Thread Rating:
  • 106 Vote(s) - 2.8 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) সমাপ্ত :---
মিষ্টি মুহুর্ত 4
Update 1

দিদিমার হঠাৎ চলে যাওয়ার পর দুটো পরিবারেই শোকের ছায়া নেমে এলো । সবাই খুব শান্ত হয়ে গেল । কারোর মুখে হাসির রেখা দেখা দিল না কয়েক সপ্তাহ। পুজার ছুটি শেষ হওয়ার পর সুচি কিছুদিন কলেজে গেলো না । সুচেতা দেবী অনেক বলে কয়েও তাকে কলেজে পাঠাতে পারলেন না । এদিকে স্নেহা দেবী আকাশ কে একরকম জোর করেই কলেজে পাঠালেন।

সুচি প্রায় এক সপ্তাহ কলেজ কামাই করার পর সুচেতা দেবী খুব বকা বকে জোর করে সুচিকে কলেজে পাঠালেন। কলেজে গিয়ে কারোর সাথেই তেমন কথা বললো না। ক্লাসের পড়ায় কিছুতেই মন বসাতে পারলো না। বারবার দিম্মার মুখ ভেসে আসছে । কতো কথা , কতো আদর , ভালোবাসা , গালে চুমু খাওয়া সব একের পর এক চোখের সামনে ভাসতে লাগলো সুচির । ক্লাসের কোলাহল তার এই শান্ত মনের ভিতর কিছুতেই প্রবেশ করতে পারলো না।

টিফিন ব্রেকে ক্লাস রুম থেকে বাইরে বার হলো না সুচি। বেঞ্চে বসে জানালা দিয়ে বাইরের গাছপালা , বিল্ডিং দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো কলেজ মাঠের দক্ষিণ কোনায় যে বড়ো বাবলা গাছটা আছে তার নিচে আকাশ কাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে । একটু ভালো করে দেখে চমকে উঠলো সুচি। ‘ আরে ! এরা তো ক্লাস নাইন আর তারই ক্লাসের সেই ছেলে গুলো যারা ক্লাসের ম্যামদের শরীর নিয়ে বাজে বাজে কথা বলে । ‚

ছেলে গুলোকে চিনতে পেরেই সুচির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো ‘ কি কথা বলছে ও ওই নোংরা ছেলেগুলোর সাথে ? আর বন্ধুত্বই বা হলো কখন ? ‚  এইসব ভাবতে ভাবতেই ঢং ঢং আওয়াজ করে টিফিন ব্রেক শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়ে গেল। বাবলা গাছের তলার আসর ভেঙে গিয়ে যখন ক্লাস টেনের ছাত্র গুলো ক্লাসরুমে ঢুকলো তখন সুচি তাদের দিকে রাগি দৃষ্টিতে কটমটিয়ে একভাবে তাকিয়ে রইলো। ছেলেগুলো সুচিকে দেখলে ভস্ম হয়ে যেত নিশ্চয়ই।

টিফিন ব্রেকের আগে সুচি ক্লাসের পড়ায় মন বসাতে পারছিল না দিম্মার স্মৃতির জন্য। টিফিন ব্রেকের পর সুচি ক্লাসের পড়ায় মন বসাতে পারলো আকাশের এই ফোরটয়েন্টি ছেলে গুলোর সাথে হেসে হেসে কথা বলার জন্য। মনে মনে ভাবতে লাগলো ‘ কি কথা বলছিল ও ? কবে থেকে বলছে ? আগে তো দেখিনি ! দিম্মার চলে যাওয়ার পর ! হ্যাঁ দিম্মার চলে যাওয়ার পরে এই প্রথম দেখছি। আগে তো দেখিনি ! তাহলে কি ও নিজেকে একা মনে করছে ! রাতে তো দিম্মার সাথে ঘুমাতো। এখন একা ঘুমায়। তাই হয়তো নিজেকে একা পাচ্ছে। ‚

চার মাস পরেই মাধ্যমিক পরিক্ষা বলে শেষ ক্লাসের ঘন্টা পড়ার পরেও ম্যাম প্রায় পনের মিনিট একস্ট্রা ক্লাস করালেন। ততক্ষণে অন্য ক্লাস রুম ফাকা হয়ে গেছে । সুচির চিন্তা হতে লাগলো , মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো ‘ আকাশ যদি বাড়ি চলে যায় তাহলে আর ধরা যাবে না। রাস্তাতেই ওকে ধরতে হবে। আরে ক্লাসটা কখন শেষ হবে ? ‚

