেই তো চাকরী করে, অলোকদার কাছে শুনেছি। ফোনে তো ওর সাথেই কথা বল তাই না ? ফেসবুকে ছবি দেখেছি মিষ্টি দেখতে। সুমিতের মুখে কথা সরছিল না, আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ না মানে একটা প্রজেক্টের কাজ করছিলাম একসাথে…..
বেলা নির্বিকার মুখে বলল, ও। আমি তোমার খাবারটা দিয়ে যাচ্ছি , অনেক দেরী হয়ে গেছে বৃহস্পতিবারের পুজো আজ। সুমিত ঠিক বুঝতে পারছিল না , ঘোরের মধ্যে আর কি কিছু বলেছে! অলোক কি সব বলে দিয়েছে? দীর্ঘদিনের অবহেলা সহ্য করার পর স্বামীর মুখে অন্য আরেক মেয়ের নাম শোনার পরও এত স্বাভাবিক সাউন্ড করেছে কেন বেলা ! মাথাটা কাজ করছিল না সুমিতের।
খাবারটা দিয়ে বেলা পুজোর ঘরে চলে গেছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে অলোকের নাম্বার ডায়েল করল সুমিত। হ্যালো অলোক হ্যাঁ বল শরীর কেমন আছ। মাচ বেটার নাউ। নেক্সট মানডে জয়েন করব, আচ্ছা তুই কি বেলাকে রিনিতার কথা কিছু বলেছিস? ঝাঁঝালো কন্ঠে ডিরেক্ট প্রশ্ন ছোড়ে সুমিত।
বৌদি একদিন জিজ্ঞেস করছিল রিনিতা নামের কেউ আমাদের অফিসে চাকরি করে কিনা, তাই বলেছি করে। এর বেশি কিছুই বলি নি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সুমিত। অফিসে অনেকেই ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ করে কিন্তু সবটাই জানে একটু বেশি ঘনিষ্ঠ বন্ধু অলোক।
-রিনিতা কেমন আছে? কেন ফোন বা ওয়াটস অ্যাপে কথা হয় নি? একটু তীর্যক সুরে কথা ছুড়ে দেয় অলোক। হয়েছে কিন্তু সেভাবে না । ওয়াটস অ্যাপেও মেসেজ পেন্ডিং। একটা কথা বলব সুমিত এখনও সময় আছে সরে আয়, আগেও বলেছি তোকে বৌদি ভীষণ ভালো মানুষ ওনাকে ঠকাস না। তোর লেকচার শোনার সময় নেই আমার রাখ।
-রাখছি একটা কথা শোন ইদানিং বসের সাথে তোর রিনিতার খুব ঘনিষ্ঠতা চলছে। অফিসে এলেই টের পাবি। টেক কেয়ার, বাই।
ফোনটা কেটে গেল।
স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সুমিত তারপর
দ্রুত রিনিতার নম্বর ডায়েল করল। একবার দুবার তিনবার ফোন রিং হয়ে গেল চতুর্থ বার ফোন রিসিভ হল, অত্যন্ত বিরক্তির সাথে ও প্রান্তে আওয়াজ এল
এত বার ফোন করছ কেন? আই অ্যাম বিজি রাইট নাউ, পরে কল করছি। কথার এমন তিক্ততা সুমিত আশা করে নি তবু শান্ত ভাবে বলল, অনেক দিন তোমার সাথে দেখা হয় নি, ভাবছিলাম আজ যদি…
-আজ আমি ভীষণ বিজি নট পসিবল, বাই দি ওয়ে তোমার তো পক্স হয়েছিল বাড়ি থেকে বেড়িও না আরো আট দশ দিন। আই অ্যাম কম্পিটলি কিয়োর নাউ । হোয়াই আর ইউ অ্যাভোয়েডিং মি রিনি?
একপ্রকার আর্তনাদ করে ওঠে সুমিত। লুক সুমিত আমি ভীষণ ব্যস্ত আর কতবার বলব ফোন রাখ। যবে থেকে অসুস্থ হয়েছি কতবার খোঁজ নিয়েছ? কিসের এত ব্যস্ততা? একটা টেক্সট পর্যন্ত কর নি ,একবারও দেখতে পর্যন্ত আসলে না এই তোমার ভালোবাসা?
