23-09-2021, 10:18 AM
পার্শীবাগান বাদুড় বাগান
আমি ঐতিহাসিক নই সাহিত্যিক নই তবুও কেন পাড়ার ইতিহাস লিখতে বসলাম জানিনা। প্রবাদ আছে, fools rush in where........। তাই বোধহয় হবে।
আজকে সায়েন্স কলেজ যেখানে অবস্থান করছে আঠারো শতকের মাঝামাঝি ওখানেই এক পার্শী ভদ্রলোকের বিশাল বাগান ছিল। সেই সুবাদে ঐ বাগান ও তার আশপাশের অঞ্চল কে পার্শীবাগান বলা হতো। পরে নাম টা পার্শীবাগান স্কোয়ার হয়। পার্শীবাগানের পেছনের যে অঞ্চল ছিল সেই গোটা অঞ্চলের নাম ছিল বাদুড় বাগান। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ির ঠিকানা এখন বিদ্যাসাগর স্ট্রিট কিন্ত তখন সবাই বলত ' বিদ্যাসাগরের বাদুড় বাগানের বাটি '। এই অঞ্চলে অনেক বড় গাছ ছিল আর সেখানে হয়তো বাদুড় ঝুলতে দেখা যেত তাই এই নামের সৃষ্টি। যত বাড়ি তৈরি হয়েছে তত গাছ কাটা গেছে আর তাতেই বাদুড়ের দল বিতাড়িত হয়েছে।
দাদাঠাকুর যখন তার কলকাতার ভুল নিয়ে বিখ্যাত গান টি রচনা করেছিলেন তখন বাদুড় ছিল না, তাই তিনি লিখেছিলেন, " বাদুড় বাগানে দেখি বাদুড় নাহি ঝোলে, "।
পার্শীবাগানের সেই পার্শী ভদ্রলোক মারা যাবার কিছু পরে ঐ বিশেষ জমি হাতবদল হয়েছিল কয়েক বার। শোনা যায় ঠাকুর বাড়ির হাতে এই জমির মালিকানা কিছু দিন ছিল। এ জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়েছিল।
পার্শীবাগান স্কোয়ার নামকরণ হয়েছিল ঠিক কবে জানা নেই তবে এই সায়েন্স কলেজের আশপাশের বেশ কিছু জায়গা কে তখন পার্শীবাগান স্কোয়ার বলা হতো। উল্টো দিকের ব্রাহ্ম গার্লস কলেজ ও সাধনা সরকার উদ্যান আজ যে জায়গাতে অবস্থান করছে সব ছিল স্কোয়ারের অন্তর্গত। পার্শীবাগান এলাকার তখন খুব গুরুত্ব ছিল। গড়পাড় অঞ্চলে আজ যে ডাকঘর আছে তার নাম তখন থেকেই পার্শীবাগান পোস্ট অফিস।
1906 সালের ছয়ই আগস্টে এইখানেই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। আজ যেটা সাধনা সরকার উদ্যান তখন তার নাম ছিল পার্শীবাগান স্কোয়ারের গ্রীয়ার পার্ক। গ্রীয়ার সাহেব ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। এই পার্কে অনুশীলন সমিতির উদ্যোগে ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়েছিল। এই পতাকার নাম পরে হয়েছিল ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ। অনুশীলন সমিতির দপ্তর ও ছাপাখানা ছিল রাজাবাজারের কাছে। আজ ও তার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
এই পতাকা সৃষ্টি করেছিলেন সচীন্দ্র প্রসাদ বসু আর সুকুমার মিত্র। প্রথম জন ছিলেন রিপন কলেজের ছাত্র আর রাষ্ট্র গুরু সুরেন্দ্র নাথের শিষ্য। দ্বিতীয় জন ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের শিষ্য। পতাকা ছিল ত্রিবর্ণ, ওপরে লাল, মাঝে হলুদ আর নীচে সবুজ। ওপরে আঁকা ছিল আটটি পদ্ম ( আট টি প্রদেশ)। মাঝে দেবনাগরী তে নীলে লেখা বন্দে মাতরম। নীচে আঁকা ছিল এক দিকে সূর্য আর একদিকে চাঁদ তারা ( মতান্তরে পূর্ণ চন্দ্র)।
বঙ্গ ভঙ্গের ঠিক এক বছর পরে প্রতিবাদ স্বরূপ এই পতাকা উত্তোলন করেছিলেন অনুশীলন সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার প্রমথ নাথ মিত্র। এই ঘটনাতে সেদিন খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিল। পার্শীবাগান তখন ছিল জাতীয়তাবাদের পিঠ স্থান। পরের বছর আর একটা পতাকা বিদেশে উত্তোলন করেছিলেন ম্যাডাম কামা, সেটা একটু অন্যরকমের। এরপর আরো কিছু রদবদলের পরে সৃষ্টি হয়েছিল আজকের জাতীয় পতাকা।