ক্লাস শেষ হতেই সুচি সবাইকে ঠেলে কলেজের বাইরে এসে ফুটপাত দিয়ে দৌড়ালো । শীতকাল পড়ে গেছে আর ঠান্ডা হাওয়াও বইছে । তাই ফুটপাত দিয়ে দৌড়াতে তেমন ধকল হচ্ছিল না সুচির। কিছুক্ষণ পরেই সুচি আকাশকে দেখতে পেল। আকাশের পাশে গিয়ে ওর সাথে হাটা শুরু করলো। সুচি পাশে আসতে আকাশ একবার সুচির দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে হাটা শুরু করলো। তিন চার পা হাটার পর একটু বড়ো দম নিয়ে সুচি জিজ্ঞাসা করলো “ কলেজ তো অনেকক্ষণ আগে ছুটি হয়েছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলি ? „

“ ওই বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলাম। „ সুচির দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো আকাশ।

“ কোন বন্ধুদের সাথে ? „

আকাশ ক্লাস নাইনের ওইসব নোংরা ছেলেদের নাম নিতেই সুচি প্রায় গর্জিয়ে উঠলো “ বড়োদের সাথে এতো কিসের কথা তোর ? „

“ তোর জেনে কি হবে ? আর তুইও তো ওদের বয়সী ! „ সুচির রাগকে আকাশ ভয় করে না। সেও পাল্টা জবাব দিয়ে দিল।

আকাশের কাছ থেকে পাল্টা জবাব পেয়ে সুচি ধমকিয়ে ওঠে “ আমার মুখের উপর তর্ক করবি না। কাল থেকে যদি দেখেছি ওই নোংরা অসভ্য ছেলেগুলোর সাথে কথা বলছিস তাহলে কাকিকে বলে দেবো সব। তারপর মুখের উপর তর্ক করার ঠেলা বুঝবি । „

সুচির ধমক খেয়ে আকাশ চুপ মেরে গেল। মনে মনে ভাবলো ‘ মা যদি জানতে পারে যে ওদের সাথে কথা বলছিল তাহলে আস্ত রাখবে না । ‚ “ কি কথা বলছিলি ওদের সাথে ? „ আকাশকে চুপ করে থাকতে দেখে সুচি আবার জিজ্ঞাসা করলো ।

কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রেখে ফুটপাতে বিছানো ইটের দিকে তাকিয়ে আকাশ বললো “ ওই , আমার কোন নায়িকা কে দেখতে ভালো লাগে। ওদের কোন নায়িকা কে দেখতে ভালো লাগে। আমি কি কি সিনেমা দেখেছি ? সিগারেট খেয়েছি কি না ? „

“ সত্যি বলছিস ? „

“ তোর সাথে মিথ্যা বলবো কেন ? „

“ কবে থেকে কথা বলছিস ওদের সাথে ? „

“ কাল থেকে । „

‘ যাক ! বেশি দিন হয়নি তাহলে। আর নোংরা কথাও তেমন বলে নি । ‚ এতক্ষণ পর সুচির মনটা শান্ত হলো। “ কাল থেকে যেন ওদের সাথে মিশতে না দেখি। কাল থেকে আমার সাথে কলেজে যাবি। „

কিছুক্ষণ একসাথে হাটার পর সুচি আবার জিজ্ঞাসা করলো “ দিম্মার কথা মনে পড়ছে ? „

আকাশ এবার পুরো চুপ করে গেল। সুচি আকাশের মুখ দেখেই বুঝতে পারলো ‘ তার সন্দেহ সঠিক। দিম্মার চলে যাওয়ার পর নিজেকে একা ভেবে বড়ো ক্লাসের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করে দিম্মার অভাব দূর করতে চাইছে। ‚ কথাটা ভেবে আকাশের ডান হাত নিজের বাম হাতে নিয়ে সুচি বললো “ আমারও খুব মনে পড়ছে । „

