25-09-2021, 10:12 AM
#গল্প
ভালোবাসার জয়
✍️সুস্মিতা রায় চৌধুরী
তিতির ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিল
সৌরভকে। সৌরভও বিনা বাক্য ব্যয়ে সই করে পাঠিয়ে দিয়েছিল প্রায় কিছুদিন হল।এবার বোধহয় হিয়ারিং এর ডেট পড়বে।
আসলে বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার এক বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম কলেজের ছাত্রী, ধনী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, তিতির প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা পিতৃ-মাতৃহীন নেহাৎই সাধারন একটি ছেলে সৌরভের।
একই কলেজে পড়তো দুজনে। সৌরভের বাংলায় অনার্স আর তিতিরের ইংলিশে। কলেজের নবীন বরণ উৎসবে সৌরভের কবিতা পাঠ শুনে মুগ্ধ হয়েছিল তিতির।নিজেই গিয়ে পরিচয় করেছিল সৌরভের সাথে।
সৌরভ প্রথম প্রথম দূরে থাকার চেষ্টা করলেও তিতিরের মত এমন নিরহংকারী ভালো মনের মেয়ের ভালোবাসা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারল না। আসলে ভালোবাসা তো করো অনুমতি নিয়ে আসে না আবার ভালোবাসা তুমি চলে যাও বললেই ভালোবাসা টা টা বাই বাই করে চলেও যায় না। তাই প্রেম অনুরাগের সীমানা ছাড়িয়ে, বসন্তের আবেশে, ভরিয়ে দিলো তাদের জীবন। সেই আবেকেই সঙ্গে নিয়ে, কেটে গেল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির কয়েকটা বছর।
পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ হবার কিছুদিনের মধ্যেই সৌরভ একটা কলেজে চাকরি পেয়ে গেল। তিতির অবশ্য তখনো চাকরি পায় নি। কারন কলেজের চাকরি তিতিরের পছন্দ ছিল না।
কিন্তু এবার ঘটলো ছন্দপতন। বসন্তের আবেশ সরিয়ে, তিতির চোখে বর্ষা নিয়ে, সৌরভের কাছে এসে বলল
"একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে। বাবা তার এক বন্ধুর ছেলে, সেও হাইকোর্টের উকিল, ধনী পরিবার, উচ্চ বংশ, তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। সামনের এক বা দুই মাসের মধ্যেই তারা আমার বিয়ে দিতে চান।"
আসলে তিতিরের বাবা মনতোষ রায়ও হাইকোর্টের একজন নামকরা উকিল।
আমি অবশ্য বলে দিয়েছি "যে আমি এই বিয়ে করতে পারবো না,আমি শুধু তোকে ভালোবাসি।"
"তা শুনে ওনারা কি বললেন?"
"ওনারা বদ্ধপরিকর এই সম্পর্ক কখনো মানবেন না।সমাজে ওদের একটা মান সম্মান আছে।সামান্য একজন বাংলা কলেজ টিচারের সাথে তারা কোনমতেই তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চান না।"
"সেটাই তো স্বাভাবিক তিতির। পুরুষের আর্থিক সামর্থ্য বিয়ের জন্য বড় কথা। তুই ওনাদের একটু বুঝিয়ে বল যদি আমাকে একটু সময় দেন তাহলে আমি একটু গুছিয়ে নিতে পারি।"
"যদি ওনারা তোকে না মানেন? আমি তোকে খুব ভালোবাসি সৌরভ,তোকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।আসলে পরিবার সব সময় চায় প্রেমটা যেন নিজ বৃত্তে, নিজ ধর্মে, সমবিত্ত সম্পন্ন কোন ছেলের সাথেই হয়।কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব বল?লাভ ইজ নট এ ট্যালেন্ট হান্ট,তাই না?
"তুই তো ওনাদেরকেও খুব ভালবাসিস তিতির।ওনারা তোকে কষ্ট করে মানুষ করেছেন। সম্পর্কের এ এক বড় টানাপোড়েন।"
"কষ্ট করে মানুষ করেছেন বলে আমার ভালোবাসাটা বুঝবেন না? সবকিছু কি সবসময় সমানে সমানে হয়?"