পার্শীবাগানের সায়েন্স কলেজের সেই জমি টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে কিনেছিলেন আইনজীবী ও দানবীর তারকনাথ পালিত। কেনার কিছু পরে তিনি জমিটা দান করে দেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কে। অবশেষে 1914 সালে আইনজীবী তারকনাথ পালিত ও বিশিষ্ট আইনজীবী ও আর এক দানবীর রাসবিহারী ঘোষের সৌজন্যে সায়েন্স কলেজ তার জয়যাত্রা শুরু করে। প্রথমে রসায়ন বিভাগ তারপর পদার্থ বিদ্যা বিভাগ চালু হয়েছিল। সায়েন্স কলেজের প্রাঙ্গনের নাম এখন রাসবিহারী শিক্ষা প্রাঙ্গন । সামনে যে বিশাল ইমারত টি রাস্তা থেকে দেখা যায় তার নাম তারকনাথ পালিত বিল্ডিং। সে সময় রাসবিহারী আর পালিত অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয়েছিল, তার খরচ যোগাতেন এই দুই মহান মানুষ।
সায়েন্স কলেজ চালু হবার পরে পার্শীবাগান স্কোয়ার নামটি ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। পার্শীবাগান কে মনে রাখার জন্য পরে সায়েন্স কলেজের দুদিকের গলি কে পার্শীবাগান বলা হতো।
রাজাবাজারের দিকের কানা গলি টা পরে পাল্টে গিরিশ বিদ্যা রত্ন লেন হয়েছে। গিরিশ বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহপাঠি ছিলেন। আঠেরোশো পঁয়তাল্লিশ সালে ইনি সংস্কৃত কলেজে গ্রন্থ্যাধক্ষ নিযুক্ত হন পরে তিনি ব্যাকরণ অধ্যাপক হয়েছিলেন।
তিনি এই অঞ্চলে থাকতেন। সায়েন্স কলেজ আর বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মাঝে যে রাস্তা টি আছে সেটাই এখন পার্শীবাগান লেন।
পার্শীবাগান লেন দিয়ে ঢুকলে বাম দিকে দেখা যায় সায়েন্স কলেজের লম্বা দেওয়াল যেটা গলির প্রায় শেষ প্রান্ত অব্দি চলে গিয়েছে। এই কলেজের নাম করলে যার নাম টি আগে উঠে আসে তিনি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ইনি প্রখ্যাত রসায়নবিদ, শিক্ষক আর দার্শনিক। ইনি বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙলার ঘরে ঘরে পাওয়া যেত আকোয়াটাইকোটিস, ন্যাপথ্যালিন আর কালো ফিনাইল। ইনি অসাধ্য সাধন করে আবিষ্কার করেন মারকিউরাস নাইট্রাইট। তাই তো কবি সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, " বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে, বাঙালি দিয়েছে বিয়ে
মোদের নব্য রসায়ন শুধু
গরমিলে মিলিয়ে "।
আচার্য্য রায় ছাড়াও যাদের নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় তারা চন্দ্রশেখর রমন (রমন এফেক্টের জন্য নোবেল প্রাইজ), সত্যেন্দ্রনাথ বসু ( বোস আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স), মেঘনাদ সাহা, দেবেন্দ্র মোহন বসু, জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ ইত্যাদি। দেশে বিদেশে অনেক মানুষ আছেন যারা বিজ্ঞানের জগতে আলো ছড়িয়েছেন বা এখনও ছড়াচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেকেই এই সায়েন্স কলেজের ছাত্র ছাত্রী।
