28-09-2021, 08:07 AM
আমার দুর্গাl
***********
কলেজের বড় দিদিমনির ঘরের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসে ঘামছিলেন বীরেন বাবু। সাড়ে দশটা বাজে। এখান থেকে এগারো টার মধ্যে বেরোলে তবে সাড়ে এগারো টার মধ্যে দোকানে পৌঁছতে পারবেন উনি। আজ ষষ্ঠী। অনেক ছোটখাট কোম্পানীতে আজ ই বোনাসের দিন। আর, বোনাস পেয়ে অনেকে এই দিনেই কেনাকাটা করতে আসেন। তাই মালিক বারবার বলে দিয়েছেন আজ বারোটা বাজার আগে ওনাকে পৌঁছনোর জন্য। আর, আজকালের মধ্যে যা শাড়ি বা অন্য জিনিষ বিক্রি হবে, তার ওপর ই নির্ভর করবে বীরেন বাবু আর সারদাময়ী বস্ত্রালয়ের বাকি স্টাফদের পুজোর বোনাস। আজকের দিন টা তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত কাল মেয়ে যখন বলল আজ কলেজ ছুটি পড়ে যাবার দিনে কলেজের বড় দিদিমণি ওনাকে কলেজে ডেকেছেন, তখন থেকেই খুব ভয় লাগছে ওনার। এমনি তে মাম্পি খুব একটা দুষ্টু না, বরং লক্ষী মেয়েই বলা যায়। মা মরা মেয়ে, নিজের খেয়ালেই থাকে বেশিরভাগ। সেই মেয়ে কোন অন্যায় করেছে কি? ভেবে ভেবে রাতে ভাল ঘুম হয়নি বীরেন বাবুর। আজ সকালে, মেয়েকে সাইকেলে করে কলেজে দিতে আসার সময়ও জিজ্ঞেস করেছিলেন 'কিরে মাম্পি, আমাকে দিদিমণি ডাকলেন কেন? তুই কি করেছিস'?'
'আমি কিছু করিনি বাবা। সত্যি বলছি। ' জোর গলায় বলেছে মেয়ে।
ঘড়িটা খারাপ হয়ে গেছে, ব্যাটারি লাগানো যায় নি। পকেট থেকে সাদা কালো মোবাইল টা বের করতে যাবেন, এমন সময় বড়দিদিমনি সামনে এলেন।
'আপনি কি ক্লাস ফাইভের দুহিতার বাবা?'
'আ...আজ্ঞে ম্যাডাম, ইয়ে দিদিমণি। '
'আসুন, প্লিজ' স্মিত মুখে হেসে বললেন উনি।
বেশ বড় ঘর। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এক কোনে টেলিফোন। নানারকম কাগজপত্তর রাখা গুছিয়ে।
'বসুন। আপনি কি জানেন আজ কেন ডাকা হয়েছে আপনাকে?'
'না...মাম্পি, দুহিতা কি কোনো অন্যায় করেছে?'
'না। সেরকম কিছু না। আমাদের বাংলার দিদিমণি ক্লাস ফাইভের 'দুর্গার' ওপর একটা রচনা লিখতে দিয়েছেলেন কদিন আগে। আপনার মেয়ের লেখাটা পড়ানোর জন্য আপনাকে ডেকেছি।'
'ও কি ভুল কিছু লিখেছে দিদিমণি? আসলে...'
'আরে, দেখুন ই না আপনি...'
কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলস্কেপ কাগজ টা নিয়ে দেখেন মাম্পির গোল ছাঁদের হাতের লেখা। বারবার বলা সত্ত্বেও মার্জিন ছাড়েনি মেয়েটা। ভুরুটা একটু কুঁচকে পড়তে শুরু করলেন বীরেন বাবু
" দুর্গা"
দুর্গা আমাদের প্রিয় ঠাকুর। শরৎকালে দুর্গা পুজো হয়। মা দুর্গার দশটি হাত আছে। মা দুর্গার বাহন সিংহ।' এই পর্যন্ত পড়ে অবাক হয়ে দিদিমণির দিকে তাকান বীরেন বাবু।
'পুরোটা পড়ুন'
'আমার বাবা বলেন, ঠাকুরকে ভালবাসলে চোখ বন্ধ করলেই দেখা যায়। আমি দুর্গা ঠাকুরকে খুব ভালবাসি। কিন্তু আমি চোখ বুজে মনে মনে ভাবলে দুর্গা ঠাকুরকে দেখতে পাই না।
আমার বাবাকে দেখতে পাই।
