27-09-2021, 09:01 AM
পরের বছর আকাশ উঠলো সপ্তম শ্রেণীতে আর সুচি উঠলো দশম শ্রেনীতে। সুচির উচ্চতা আর না বাড়লেও আকাশের বেড়েছে। আকাশ এখন 5'2 ফুটের। আর এখনই ওর মুখ বাবার মতোই চওড়া হতে শুরু করেছে।
প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠান হয় । শনিবার আর রবিবার দুই দিন ধরে হবে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেইমতো কলেজের খেলার মাঠে বানানো হলো মঞ্চ। শনিবার হাফডে ক্লাস হওয়ার পর সবাই চলে গেল অনুষ্ঠানে। বড়ো ক্লাস মানে অষ্টম থেকে দশম শ্রেনীর ছাত্র ছাত্রীরা পিছনের দিকে বসেছে। আর বাচ্চারা সামনে। আকাশ সপ্তম শ্রেনীতে পড়ে তাই সে সামনের দিকে বসতে যাচ্ছিল। বসার আগেই আকাশ শুনলো কেউ একজন ‘ আকাশ। এই আকাশ ‚ বলে পিছন দিক থেকে ডাকছে। পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সুচি হাত নেড়ে ওকেই ডাকছে। আকাশ পিছনের সারিতে যেতে সুচি পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে বললো “ এখানে বস । „
আকাশ সুচির পাশে বসলো। আশেপাশে সব উঁচু ক্লাসের দিদি দাদারা বসে আছে। তাদের মাঝে একা আকাশ। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো হেডমাস্টার জগদীশ ঘোষের উদ্বোধন বক্তৃতা। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই সবার মাথা যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেল । আকাশ সুচির মুখের দিকে তাকালো। দুজনেরই একই অবস্থা।
দশ মিনিটে সবাই চেয়ারে বসেই নড়েচড়ে উঠতে লাগলো। কুড়ি মিনিট অতিক্রম করতেই সবার মনে হলো দুই ঘন্টা ধরে স্যার বলছেন। আর সেইসাথে সবার চোখে ঘুম চলে এলো । নিদ্রা দেবী যেন পৃথিবীর সব নিদ্রা এই কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের চোখে দিয়ে দিয়েছেন।
কলেজের ছাত্রছাত্রী শুধু নয় সাথে স্যার ম্যামদের মুখেও বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। আকাশ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কয়েকজন ঘুমিয়ে পড়েছে। আর সুচি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো উপর ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র আসতে আসতে কেটে পড়ছে। সেটা দেখে সুচি আকাশের কাঁধে ঠেলা দিয়ে বললো “ চল কেটে পড়ি। „
আকাশ ঘুমিয়ে পড়ার আগের অবস্থায় পৌঁছে গেছিল। সুচির ধাক্কায় আকাশের ঘোর কেটে গেল “ তোর নাচ আছে না ! „
“ আমার নাচ কালকে আছে । এখন চল । „
“ হ্যাঁ চল। „ আকাশ বললো “ একবার যদি ঘুমাই তাহলে কয় বছর ঘুম ভাঙবে জানিনা । „
সুচি আকাশের কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো। তারপর দুজনেই কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাটা দিল। রাস্তায় আসতে আসতে আকাশ বললো “ যদি জেঠিমা জিজ্ঞাসা করে তাহলে কি বলবি ? „
“ বলবো আজকে তো কিছু হবে না। স্যার ম্যাম শুধু বক্তৃতা দেবে আর বাচ্চারা আবৃত্তি করবে, তাই চলে এসছি। কাকি জিজ্ঞাসা করলে তুইও এটাই বলবি। „
কিছুক্ষণ পর আকাশ বললো “ সবাই তো কলেজে ! এখন বাড়ি গিয়ে কি করবো ? „
সুচি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো “ সিনেমা দেখতে যাবি ?
“ সিনেমা ! „ অনেক দিন হলো আকাশ সিনেমা হলে যাইনি। তাই সিনেমা দেখতে যাবে শুনেই চোখটা খুশিতে বড়ো হয়ে উঠলো।
“ হ্যাঁ। শোন। তুই বাড়ি গিয়ে ব্যাগটা রেখে একটা জামা গায় চাপিয়ে চলে আসবি। „
“ আর টাকা ? „
“ দিদিমার কাছ থেকে নিবি । „
সুচির কথা মতো চুপিচুপি নিজের ঘরে ঢুকে জামা পাল্টে দিদিমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিল। টাকা নেওয়ার সময় দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন “ কি করবি এতো টাকা ? „
“ সিনেমা দেখতে যাবো। „ দিদিমাকে সত্য বললে কোন ভয় নেই। তাই সে সত্যিটাই বলে দিল।
“ সিনেমা ? কার সাথে দেখতে যাবি ? „
“ সুচির সাথে । „
সুচির নাম শুনে দিদিমা টাকা দিয়ে দিলেন। সিনেমা দেখে সুচি আর আকাশ যখন ফিরলো তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসছে। তাই কেউ বুঝতে পারলো না এরা কোথায় গেছিল।
পরের দিন কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সুচি নাচলো। হাততালির ঝড় উঠলো দর্শকদের মধ্যে । দর্শকদের মধ্যে দুজন ছেলে দাড়িয়ে সুচির নাচ দেখছিল। দুজনের বয়স সতেরো আঠারো হবে। ওই দুজনের মধ্যে একজন পাশেরজনের উদ্দেশ্যে বললো “ খুব ভালো নাচে। আমাদের ওখানেই শেখে। „
পাশেরজন বললো “ খুব সুন্দর দেখতে । একদম নায়িকাদের মতো ফিগার । „
সেদিন রাতেই আকাশের মামি ফোন করলো । এই দুই তিন বছর হলো আকাশের মামি তিলোত্তমা নিয়মিত ফোন করে খোঁজখবর নেয়। আকাশের মামা তেমন একটা ফোন করেন না। কাজে খুব ব্যাস্ত। তিলোত্তমা যে প্রেগন্যান্ট এটা দিদিমা জানতেন। এবং সুখবরের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। আজকে আকাশের মামি ফোন করে বললো “ ছেলে হয়েছে । অজয় নাম রেখেছি। „
কথাটা শুনে দিদিমার চোখে জল চলে এলো “ বা্ঃ খুব সুন্দর নাম। বলছি , এখানে আয় না তোরা একদিন । „
“ আমি তো বারবার বলি ‘ চলো না ওখানে । কতদিন দেখিনি সবাইকে । সেই বিয়ের সময় দেখেছিলাম। ‚ ও বলে ‘ কাজে খুব ব্যাস্ত। একটু খালি হলেই যাবো। ‚ নাও ওর সাথেই কথা বলো। „ বলে আকাশের মামার কাছে ফোনটা দিয়ে দিলো তিলোত্তমা ।
“ হ্যালো । „
“ হ্যালো। এখানে আয় না তোরা। তোদের খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। „ কথাটায় কতোটা আবেগ ভালোবাসা মিশে ছিল সেটা ফোনের ও প্রান্তে থাকা আকাশের মামা বুঝতে পারলো না।
“ আচ্ছা ঠিক আছে। এবার পূজার সময় যাবো। এখন রাখছি । „ বলে ফোনটা কেটে দিল । কিছুক্ষণ পর আকাশের বাবার স্ক্রিনটাচ ফোনে আকাশের মামা বেবির একটা ফটো পাঠিয়ে দিল। ফটোটা দেখে দিদিমার চোখে জল আর মুখে হাসি দেখা দিল “ একদম স্নেহুর মতো হয়েছে । „