তারপর দুজনে একসাথে বাড়ির দিকে হাটতে লাগলো। পরের দিন থেকে আকাশ সুচির সাথেই কলেজে যেতে শুরু করলো । সুচি আকাশকে আর ওদের সাথে মিশতে দিল না।

কয়েক সপ্তাহ শাশুড়ি মায়ের ফোন না পেয়ে তিলোত্তমা নিজে ফোন করলো। আকাশের মা তখন রুটি করার জন্য আটায় জল দিয়ে আটা মাখছিলেন। তিলোত্তমার ফোন পেয়ে আকাশের মা ফোনটা স্পিকারে দিয়ে বললেন “ হ্যালো । „

“ ও দিদি বলছো ! মা আছে ? „

“ মা আর ....... কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না স্নেহা দেবী। কিছু একটা যেন গলায় বেধে গেল তার।

“ হ্যালো ! হ্যাঁ দিদি ! কিছু শুনতে পাচ্ছি না । „

“ মা নেই । „ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনটাকে শক্ত করে বলেই ফেললেন কথাটা।

“ কোথায় গেছে ? „ অপরপ্রান্ত থেকে তিলোত্তমা সকৌতুহলী প্রশ্ন করলো।

“ যেখানে আমার বাবা আছে সেখানে । „ কথাটা বলার সময় চোখের কোনায় এক ফোটা জল চিকচিক করে উঠলো স্নেহা দেবীর।

তিলোত্তমা বুঝতে পারলো যে দিদিমা মারা গেছেন। কিছুক্ষণ দুই প্রান্ত চুপ থাকার পর শান্তি ভঙ্গ করলো তিলোত্তমা “ আমাদের একবারও জানালে না দিদি ! „

“ জানাতাম যদি আপন হতে। মা তোমাদের এখানে আসতে বলেছিল পুজার সময়। তোমরা না এসে মাকে কতোটা কষ্ট দিয়েছিলে সেটা তোমরা জানো না। তোমরাই আমাদের সাথে পরের মতো আচরণ করেছো। তাই আর জানানোর প্রয়োজন বোধ করি নি। „ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফোনটা কেটে দিয়ে চোখের কোনায় লেগে থাকা জলের ফোটাটা হাতের পিঠ দিয়ে মুছে আবার আটা মাখতে শুরু করলেন স্নেহা দেবী।

এই ঘটনা আকাশ বা আকাশের বাবা জানতে পারলেন না। এরপর রোজ কলেজ টিউশন খেলাধুলা আর নাচের ক্লাসের মধ্যে দিয়ে ডিসেম্বর মাস শেষ হয়ে জানুয়ারি মাস পরে গেল। নতুন বছর শুরু হতে আকাশ অষ্টম শ্রেনীতে উঠে গেল। আর সুচির মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এলো।  

দিম্মার কথা সুচি কখনও ভোলে নি। ভুলতে চায় ও না । দিম্মা তাকে মন দিয়ে পড়ে পরিক্ষা দিতে বলেছিল। ‘ বাবা মায়ের জন্য , নিজের জন্য , নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভালো নাম্বারে পাস করা দরকার। ‚ এটা দিম্মা তাকে অনেক বার বলেছেন । তাই সুচি ডিসেম্বর থেকেই মন দিয়ে পড়তে লাগলো। সুমি তার বোনকে সবরকম ভাবেই সাহায্য করতে লাগলো।

মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর একদিন সন্ধ্যায় স্নেহা দেবী দেখলেন নুন শেষ। তিনি আকাশকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বললেন “ যা । নুন নিয়ে আয় । „

আকাশ টাকাটা নিয়ে নিচে নেমে সোসাইটির বাইরের দোকান থেকে একটা নুনের প্যাকেট আর একটা চিপসের প্যাকেট কিনলো। চিপসটা খেতে খেতে আসার সময় সে দেখলো প্যাকেটের ভিতর একটা ছোট প্লাস্টিকের ভিতর একটা বাঁশি আছে। বাঁশিটা হাতে নিয়েই একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল আকাশের পুরো মুখে ।