গলির ডান দিকে লম্বা হয়ে চলে গেছে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দেওয়াল। এই সেই বিখ্যাত বাড়ি যেখানে থাকতেন আচার্য জগদীশ বোস। ইনি পদার্থবিদ, জৈবপদার্থ বিজ্ঞানী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, প্রত্নতত্ত্ব বিদ তার ওপর ছিলেন কল্পবিজ্ঞানের লেখক। উনি রেডিও বিজ্ঞানের জনক ও ক্রেসকোগ্রাফের আবিষ্কারক। রবীন্দ্রনাথ ওনার সম্বন্ধে বলেছেন, " ভারতের কোনো বৃদ্ধ ঋষি তরুণ মুর্তি, তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ " ।
জগদীশ বোসের সঙ্গে ছিলেন তার বিখ্যাত স্ত্রী লেডি অবলা বোস। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারিকা, শিক্ষাবিদ ও সুলেখিকা। নারী শিক্ষা প্রসার ও বিধবাদের জীবনযাপনের সাহায্য করার জন্য তিনি বিশেষ ভাবে পরিচিত। তার দিদি ছিলেন সরলা রায় তিনিও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।
এই বাড়িতেই থাকতেন তাদের ভাগ্নে বিখ্যাত পদার্থবিদ দেবেন্দ্র মোহন বসু।
এই পার্শীবাগান লেন দিয়ে আর একটু এগোলে পাবেন আজকের বারো নম্বর বাড়ি, সেখানে একদা ছিলেন রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী। ইনি ছিলেন রিপন কলেজের অধ্যক্ষ। বিজ্ঞান ও দর্শনের দূরুহ বিষয় কে খুব সহজ করে বাঙলা তে লিখতে পারতেন। তার লেখা অনেক বই আছে। উনি খুব প্রাঞ্জল বাঙলা তে ছাত্র দের পড়াতেন। উনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাণপুরুষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ওনার সম্পর্কে বলেছেন, " তোমার বাক্য সুন্দর, তোমার হাস্য সুন্দর তুমি রামেন্দ্র সুন্দর "।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি পার্শীবাগান ছেড়ে পটলডাঙা তে চলে গিয়েছিলেন। ঐ বাড়িতেই 1919 সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন অসুস্থ বন্ধু কে দেখতে। গিয়ে তিনি নাইট হুড পরিত্যাগ করার সেই ঐতিহাসিক চিঠিটা পড়ে শুনিয়েছিলেন। রামেন্দ্র সুন্দর একেবারেই আপ্লুত আর অভিভুত। তিনি বলেছিলেন যে এর চেয়েও ভাল প্রতিবাদ আর হয় না। রবীন্দ্রনাথ ফিরে যাবার পরেই রামেন্দ্র কোমায় চলে যান আর কিছুদিন বাদে মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে তিনি দেহ রাখলেন।
এই রামেন্দ্র র ছোট ভাই দুর্গাদাস ছিলেন আমার মায়ের মাতামহ। রামেন্দ্র র জন্মস্থান মুর্শিদাবাদ জেলার জেমো গ্রামে। সেই বাড়িতে তাই ছোট বেলায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, কারণ ওটা আমার মায়ের মামার বাড়ি।
রামেন্দ্র সুন্দরের পরের বাড়িটা চোদ্দ নম্বর ছিল বিখ্যাত বসু বাড়ি। ঐখানে থাকতেন চার ভাই, কৃষ্ণ শেখর, শশিশেখর, রাজশেখর আর গিরীন্দ্র শেখর। এ বাড়ি এখন বিক্রি হয়ে গেছে। পাশাপাশি দুটো বাড়ি আছে।
রাজশেখর বা পরশুরামের কথা সবাই জানেন। তাঁর লেখায় ছিল অনাবিল হাস্যরস আর তার চরিত্র সৃষ্টি ছিল অসাধারণ। হাসির গল্প ছাড়াও তিনি রামায়ণ, মহাভারত, চলন্তিকা ইত্যাদি বই লিখেছেন। তিনি ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালের মুখ্য রসায়নবিদ। রসায়নের রস আর সাহিত্য রস দুটোতেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। একটা গল্প না বললেই নয়। আচার্য্য রায় একদিন রবীন্দ্রনাথ কে চিঠি লিখে জানালেন যে রাজশেখর এখন নিজের কাজের চেয়েও বেশি লেখালিখি নিয়ে মেতে আছে। উনি লিখলেন, " আপনি তার কোন লেখার প্রশংসা করিয়াছিলেন আর তারপর তাকে থামানো যাইতেছে না। এরপর সে আবার যখন লিখিবে তখন আপনি একটু কড়া করে সমালোচনা করবেন। "