"তাও ওনাদেরতো বোঝানোর চেষ্টাটা আমাদের করতেই হবে।তেমন হলে না হয় আমি গিয়ে তোর বাবার সাথে দেখা করব। ওনাকে অনুরোধ করবো।"
"ঠিক আছে তুই না হয় একবার চেষ্টা করে দেখ।।"
এরপর একদিন সৌরভ গেল তিতিরের বাবার কাছে।অনুরোধ করলো তাকে একটু সময় দেওয়ার জন্য।উনি রাজি হলেন না। উল্টে বললেন "তুমি কি ভালোবাসার জন্য আমার সাথে যুদ্ধে নামতে চাও?"সৌরভ বলল "ভালোবাসা তো কখনো যুদ্ধ চায় না স্যার,ভালোবাসা তো ভালোবাসতেই চায়। এই আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ভালোবাসাকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছে যুগ যুগ ধরে।"
"বৈষম্য তো থাকবেই।সেটাই তো স্বাভাবিক।আমি এমন চালচুলোহীন, পিতৃ-মাতৃহীন ছেলের হাতে মেয়েকে দিতে পারব না।"
এবার সৌরভ হেসে বলল
"মেয়েকে দেবেন কি স্যার? তিতিরকি একটা বস্তু নাকি?ও একজন যথেষ্ট শিক্ষিত মানুষ। আর বিয়ে তো একজন মানুষের সাথে মানুষেরই হয়।"
"আসলে তো এই ভালবাসার অন্তরালে আছে অর্থের লোভ,হাই সোসাইটিতে ওঠার চেষ্টা।আত্নসম্মানে আঘাত লেগেছিল সেদিন সৌরভের গভীর প্রত্যয়ে বলেছিল
"ক্ষমা করবেন স্যার।আমরা একে অপরকে ভালোবেসেছি,আমরা ভালো থাকবো, একে অপরকে ভালো রাখবো।"
এরপর কয়েকজন বন্ধুর উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রি এবং মালাবদল করে ওদের বিয়ে হয়।শহরতলীতে একটা ছোট দু কামরার ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু হয় তাদের ভালোবাসার লাল নীল সংসার।সুখেই চলছিল তাদের যৌথযাপন।সৌরভ চেষ্টা করছিল একটু সঞ্চয় করে এবং ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটা ছোট ফ্ল্যাট কেনার।
একটু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য সৌরভ একটা দুটো প্রাইভেট টিউশনি নিলো। কোন কোন দিন হাঁটতে হাঁটতে ফিরে অটোর ভাড়া বাঁচাতো। কিন্তু ফিরে এসেই তিতিরের ওই সদাহাস্যময়ী মুখটা দেখে সৌরভের সব ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যেত।ভালোবাসা বোধ হয় এক সঞ্জীবনী সুধা কষ্টেও প্রাণ জুড়িয়ে দেয়।তিতির কোনদিনই রন্ধন পটীয়সী ছিল না।তাই প্রধান রান্নার দায়িত্বটা ছিল সৌরভেরই ওপর। সৌরভ বলতো কলমের, চাকরির পরীক্ষার যদি কোন লিঙ্গ না হয় তাহলে খুন্তিরই বা কেন হবে?