দুই দিন পর বিকালে ভাত ঘুম থেকে উঠে দিদিমা ছাদে এলেন। এখন আর আগের মতো তিনটে সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে হাওয়া খাওয়া যায় না। তার জায়গায় একটা সিড়ি ভেঙে উপরে ছাদে এসেই হাওয়া খান দিদিমা। বুড়ো বয়সে যা সমস্যা হয় তাই আর কি। বাতের সমস্যা তো আছেই। সুগারটাও ওঠানামা করছে। ডাক্তার হাঁটতে বলেছেন। কিন্তু হাঁটতে গেলেই তো বাতের ব্যাথা চাগান দেয়।
ছাদে এসে দিদিমা দেখলেন ছাদের রেলিং ধরে , পিঠে লম্বা চুল ছড়িয়ে সুচি দাঁড়িয়ে আছে। সুচির চুল আর একটু হলে কোমর স্পর্শ করবে। দিদিমা সুচির চুল দেখতে দেখতে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সুচিকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি দেখলেন যে সুচি তার অস্তিত্ব এখনও খেয়ালই করেনি। সুচি একমনে নিচে মাঠে তাকিয়ে আছে। দিদিমা দেখলেন সোসাইটির মাঠে বারো তেরো বছরের ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে , সুচি একমনে তাদের খেলাই দেখছে । আর সুচি তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশ এখন ফিল্ডিং করছে।
তিনি আর কিছু বললেন না। চুপচাপ সুচিকে দেখতে লাগলেন। তিনি দেখলেন সুচির মুখের হাবভাব খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
দিদিমা এবার আরও ভালো করে খেয়াল করলেন। খেলার মাঠে যে ব্যাট করছে সে একটা শট মারলো । বলটা একবার ড্রপ খেয়ে সোজা আকাশের হাতের তালুতে এসে বন্দী হলো। আর সেই সাথে সুচির ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক মিষ্টি আনন্দের রেখা। সুচি হাসছে। সুচির হাসি দেখে দিদিমার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।
পরের বলটা আকাশের দশ হাত দুর থেকে বাউন্ডারির দিকে চলে যাচ্ছিল । আকাশ কিছুটা দৌড়ে ঝাপিয়ে পড়লো বলটা উপর। কিন্তু ততক্ষণে বলটা বাউন্ডারি ক্রশ করে ব্যাটসম্যান কে চার রান দিয়ে দিল। আর দিদিমা দেখলেন সুচির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সুচির ভুরু আর নাক কুচকে গেল। মুখে চরম বিরক্তি ফুটে উঠেছে । পরের দুটো বল ব্যাটসম্যান অন্য ফিল্ডারদের কাছে পাঠালো। একটাতে সে দৌড়ে দুই রান নিল আর একটাতে সে চার রান করলো। কিন্তু সুচির মুখে কিছুই ফুটে উঠলো না।
ওভারের আর একটাই বল বাকি। এই ব্যাটসম্যান অনেক রান করেছে। আটকাতে হবে। বলার একটা ফুলটস বল দিল। ব্যাটসম্যান দুই পা এগিয়ে এসে একটা ছয় হাকালো। কিন্তু একি ! বল বাউন্ডারির বাইরে না গিয়ে অনন্ত আকাশে উঠে গেল । আর আমাদের বারো বছরের ক্লাস সেভেনের আকাশ দুই হাতের তালু দিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসা বলটাকে তালুবন্দী করে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে মাঠে সবাই আকাশকে ঘিরে ধরলো। আর এদিকে সুচি খুশিতে জোড়ে yes বলে চিল্লিয়ে উঠলো। আর সেই সাথে সুচি খেয়াল করলো তার পাশে দিদিমা দাঁড়িয়ে আছে “ তুমি কখন এলে ? „
“ আমি এইতো এলাম। „ তারপর পুরো মুখে হাসি আর দুষ্টুমি ছড়িয়ে দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন “ খেলা দেখছিস ? „
“ হ্যাঁ । „
“ নাড়ু খাবি ? „
“ নাড়ু ! „ নাড়ুর কথা শুনে সুচির চোখ বড়ো হয়ে গেল। দিদিমার হাতের নাড়ু , আচার , এমনকি বিভিন্ন পার্বনে বানানো মিষ্টি আর হরেকরকমের পিঠের সে একনিষ্ঠ খাদক। খুব তৃপ্তি করে খায় দিদিমার হাতে বানানো খাবার।
“ চল। „ সুচির এই খুশি দেখে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যায় দিদিমার।
তারপর দুজনেই নিচে নেমে গেল। দিদিমা ঘরে গিয়ে নাড়ুর কৌটো বার করলেন । আকাশের চোখ বাঁচিয়ে সুচির জন্য লুকিয়ে নাড়ু রেখে দিতে হয়। না হলে আকাশ সব খেয়ে নেয়। নাড়ুর কৌটো খুলতে খুলতে দিদিমা বললেন “ একটা কথা বলবো। রাখবি ? „
“ কি কথা ? „
“ আগে বল রাখবি । „
“ অবশ্যই রাখবো। কি কথা ? সেটা তো বলো ! „
“ তুই আমার দাদুভাইয়ের খেয়াল রাখবি। কথা দে ওকে আগলে রাখবি সবসময় । রাখবি তো ! „ কথাটা বলতে বলতে দিদিমার চোখ জ্বলে উঠলো যেন।
দিম্মার চোখ সুচির একটাই কথা মনে হলো ‘ এই চোখ শুধুমাত্র হ্যাঁ শুনতে চাইছে। চোখ আবার শোনে নাকি ! চোখ দিয়ে তো দেখে। কিন্তু এই চোখ জানতে চাইছে। শুধুমাত্র হ্যাঁ শুনতে চাইছে ‚ । দিম্মার ওই চোখ দেখে সুচি “ হ্যাঁ রাখবো । „ বলে দিল
“ এই নে । „ বলে কৌটোর ভিতরে পরে থাকা শেষ চারটে নারকেল নাড়ু সুচিকে দিয়ে দিলেন “ তোর চুল এরকম কেন ? আজ চিরুনি করিস নি ? „
“ কলেজ থেকে ফিরে আর আজ ইচ্ছা হয়নি । „
“ চল আমি করে দিচ্ছি। „
“ দাড়াও । „ বলে সুচি নিজের ঘর থেকে একটা তেল আনলো। তারপর দিদিমা আর সুচি একটা বিছানা নিয়ে উপরে উঠে গেলেন । দিনে একবার ছাদে ওঠাই কষ্টের। আজকে দুইবার উঠে একটু বেশি ব্যাথা পেলেন হাটুতে।
ছাদে বিছানা পেতে সুচি বসলো তার লম্বা চুল পিঠে ছড়িয়ে । দিদিমা সুচির পিছনে বসে দুই হাতের তালুতে তেল নিয়ে সুচির চুলে মাখাতে মাখাতে বললেন “ সামনে তোর মাধ্যমিক না ! „
“ হ্যাঁ । পরের বছর ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মাধ্যমিক শুরু হবে । „
“ মন দিয়ে পড়বি। আর দুষ্টুমি করিস না। „
“ সেদিনের পর তো করিনি। „
“ শনিবার কলেজ কামাই করে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলি। „ সুচিকে চুপ করে থাকতে দেখে দিদিমা আরও বললেন “ সিনেমা দেখার সময় অনেক পাবি। বড়ো হয়েছিস আর আকাশও বড়ো হচ্ছে । ওর খেয়াল রাখ। রাখবি তো ! „
এতক্ষণ ধরে মনে জেগে ওঠা ভয়টা এবার যেন বেড়ে গেল। দিদিমার কথা শুনে সুচির মনে হচ্ছিল যেন দিদিমা কোথাও চলে যাবে “ তুমি এমন ভাবে বলছো কেন ? .....