সন্ধ্যা হওয়ার পরেই সুচি টেবিলে বসে ভূগোল বই নিয়ে পড়তে শুরু করেছিল । এক দিন পরেই ভুগোল পরিক্ষা । আর সুমি খাটে বসে একটা মোটা কম্পিউটার এর বই খুলে দেখছিল কোন কোন অধ্যায় পড়া হওয়ার সাথে রিভিশনও হয়ে গেছে , আর কোনটা শুধু পড়া হয়েছে কিন্তু রিভিশন হয়নি। সুমি উচ্চমাধ্যমিক এর পর ইঞ্জিনিয়ারিং না করে  BBA পড়েছে। এখন MBA পড়ছে। উদ্দেশ্যে বাংঙ্কে চাকরি করা। দুই বোন যখন নিজের পড়ায় ধ্যানমগ্ন ঠিক তখন আকাশ ঘরে ঢুকলো । হাতে তার সেই ছোট প্লাস্টিকের বাঁশি আর মুখে সেই দুষ্টুমিভরা হাসিটা এখনও আছে । বাঁশির মুখে প্লাস্টিক গুটিয়ে রাখা। বাঁশিতে ফু দিলে প্লাস্টিকটা খুলে লম্বা হয়ে যায়।

আকাশ ঘরে ঢোকা মাত্রই দুই বোন আকাশের দিকে তাকালো। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিল। আকাশ সুমির পড়ার চেয়ার নিয়ে সুচির পাশে বসলো। সুচি ভুরু কুচকে কিছুক্ষণ আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। বোঝার চেষ্টা করলো আকাশ এখানে কি জন্য এসছে। কিন্তু কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না। কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার পড়ায় মন দিল।

“ গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষের প্রধান জীবিকা হলো........প্যাঁএএএএএএ । সুচির বাক্য শেষ হওয়ার আগেই আকাশ তার বাঁশি বাজালো। বাঁশি তে ফু দিতেই গুটিয়ে রাখা প্লাস্টিক খুলে গিয়ে সুচির নাকের সামনে চলে এলো। বাঁশির শব্দে আর ওই প্লাস্টিকটার জন্য সুচি একরাশ বিরক্তি মুখে ফুটিয়ে বললো “ কাল বাদে পরশু আমার পরীক্ষা। এরকম করিস না , মার খাবি বলে দিলাম ! „

আকাশ সুচির কথায় কান না দিয়ে , সুচির দিকে না তাকিয়ে টেবিলের উপর রাখা ভুগোল বইটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর সুচি আবার পড়া শুরু করলো “ গাঙ্গেয় সমভূমির মৃত্তিকা ধান চাষের জন্য ....... প্যাঁএএএএএএএএএ

এবার সুচি কিছু বললো না। ভুগোল বইটা তুলে আকাশের মুখের উপর সপাটে বসিয়ে দিল। আকাশ চেয়ার থেকে উঠে হাসতে হাসতে দৌড়ে ঘরের বাইরে যেতে লাগলো। সুচিও চেয়ার থেকে উঠে আকাশের পাছায় সপাটে একটা খালি পায়ের লাথি বসিয়ে দিল। সুচি আর আকাশের এই কান্ড দেখে সুমি হো হো হো করে হাসতে হাসতে খাটের উপর গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আকাশ ঘর থেকে চলে গেলে সুচি দিদিকে বললো “ ও কি এখনও বাচ্চা ! „

সুমি হাসতে হাসতে বললো “ এটা তো সবথেকে ভালো তুই জানিস । „

সুচি দিদির কথার মানে বুঝতে পারলো না। সে আবার চেয়ারে বসে পড়তে লাগলো। “ গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের প্রধান জীবিকা হলো কৃষিকাজ ও মৎস্যচাষ। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের মৃত্তিকা ধান চাষের জন্য খুব উর্বর। „

সুচির মাধ্যমিক পরিক্ষা শেষ হওয়ার কয়েক মাস পরে রেজাল্ট বার হলো । সুচি স্টার মার্কস পেয়ে পাস করলো। সুচির মা বাবা যারপরনাই খুব খুশি হলেন। মেয়ে এতো ভালো রেজাল্ট করবে সেটা তারা ভাবতে পারেন নি। ভালো রেজাল্ট করার জন্য সমরেশ বাবু ছোট মেয়েকে একটা নোকিয়া ফোন কিনে দিলেন। তাতে শুধু কথা বলা আর রেডিও শোনা ছাড়া কিছু হয় না। সুচি ফোন পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি সুরে আবদার করলো “ মা একটা স্ক্রিনটাচ ফোন কিনে দাও না ! „