আমার বাবার দশটা হাত নেই। মাত্র দুটো হাত। বাবার সিংহ নেই, একটা সাইকেল আছে। কিন্তু সেই সাইকেলে চড়ে কাকভোরে উঠে বাবা বাড়িতে বাড়িতে খবরের কাগজ বিলি করেন। তারপর বাড়ি ফিরে আমাকে কলেজে পৌঁছে দেন। তারপর নিজে কাজে বেড়িয়ে যান। বাবা গড়িয়া বাজারের কাছে একটি শাড়ির দোকানে কাজ করেন। রাতে বাড়ি ফিরে বাবা আমাকে পড়াতে বসেন। কারন বাবা বলেন বাবা মা ছাড়া পড়া হয় না ঠিকমত। আমার মা নেই, তাই বাবাই আমাকে পড়ান। তারপর আমি যতক্ষন না ঘুমোচ্ছি বাবা আমার সাথে গল্প করেন। বাবার ও ঘুম পায় সারাদিনের পরিশ্রমে। কিন্তু আমাকে কক্ষনো কিছু বলেন না। বাবার নিজের জুতো টা ক্ষয়ে গেছে কিন্ত আমাকে বাবা দুটো নরম জুতো কিনে দিয়েছেন। আমার বন্ধু কনীনিকা আমাকে বলেছে বাবার দোকানের মালিক বাবাকে সবার সামনে বকাবকি করেন, ও কাকিমার সাথে দোকানে গিয়ে শুনেছে। আমার সেটা শুনে খুব কষ্ট হয়েছে। সেদিন আমি কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার ভান করেছিলাম। একটু পরে ক্লান্ত শরীরে বাবাও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি দেখেছি বাবার গালে শুকিয়ে থাকা চোখের জল। কনীনিকা বলেছিল বাবাকে নাকি শাড়ি পড়ে দেখাতে হয় সবাই কে, শাড়িটা কেমন। ও বলতে বলতে খুব হাসছিল। কৃতিকা, পৌলমীও খুব হাসছিল। তাই আমি ওদের বলতে চাই, সব প্রতিকুলতা, অভাব আর দুঃখের মধ্যেও আমার বাবা যেভাবে হাসিমুখে আমার, ঠাম্মা আর দাদুর সেবা করেন, ভালবাসেন, তাতে আমার বাবাই আমার দুর্গা। কারন মা দুর্গার মতো ই, আমার বাবাও, দুর্গতি বিনাশ করেন আমাদের পরিবারের জন্য।'
পড়তে পড়তে হাতটা কাঁপছিল বীরেন বাবুর। চোখটা জ্বালা করছে বড্ড।
'ভাল থাকবেন বীরেন বাবু। এভাবেই, আপনার মেয়ের দুর্গা হয়ে।' বড় দিদিমণির কথায় ভেসে যাওয়া চোখ নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করেন উনি। বন্ধ চোখের আড়ালে একবার মাম্পির মুখ। আরেকবার মা দুর্গার। তিনিও যে আমাদের সবার 'দুহিতা'।
Collected............
***********
কলেজের বড় দিদিমনির ঘরের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসে ঘামছিলেন বীরেন বাবু। সাড়ে দশটা বাজে। এখান থেকে এগারো টার মধ্যে বেরোলে তবে সাড়ে এগারো টার মধ্যে দোকানে পৌঁছতে পারবেন উনি। আজ ষষ্ঠী। অনেক ছোটখাট কোম্পানীতে আজ ই বোনাসের দিন। আর, বোনাস পেয়ে অনেকে এই দিনেই কেনাকাটা করতে আসেন। তাই মালিক বারবার বলে দিয়েছেন আজ বারোটা বাজার আগে ওনাকে পৌঁছনোর জন্য। আর, আজকালের মধ্যে যা শাড়ি বা অন্য জিনিষ বিক্রি হবে, তার ওপর ই নির্ভর করবে বীরেন বাবু আর সারদাময়ী বস্ত্রালয়ের বাকি স্টাফদের পুজোর বোনাস। আজকের দিন টা তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত কাল মেয়ে যখন বলল আজ কলেজ ছুটি পড়ে যাবার দিনে কলেজের বড় দিদিমণি ওনাকে কলেজে ডেকেছেন, তখন থেকেই খুব ভয় লাগছে ওনার। এমনি তে মাম্পি খুব একটা দুষ্টু না, বরং লক্ষী মেয়েই বলা যায়। মা মরা মেয়ে, নিজের খেয়ালেই থাকে বেশিরভাগ। সেই মেয়ে কোন অন্যায় করেছে কি? ভেবে ভেবে রাতে ভাল ঘুম হয়নি বীরেন বাবুর। আজ সকালে, মেয়েকে সাইকেলে করে কলেজে দিতে আসার সময়ও জিজ্ঞেস করেছিলেন 'কিরে মাম্পি, আমাকে দিদিমণি ডাকলেন কেন? তুই কি করেছিস'?'
'আমি কিছু করিনি বাবা। সত্যি বলছি। ' জোর গলায় বলেছে মেয়ে।
ঘড়িটা খারাপ হয়ে গেছে, ব্যাটারি লাগানো যায় নি। পকেট থেকে সাদা কালো মোবাইল টা বের করতে যাবেন, এমন সময় বড়দিদিমনি সামনে এলেন।
'আপনি কি ক্লাস ফাইভের দুহিতার বাবা?'