দিদিমা সুচির কথার মানে স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। তাই সুচিকে আর বেশি কিছু বলতে না দিয়ে তিনি বললেন “ আকাশ তো এখন বেশিরভাগ সময় তোর সাথেই থাকে। বাড়িতে আর কোথায় থাকে ! তুই বড়ো। তাই তাকে দায়িত্ব নিতে ওর খেয়াল রাখার। „
“ ও যা বদমাশ হয়েছে দেখলেই তো মারতে ইচ্ছা করে । „ দিদিমার কথায় সুচির মনটা শান্ত হলো।
“ ওই একটু আধটু শাসন করবি আর আগলে রাখবি। „ বলে সুচির গালে একটা চুমু খেলেন ।
“ তুমি আমাকেই সবসময় চুমু খাও কেন বলোতো ? „
এতক্ষণ চুলে তেল লাগানোর পর এবার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিতে দিতে দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন “ এমা ! তাহলে কাকে আদর করবো ? „
“ কেন ! তোমার মেয়ে । আকাশের মা । „
“ বোকা মেয়ে একটা। স্নেহার কি আর আমার আদর খাওয়ার বয়স আছে ! ওর তো এখন....... বাকি কথা বলতে গিয়ে দিদিমা খুব লজ্জা পেলেন। লজ্জার কারনে আর কথাটা মুখ দিয়ে বার হলো না।
আসলে দিদিমা বলতে যাচ্ছিলেন ‘ ওর তো এখন আকাশের বাবার আদর খাওয়ার বয়স।‚ এই কথাটা মাথাতে আসতেই লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠলো ‘ ইসসসস কি ভাবছি আমি এইসব। ‚
পরের শনিবার সুচি যখন নাচ শিখতে নাচের ক্লাসে গেল তখন সেইদিন বার্ষিক অনুষ্ঠানের ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো “ হায়। „
“ হায়। „
“ আমার নাম রাজ। আমি এখানে নতুন এসছি। রবিবার তোমার নাচ দেখলাম। খুব সুন্দর নাচো তুমি । „
“ Thanks. আমার নাম সুচিত্রা। ওই একটু আধটু পারি । „
“ কি বলছো তুমি ! একটু আধটু না খুব ভালো নাচো । তুমি যদি ভালো ভাবে মডার্ন ডান্স শিখতে পারো তাহলে খুব উঁচু জায়গায় পৌছে যাবে.....
তারপর দুজনে একসাথে নাচ শিখে বাড়ি চলে এলো। খুব শীঘ্রই সুচি আর রাজ খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠলো। তারপর আকাশের সাথে কলেজ যাওয়া , টিউশন করা , পড়াশোনা করা আর ওই নাচের ক্লাসের মধ্যে দিয়ে সময় কখন কেটে গেল কেউ বুঝতেই পারলো না। এবছর পূজার সময় পঞ্চমীর দিন রাতে দিদিমা তিলোত্তমা কে ফোন করলেন “ কেমন আছো তোমরা ? „
“ আমরা ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো ? „
“ আমি ভালো আছি। স্নেহু আছে ? „
“ ও তো নেই। ব্যাবসার জন্য দিল্লিতে গেছে। দুই সপ্তাহ পর আসবে। „
দিদিমা চোখের জল মুছে বললেন “ অজয় কেমন আছে ? „
“ ও খুব ভালো আছে। খুব দুষ্টু হয়েছে জানো .....
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে দিদিমা ফোনটা রেখে দিলেন। এবার পুজার সময় আকাশের মামা আসবে বলেছিল। সেই আশায় এতগুলো দিন কাটিয়েছেন দিদিমা। তিলোত্তমার কথা শুনে দিদিমা বুঝলেন আকাশের মামা এখানে আসার কথা ভুলে গেছে। দিদিমা নিরবে কিছুক্ষণ চোখের জল ফেললেন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে স্নেহা দেবী মায়ের কথা শুনছিলেন। মায়ের কান্না দেখে স্নেহা দেবীর চোখেও জল চলে এলো। আকাশের মা যে তাকে দেখে কাঁদছে সেটা দিদিমা জানতে পারলেন না।
অষ্টমীর দিন সুচি রাজকে তাদের সোসাইটি তে ডেকেছিল নাচ দেখার জন্য। সুচির নাচ দেখার পর রাজ খুব প্রশংসা করলো। দিদিমা নিচে নামতেই পারলেন না। খুব ইচ্ছা ছিল সুচির নাচ দেখার। সেটাও পূর্ণ্য হলো না।
পুজা শুরু হলে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া চলে আসে। বিজয়া দশমীর দুই দিন পর রাতে একটা চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমাতে খুব আরাম হচ্ছিল আকাশের। ভোর বেলার দিকে আকাশের ঘুম ভেঙে গেল দিদিমার কাশিতে। আকাশ উঠে দিদিমাকে জল দিল। দিদিমা উঠে বসে জল খেয়ে আকাশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
আকাশ ঘুম থেকে উঠে দেখলো দিদিমা ঘুমাচ্ছে। সে চুপচাপ উঠে চলে গেল। আধ ঘন্টা পর ব্রাশ করে এসে দেখলো তখনও দিদিমা ঘুমাচ্ছে। আকাশের বুকটা কেমন একটা করে উঠলো। সে মাকে ডেকে আনলো। স্নেহা দেবী এসে দিদিমার মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন ‘ না জ্বর নেই। ‚ তারপর জিজ্ঞাসা করলেন “ তোমার অসুবিধা হচ্ছে? ডাক্তার ডাকবো। „
দিদিমা চোখের পাতা হাল্কা খুলে মাথাটা দুই দিকে নাড়ালেন । মা বারন করলেও স্নেহা দেবী ফোন করে ডাক্তার ডাকলেন। আধঘণ্টা পর ডাক্তার এলো। এই পুরো সময় আকাশের মাথায় দিদিমা হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তখন স্নেহা দেবী এসে বললেন “ মাকে আর জ্বালাতন করিস না। পড়তে বস গিয়ে । „ মায়ের কথায় আকাশ বইপত্র নিয়ে সোফায় চলে গেল।
ডাক্তার আসলে আকাশ , আকাশের মা বাবা সবাই ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। ডাক্তার দিদিমার পাশে খাটে বসে দিদিমার নাড়ি দেখে দুই দিকে মাথা নেড়ে একটা বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে বললেন “ বেঁচে নেই । „
খবরটা শুনেই আকাশের মায়ের মাথা কাজ করা বন্ধ করেদিল । বুকটা ধড়াস করে উঠলো সবার । গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে এলো আকাশের মার “ এইতো আকাশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল । „
“ এই পাঁচ সাত মিনিট আগেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন । „ কথাটা বলে ডাক্তার তার ব্রিফকেস থেকে একটা ডেথ সার্টিফিকেট বার করে তাতে দিদিমার নাম লিখে নিচে একটা সই করে দিলেন ।