এ চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ জানালেন, " সমালোচনার দরকার নেই, রাজশেখর গিল্টি নয় সে একেবারে খাঁটি সোনা "।
এই চোদ্দ নম্বর বাড়িতে প্রায় আড্ডা বসতো। আর তাতে বসু ভাই রা ছাড়াও থাকতেন নজরুল, বিপ্লবী পুলিন দাস, আচার্য্য রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু,মেঘনাদ সাহা এবং আরও অনেকে।
রাজশেখর অবশ্য পরে এই বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি করে উঠে গিয়েছিলেন।
রাজশেখরের ছোট ভাই গিরীন্দ্র শেখর ছিলেন আর এক বিখ্যাত মানুষ। তিনি কলকাতার মানসিক রোগ চিকিৎসার একজন পথিকৃত ও দিকপাল। তিনি জাদুবিদ্যা ও হিপনটিজম শিক্ষা করেছিলেন ও সেটাই মানসিক রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োগ করতেন। তখন ফ্রয়েডের ( সাইকো এনালিসিস) এর কথা ভারতে কেউ জানত না। পরে জানা গিয়েছিল যে গিরীন্দ্র শেখর যে চিকিৎসা প্রণালী উদ্ভাবন করেছিলেন সেটার সঙ্গে ফ্রয়েডের চিকিৎসা পদ্ধতির বেশ কিছু মিল ছিল। তিনি মনোবিজ্ঞানে এম এস সি পরে ডি এস সি ডিগ্রি লাভ করেন। তার লেখা একাধিক বই আছে। তিনি তার বাড়িতেই ভারতীয় মনঃ সমীক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। অনেক নামকরা ডাক্তার ও মানুষ এতে যুক্ত ছিলেন। দাদা রাজশেখরের দান করা জমিতে তিনি গোবরা তে প্রথম মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার সুযোগ্য ভাইপো ডাক্তার বিজয় কেতু বোস তাকে আজীবন সাহায্য করে গেছেন। গিরীন্দ্র র মৃত্যুর পর তার ভাইপো এখানে আজীবন চিকিৎসা করেছেন। এখানে অনেক বড় ডাক্তার আসতেন আর প্রায় নিখরচায় অনেক রোগীর চিকিৎসা করতেন। ডাক্তার বিজয়কেতু কে আমি অনেক দিন কাছ থেকে দেখেছি।
আমি ঐতিহাসিক নই সাহিত্যিক নই তবুও কেন পাড়ার ইতিহাস লিখতে বসলাম জানিনা। প্রবাদ আছে, fools rush in where........। তাই বোধহয় হবে।
আজকে সায়েন্স কলেজ যেখানে অবস্থান করছে আঠারো শতকের মাঝামাঝি ওখানেই এক পার্শী ভদ্রলোকের বিশাল বাগান ছিল। সেই সুবাদে ঐ বাগান ও তার আশপাশের অঞ্চল কে পার্শীবাগান বলা হতো। পরে নাম টা পার্শীবাগান স্কোয়ার হয়। পার্শীবাগানের পেছনের যে অঞ্চল ছিল সেই গোটা অঞ্চলের নাম ছিল বাদুড় বাগান। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ির ঠিকানা এখন বিদ্যাসাগর স্ট্রিট কিন্ত তখন সবাই বলত ' বিদ্যাসাগরের বাদুড় বাগানের বাটি '। এই অঞ্চলে অনেক বড় গাছ ছিল আর সেখানে হয়তো বাদুড় ঝুলতে দেখা যেত তাই এই নামের সৃষ্টি। যত বাড়ি তৈরি হয়েছে তত গাছ কাটা গেছে আর তাতেই বাদুড়ের দল বিতাড়িত হয়েছে।
দাদাঠাকুর যখন তার কলকাতার ভুল নিয়ে বিখ্যাত গান টি রচনা করেছিলেন তখন বাদুড় ছিল না, তাই তিনি লিখেছিলেন, " বাদুড় বাগানে দেখি বাদুড় নাহি ঝোলে, "।
পার্শীবাগানের সেই পার্শী ভদ্রলোক মারা যাবার কিছু পরে ঐ বিশেষ জমি হাতবদল হয়েছিল কয়েক বার। শোনা যায় ঠাকুর বাড়ির হাতে এই জমির মালিকানা কিছু দিন ছিল। এ জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়েছিল।
পার্শীবাগান স্কোয়ার নামকরণ হয়েছিল ঠিক কবে জানা নেই তবে এই সায়েন্স কলেজের আশপাশের বেশ কিছু জায়গা কে তখন পার্শীবাগান স্কোয়ার বলা হতো। উল্টো দিকের ব্রাহ্ম গার্লস কলেজ ও সাধনা সরকার উদ্যান আজ যে জায়গাতে অবস্থান করছে সব ছিল স্কোয়ারের অন্তর্গত। পার্শীবাগান এলাকার তখন খুব গুরুত্ব ছিল। গড়পাড় অঞ্চলে আজ যে ডাকঘর আছে তার নাম তখন থেকেই পার্শীবাগান পোস্ট অফিস।