-শোন ঐ পক্স রোগের রুগী দেখতে গিয়ে কি নিজে রোগ বাঁধিয়ে ফিরব! আর ভালোবাসার কথা তো একেবারেই বলো না কিসের ভালোবাসা? দুজনে একসাথে কিছু ভালো সময় কাটিয়েছি দ্যাট সেট।
বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে ছিল সুমিত। কি বললে? রিনিতা এবার হেসে ওঠে, তুমি বড় ছেলে মানুষ সুমিত, এত উত্তেজিত হয়ো না, টেক ইট ইজি, শরীর ভালো নেই তোমার। সুমিতের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে,
-তার মানে যা শুনেছি সব সত্যি? বসের সাথে…. ছিঃ!! আমি তোমার জন্য কি না করেছি।
যা করেছ তার পরিবর্তে অনেক পেয়েছ। আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য ওকে ডিভোর্স দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম , ডিভোর্সের কাগজটা পর্যন্ত তুমি দেখেছ। আর এখন কিনা তুমি এসব বলছো….
কঁকিয়ে ওঠে সুমিত। আমি বলেছিলাম তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা? তুমি তোমার ইচ্ছায় ডিসিশন নিয়েছো। খুব স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলছিল রিনিতা।
সুমিত এবার চেঁচিয়ে ওঠে ,
-তাহলে এতদিন আমাদের মধ্যে যা ছিল তা কি ছিল ?
জাস্ট টাইম পাস আর কিছুই না । ইউ আর নট মাই টাইপ। আমার টার্গেট ছিল মিঃ রক্ষিত । তোমার সাথে মেলামেশা দেখে তিনি জেলাস হয়েছেন অ্যান্ড দেন হি প্রপোসড মি।তোমার লজ্জা করছে না রিনিতা এসব বলতে। ওপাশ থেকে অট্টহাসি শোনা গেল। টেক ইট ইজি সুমিত। সুমিত এবার ভগ্ন কন্ঠে বলে,
-মিঃ রক্ষিতের কি এমন আছে যা আমার নেই। আমি মিঃ রক্ষিতের থেকে অনেক বেশি হ্যান্ডসাম, গুড লুকিং, ইউ অলওয়েজ এপ্রিশিয়েট মি রিনি। তুমি যখন যা চেয়েছ তাই দিয়েছি , কেন আমার সাথে এমন করছ তুমি ?
-গ্রো আপ ডিয়ার, নাটক করো না, বসের সাথে তোমার তুলনা? তুমি নিজেকে কি ভাবো সুমিত!
বিরক্তি ঝরে পরল রিনিতার কথায়। লুক, এত কথা বলে লাভ নেই যা হয়েছিল দুজনের সম্মতিতে হয়েছিল এখন আর তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই ,পারলে আমাকে ভুলে যেও।
দাঁতে দাঁত পিষে সুমিত ফোনটা শক্ত করে ধরে।
-ভুলে যাব? আই উইল এক্সপোজ ইউ, ব্লাডি…. চুপ ! আর একটা কথা বললে… হিসহিসিয়ে উঠল রিনিতা
আমি চাইলে সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্ট'-এর অভিযোগ আনতে পারি তোমার বিরুদ্ধে জান? আর তুমি কি মনে কর বস কিছু জানে না ? সব জেনেই সে আমাকে কাছে টেনেছে। রাইট নাউ আমরা লিভ টুগেদার করছি।
আর হ্যাঁ আর একটা কথা তোমার চাকরিটা আদৌ থাকবে কিনা সেটা চিন্তা কর।
ফোনটা কেটে দিল রিনিতা। ফোনটা ধরে বিহ্বলের মত দাঁড়িয়ে ছিল সুমিত। উলুধ্বনি ঘন্টা ধ্বনিতে চমক ভাঙ্গল। ধীরপদে ঘরে ডুকে দুর্বল শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিল। একটু পর ঠাকুর ঘর থেকে বেলা বেড়িয়ে এসে সুমিতের মাথায় পুজোর ফুল ছুঁইয়ে হাতে প্রসাদ দিল।
ক্লান্ত ক্লিষ্ট মুখটা নিষ্পলক চোখে দেখছিল সুমিত, বেলার এত মধুময় ,সমাহিত রূপ আগে চোখে পড়েনি।
বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল সুমিতকে , টেবিলে খাবারটার দিকে চোখ পড়তে বেলা বলল, কী হল এখনো খাও নি !