কথাটা শুনেই আকাশের মা ডুকরে চিল্লিয়ে কেঁদে উঠলেন “ ও মা কথা বলছো না কেন ? কোথায় চলে গেলে তুমি আমাদের ছেড়ে ? আমরা কাকে নিয়ে থাকবো ? „
ডাক্তারের কথা শুনে আকাশের বাবারও কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছিল। মাথার উপর শেষ হাতটাও উঠে গেল। কিন্তু এটা চোখের জল ফেলে নিজেকে দুর্বল করার সময় নয়। এইসময় তাকেই সবাইকে সামলাতে হবে। তাই তিনি স্ত্রী কে বললেন “ শান্ত হও একটু। তুমি ভেঙে পড়লে আকাশ কি করবে ? ভাবো একটু । „
কিন্তু আকাশের মাকে তিনি থামাতে পারলেন না। স্নেহা দেবী তখনও চিল্লিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ কাঁদার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন । স্নেহা দেবীর কান্না শুনে পাশের ফ্ল্যাটের সুচি , সুচির মা আর বাবা দৌড়ে এলেন। এসেই বুঝতে পারলেন কি হয়েছে। সুচিকে তুই আকাশকে অন্য কোথাও নিয়ে যা বলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া স্নেহা দেবীকে সামলাতে গেলেন ।
সুচিকে আকাশের দায়িত্ব দিলেও হলো কিন্তু উল্টো। দিদিমার কথা শুনে সুচিও অজ্ঞান হয়ে গেল । আকাশ তখন থেকে খাটের পাশেই চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল। সুচিকে টলতে দেখে আকাশ সুচিকে ওই অজ্ঞান অবস্থায় ধরে এনে সোফায় বসানো । টেবিলে থাকা জলের বোতল থেকে জল নিয়ে সুচির চোখে ঝাপটা দিলো। সুচি চোখ খুলে কিছুক্ষণ পর দিম্মা বলে ডুকরে চিল্লিয়ে দিদিমার ঘরে যেতে গেল। কিন্তু আকাশ যেতে দিল না। সুচির হাত ধরে টেনে এনে আবার সোফায় বসিয়ে দিল “ যাসনা ওখানে দিম্মা কষ্ট পাবে। „ আকাশ এতক্ষণ চোখের জল ফেলেনি তার কারন এটাই। সে বড়ো হয়ে গেছে আর তার উপর আকাশকে কাঁদতে দেখলে দিদিমা কষ্ট পাবে। তাই কাঁদতে ইচ্ছা হলেও আকাশ মন শক্ত করে নিজেকে সামলে রেখেছে।
আকাশের কথায় সোফায় বসেই আকাশকে জড়িয়ে ধরলো সুচি। সুচির চোখ থেকে পড়ছে বড়ো বড়ো অশ্রু বিন্দু। সেই জলে আকাশের পিঠের জামা ভিজে যেতে লাগলো। এবার আকাশও নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। সুচিকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদতে শুরু করলো। তার চোখ থেকেও ঝরে পড়ছে অজস্র অশ্রুবিন্দু।
ওদিকে সুচেতা দেবীও আকাশের মার চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরালেন। আকাশের মা চোখ খুলে সুচির মাকে জড়িয়ে ধরে “ এ আমার কি হলো বলো ! মা আমায় ছেড়ে চলে গেল । „ বলতে বলতে তিনি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন ।
সুচেতা দেবী আবার চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে স্নেহা দেবীর জ্ঞান ফেরালেন। এবার জ্ঞান ফেরার পর আকাশের মা আর কাঁদলেন না। চুপচাপ দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলেন। সেই সময় আকাশের বাবা স্নেহা দেবীর সামনে গিয়ে বললেন “ স্নেহাংশুকে একবার ফোন করো। „
আকাশের মায়ের মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠলো। বড়ো বড়ো চোখ করে “ না । „ বলে উঠলেন। আকাশের বাবা ওই রাগী মুখ দেখে আর রাগী স্বরে “ না । „ শুনে আকাশের মামাকে আর ফোন করলেন না।
কিছুক্ষণ পর সুচি আর আকাশ শান্ত হয়ে দিদিমার পাশে এসে বসলো। দিদিমার পাশে বসে চুপচাপ দিদিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। দুই গালে এখনও চোখের জলের দাগ ফুটে আছে। কিছুক্ষণ দিদিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দিদিমার বুকে মাথা রেখে শুলো সুচি। দিদিমার বুকে মাথা রাখতেই কতো পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে গেল তার। সেই ছয় বছর বয়স থেকে দিম্মার ভালোবাসা আদর পেয়ে এসছে সে। সেই আদর ভালোবাসা হাসি ঠাট্টা , সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া খুলে দেওয়া থেকে বাঁচানো , সুচিকে হোস্টেলে না পাঠানোর জন্য বাবাকে মানানো সব মনে পড়তে লাগলো। একটা একটা স্মৃতি সুচির চোখে জলের বান ডেকে আনলো। দিদিমার বুকে মাথা চুপচাপ কেঁদে চললো। আর মনে মনে বললো “ আমাকে এবার আচার কে খাওয়াবে দিম্মা ? আকাশের কাছ থেকে নাড়ু বাঁচিয়ে আমার জন্য কে রেখে দিম্মা ? „
এতক্ষনে আশেপাশের সব প্রতবেশী এসে উপস্থিত হয়ে গেছিল। আর বিভিন্ন কথা বলে আকাশের বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ করে পরিবারের উপর ছেয়ে যাওয়া শোকের ছায়া সামলাতে দুপুর হয়ে গেল। আকাশের মা সেই যে মুখ বন্ধ করেছিলেন তারপর আর মুখ খোলেন নি। পড়নের শাড়ির যবুথবু অবস্থা। বিকালের দিকে যখন আকাশের বাবা , সুচির বাবা আর প্রতিবশীদের কয়েকজন দিদিমাকে দাহ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে খুব কাঁদলেন তিনি।
প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠান হয় । শনিবার আর রবিবার দুই দিন ধরে হবে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেইমতো কলেজের খেলার মাঠে বানানো হলো মঞ্চ। শনিবার হাফডে ক্লাস হওয়ার পর সবাই চলে গেল অনুষ্ঠানে। বড়ো ক্লাস মানে অষ্টম থেকে দশম শ্রেনীর ছাত্র ছাত্রীরা পিছনের দিকে বসেছে। আর বাচ্চারা সামনে। আকাশ সপ্তম শ্রেনীতে পড়ে তাই সে সামনের দিকে বসতে যাচ্ছিল। বসার আগেই আকাশ শুনলো কেউ একজন ‘ আকাশ। এই আকাশ ‚ বলে পিছন দিক থেকে ডাকছে। পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সুচি হাত নেড়ে ওকেই ডাকছে। আকাশ পিছনের সারিতে যেতে সুচি পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে বললো “ এখানে বস । „