1906 সালের ছয়ই আগস্টে এইখানেই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। আজ যেটা সাধনা সরকার উদ্যান তখন তার নাম ছিল পার্শীবাগান স্কোয়ারের গ্রীয়ার পার্ক। গ্রীয়ার সাহেব ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। এই পার্কে অনুশীলন সমিতির উদ্যোগে ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়েছিল। এই পতাকার নাম পরে হয়েছিল ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ। অনুশীলন সমিতির দপ্তর ও ছাপাখানা ছিল রাজাবাজারের কাছে। আজ ও তার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
এই পতাকা সৃষ্টি করেছিলেন সচীন্দ্র প্রসাদ বসু আর সুকুমার মিত্র। প্রথম জন ছিলেন রিপন কলেজের ছাত্র আর রাষ্ট্র গুরু সুরেন্দ্র নাথের শিষ্য। দ্বিতীয় জন ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের শিষ্য। পতাকা ছিল ত্রিবর্ণ, ওপরে লাল, মাঝে হলুদ আর নীচে সবুজ। ওপরে আঁকা ছিল আটটি পদ্ম ( আট টি প্রদেশ)। মাঝে দেবনাগরী তে নীলে লেখা বন্দে মাতরম। নীচে আঁকা ছিল এক দিকে সূর্য আর একদিকে চাঁদ তারা ( মতান্তরে পূর্ণ চন্দ্র)।
বঙ্গ ভঙ্গের ঠিক এক বছর পরে প্রতিবাদ স্বরূপ এই পতাকা উত্তোলন করেছিলেন অনুশীলন সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার প্রমথ নাথ মিত্র। এই ঘটনাতে সেদিন খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিল। পার্শীবাগান তখন ছিল জাতীয়তাবাদের পিঠ স্থান। পরের বছর আর একটা পতাকা বিদেশে উত্তোলন করেছিলেন ম্যাডাম কামা, সেটা একটু অন্যরকমের। এরপর আরো কিছু রদবদলের পরে সৃষ্টি হয়েছিল আজকের জাতীয় পতাকা।
পার্শীবাগানের সায়েন্স কলেজের সেই জমি টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে কিনেছিলেন আইনজীবী ও দানবীর তারকনাথ পালিত। কেনার কিছু পরে তিনি জমিটা দান করে দেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কে। অবশেষে 1914 সালে আইনজীবী তারকনাথ পালিত ও বিশিষ্ট আইনজীবী ও আর এক দানবীর রাসবিহারী ঘোষের সৌজন্যে সায়েন্স কলেজ তার জয়যাত্রা শুরু করে। প্রথমে রসায়ন বিভাগ তারপর পদার্থ বিদ্যা বিভাগ চালু হয়েছিল। সায়েন্স কলেজের প্রাঙ্গনের নাম এখন রাসবিহারী শিক্ষা প্রাঙ্গন । সামনে যে বিশাল ইমারত টি রাস্তা থেকে দেখা যায় তার নাম তারকনাথ পালিত বিল্ডিং। সে সময় রাসবিহারী আর পালিত অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয়েছিল, তার খরচ যোগাতেন এই দুই মহান মানুষ।
সায়েন্স কলেজ চালু হবার পরে পার্শীবাগান স্কোয়ার নামটি ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। পার্শীবাগান কে মনে রাখার জন্য পরে সায়েন্স কলেজের দুদিকের গলি কে পার্শীবাগান বলা হতো।
রাজাবাজারের দিকের কানা গলি টা পরে পাল্টে গিরিশ বিদ্যা রত্ন লেন হয়েছে। গিরিশ বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহপাঠি ছিলেন। আঠেরোশো পঁয়তাল্লিশ সালে ইনি সংস্কৃত কলেজে গ্রন্থ্যাধক্ষ নিযুক্ত হন পরে তিনি ব্যাকরণ অধ্যাপক হয়েছিলেন।
তিনি এই অঞ্চলে থাকতেন। সায়েন্স কলেজ আর বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মাঝে যে রাস্তা টি আছে সেটাই এখন পার্শীবাগান লেন।