সুমিতের ভেতরটা কষ্টে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল, তুমিও তো খাও নি, একসাথেই খাব। অবাক চোখে সুমিতের দিকে একটু ক্ষণ তাকিয়ে মৃদু হেসে বেলা বলল ,
-শেষ কবে একসাথে খেয়েছি মনে পড়ে ? বিয়ের দিন তাই না? সুমিতের সত্যিই কিছু বলার ছিল না।
স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বসো আমি একটু পর বসছি।
কোন রকমে অল্প কিছু খেয়ে উঠে পড়ে সুমিত।রিনিতার জন্য কি না করছে , প্রতি মাসে গাদা গুচ্ছের শপিং করেছে রিনিতা আর বিল ভরেছে সুমিত। এমনকি দুজনে একসাথে থাকবে বলে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ফিক্স ডিপোজিট ভেঙে লক্ষাধিক টাকা দিয়েছে রিনিতাকে।
মাথাটা দপ দপ করছিল সুমিতের। এভাবে ঠকাল রিনিতা! অপমানে , অনুশোচনায় সুমিতের মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। সুমিত নির্ঘুম , মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ, পাশের ঘরে বেলা ঘুমোচ্ছিল, ধীরে ধীরে পা ফেলে বিছানার পাশে গিয়ে বসল সুমিত । বিছানাটা একটু নড়ে উঠতেই বেলা পাশ ফিরল,
কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল সুমিতের দিকে তারপর বলল,
-কিছু চাই?
সুমিত নিচুস্বরে বলল ,
আজকের রাতটা এখানে শোবো ।
বিস্ময়ের চোখে তাকালো বেলা,
এই ঘরে শোবে কেন?
ঘুম আসছে না আমার ।
বেলার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আজ এতদিন পরে সুমিত তার কাছে এসেছে।
কিছু না বলে পাশ ফিরে শুলো বেলা ।
সুমিতের সমস্ত মন জুড়ে একটা চরম অস্থিরতা ,
প্রত্যাখ্যানের অপমানে সারা শরীর জ্বলছিল।
কল্পনার চোখে রিনিতাকে বসের সাথে দেখতে পাচ্ছিল সুমিত, শরীরের অভ্যন্তরে অবদমিত ইচ্ছাগুলো দ্রুত যেন জেগে উঠছিল একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা, একটা তীব্র আশ্লেষে জাপটে ধরল বেলাকে।
ভীষণভাবে চমকে উঠে তড়িৎ গতিতে সোজা উঠে বসল বেলা। কি হচ্ছে! আজ তোমাকে চাই আমার ।
সুমিতকে এক ঝটকায় দূরে ঠেলে দেয় বেলা,
আমার বিনা অনুমতিতে আমাকে ছোঁবে না তুমি।
নিজের স্ত্রীকে ছোঁয়ার জন্য অনুমতি দরকার ? ঘর্মাক্ত মুখটা বীভৎস দেখাচ্ছিলো সুমিতের। হ্যাঁ দরকার ! এতদিন কোথায় ছিলে তুমি! আজ হঠাৎ কি হল?
তীব্র কন্ঠে বলল বেলা। সারা মন জুড়ে একটা অসহ্য যন্ত্রণা যে মানুষটার জন্য প্রতি রাতে বেলা অপেক্ষা করেছে সে মানুষটা আজ তার কাছে আসতে চাইছে!
উত্তেজিত গলায় সুমিত বলল, কাছে এসো। বেলা খাট থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তারপর স্থির দৃষ্টিতে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা চিঠি লিখে রেখেছিলাম ভেবেছিলাম সেটা দিয়ে কাল সকালে চলে যাব কিন্তু ভালোই হলো সামনাসামনি কথাগুলো বলে যাওয়াই ভালো।
সুমিত ঠিক বুঝতে পারছিল না বেলা কি বলছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কি বলছ? শান্ত দৃষ্টি মেলে ধীরে ধীরে বেলা বলল, তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ, তোমার মাকে ফোন করে দিয়েছি কালই হয়তো উনি এসে পড়বেন। আমি ভোরেই চলে যাব।
- মাকে ফোন করেছো কেন ? আর তুমি কোথায় যাবে?