এরপর তিতির একটা এডভার্টাইজিং এজেন্সিতে চাকরি পায়। তিতিরের চাকরি পাওয়ার খবর শুনে তিতিরের বাবা-মা হাজির হন তার সাথে দেখা করতে। তিতিরও অনেকদিন পর বাবা মাকে পেয়ে খুব খুশি। তবে তিতিরকে এমন একটা ছোট ভাড়া বাড়িতে থাকতে দেখে তাদের বেশ কষ্ট হয়।
এরপর মনোতোষ বাবু একদিন এসে তাদেরকে বলেন"এত কষ্ট করে তোমাদের এখানে থাকার দরকার নেই।আমাদের তো একটা ফ্ল্যাট ভবানীপুরে কেনা আছে তোমরা বরং দুজনে সেখানে গিয়ে
শুনে তিতিরের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আনন্দে সে সৌরভের সাথে কোন আলোচনা না করেই তার বাবার কথায় সম্মত হয়ে যায়।
"কিন্তু এবার সকলকে অবাক করে দিয়ে সৌরভ বলে
"মাপ করবেন,আমরা এখনই আপনার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে পারব না। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আমরা নিজেরাই একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনতে পারব। তেমন হলে না হয় তিতির না হয় আপনাদের বাড়িতে গিয়ে, আপনাদের সঙ্গে দেখা করে আসবে।"
এবার মনোতোষবাবু বললেন "তার মানে তুমি আমাদের ওই ফ্ল্যাটে থাকবে না?"
"না, কখনোই না।"
কথাটা বলেই সৌরভ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এবার মনোতোষবাবুও বেশ মনোক্ষুন্ন হয়েই চলে গেলেন। তিতিরের খুব খারাপ লাগলো এই ঘটনায়। এরপর থেকেই সৌরভ আর তিতিরের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব বাড়তে থাকলো।
এরপর তিতির একদিন সৌরভ কে বলল "আমার বাবা-মা, আমাদের বিয়েটাকে মেনে নেয় নি বলে, তুই কি আমার বাবা-মায়ের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিস? কিন্তু ভালোবেসে বিয়ে করেছি বলে, আমারও যে ইচ্ছে অনিচ্ছার দাম থাকবে না এমনটা তো নয়? আমার ইচ্ছেটাকে, তোরও সম্মান করা উচিত।" আসলে সৌরভ বিয়ের আগে তার বাবার বলা কথাগুলো তিতিরকে কখনো জানায়নি তাই বলল
"ঠিক আছে তোর যদি আমার সিদ্ধান্তটাকে ভুল মনে হয়, তাহলে তুই সচ্ছন্দে তোর বাবা-মার কাছে গিয়ে থাকতে পারিস। আমি কোন ভাবেই, নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেব না।"
এরপর ধীরে ধীরে সম্পর্কের মধ্যে এল
তিক্ততা। একদিন তিতির রাগ করে সত্যিই ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেল নিজের বাবা-মায়ের কাছে। সৌরভ তিতিরকে একবারো আটকালো না, বোঝানোর নূন্যতম চেষ্টাও করলো না।"
খুব কষ্ট হল তিতিরের। তবে তিতিরের বাবা-মা বোধহয় এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তারা তিতিরকে বোঝালেন
এখনো খুব বেশি দেরি হয়নি। তুমি ভালো চাকরি করছো। সৌরভকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নাও।
বড় বিষন্ন তিতির। সৌরভ তার অভিমানের ভাষাটা বুঝলো না।ভালোবাসা কি এমন ভাবেই ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে দেয়, হৃদয় ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। রাগ করে তিতির ডিভোর্সের পেপারগুলো, পাঠিয়ে দেয় এই ভেবে, যে এবার নিশ্চয়ই সৌরভ তার কাছে আসবে। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইবে।
কিন্তু এসবের কোন কিছুই হলো না। সৌরভ সই করে দিলো ডিভোর্স পেপারে। আসা তো দূরের কথা একবার ফোন বা মেসেজ কিছুই করলো না।
অভিমানী মেঘে ঢেকে গেল তিতিরের, মনের ঘর। এত নিষ্ঠুর সৌরভ?
এরপর তিতির নিজেই ফোন করে সৌরভ কে বলল "সামনের রবিবার আমি যাব। আমার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসবো।"
সৌরভ বলল "ঠিক আছে আসিস,নিয়ে যাস। রবিবার বেলার দিকে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে তিতির এল সৌরভের কাছে। এতদিন পর সৌরভকে দেখে অনেক কষ্টে নিজের চোখের জলকে, সংবরণ করে বলল
"তুই খুব খুশি তাই না রে? কি সুন্দর ডিভোর্স পেপারে সই করে দিলি।"
"তোকে তো অদেও আমার কিছুই নেই।শুধু আত্মসম্মানটুকু বিসর্জন দিতে পারি নি।"
"আর আমাকে খুব সহজেই বিসর্জন দিয়ে দেওয়া যায়।"
"ভালোবাসার বিসর্জন হয় না, ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটে না।"
এবার তিতির হঠাৎ বলল "কি রান্না করছিস রে তুই,আমার খুব খিদে পেয়েছে?"