“ না । তোর বাবা বকবে। আগে উচ্চমাধ্যমিক পাস কর । উচ্চমাধ্যমিক পাস করলে তারপর স্ক্রিনটাচ ফোন কিনে দেবে বলেছে। „

“ ধ্যাৎ ! ভাল লাগে না এইসব । আমার সব বন্ধুদের কাছে তো আছে স্মার্টফোন। জয়শ্রী তো আমার থেকেও কম নাম্বার পেয়েছে। ওকে তো কাকা পনের হাজার টাকার স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে।

সুচেতা দেবী বললেন “ বললাম তো আগে উচ্চমাধ্যমিক পাস কর । তারপর স্মার্টফোন পাবি । সুমির পড়াশোনার জন্য কত খরচা হচ্ছে সেটা ভাব । „ মায়ের কথা শুনে সুচি চুপ করে গেল।

রেজাল্ট বার হওয়ার পর প্রথম দুই দিন নাচের ক্লাসে গিয়ে সুচি রাজ কে দেখতে পেলো না। তৃতীয় দিনে সুচি রাজের বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতে সে বললো “ ও তো উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে JNU তে চলে গেছে । „

কথাটা বলে রাজের বন্ধু অভি একটা পুরানো কথা ভাবলো। কয়েক দিন আগে যখন রাজ অভিকে কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেছিল তখন অভি জিজ্ঞাসা করেছিল “ তুই সেদিন সুচির নাচ দেখে বলেছিলি ওকে গার্লফ্রেন্ড বানাবি । আব কা হুয়া ? „

রাজ একটু হেসে বলেছিল “ ওর সাথে বন্ধুত্ব করে কয়েকদিন কথা বলে বুঝেছিলাম যে ও টিপিক্যাল বাঙালি মহিলাদের মতো আর খুব পজেসিভ। মানে ওর সাথে যে রিলেশনে যাবে তাকে রাস্তায় বার হতে গেলে চোখে কাল কাপড় পড়ে বার হতে হবে। কোন মেয়ের দিকে তাকানো যাবে না। ভাব একবার ! „ তারপর কিছুক্ষণ হাসতে হাসতে রাজ বলেছিল “ Backdated মেয়ে । „

রাজের বলা কথা গুলো অভি আর সুচিকে বললো না। সুচির দুঃখ হলো না। রাজ সুচিকে অন্য চোখে দেখলেও সুচির কাছে সে একজন ভালো বন্ধু অপেক্ষা আর কিছু ছিল না। শুধু মনে মনে ভাবলো “ আমাকে না বলে চলে গেল ! „

নাচের ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরে উপরে উঠতেই আকাশের ফ্ল্যাটের বাইরে থেকেই খুব জোরে টিভির আওয়াজ শুনতে পেল । উকি মেরে দেখলো আকাশ একটা সিনেমা দেখছে। সুচি নিজের ঘরে না গিয়ে আকাশের পাশে বসে সিনেমা দেখতে শুরু করলো। সেই সিনেমাটা পছন্দ না হতে টিভির রিমোট টা নিয়ে অন্য চ্যানেল লাগিয়ে দিল।

চ্যানেল ঘোরাতেই আকাশ ভুরু কুচকে জিজ্ঞাসা করলো “ চ্যানেল ঘোরালি কেন ? „

“ ওটা আমরা ভালো লাগছিল না তাই । „

“ আমি তো দেখছিলাম । „

“ এখন এটা দেখ । „

সুচির সাথে কথায় না পেরে উঠে আকাশ একবার সুচির দিকে তাকিয়ে রিমোট কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। সুচি রিমোট টা দিল না। রিমোট না দিয়েই সোফার উপর রাখা কুশন দিয়ে আকাশের মুখের উপর মারলো। আকাশ রিমোট এক হাতে ধরে আর এক হাতে কুশনটা সরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। সুচি কুশনটা দিয়েই আরও কয়েকবার আকাশকে মারলো। তারপর দুজনের হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল। সুচি ভুলেই গেল যে ‘ রাজ তাকে না বলে দিল্লি চলে গেছে । ‚