প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে সুমিত। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি কাল। অসহ্য বিস্ময়ে অমিত বলল, চলে যাচ্ছো মানে? জীবনের সাথে অনেক লড়াই করলাম কিন্তু এখন নিজেকে মুক্তি দেওয়ার সময় এসেছে । কি বলতে চাইছ ? একপ্রকার ফুঁসে উঠলো সুমিত।
বিছানার তল থেকে ডিভোর্সের পেপারটা বের করলো বেলা। এটা ওয়ারড্রবে পেয়েছিলাম । সাইন করে দিয়েছি দেখে নাও। সুমিতের মুখ থেকে কথা সরছিল না নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সেদিন যখন তুমি অসুস্থ হলে তখন ওয়ারড্রব থেকে টাকা বের করতে গিয়ে ডিভোর্স লেটারটা দেখলাম।
অসুস্থ অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে আমার বিবেকে বেঁধেছিল, তুমি এখন সুস্থ আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারি। রিনিতাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এস।
বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সুমিত। নিজের সর্বনাশটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। বেলা তুমি ভুল বুঝছ। মৃদু হাসি ফুটে উঠল বেলার মুখে, ভুল বুঝছি!! তোমার সাথে আমার সংসার জীবনে পথচলার প্রায় দুটো বছর পার হয়ে গেছে, প্রথমদিকে জানো খুব চেষ্টা করতাম তোমার মন পেতে কিন্তু দেখলাম তোমার মনের নাগাল পাওয়া অত সহজ নয়, কোনদিনই তুমি তোমার মনের মত মানুষকে খুঁজে পাওনি আমার মধ্যে। কিন্তু আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম সেকথা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।
আকুলভাবে সুমিত বলল, সে কথা আমি অস্বীকার করছি না বেলা। একটা ভগ্ন গলায় বেলা বলে চলেছিল, গরিব ঘরের মা মরা মেয়ে আমি তোমাকে আশ্রয় করেই বাঁচতে চেয়েছিলাম। বারবার ভিক্ষুকের মতো তোমার কাছে গিয়েছি শুধু এতটুকু আর্তি আমাকে নাও কিন্তু অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিয়েছ, একটা মেয়ের কাছে এটা যে কত লজ্জার তা যদি বুঝতে!
তীব্র যন্ত্রণায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বেলার ভেতর থেকে। সুমিত মাথা নীচু করে বসেছিল। আমার জন্য তোমার চোখে বিন্দুমাত্র মুগ্ধতা কখনো দেখিনি , আমি জানি আমি সুন্দর নই কিন্তু আমারও তো মন আছে আমারও কিছু ইচ্ছে আছে কিন্তু সেসব তুমি কোনদিনই বোঝার চেষ্টা করনি।
তাও মেনে নিয়েছিলাম জানো ভাবতাম ঠিক একদিন তোমার মন পাবো কিন্তু পোড়া কপালি আমি তোমার মন পাওয়া তো দূরের কথা সামান্য করুণাটুকুও পাই নি কোনদিন।
স্খলিত গলায় সুমিত বলল,
- একটা কি সুযোগ দেবে না আমায়?
বেলা বলে চলেছিল এক নাগাড়ে,
-প্রতিদিন যখন তুমি অন্য ঘরে গিয়ে শুয়ে পরতে আমি রাত জেগে অপেক্ষা করতাম এই হয়ত তুমি আসবে, অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতাম খোলা দরজার দিকে এক সময় চোখে জল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম তাতে অবশ্য তোমার কিছু আসতো বা যেত না।
তোমার মায়ের ওখান থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝেই তোমার জামা কাপড়ে লিপস্টিকের দাগ দেখতে পেতাম। রেষ্টুরেন্টের বিল, শপিংমলের বিল কোন কিছুই দৃষ্টি এড়ায় নি। বুঝতে পারছিলাম সব তাই সবসময় সবরকম ভাবে তোমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু একটা সময়ে বুঝলাম যে যেতে চায় তাকে জোর করে বেঁধে রাখা যায় না। তবু কোথাও যেন একটা আশা ছিল তুমি ভুল বুঝে হয়তো বা ফিরে আসবে ।
সুমিত আকুলভাবে বেলার হাতটা চেপে ধরে,
- সব কিছু ভুলিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করা যায় না ? আমি ভুল করেছিলাম এ ভুল আর হবে না বিশ্বাস করো।
স্থির দৃষ্টিতে তাকালো বেলা ,
-আমাকে একটা কথার জবাব দেবে ? আমি যদি কোন ছেলের সাথে রাত কাটিয়ে এসে তোমাকে বলতাম ক্ষমা করে দিতে , তুমি আবার ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে আমাকে?
- বেলা রিনিতা আমার জীবনে নেই ও ছেড়ে গেছে আমাকে, প্লিজ তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা।
কঁকিয়ে ওঠে সুমিত।
- কিন্তু এখন আমিও যে এখন অন্য পথে হাঁটছি সুমিত , আমার জীবনেও অন্য কেউ এসেছে ।
বিষ্ফোরিত চোখে সুমিত চেঁচিয়ে উঠল
- মানে!!