'আ...আজ্ঞে ম্যাডাম, ইয়ে দিদিমণি। '
'আসুন, প্লিজ' স্মিত মুখে হেসে বললেন উনি।
বেশ বড় ঘর। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এক কোনে টেলিফোন। নানারকম কাগজপত্তর রাখা গুছিয়ে।
'বসুন। আপনি কি জানেন আজ কেন ডাকা হয়েছে আপনাকে?'
'না...মাম্পি, দুহিতা কি কোনো অন্যায় করেছে?'
'না। সেরকম কিছু না। আমাদের বাংলার দিদিমণি ক্লাস ফাইভের 'দুর্গার' ওপর একটা রচনা লিখতে দিয়েছেলেন কদিন আগে। আপনার মেয়ের লেখাটা পড়ানোর জন্য আপনাকে ডেকেছি।'
'ও কি ভুল কিছু লিখেছে দিদিমণি? আসলে...'
'আরে, দেখুন ই না আপনি...'
কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলস্কেপ কাগজ টা নিয়ে দেখেন মাম্পির গোল ছাঁদের হাতের লেখা। বারবার বলা সত্ত্বেও মার্জিন ছাড়েনি মেয়েটা। ভুরুটা একটু কুঁচকে পড়তে শুরু করলেন বীরেন বাবু
" দুর্গা"
দুর্গা আমাদের প্রিয় ঠাকুর। শরৎকালে দুর্গা পুজো হয়। মা দুর্গার দশটি হাত আছে। মা দুর্গার বাহন সিংহ।' এই পর্যন্ত পড়ে অবাক হয়ে দিদিমণির দিকে তাকান বীরেন বাবু।
'পুরোটা পড়ুন'
'আমার বাবা বলেন, ঠাকুরকে ভালবাসলে চোখ বন্ধ করলেই দেখা যায়। আমি দুর্গা ঠাকুরকে খুব ভালবাসি। কিন্তু আমি চোখ বুজে মনে মনে ভাবলে দুর্গা ঠাকুরকে দেখতে পাই না।
আমার বাবাকে দেখতে পাই।
আমার বাবার দশটা হাত নেই। মাত্র দুটো হাত। বাবার সিংহ নেই, একটা সাইকেল আছে। কিন্তু সেই সাইকেলে চড়ে কাকভোরে উঠে বাবা বাড়িতে বাড়িতে খবরের কাগজ বিলি করেন। তারপর বাড়ি ফিরে আমাকে কলেজে পৌঁছে দেন। তারপর নিজে কাজে বেড়িয়ে যান। বাবা গড়িয়া বাজারের কাছে একটি শাড়ির দোকানে কাজ করেন। রাতে বাড়ি ফিরে বাবা আমাকে পড়াতে বসেন। কারন বাবা বলেন বাবা মা ছাড়া পড়া হয় না ঠিকমত। আমার মা নেই, তাই বাবাই আমাকে পড়ান। তারপর আমি যতক্ষন না ঘুমোচ্ছি বাবা আমার সাথে গল্প করেন। বাবার ও ঘুম পায় সারাদিনের পরিশ্রমে। কিন্তু আমাকে কক্ষনো কিছু বলেন না। বাবার নিজের জুতো টা ক্ষয়ে গেছে কিন্ত আমাকে বাবা দুটো নরম জুতো কিনে দিয়েছেন। আমার বন্ধু কনীনিকা আমাকে বলেছে বাবার দোকানের মালিক বাবাকে সবার সামনে বকাবকি করেন, ও কাকিমার সাথে দোকানে গিয়ে শুনেছে। আমার সেটা শুনে খুব কষ্ট হয়েছে। সেদিন আমি কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার ভান করেছিলাম। একটু পরে ক্লান্ত শরীরে বাবাও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি দেখেছি বাবার গালে শুকিয়ে থাকা চোখের জল। কনীনিকা বলেছিল বাবাকে নাকি শাড়ি পড়ে দেখাতে হয় সবাই কে, শাড়িটা কেমন। ও বলতে বলতে খুব হাসছিল। কৃতিকা, পৌলমীও খুব হাসছিল। তাই আমি ওদের বলতে চাই, সব প্রতিকুলতা, অভাব আর দুঃখের মধ্যেও আমার বাবা যেভাবে হাসিমুখে আমার, ঠাম্মা আর দাদুর সেবা করেন, ভালবাসেন, তাতে আমার বাবাই আমার দুর্গা। কারন মা দুর্গার মতো ই, আমার বাবাও, দুর্গতি বিনাশ করেন আমাদের পরিবারের জন্য।'
পড়তে পড়তে হাতটা কাঁপছিল বীরেন বাবুর। চোখটা জ্বালা করছে বড্ড।
'ভাল থাকবেন বীরেন বাবু। এভাবেই, আপনার মেয়ের দুর্গা হয়ে।' বড় দিদিমণির কথায় ভেসে যাওয়া চোখ নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করেন উনি। বন্ধ চোখের আড়ালে একবার মাম্পির মুখ। আরেকবার মা দুর্গার। তিনিও যে আমাদের সবার 'দুহিতা'।
Collected............