আকাশ সুচির পাশে বসলো। আশেপাশে সব উঁচু ক্লাসের দিদি দাদারা বসে আছে। তাদের মাঝে একা আকাশ। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো হেডমাস্টার জগদীশ ঘোষের উদ্বোধন বক্তৃতা। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই সবার মাথা যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেল । আকাশ সুচির মুখের দিকে তাকালো। দুজনেরই একই অবস্থা।
দশ মিনিটে সবাই চেয়ারে বসেই নড়েচড়ে উঠতে লাগলো। কুড়ি মিনিট অতিক্রম করতেই সবার মনে হলো দুই ঘন্টা ধরে স্যার বলছেন। আর সেইসাথে সবার চোখে ঘুম চলে এলো । নিদ্রা দেবী যেন পৃথিবীর সব নিদ্রা এই কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের চোখে দিয়ে দিয়েছেন।
কলেজের ছাত্রছাত্রী শুধু নয় সাথে স্যার ম্যামদের মুখেও বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। আকাশ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কয়েকজন ঘুমিয়ে পড়েছে। আর সুচি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো উপর ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র আসতে আসতে কেটে পড়ছে। সেটা দেখে সুচি আকাশের কাঁধে ঠেলা দিয়ে বললো “ চল কেটে পড়ি। „
আকাশ ঘুমিয়ে পড়ার আগের অবস্থায় পৌঁছে গেছিল। সুচির ধাক্কায় আকাশের ঘোর কেটে গেল “ তোর নাচ আছে না ! „
“ আমার নাচ কালকে আছে । এখন চল । „
“ হ্যাঁ চল। „ আকাশ বললো “ একবার যদি ঘুমাই তাহলে কয় বছর ঘুম ভাঙবে জানিনা । „
সুচি আকাশের কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো। তারপর দুজনেই কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাটা দিল। রাস্তায় আসতে আসতে আকাশ বললো “ যদি জেঠিমা জিজ্ঞাসা করে তাহলে কি বলবি ? „
“ বলবো আজকে তো কিছু হবে না। স্যার ম্যাম শুধু বক্তৃতা দেবে আর বাচ্চারা আবৃত্তি করবে, তাই চলে এসছি। কাকি জিজ্ঞাসা করলে তুইও এটাই বলবি। „
কিছুক্ষণ পর আকাশ বললো “ সবাই তো কলেজে ! এখন বাড়ি গিয়ে কি করবো ? „
সুচি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো “ সিনেমা দেখতে যাবি ?
“ সিনেমা ! „ অনেক দিন হলো আকাশ সিনেমা হলে যাইনি। তাই সিনেমা দেখতে যাবে শুনেই চোখটা খুশিতে বড়ো হয়ে উঠলো।
“ হ্যাঁ। শোন। তুই বাড়ি গিয়ে ব্যাগটা রেখে একটা জামা গায় চাপিয়ে চলে আসবি। „
“ আর টাকা ? „
“ দিদিমার কাছ থেকে নিবি । „
সুচির কথা মতো চুপিচুপি নিজের ঘরে ঢুকে জামা পাল্টে দিদিমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিল। টাকা নেওয়ার সময় দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন “ কি করবি এতো টাকা ? „
“ সিনেমা দেখতে যাবো। „ দিদিমাকে সত্য বললে কোন ভয় নেই। তাই সে সত্যিটাই বলে দিল।
“ সিনেমা ? কার সাথে দেখতে যাবি ? „
“ সুচির সাথে । „
সুচির নাম শুনে দিদিমা টাকা দিয়ে দিলেন। সিনেমা দেখে সুচি আর আকাশ যখন ফিরলো তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসছে। তাই কেউ বুঝতে পারলো না এরা কোথায় গেছিল।
পরের দিন কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সুচি নাচলো। হাততালির ঝড় উঠলো দর্শকদের মধ্যে । দর্শকদের মধ্যে দুজন ছেলে দাড়িয়ে সুচির নাচ দেখছিল। দুজনের বয়স সতেরো আঠারো হবে। ওই দুজনের মধ্যে একজন পাশেরজনের উদ্দেশ্যে বললো “ খুব ভালো নাচে। আমাদের ওখানেই শেখে। „
পাশেরজন বললো “ খুব সুন্দর দেখতে । একদম নায়িকাদের মতো ফিগার । „
সেদিন রাতেই আকাশের মামি ফোন করলো । এই দুই তিন বছর হলো আকাশের মামি তিলোত্তমা নিয়মিত ফোন করে খোঁজখবর নেয়। আকাশের মামা তেমন একটা ফোন করেন না। কাজে খুব ব্যাস্ত। তিলোত্তমা যে প্রেগন্যান্ট এটা দিদিমা জানতেন। এবং সুখবরের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। আজকে আকাশের মামি ফোন করে বললো “ ছেলে হয়েছে । অজয় নাম রেখেছি। „
কথাটা শুনে দিদিমার চোখে জল চলে এলো “ বা্ঃ খুব সুন্দর নাম। বলছি , এখানে আয় না তোরা একদিন । „
“ আমি তো বারবার বলি ‘ চলো না ওখানে । কতদিন দেখিনি সবাইকে । সেই বিয়ের সময় দেখেছিলাম। ‚ ও বলে ‘ কাজে খুব ব্যাস্ত। একটু খালি হলেই যাবো। ‚ নাও ওর সাথেই কথা বলো। „ বলে আকাশের মামার কাছে ফোনটা দিয়ে দিলো তিলোত্তমা ।
“ হ্যালো । „
“ হ্যালো। এখানে আয় না তোরা। তোদের খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। „ কথাটায় কতোটা আবেগ ভালোবাসা মিশে ছিল সেটা ফোনের ও প্রান্তে থাকা আকাশের মামা বুঝতে পারলো না।
“ আচ্ছা ঠিক আছে। এবার পূজার সময় যাবো। এখন রাখছি । „ বলে ফোনটা কেটে দিল । কিছুক্ষণ পর আকাশের বাবার স্ক্রিনটাচ ফোনে আকাশের মামা বেবির একটা ফটো পাঠিয়ে দিল। ফটোটা দেখে দিদিমার চোখে জল আর মুখে হাসি দেখা দিল “ একদম স্নেহুর মতো হয়েছে । „
দুই দিন পর বিকালে ভাত ঘুম থেকে উঠে দিদিমা ছাদে এলেন। এখন আর আগের মতো তিনটে সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে হাওয়া খাওয়া যায় না। তার জায়গায় একটা সিড়ি ভেঙে উপরে ছাদে এসেই হাওয়া খান দিদিমা। বুড়ো বয়সে যা সমস্যা হয় তাই আর কি। বাতের সমস্যা তো আছেই। সুগারটাও ওঠানামা করছে। ডাক্তার হাঁটতে বলেছেন। কিন্তু হাঁটতে গেলেই তো বাতের ব্যাথা চাগান দেয়।