সৌরভ বলল "ভাত আর ডিমের ঝোল।তবে ডিম কিন্তু একটাই আছে।"
"ঠিক আছে তুই ডিমটা খাস।আমি শুধু আলু ঝোল দিয়েই খেয়ে নেব।"
কিন্তু খেয়ে যেতে গেলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোর বাড়িতে হয়তো সবাই চিন্তা করবে।
"তাড়িয়ে দিচ্ছিস আমাকে? জানিস আমি কতদিন ভালো করে খাইনি, ঘুমোইনি।"এবার সৌরভ তিতিরের খুব কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল
কেন খাস নি,ঘুমাস নি তুই তো ভাল থাকবি বলেই গিয়েছিলি?
"তুই বুঝি খুব ভালো ছিলি?"
"জানিস তো তিতির,চোখ কাঁদে অনেক পরে,আগে কাঁদে অন্তর।তোকে ছেড়ে আমি ভালো থাকবো এটা তুই ভাবলি কি করে?"
তুই জানিস আজকের দিনটা কি? এবার সৌরভ তিতিরের কানের পাশ থেকে চুলটা সরিয়ে তিতিরের লালচে গোলাপী ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো তারপর আস্তে করে বলল 'শুভ চুম্বন দিবস'।"
"তোর মনে আছে?"
হ্যাঁ,যা এবার ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে আয়। আমি টেবিলে খাবার আনছি।"
ঘরে গিয়ে তিতির অবাক হয়ে গেল।
বিছানার উপরে রাখা আছে একটা সুন্দর টেডি। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা আছে অনেক গুলো চকলেট।আর একটা গোলাপের তলায় রাখা আছে একটা কাগজ। সেটা তুলে পড়তে শুরু করল তিতির,সৌরভ লিখেছে
"অনন্ত বিরহ দিলেও
আমি তোমারই থাকবো
অনন্ত বিরহ পেলে
আমার মনকে যাচাই করে নেব কষ্টিপাথরে, তুমি আমাকে অনন্ত বিরহ দিও
তবুও তোমাকেই আমি ভালোবাসতে চাই নিখাদ প্রেমে।"
এবার তিতির কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পরল সৌরভের বুকে। সৌরভও শক্ত করে তিতিরকে জড়িয়ে ধরল ওর বুকের মধ্যে,তারপর বলল "কাঁদছিস কেন? দেখ, ভালোবাসা কেমন জিতে গেল ক্ষমতার কাছে, বিত্তের কাছে। এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এটা তো আমার ভালোবাসার পরীক্ষা ছিল রে।"
এবার তিতিরের চোখ গেল খাবার টেবিলের দিকে চিকেন কষা,ফ্রাইড রাইস,আলুর দম আইসক্রিম এ সবই তো তিতিরের প্রিয় খাবার।"তুই যে বললি শুধু ডিমের ঝোল আর ভাত রান্না করেছিস।এগুলো তো সবই আমার প্রিয় খাবার।তার মানে তুই সব বুঝতে পেরে গিয়েছিলি?"