দুজনের হুটোপুটি দেখে স্নেহা দেবী এসে বললেন “ তোদের কাউকেই দেখতে হবে না। „ বলে রিমোট টা নিয়ে বাংলা ঘরোয়া ধারাবাহিক এর চ্যানেল চালিয়ে দিলেন। অগত্যা দুজনকে চুপচাপ বসে ওই ধারাবাহিক দেখতে লাগলো । সমরেশ বাবু অফিস থেকে ফিরতেই সুচি নিজের ঘরে চলে গেল। 


মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার জন্য সুচি কমার্স নিয়ে অন্য কলেজে ভর্তি হলো । কলেজ শুরু হতে এখনও দুই সপ্তাহ মতো বাকি। রোজ জয়শ্রীর সাথে পার্কে আড্ডা দেওয়া আর জয়শ্রীর নতুন ফোনের বিভিন্ন কেরামতি দেখতে দেখতে ছুটির দিন গুলো কেটে যাচ্ছিল। একদিন বিকালে পার্কে বসে সুচি কে জয়শ্রী দেখাচ্ছিল কিভাবে পুরানো যুগের গান ডাউনলোড করা যায়। ঠিক এমন সময় তলপেটে তীব্র ব্যাথা শুরু হতে সুচি উঠে ঘরে চলে গেল।

আকাশ তখন ক্রিকেট খেলছিল। ক্রিকেট খেলার সময় একবার আকাশ দেখেছিল সুচিকে ছোটদের দোলনায় বসে জয়শ্রীর সাথে গল্প করতে। কিছুক্ষণ পর সুচিকে পেটে হাত দিয়ে চলে যেতেও দেখেছিল  কিন্তু তখন খেলার উৎসাহে সেইভাবে খেয়াল করতে পরেনি সে। ক্রিকেট ম্যাচ খেলে  হাত পা ধুয়ে পড়তে বসার দুই মিনিট পরেই সুচির ওই পেটে হাত দিয়ে পার্ক থেকে চলে যাওয়ার কথা মনে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বই গুছিয়ে মায়ের চোখের আড়ালে সে সুচির ফ্ল্যাটে চলে গেল। জেঠিমা তখন আর সব বাঙালী গৃহিনীর মতোই বাংলা ধারাবাহিক দেখছেন। ফ্ল্যাটে ঢুকে জেঠিমা কে জিজ্ঞাসা করলো “ জেঠিমা, সুচি কোথায় ? „

আকাশ যে চুপিচুপি ঘরে এসে ঢুকেছে সেটা সুচির মা খেয়াল করেন নি। আকাশের আওয়াজে মুখ ঘুরিয়ে বললেন “ ঘরে আছে। „

জেঠিমার কথা শুনেই আকাশ সুচির ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আকাশকে থামানোর জন্য জেঠিমা বললেন “ যাস না , ও অসুস্থ। „

‘ সুচি অসুস্থ। ‚ কথাটা শুনেই আকাশের কপালে ভাঁজ পড়লো। জেঠিমা বারন করলেও , জেঠিমার বারন উপেক্ষা করে আকাশ সুচির ঘরের দিকে পা বাড়ালো ।

আকাশ সুচির ঘরে ঢুকে দেখলো সুমি টেবিলে বসে মোটা একটা বই নিয়ে পড়ছে । সামনে তার একটা ল্যাপটপ খোলা। একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ সমরেশ বাবু মেয়েকে কিনে দিয়েছিলেন। এটা সেই ল্যাপটপ । আর যে বইটা খোলা আছে সেই বইটার আকার দেখে আকাশের মনে হলো ‘ এই বইটা দিয়ে যদি একবার কাউকে মারা হয় তাহলে দ্বিতীয় বার আর প্রহার করার দরকার পড়বে না। দ্বিতীয় বার মারার আগেই সে ইহজগত ত্যাগ করবে । ‚ আর সুচি খাটের উপর একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। মুখে তার তীব্র ব্যাথার ছাপ স্পষ্ট ।

আকাশ ঘরে ঢুকতেই দুই বোন আকাশের দিকে তাকালো কিন্তু কেউ কিছু বললো না। আকাশ সুচির পাশে গিয়ে বসলো “ কি হয়েছে? শরীর খারাপ ? „

সুচি কিছুক্ষণ আকাশের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো “ মাসিক হয়েছে । „