ছাদে এসে দিদিমা দেখলেন ছাদের রেলিং ধরে , পিঠে লম্বা চুল ছড়িয়ে সুচি দাঁড়িয়ে আছে। সুচির চুল আর একটু হলে কোমর স্পর্শ করবে। দিদিমা সুচির চুল দেখতে দেখতে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সুচিকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি দেখলেন যে সুচি তার অস্তিত্ব এখনও খেয়ালই করেনি। সুচি একমনে নিচে মাঠে তাকিয়ে আছে। দিদিমা দেখলেন সোসাইটির মাঠে বারো তেরো বছরের ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে , সুচি একমনে তাদের খেলাই দেখছে । আর সুচি তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশ এখন ফিল্ডিং করছে।
তিনি আর কিছু বললেন না। চুপচাপ সুচিকে দেখতে লাগলেন। তিনি দেখলেন সুচির মুখের হাবভাব খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
দিদিমা এবার আরও ভালো করে খেয়াল করলেন। খেলার মাঠে যে ব্যাট করছে সে একটা শট মারলো । বলটা একবার ড্রপ খেয়ে সোজা আকাশের হাতের তালুতে এসে বন্দী হলো। আর সেই সাথে সুচির ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক মিষ্টি আনন্দের রেখা। সুচি হাসছে। সুচির হাসি দেখে দিদিমার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।
পরের বলটা আকাশের দশ হাত দুর থেকে বাউন্ডারির দিকে চলে যাচ্ছিল । আকাশ কিছুটা দৌড়ে ঝাপিয়ে পড়লো বলটা উপর। কিন্তু ততক্ষণে বলটা বাউন্ডারি ক্রশ করে ব্যাটসম্যান কে চার রান দিয়ে দিল। আর দিদিমা দেখলেন সুচির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সুচির ভুরু আর নাক কুচকে গেল। মুখে চরম বিরক্তি ফুটে উঠেছে । পরের দুটো বল ব্যাটসম্যান অন্য ফিল্ডারদের কাছে পাঠালো। একটাতে সে দৌড়ে দুই রান নিল আর একটাতে সে চার রান করলো। কিন্তু সুচির মুখে কিছুই ফুটে উঠলো না।
ওভারের আর একটাই বল বাকি। এই ব্যাটসম্যান অনেক রান করেছে। আটকাতে হবে। বলার একটা ফুলটস বল দিল। ব্যাটসম্যান দুই পা এগিয়ে এসে একটা ছয় হাকালো। কিন্তু একি ! বল বাউন্ডারির বাইরে না গিয়ে অনন্ত আকাশে উঠে গেল । আর আমাদের বারো বছরের ক্লাস সেভেনের আকাশ দুই হাতের তালু দিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসা বলটাকে তালুবন্দী করে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে মাঠে সবাই আকাশকে ঘিরে ধরলো। আর এদিকে সুচি খুশিতে জোড়ে yes বলে চিল্লিয়ে উঠলো। আর সেই সাথে সুচি খেয়াল করলো তার পাশে দিদিমা দাঁড়িয়ে আছে “ তুমি কখন এলে ? „
“ আমি এইতো এলাম। „ তারপর পুরো মুখে হাসি আর দুষ্টুমি ছড়িয়ে দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন “ খেলা দেখছিস ? „
“ হ্যাঁ । „
“ নাড়ু খাবি ? „
“ নাড়ু ! „ নাড়ুর কথা শুনে সুচির চোখ বড়ো হয়ে গেল। দিদিমার হাতের নাড়ু , আচার , এমনকি বিভিন্ন পার্বনে বানানো মিষ্টি আর হরেকরকমের পিঠের সে একনিষ্ঠ খাদক। খুব তৃপ্তি করে খায় দিদিমার হাতে বানানো খাবার।
“ চল। „ সুচির এই খুশি দেখে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যায় দিদিমার।
তারপর দুজনেই নিচে নেমে গেল। দিদিমা ঘরে গিয়ে নাড়ুর কৌটো বার করলেন । আকাশের চোখ বাঁচিয়ে সুচির জন্য লুকিয়ে নাড়ু রেখে দিতে হয়। না হলে আকাশ সব খেয়ে নেয়। নাড়ুর কৌটো খুলতে খুলতে দিদিমা বললেন “ একটা কথা বলবো। রাখবি ? „
“ কি কথা ? „
“ আগে বল রাখবি । „
“ অবশ্যই রাখবো। কি কথা ? সেটা তো বলো ! „
“ তুই আমার দাদুভাইয়ের খেয়াল রাখবি। কথা দে ওকে আগলে রাখবি সবসময় । রাখবি তো ! „ কথাটা বলতে বলতে দিদিমার চোখ জ্বলে উঠলো যেন।
দিম্মার চোখ সুচির একটাই কথা মনে হলো ‘ এই চোখ শুধুমাত্র হ্যাঁ শুনতে চাইছে। চোখ আবার শোনে নাকি ! চোখ দিয়ে তো দেখে। কিন্তু এই চোখ জানতে চাইছে। শুধুমাত্র হ্যাঁ শুনতে চাইছে ‚ । দিম্মার ওই চোখ দেখে সুচি “ হ্যাঁ রাখবো । „ বলে দিল
“ এই নে । „ বলে কৌটোর ভিতরে পরে থাকা শেষ চারটে নারকেল নাড়ু সুচিকে দিয়ে দিলেন “ তোর চুল এরকম কেন ? আজ চিরুনি করিস নি ? „
“ কলেজ থেকে ফিরে আর আজ ইচ্ছা হয়নি । „
“ চল আমি করে দিচ্ছি। „
“ দাড়াও । „ বলে সুচি নিজের ঘর থেকে একটা তেল আনলো। তারপর দিদিমা আর সুচি একটা বিছানা নিয়ে উপরে উঠে গেলেন । দিনে একবার ছাদে ওঠাই কষ্টের। আজকে দুইবার উঠে একটু বেশি ব্যাথা পেলেন হাটুতে।
ছাদে বিছানা পেতে সুচি বসলো তার লম্বা চুল পিঠে ছড়িয়ে । দিদিমা সুচির পিছনে বসে দুই হাতের তালুতে তেল নিয়ে সুচির চুলে মাখাতে মাখাতে বললেন “ সামনে তোর মাধ্যমিক না ! „
“ হ্যাঁ । পরের বছর ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মাধ্যমিক শুরু হবে । „
“ মন দিয়ে পড়বি। আর দুষ্টুমি করিস না। „
“ সেদিনের পর তো করিনি। „
“ শনিবার কলেজ কামাই করে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলি। „ সুচিকে চুপ করে থাকতে দেখে দিদিমা আরও বললেন “ সিনেমা দেখার সময় অনেক পাবি। বড়ো হয়েছিস আর আকাশও বড়ো হচ্ছে । ওর খেয়াল রাখ। রাখবি তো ! „
এতক্ষণ ধরে মনে জেগে ওঠা ভয়টা এবার যেন বেড়ে গেল। দিদিমার কথা শুনে সুচির মনে হচ্ছিল যেন দিদিমা কোথাও চলে যাবে “ তুমি এমন ভাবে বলছো কেন ? .....