"হ্যাঁ,তুই যেমন অত ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছিস তোর সব জিনিস নিয়ে যেতে। আমি কি জানি না তুই এখানে থেকে যাবি বলেই ব্যাগে শুধু তোর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস গুলোই এনেছিস।"আমাদের ভালোবাসা জিতে গেছে তিতির।"
এমন ভাবেই ভালোবাসা জিতে যাক ধর্মের কাছে,ক্ষমতার কাছে,বিত্তের কাছে জাতিভেদের কাছে।
ভালোবাসার জয়
✍️সুস্মিতা রায় চৌধুরী
তিতির ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিল
সৌরভকে। সৌরভও বিনা বাক্য ব্যয়ে সই করে পাঠিয়ে দিয়েছিল প্রায় কিছুদিন হল।এবার বোধহয় হিয়ারিং এর ডেট পড়বে।
আসলে বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার এক বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম কলেজের ছাত্রী, ধনী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, তিতির প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা পিতৃ-মাতৃহীন নেহাৎই সাধারন একটি ছেলে সৌরভের।
একই কলেজে পড়তো দুজনে। সৌরভের বাংলায় অনার্স আর তিতিরের ইংলিশে। কলেজের নবীন বরণ উৎসবে সৌরভের কবিতা পাঠ শুনে মুগ্ধ হয়েছিল তিতির।নিজেই গিয়ে পরিচয় করেছিল সৌরভের সাথে।
সৌরভ প্রথম প্রথম দূরে থাকার চেষ্টা করলেও তিতিরের মত এমন নিরহংকারী ভালো মনের মেয়ের ভালোবাসা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারল না। আসলে ভালোবাসা তো করো অনুমতি নিয়ে আসে না আবার ভালোবাসা তুমি চলে যাও বললেই ভালোবাসা টা টা বাই বাই করে চলেও যায় না। তাই প্রেম অনুরাগের সীমানা ছাড়িয়ে, বসন্তের আবেশে, ভরিয়ে দিলো তাদের জীবন। সেই আবেকেই সঙ্গে নিয়ে, কেটে গেল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির কয়েকটা বছর।
পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ হবার কিছুদিনের মধ্যেই সৌরভ একটা কলেজে চাকরি পেয়ে গেল। তিতির অবশ্য তখনো চাকরি পায় নি। কারন কলেজের চাকরি তিতিরের পছন্দ ছিল না।
কিন্তু এবার ঘটলো ছন্দপতন। বসন্তের আবেশ সরিয়ে, তিতির চোখে বর্ষা নিয়ে, সৌরভের কাছে এসে বলল
"একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে। বাবা তার এক বন্ধুর ছেলে, সেও হাইকোর্টের উকিল, ধনী পরিবার, উচ্চ বংশ, তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। সামনের এক বা দুই মাসের মধ্যেই তারা আমার বিয়ে দিতে চান।"
আসলে তিতিরের বাবা মনতোষ রায়ও হাইকোর্টের একজন নামকরা উকিল।
আমি অবশ্য বলে দিয়েছি "যে আমি এই বিয়ে করতে পারবো না,আমি শুধু তোকে ভালোবাসি।"
"তা শুনে ওনারা কি বললেন?"
"ওনারা বদ্ধপরিকর এই সম্পর্ক কখনো মানবেন না।সমাজে ওদের একটা মান সম্মান আছে।সামান্য একজন বাংলা কলেজ টিচারের সাথে তারা কোনমতেই তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চান না।"
"সেটাই তো স্বাভাবিক তিতির। পুরুষের আর্থিক সামর্থ্য বিয়ের জন্য বড় কথা। তুই ওনাদের একটু বুঝিয়ে বল যদি আমাকে একটু সময় দেন তাহলে আমি একটু গুছিয়ে নিতে পারি।"
"যদি ওনারা তোকে না মানেন? আমি তোকে খুব ভালোবাসি সৌরভ,তোকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।আসলে পরিবার সব সময় চায় প্রেমটা যেন নিজ বৃত্তে, নিজ ধর্মে, সমবিত্ত সম্পন্ন কোন ছেলের সাথেই হয়।কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব বল?লাভ ইজ নট এ ট্যালেন্ট হান্ট,তাই না?
"তুই তো ওনাদেরকেও খুব ভালবাসিস তিতির।ওনারা তোকে কষ্ট করে মানুষ করেছেন। সম্পর্কের এ এক বড় টানাপোড়েন।"
"কষ্ট করে মানুষ করেছেন বলে আমার ভালোবাসাটা বুঝবেন না? সবকিছু কি সবসময় সমানে সমানে হয়?"