বেলার বিক্ষুব্ধ কন্ঠে তখন প্রগলভতা,
- আজ সব জানিয়েই বিদায় নেব তোমার কাছ থেকে , তোমার কাছ থেকে দিনের পর দিন অবহেলা পেয়ে যখন সুইসাইড করার কথা ভাবছিলাম, তখন হঠাৎ একদিন ফেসবুকে আমাদের গ্রামের ছেলে শেখরকে খুঁজে পেলাম।
শেখর আমাকে জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়। শেখর না থাকলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না আমার মধ্যেও সৌন্দর্য্য আছে , আমাকেও কেউ পাগলের মত ভালবাসতে পারে, ও নতুন করে আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছিল।
নিমিষেই সুমিতের চোখটা জ্বলে ওঠে, তীব্র রাগে ফেটে পড়ে বলে,
-এতক্ষন ভাবছিলাম সব দোষ আমার আর তলে তলে তুমিও ছিঃ।
বেলার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
-আমিও রক্তমাংসের মানুষ সুমিত আমারও মন আছে, ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে। তবে তোমার মত আমি প্রেমে ভেসে গিয়ে তাকে বিছানায় টেনে আনিনি।
- ও প্রতি রাতে তুমি তাহলে তার সাথেই ব্যস্ত থাকতে ।
ঘেন্নায় মুখ বিকৃত করল সুমিত।
-হ্যাঁ থাকতাম। তোমার একটু সময়ের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি আমি কিন্তু তোমার কাছে আমার জন্য কোন সময় ছিল না আসলে কখনো তুমি আমাকে নিজের যোগ্য বলেই মনে করনি। বাড়ির একটা ফার্নিচারের সাথে আমার কোন পার্থক্য ছিল কি?
শেখরের সাথে কথা বলে একটু মনের শান্তি অন্তত খুঁজে পেতাম।
সুমিতের তীব্র ঘৃনা মেশানো গলায় বলল,
-নষ্ট মেয়ে মানুষ!
চোখ থেকে আগুন ঝরে পড়ল বেলার,
-তুমি করলে সেটা দোষের নয় কারন তুমি তো পুরুষ মানুষ! তোমার বেলায় সাত খুন মাফ আর আমি করলে নষ্ট মেয়ে মানুষ!!
-তোমাদের মত পুরুষরা বিবাহিত স্ত্রীদের টেকেন ফর গ্রান্টেড হিসেবে নিয়ে নেয় ,অবলীলায় অবৈধ সম্পর্কে জড়ায়, সে সম্পর্ক টিকলে ভালো কথা নইলে ঘরে স্ত্রী তো আছেই তাই না ??
তীব্র বিদ্বেষ ঝরে পরলো বেলার কণ্ঠ দিয়ে।
সুমিত চোয়াল শক্ত করে বলল ,
- এবার তুমি বাড়াবাড়ি করছ।
বেলা এবার শান্ত ভাবে বলল,
-তুমি কি মনে করো সুমিত দিনের পর দিন তুমি যা খুশি করে যাবে আর আমি তোমার অপেক্ষাতেই সারা জীবন কাটিয়ে দেবো আর কখন তুমি একটু ভালোবাসার ভিক্ষা দিতে আসবে তার প্রতীক্ষা করব? জীবনে কিছু না পেয়েও সুখী সুখী ভাব করে সারাটা জীবন আমি কাটাতে চাই না সুমিত।
সুমিতের মুখখানা এবার রক্ত শূন্য বিবর্ণ দেখাচ্ছিল।
বেলার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
- এভাবে তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না মা এলে মাকে কি বলব আমি?
বেলা সুমিতের হাতটা ছাড়িয়ে বলল,
-যা সত্যি তাই বলবে । আর একটা কথা রিনিতা ছেড়ে চলে গেল বলেই এখন তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছ । কিন্তু দুদিন বাদে আর এক রিনিতা আসবে না কে বলতে পারে!
সুমিতের এবার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছিল,
-তুমি ভুল করছ বেলা। প্লিজ আর একবার ভাব।
হাতের শাঁখা পলাগুলো খুলতে খুলতে বেলা বলল,
- শেখরের বাঁ হাত এক্সিডেন্টে কাটা পড়েছিল তাই ইচ্ছে থাকলেও সে তার ভালোবাসার কথাটা আমার বাবাকে বলতে পারে নি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে বিয়েও করে নি। শেখর তোমার মত সুদর্শন নয় অত বড় চাকরিও করে না সামান্য একটা স্টেশনারী দোকান আছে ওর । দুবেলার ভাতটুকু আর অপরিসীম ভালোবাসা অন্তত দিতে পারবে ।
ভোর হয়ে এসেছিল, বেলার ফোনটা বেজে উঠল,
-হ্যাঁ একটু দাঁড়াও শেখর আসছি।
শেখর নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমি আসি , আর একটা অনুরোধ তোমার কাছে মায়ের কাছে সব সত্যি গুলো বলো, উনি ঠিক বুঝবেন। আর ভালো থাকার চেষ্টা করো।
(সমাপ্ত)
K. K. Roy