দিদিমা সুচির কথার মানে স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। তাই সুচিকে আর বেশি কিছু বলতে না দিয়ে তিনি বললেন “ আকাশ তো এখন বেশিরভাগ সময় তোর সাথেই থাকে। বাড়িতে আর কোথায় থাকে ! তুই বড়ো। তাই তাকে দায়িত্ব নিতে ওর খেয়াল রাখার। „
“ ও যা বদমাশ হয়েছে দেখলেই তো মারতে ইচ্ছা করে । „ দিদিমার কথায় সুচির মনটা শান্ত হলো।
“ ওই একটু আধটু শাসন করবি আর আগলে রাখবি। „ বলে সুচির গালে একটা চুমু খেলেন ।
“ তুমি আমাকেই সবসময় চুমু খাও কেন বলোতো ? „
এতক্ষণ চুলে তেল লাগানোর পর এবার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিতে দিতে দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন “ এমা ! তাহলে কাকে আদর করবো ? „
“ কেন ! তোমার মেয়ে । আকাশের মা । „
“ বোকা মেয়ে একটা। স্নেহার কি আর আমার আদর খাওয়ার বয়স আছে ! ওর তো এখন....... বাকি কথা বলতে গিয়ে দিদিমা খুব লজ্জা পেলেন। লজ্জার কারনে আর কথাটা মুখ দিয়ে বার হলো না।
আসলে দিদিমা বলতে যাচ্ছিলেন ‘ ওর তো এখন আকাশের বাবার আদর খাওয়ার বয়স।‚ এই কথাটা মাথাতে আসতেই লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠলো ‘ ইসসসস কি ভাবছি আমি এইসব। ‚
পরের শনিবার সুচি যখন নাচ শিখতে নাচের ক্লাসে গেল তখন সেইদিন বার্ষিক অনুষ্ঠানের ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো “ হায়। „
“ হায়। „
“ আমার নাম রাজ। আমি এখানে নতুন এসছি। রবিবার তোমার নাচ দেখলাম। খুব সুন্দর নাচো তুমি । „
“ Thanks. আমার নাম সুচিত্রা। ওই একটু আধটু পারি । „
“ কি বলছো তুমি ! একটু আধটু না খুব ভালো নাচো । তুমি যদি ভালো ভাবে মডার্ন ডান্স শিখতে পারো তাহলে খুব উঁচু জায়গায় পৌছে যাবে.....
তারপর দুজনে একসাথে নাচ শিখে বাড়ি চলে এলো। খুব শীঘ্রই সুচি আর রাজ খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠলো। তারপর আকাশের সাথে কলেজ যাওয়া , টিউশন করা , পড়াশোনা করা আর ওই নাচের ক্লাসের মধ্যে দিয়ে সময় কখন কেটে গেল কেউ বুঝতেই পারলো না। এবছর পূজার সময় পঞ্চমীর দিন রাতে দিদিমা তিলোত্তমা কে ফোন করলেন “ কেমন আছো তোমরা ? „
“ আমরা ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো ? „
“ আমি ভালো আছি। স্নেহু আছে ? „
“ ও তো নেই। ব্যাবসার জন্য দিল্লিতে গেছে। দুই সপ্তাহ পর আসবে। „
দিদিমা চোখের জল মুছে বললেন “ অজয় কেমন আছে ? „
“ ও খুব ভালো আছে। খুব দুষ্টু হয়েছে জানো .....
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে দিদিমা ফোনটা রেখে দিলেন। এবার পুজার সময় আকাশের মামা আসবে বলেছিল। সেই আশায় এতগুলো দিন কাটিয়েছেন দিদিমা। তিলোত্তমার কথা শুনে দিদিমা বুঝলেন আকাশের মামা এখানে আসার কথা ভুলে গেছে। দিদিমা নিরবে কিছুক্ষণ চোখের জল ফেললেন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে স্নেহা দেবী মায়ের কথা শুনছিলেন। মায়ের কান্না দেখে স্নেহা দেবীর চোখেও জল চলে এলো। আকাশের মা যে তাকে দেখে কাঁদছে সেটা দিদিমা জানতে পারলেন না।
অষ্টমীর দিন সুচি রাজকে তাদের সোসাইটি তে ডেকেছিল নাচ দেখার জন্য। সুচির নাচ দেখার পর রাজ খুব প্রশংসা করলো। দিদিমা নিচে নামতেই পারলেন না। খুব ইচ্ছা ছিল সুচির নাচ দেখার। সেটাও পূর্ণ্য হলো না।
পুজা শুরু হলে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া চলে আসে। বিজয়া দশমীর দুই দিন পর রাতে একটা চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমাতে খুব আরাম হচ্ছিল আকাশের। ভোর বেলার দিকে আকাশের ঘুম ভেঙে গেল দিদিমার কাশিতে। আকাশ উঠে দিদিমাকে জল দিল। দিদিমা উঠে বসে জল খেয়ে আকাশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
আকাশ ঘুম থেকে উঠে দেখলো দিদিমা ঘুমাচ্ছে। সে চুপচাপ উঠে চলে গেল। আধ ঘন্টা পর ব্রাশ করে এসে দেখলো তখনও দিদিমা ঘুমাচ্ছে। আকাশের বুকটা কেমন একটা করে উঠলো। সে মাকে ডেকে আনলো। স্নেহা দেবী এসে দিদিমার মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন ‘ না জ্বর নেই। ‚ তারপর জিজ্ঞাসা করলেন “ তোমার অসুবিধা হচ্ছে? ডাক্তার ডাকবো। „
দিদিমা চোখের পাতা হাল্কা খুলে মাথাটা দুই দিকে নাড়ালেন । মা বারন করলেও স্নেহা দেবী ফোন করে ডাক্তার ডাকলেন। আধঘণ্টা পর ডাক্তার এলো। এই পুরো সময় আকাশের মাথায় দিদিমা হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তখন স্নেহা দেবী এসে বললেন “ মাকে আর জ্বালাতন করিস না। পড়তে বস গিয়ে । „ মায়ের কথায় আকাশ বইপত্র নিয়ে সোফায় চলে গেল।
ডাক্তার আসলে আকাশ , আকাশের মা বাবা সবাই ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। ডাক্তার দিদিমার পাশে খাটে বসে দিদিমার নাড়ি দেখে দুই দিকে মাথা নেড়ে একটা বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে বললেন “ বেঁচে নেই । „
খবরটা শুনেই আকাশের মায়ের মাথা কাজ করা বন্ধ করেদিল । বুকটা ধড়াস করে উঠলো সবার । গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে এলো আকাশের মার “ এইতো আকাশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল । „
“ এই পাঁচ সাত মিনিট আগেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন । „ কথাটা বলে ডাক্তার তার ব্রিফকেস থেকে একটা ডেথ সার্টিফিকেট বার করে তাতে দিদিমার নাম লিখে নিচে একটা সই করে দিলেন ।
কথাটা শুনেই আকাশের মা ডুকরে চিল্লিয়ে কেঁদে উঠলেন “ ও মা কথা বলছো না কেন ? কোথায় চলে গেলে তুমি আমাদের ছেড়ে ? আমরা কাকে নিয়ে থাকবো ? „
ডাক্তারের কথা শুনে আকাশের বাবারও কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছিল। মাথার উপর শেষ হাতটাও উঠে গেল। কিন্তু এটা চোখের জল ফেলে নিজেকে দুর্বল করার সময় নয়। এইসময় তাকেই সবাইকে সামলাতে হবে। তাই তিনি স্ত্রী কে বললেন “ শান্ত হও একটু। তুমি ভেঙে পড়লে আকাশ কি করবে ? ভাবো একটু । „
কিন্তু আকাশের মাকে তিনি থামাতে পারলেন না। স্নেহা দেবী তখনও চিল্লিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ কাঁদার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন । স্নেহা দেবীর কান্না শুনে পাশের ফ্ল্যাটের সুচি , সুচির মা আর বাবা দৌড়ে এলেন। এসেই বুঝতে পারলেন কি হয়েছে। সুচিকে তুই আকাশকে অন্য কোথাও নিয়ে যা বলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া স্নেহা দেবীকে সামলাতে গেলেন ।
সুচিকে আকাশের দায়িত্ব দিলেও হলো কিন্তু উল্টো। দিদিমার কথা শুনে সুচিও অজ্ঞান হয়ে গেল । আকাশ তখন থেকে খাটের পাশেই চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল। সুচিকে টলতে দেখে আকাশ সুচিকে ওই অজ্ঞান অবস্থায় ধরে এনে সোফায় বসানো । টেবিলে থাকা জলের বোতল থেকে জল নিয়ে সুচির চোখে ঝাপটা দিলো। সুচি চোখ খুলে কিছুক্ষণ পর দিম্মা বলে ডুকরে চিল্লিয়ে দিদিমার ঘরে যেতে গেল। কিন্তু আকাশ যেতে দিল না। সুচির হাত ধরে টেনে এনে আবার সোফায় বসিয়ে দিল “ যাসনা ওখানে দিম্মা কষ্ট পাবে। „ আকাশ এতক্ষণ চোখের জল ফেলেনি তার কারন এটাই। সে বড়ো হয়ে গেছে আর তার উপর আকাশকে কাঁদতে দেখলে দিদিমা কষ্ট পাবে। তাই কাঁদতে ইচ্ছা হলেও আকাশ মন শক্ত করে নিজেকে সামলে রেখেছে।
আকাশের কথায় সোফায় বসেই আকাশকে জড়িয়ে ধরলো সুচি। সুচির চোখ থেকে পড়ছে বড়ো বড়ো অশ্রু বিন্দু। সেই জলে আকাশের পিঠের জামা ভিজে যেতে লাগলো। এবার আকাশও নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। সুচিকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদতে শুরু করলো। তার চোখ থেকেও ঝরে পড়ছে অজস্র অশ্রুবিন্দু।
ওদিকে সুচেতা দেবীও আকাশের মার চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরালেন। আকাশের মা চোখ খুলে সুচির মাকে জড়িয়ে ধরে “ এ আমার কি হলো বলো ! মা আমায় ছেড়ে চলে গেল । „ বলতে বলতে তিনি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন ।
সুচেতা দেবী আবার চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে স্নেহা দেবীর জ্ঞান ফেরালেন। এবার জ্ঞান ফেরার পর আকাশের মা আর কাঁদলেন না। চুপচাপ দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলেন। সেই সময় আকাশের বাবা স্নেহা দেবীর সামনে গিয়ে বললেন “ স্নেহাংশুকে একবার ফোন করো। „
আকাশের মায়ের মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠলো। বড়ো বড়ো চোখ করে “ না । „ বলে উঠলেন। আকাশের বাবা ওই রাগী মুখ দেখে আর রাগী স্বরে “ না । „ শুনে আকাশের মামাকে আর ফোন করলেন না।
কিছুক্ষণ পর সুচি আর আকাশ শান্ত হয়ে দিদিমার পাশে এসে বসলো। দিদিমার পাশে বসে চুপচাপ দিদিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। দুই গালে এখনও চোখের জলের দাগ ফুটে আছে। কিছুক্ষণ দিদিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দিদিমার বুকে মাথা রেখে শুলো সুচি। দিদিমার বুকে মাথা রাখতেই কতো পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে গেল তার। সেই ছয় বছর বয়স থেকে দিম্মার ভালোবাসা আদর পেয়ে এসছে সে। সেই আদর ভালোবাসা হাসি ঠাট্টা , সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া খুলে দেওয়া থেকে বাঁচানো , সুচিকে হোস্টেলে না পাঠানোর জন্য বাবাকে মানানো সব মনে পড়তে লাগলো। একটা একটা স্মৃতি সুচির চোখে জলের বান ডেকে আনলো। দিদিমার বুকে মাথা চুপচাপ কেঁদে চললো। আর মনে মনে বললো “ আমাকে এবার আচার কে খাওয়াবে দিম্মা ? আকাশের কাছ থেকে নাড়ু বাঁচিয়ে আমার জন্য কে রেখে দিম্মা ? „
এতক্ষনে আশেপাশের সব প্রতবেশী এসে উপস্থিত হয়ে গেছিল। আর বিভিন্ন কথা বলে আকাশের বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ করে পরিবারের উপর ছেয়ে যাওয়া শোকের ছায়া সামলাতে দুপুর হয়ে গেল। আকাশের মা সেই যে মুখ বন্ধ করেছিলেন তারপর আর মুখ খোলেন নি। পড়নের শাড়ির যবুথবু অবস্থা। বিকালের দিকে যখন আকাশের বাবা , সুচির বাবা আর প্রতিবশীদের কয়েকজন দিদিমাকে দাহ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে খুব কাঁদলেন তিনি।