"তাও ওনাদেরতো বোঝানোর চেষ্টাটা আমাদের করতেই হবে।তেমন হলে না হয় আমি গিয়ে তোর বাবার সাথে দেখা করব। ওনাকে অনুরোধ করবো।"
"ঠিক আছে তুই না হয় একবার চেষ্টা করে দেখ।।"
এরপর একদিন সৌরভ গেল তিতিরের বাবার কাছে।অনুরোধ করলো তাকে একটু সময় দেওয়ার জন্য।উনি রাজি হলেন না। উল্টে বললেন "তুমি কি ভালোবাসার জন্য আমার সাথে যুদ্ধে নামতে চাও?"সৌরভ বলল "ভালোবাসা তো কখনো যুদ্ধ চায় না স্যার,ভালোবাসা তো ভালোবাসতেই চায়। এই আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ভালোবাসাকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছে যুগ যুগ ধরে।"
"বৈষম্য তো থাকবেই।সেটাই তো স্বাভাবিক।আমি এমন চালচুলোহীন, পিতৃ-মাতৃহীন ছেলের হাতে মেয়েকে দিতে পারব না।"
এবার সৌরভ হেসে বলল
"মেয়েকে দেবেন কি স্যার? তিতিরকি একটা বস্তু নাকি?ও একজন যথেষ্ট শিক্ষিত মানুষ। আর বিয়ে তো একজন মানুষের সাথে মানুষেরই হয়।"
"আসলে তো এই ভালবাসার অন্তরালে আছে অর্থের লোভ,হাই সোসাইটিতে ওঠার চেষ্টা।আত্নসম্মানে আঘাত লেগেছিল সেদিন সৌরভের গভীর প্রত্যয়ে বলেছিল
"ক্ষমা করবেন স্যার।আমরা একে অপরকে ভালোবেসেছি,আমরা ভালো থাকবো, একে অপরকে ভালো রাখবো।"
এরপর কয়েকজন বন্ধুর উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রি এবং মালাবদল করে ওদের বিয়ে হয়।শহরতলীতে একটা ছোট দু কামরার ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু হয় তাদের ভালোবাসার লাল নীল সংসার।সুখেই চলছিল তাদের যৌথযাপন।সৌরভ চেষ্টা করছিল একটু সঞ্চয় করে এবং ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটা ছোট ফ্ল্যাট কেনার।
একটু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য সৌরভ একটা দুটো প্রাইভেট টিউশনি নিলো। কোন কোন দিন হাঁটতে হাঁটতে ফিরে অটোর ভাড়া বাঁচাতো। কিন্তু ফিরে এসেই তিতিরের ওই সদাহাস্যময়ী মুখটা দেখে সৌরভের সব ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যেত।ভালোবাসা বোধ হয় এক সঞ্জীবনী সুধা কষ্টেও প্রাণ জুড়িয়ে দেয়।তিতির কোনদিনই রন্ধন পটীয়সী ছিল না।তাই প্রধান রান্নার দায়িত্বটা ছিল সৌরভেরই ওপর। সৌরভ বলতো কলমের, চাকরির পরীক্ষার যদি কোন লিঙ্গ না হয় তাহলে খুন্তিরই বা কেন হবে?