পার্শীবাগান লেন দিয়ে ঢুকলে বাম দিকে দেখা যায় সায়েন্স কলেজের লম্বা দেওয়াল যেটা গলির প্রায় শেষ প্রান্ত অব্দি চলে গিয়েছে। এই কলেজের নাম করলে যার নাম টি আগে উঠে আসে তিনি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ইনি প্রখ্যাত রসায়নবিদ, শিক্ষক আর দার্শনিক। ইনি বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙলার ঘরে ঘরে পাওয়া যেত আকোয়াটাইকোটিস, ন্যাপথ্যালিন আর কালো ফিনাইল। ইনি অসাধ্য সাধন করে আবিষ্কার করেন মারকিউরাস নাইট্রাইট। তাই তো কবি সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, " বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে, বাঙালি দিয়েছে বিয়ে
মোদের নব্য রসায়ন শুধু
গরমিলে মিলিয়ে "।
আচার্য্য রায় ছাড়াও যাদের নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় তারা চন্দ্রশেখর রমন (রমন এফেক্টের জন্য নোবেল প্রাইজ), সত্যেন্দ্রনাথ বসু ( বোস আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স), মেঘনাদ সাহা, দেবেন্দ্র মোহন বসু, জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ ইত্যাদি। দেশে বিদেশে অনেক মানুষ আছেন যারা বিজ্ঞানের জগতে আলো ছড়িয়েছেন বা এখনও ছড়াচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেকেই এই সায়েন্স কলেজের ছাত্র ছাত্রী।
গলির ডান দিকে লম্বা হয়ে চলে গেছে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দেওয়াল। এই সেই বিখ্যাত বাড়ি যেখানে থাকতেন আচার্য জগদীশ বোস। ইনি পদার্থবিদ, জৈবপদার্থ বিজ্ঞানী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, প্রত্নতত্ত্ব বিদ তার ওপর ছিলেন কল্পবিজ্ঞানের লেখক। উনি রেডিও বিজ্ঞানের জনক ও ক্রেসকোগ্রাফের আবিষ্কারক। রবীন্দ্রনাথ ওনার সম্বন্ধে বলেছেন, " ভারতের কোনো বৃদ্ধ ঋষি তরুণ মুর্তি, তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ " ।
জগদীশ বোসের সঙ্গে ছিলেন তার বিখ্যাত স্ত্রী লেডি অবলা বোস। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারিকা, শিক্ষাবিদ ও সুলেখিকা। নারী শিক্ষা প্রসার ও বিধবাদের জীবনযাপনের সাহায্য করার জন্য তিনি বিশেষ ভাবে পরিচিত। তার দিদি ছিলেন সরলা রায় তিনিও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।
এই বাড়িতেই থাকতেন তাদের ভাগ্নে বিখ্যাত পদার্থবিদ দেবেন্দ্র মোহন বসু।
এই পার্শীবাগান লেন দিয়ে আর একটু এগোলে পাবেন আজকের বারো নম্বর বাড়ি, সেখানে একদা ছিলেন রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী। ইনি ছিলেন রিপন কলেজের অধ্যক্ষ। বিজ্ঞান ও দর্শনের দূরুহ বিষয় কে খুব সহজ করে বাঙলা তে লিখতে পারতেন। তার লেখা অনেক বই আছে। উনি খুব প্রাঞ্জল বাঙলা তে ছাত্র দের পড়াতেন। উনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাণপুরুষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ওনার সম্পর্কে বলেছেন, " তোমার বাক্য সুন্দর, তোমার হাস্য সুন্দর তুমি রামেন্দ্র সুন্দর "।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি পার্শীবাগান ছেড়ে পটলডাঙা তে চলে গিয়েছিলেন। ঐ বাড়িতেই 1919 সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন অসুস্থ বন্ধু কে দেখতে। গিয়ে তিনি নাইট হুড পরিত্যাগ করার সেই ঐতিহাসিক চিঠিটা পড়ে শুনিয়েছিলেন। রামেন্দ্র সুন্দর একেবারেই আপ্লুত আর অভিভুত। তিনি বলেছিলেন যে এর চেয়েও ভাল প্রতিবাদ আর হয় না। রবীন্দ্রনাথ ফিরে যাবার পরেই রামেন্দ্র কোমায় চলে যান আর কিছুদিন বাদে মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে তিনি দেহ রাখলেন।