আগস্ট মাসে কলকাতায় বরফ পরলে মানুষের মুখ বিস্ময়ে যেমন হয়ে যাবে ঠিক তেমনি ভুরু কপালে তুলে, চোখ বড়ো বড়ো করে মুখে সেই বিস্ময় নিয়ে আকাশ জিজ্ঞাসা করলো “ তুই মেয়ে ? „

সুচির মাথাটা রাগে দপ করে জ্বলে উঠলো । এটা একটা জঘন্য ইয়ার্কি । অন্যদিন হলে হয়তো সুচি সহ্য করে নিত কিন্তু আজকে এই কিছুক্ষণ আগে শুরু হওয়া মাসিকের জন্য তলপেটটা ব্যাথায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। এই ব্যাথার জন্য আকাশের ইয়ার্কি সহ্য করতে পারলো না সুচি। ঠাসসসসসস করে ডান হাতের চড় আকাশের বাঁ গালে বসিয়ে দিল। সুচির চড়ের শব্দে সুমি চেয়ারে বসেই নড়ে উঠলো। সুচেতা দেবী লিভিংরুম থেকেই শব্দটা শুনে চমকে উঠলেন ।

আরও একটা মারার আগেই আকাশ খাট থেকে উঠে গেল । গালে হাত বোলাতে বোলাতে ঘরের বাইরে চলে এলো। আকাশ ঘর থেকে বাইরে বার হওয়ার সময় আকাশের পিঠের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সুচি বললো “ idiot „

আকাশ সুচির বলা কথাটা শুনতে পেল না। আকাশ ঘরের বাইরে আসার পর লিভিংরুমের সোফায় বসে থাকা সুচেতা দেবী আকাশকে গালে বোলাতে দেখে বললেন “ বারন করেছিলাম। শুনলি না তো !

জেঠিমার কথার উত্তর না দিয়ে আকাশ ফ্ল্যাটের বাইরে চলে এলো। সিড়ি দিয়ে বিল্ডিং এর নিচে নামার সময় মনে মনে অনুশোচনা হলো ‘ ইয়ার্কিটা মারা উচিত হয়নি। ওর যে নিয়মিত মাসিক হয় সেটা জানতাম না তো ! বলতে গেলে তো সবসময় আমি ওর আশে পাশেই থাকি। তাহলে এতদিন জানতে পারিনি কেন ? এক মিনিট ! সুচির যেমন নিয়মিত মাসিক হয় তেমনি তো মা সুমি জেঠিমার ও হয়। আর সেটা আমি জানি না !!! ‚ কথাটা মাথাতে আসতেই আকাশ সিড়িতে দাড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ একভাবে সিড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে সে আবার সিড়ি ভেঙে বিল্ডিং এর বাইরে চলে গেল ।

প্রায় দশ পনেরো মিনিট পর আকাশ আবার সুচির ফ্ল্যাটে এলো। এবার তার হাতে একটা প্লাস্টিক। সুচেতা দেবী বুঝতে পারলেন না প্লাস্টিক এর ভিতরে কি আছে “ তুই আবার এসছিস । ও কিন্তু রেগে আছে খুব। ওর কাছে যাস না । „

আকাশ ঠোটের কোনায় হাসি নিয়ে সুচির ঘরে ঢুকে খেল। সুমি আকাশকে দেখে ভাবলো ‘ এইতো কিছুক্ষণ আগে চড় খেল। এখন আবার এসছে। ‚

আকাশ এসে ফের সুচির পাশে বসলো। হাতের প্লাস্টিক টা সুচির হাতের কাছে রাখলো। সুচি দেখলো প্লাস্টিক এর ভিতরে দুটো ডেইরিমিল্ক একটা কিটক্যাট আর কয়েকটা ক্যাটবেরি লজেন্স আছে।

আকাশ প্লাস্টিকটা দিয়ে , সুচির হাতের উপর হাত রেখে প্রায় এক দুই  মিনিট মতো বসে রইলো। তারপর উঠে ঘরের বাইরে চলে যেতে লাগলো । আকাশ ঘরের বাইরে চলে যাওয়ার সময় সুচি আকাশের পিঠের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি নিয়ে বললো “ Idiot । „
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) চলছে :--- - by Bichitro - 03-10-2021, 09:30 AM



Users browsing this thread: 153 Guest(s)