এরপর তিতির একটা এডভার্টাইজিং এজেন্সিতে চাকরি পায়। তিতিরের চাকরি পাওয়ার খবর শুনে তিতিরের বাবা-মা হাজির হন তার সাথে দেখা করতে। তিতিরও অনেকদিন পর বাবা মাকে পেয়ে খুব খুশি। তবে তিতিরকে এমন একটা ছোট ভাড়া বাড়িতে থাকতে দেখে তাদের বেশ কষ্ট হয়।
এরপর মনোতোষ বাবু একদিন এসে তাদেরকে বলেন"এত কষ্ট করে তোমাদের এখানে থাকার দরকার নেই।আমাদের তো একটা ফ্ল্যাট ভবানীপুরে কেনা আছে তোমরা বরং দুজনে সেখানে গিয়ে
শুনে তিতিরের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আনন্দে সে সৌরভের সাথে কোন আলোচনা না করেই তার বাবার কথায় সম্মত হয়ে যায়।
"কিন্তু এবার সকলকে অবাক করে দিয়ে সৌরভ বলে
"মাপ করবেন,আমরা এখনই আপনার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে পারব না। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আমরা নিজেরাই একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনতে পারব। তেমন হলে না হয় তিতির না হয় আপনাদের বাড়িতে গিয়ে, আপনাদের সঙ্গে দেখা করে আসবে।"
এবার মনোতোষবাবু বললেন "তার মানে তুমি আমাদের ওই ফ্ল্যাটে থাকবে না?"
"না, কখনোই না।"
কথাটা বলেই সৌরভ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এবার মনোতোষবাবুও বেশ মনোক্ষুন্ন হয়েই চলে গেলেন। তিতিরের খুব খারাপ লাগলো এই ঘটনায়। এরপর থেকেই সৌরভ আর তিতিরের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব বাড়তে থাকলো।
এরপর তিতির একদিন সৌরভ কে বলল "আমার বাবা-মা, আমাদের বিয়েটাকে মেনে নেয় নি বলে, তুই কি আমার বাবা-মায়ের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিস? কিন্তু ভালোবেসে বিয়ে করেছি বলে, আমারও যে ইচ্ছে অনিচ্ছার দাম থাকবে না এমনটা তো নয়? আমার ইচ্ছেটাকে, তোরও সম্মান করা উচিত।" আসলে সৌরভ বিয়ের আগে তার বাবার বলা কথাগুলো তিতিরকে কখনো জানায়নি তাই বলল
"ঠিক আছে তোর যদি আমার সিদ্ধান্তটাকে ভুল মনে হয়, তাহলে তুই সচ্ছন্দে তোর বাবা-মার কাছে গিয়ে থাকতে পারিস। আমি কোন ভাবেই, নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেব না।"
এরপর ধীরে ধীরে সম্পর্কের মধ্যে এল
তিক্ততা। একদিন তিতির রাগ করে সত্যিই ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেল নিজের বাবা-মায়ের কাছে। সৌরভ তিতিরকে একবারো আটকালো না, বোঝানোর নূন্যতম চেষ্টাও করলো না।"
খুব কষ্ট হল তিতিরের। তবে তিতিরের বাবা-মা বোধহয় এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তারা তিতিরকে বোঝালেন
এখনো খুব বেশি দেরি হয়নি। তুমি ভালো চাকরি করছো। সৌরভকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নাও।
বড় বিষন্ন তিতির। সৌরভ তার অভিমানের ভাষাটা বুঝলো না।ভালোবাসা কি এমন ভাবেই ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে দেয়, হৃদয় ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। রাগ করে তিতির ডিভোর্সের পেপারগুলো, পাঠিয়ে দেয় এই ভেবে, যে এবার নিশ্চয়ই সৌরভ তার কাছে আসবে। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইবে।
কিন্তু এসবের কোন কিছুই হলো না। সৌরভ সই করে দিলো ডিভোর্স পেপারে। আসা তো দূরের কথা একবার ফোন বা মেসেজ কিছুই করলো না।
অভিমানী মেঘে ঢেকে গেল তিতিরের, মনের ঘর। এত নিষ্ঠুর সৌরভ?
এরপর তিতির নিজেই ফোন করে সৌরভ কে বলল "সামনের রবিবার আমি যাব। আমার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসবো।"
সৌরভ বলল "ঠিক আছে আসিস,নিয়ে যাস। রবিবার বেলার দিকে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে তিতির এল সৌরভের কাছে। এতদিন পর সৌরভকে দেখে অনেক কষ্টে নিজের চোখের জলকে, সংবরণ করে বলল
"তুই খুব খুশি তাই না রে? কি সুন্দর ডিভোর্স পেপারে সই করে দিলি।"
"তোকে তো অদেও আমার কিছুই নেই।শুধু আত্মসম্মানটুকু বিসর্জন দিতে পারি নি।"
"আর আমাকে খুব সহজেই বিসর্জন দিয়ে দেওয়া যায়।"
"ভালোবাসার বিসর্জন হয় না, ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটে না।"
এবার তিতির হঠাৎ বলল "কি রান্না করছিস রে তুই,আমার খুব খিদে পেয়েছে?"