এই রামেন্দ্র র ছোট ভাই দুর্গাদাস ছিলেন আমার মায়ের মাতামহ। রামেন্দ্র র জন্মস্থান মুর্শিদাবাদ জেলার জেমো গ্রামে। সেই বাড়িতে তাই ছোট বেলায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, কারণ ওটা আমার মায়ের মামার বাড়ি।
রামেন্দ্র সুন্দরের পরের বাড়িটা চোদ্দ নম্বর ছিল বিখ্যাত বসু বাড়ি। ঐখানে থাকতেন চার ভাই, কৃষ্ণ শেখর, শশিশেখর, রাজশেখর আর গিরীন্দ্র শেখর। এ বাড়ি এখন বিক্রি হয়ে গেছে। পাশাপাশি দুটো বাড়ি আছে।
রাজশেখর বা পরশুরামের কথা সবাই জানেন। তাঁর লেখায় ছিল অনাবিল হাস্যরস আর তার চরিত্র সৃষ্টি ছিল অসাধারণ। হাসির গল্প ছাড়াও তিনি রামায়ণ, মহাভারত, চলন্তিকা ইত্যাদি বই লিখেছেন। তিনি ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালের মুখ্য রসায়নবিদ। রসায়নের রস আর সাহিত্য রস দুটোতেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। একটা গল্প না বললেই নয়। আচার্য্য রায় একদিন রবীন্দ্রনাথ কে চিঠি লিখে জানালেন যে রাজশেখর এখন নিজের কাজের চেয়েও বেশি লেখালিখি নিয়ে মেতে আছে। উনি লিখলেন, " আপনি তার কোন লেখার প্রশংসা করিয়াছিলেন আর তারপর তাকে থামানো যাইতেছে না। এরপর সে আবার যখন লিখিবে তখন আপনি একটু কড়া করে সমালোচনা করবেন। "
এ চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ জানালেন, " সমালোচনার দরকার নেই, রাজশেখর গিল্টি নয় সে একেবারে খাঁটি সোনা "।
এই চোদ্দ নম্বর বাড়িতে প্রায় আড্ডা বসতো। আর তাতে বসু ভাই রা ছাড়াও থাকতেন নজরুল, বিপ্লবী পুলিন দাস, আচার্য্য রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু,মেঘনাদ সাহা এবং আরও অনেকে।
রাজশেখর অবশ্য পরে এই বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি করে উঠে গিয়েছিলেন।
রাজশেখরের ছোট ভাই গিরীন্দ্র শেখর ছিলেন আর এক বিখ্যাত মানুষ। তিনি কলকাতার মানসিক রোগ চিকিৎসার একজন পথিকৃত ও দিকপাল। তিনি জাদুবিদ্যা ও হিপনটিজম শিক্ষা করেছিলেন ও সেটাই মানসিক রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োগ করতেন। তখন ফ্রয়েডের ( সাইকো এনালিসিস) এর কথা ভারতে কেউ জানত না। পরে জানা গিয়েছিল যে গিরীন্দ্র শেখর যে চিকিৎসা প্রণালী উদ্ভাবন করেছিলেন সেটার সঙ্গে ফ্রয়েডের চিকিৎসা পদ্ধতির বেশ কিছু মিল ছিল। তিনি মনোবিজ্ঞানে এম এস সি পরে ডি এস সি ডিগ্রি লাভ করেন। তার লেখা একাধিক বই আছে। তিনি তার বাড়িতেই ভারতীয় মনঃ সমীক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। অনেক নামকরা ডাক্তার ও মানুষ এতে যুক্ত ছিলেন। দাদা রাজশেখরের দান করা জমিতে তিনি গোবরা তে প্রথম মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার সুযোগ্য ভাইপো ডাক্তার বিজয় কেতু বোস তাকে আজীবন সাহায্য করে গেছেন। গিরীন্দ্র র মৃত্যুর পর তার ভাইপো এখানে আজীবন চিকিৎসা করেছেন। এখানে অনেক বড় ডাক্তার আসতেন আর প্রায় নিখরচায় অনেক রোগীর চিকিৎসা করতেন। ডাক্তার বিজয়কেতু কে আমি অনেক দিন কাছ থেকে দেখেছি।