সৌরভ বলল "ভাত আর ডিমের ঝোল।তবে ডিম কিন্তু একটাই আছে।"
"ঠিক আছে তুই ডিমটা খাস।আমি শুধু আলু ঝোল দিয়েই খেয়ে নেব।"
কিন্তু খেয়ে যেতে গেলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোর বাড়িতে হয়তো সবাই চিন্তা করবে।
"তাড়িয়ে দিচ্ছিস আমাকে? জানিস আমি কতদিন ভালো করে খাইনি, ঘুমোইনি।"এবার সৌরভ তিতিরের খুব কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল
কেন খাস নি,ঘুমাস নি তুই তো ভাল থাকবি বলেই গিয়েছিলি?
"তুই বুঝি খুব ভালো ছিলি?"
"জানিস তো তিতির,চোখ কাঁদে অনেক পরে,আগে কাঁদে অন্তর।তোকে ছেড়ে আমি ভালো থাকবো এটা তুই ভাবলি কি করে?"
তুই জানিস আজকের দিনটা কি? এবার সৌরভ তিতিরের কানের পাশ থেকে চুলটা সরিয়ে তিতিরের লালচে গোলাপী ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো তারপর আস্তে করে বলল 'শুভ চুম্বন দিবস'।"
"তোর মনে আছে?"
হ্যাঁ,যা এবার ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে আয়। আমি টেবিলে খাবার আনছি।"
ঘরে গিয়ে তিতির অবাক হয়ে গেল।
বিছানার উপরে রাখা আছে একটা সুন্দর টেডি। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা আছে অনেক গুলো চকলেট।আর একটা গোলাপের তলায় রাখা আছে একটা কাগজ। সেটা তুলে পড়তে শুরু করল তিতির,সৌরভ লিখেছে
"অনন্ত বিরহ দিলেও
আমি তোমারই থাকবো
অনন্ত বিরহ পেলে
আমার মনকে যাচাই করে নেব কষ্টিপাথরে, তুমি আমাকে অনন্ত বিরহ দিও
তবুও তোমাকেই আমি ভালোবাসতে চাই নিখাদ প্রেমে।"
এবার তিতির কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পরল সৌরভের বুকে। সৌরভও শক্ত করে তিতিরকে জড়িয়ে ধরল ওর বুকের মধ্যে,তারপর বলল "কাঁদছিস কেন? দেখ, ভালোবাসা কেমন জিতে গেল ক্ষমতার কাছে, বিত্তের কাছে। এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এটা তো আমার ভালোবাসার পরীক্ষা ছিল রে।"
এবার তিতিরের চোখ গেল খাবার টেবিলের দিকে চিকেন কষা,ফ্রাইড রাইস,আলুর দম আইসক্রিম এ সবই তো তিতিরের প্রিয় খাবার।"তুই যে বললি শুধু ডিমের ঝোল আর ভাত রান্না করেছিস।এগুলো তো সবই আমার প্রিয় খাবার।তার মানে তুই সব বুঝতে পেরে গিয়েছিলি?"
"হ্যাঁ,তুই যেমন অত ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছিস তোর সব জিনিস নিয়ে যেতে। আমি কি জানি না তুই এখানে থেকে যাবি বলেই ব্যাগে শুধু তোর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস গুলোই এনেছিস।"আমাদের ভালোবাসা জিতে গেছে তিতির।"
এমন ভাবেই ভালোবাসা জিতে যাক ধর্মের কাছে,ক্ষমতার কাছে,বিত্তের কাছে জাতিভেদের কাছে।