19-09-2021, 09:00 AM
(This post was last modified: 19-09-2021, 10:21 AM by Bichitro. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
Update 4
সঞ্জয়কে কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার বানানোর পর কোম্পানির লাভ হয়েছে খুব। এতে আকাশের বাবা খুব খুশি। এমনকি এতদিনে যে সঞ্জয়ের চরিত্রের কোন বদ গুন তিনি দেখতে পাননি তাতে আরো বেশি খুশি।
একদিন বিকালে অফিসে বসে লাভের হিসাব করার সময় লাভের অঙ্ক দেখে শুভাশীষ বাবুর মুড ভালো হয়ে গেল। সঞ্জয়কে একটা ট্রিট দেওয়ার ইচ্ছা হলো আকাশের বাবার । ঠিক তখনই মনে পড়লো কয়েকদিন পর আকাশের জন্মদিন “ সামনের সোমবার আকাশের জন্মদিন। সন্ধ্যায় আমরা খুব ছোট করে উদযাপন করছি । তোমার পুরো পরিবারকে আসতে হবে কিন্তু ! „ গোধূলির জন্মদিনে সঞ্জয় তাকে সপরিবারে নেমন্তন্ন করেছিল তাই তিনিও সঞ্জয়ের পুরো পরিবারকেই আমন্ত্রণ দিয়ে দিলেন ।
কথাটা শুনেই সঞ্জয়ের চোখ জ্বলে উঠলো । নিজের মেয়ের সাথে আকাশের সম্পর্ক গড়ার যে পরিকল্পনা সে করেছিল তা সফল হতে দেখতে পেলো সঞ্জয় “ অবশ্যই আসবো। আপনি বলছেন আর আমি আসবো না ! এটা কখনো হয় ! „
আকাশের বাবা সঞ্জয় কে তুমি করে বললেও সঞ্জয় এখনও শুভাশীষ বাবুকে আপনি করেই সম্বোধন করে। সঞ্জয় আমন্ত্রণ গ্রহণ করায় আকাশের বাবার ঠোঁটের হাসিটা আরও বড়ো হয়ে গেল।
সোমবার আকাশ কলেজ ছুটি করলো। দুপুর বেলা স্নান করে দিদিমা যে পায়েস বানিয়েছিলেন সেটা সুচি আর সুচির বাবা বাদে সবাই খাইয়ে আশীর্বাদ করলো। কারন সুচি গেছে কলেজে আর সমরেশ বাবু গেছেন অফিসে। সুচি কলেজ থেকে ফিরলেই আকাশ , দিদিমা , আর সুচি আকাশদের ফ্ল্যাটের লিভিংরুম সাজাতে শুরু করলো। লাল নীল হলুদ রঙের তিনটে করে বেলুন দিয়ে সব জায়গায় বাঁধলো। সরু লম্বা রঙিন কাগজ টাঙালো । লিভিংরুমটাকে পুরো অনুষ্ঠান বাড়ির মতো সাজিয়ে তুললো।
সন্ধ্যা সাতটায় কেক কাটার আগেই সোসাইটির যাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তারা চলে এলো । বিপ্লব আর জয়শ্রী ও এলো। বিপ্লব এসেই আকাশের সাথে কয়েকটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি নিয়ে খেলতে শুরু করে দিল।
সুচির মা তো স্নেহা দেবীকে সাহায্য করছিলেন। আর পুরো পরিবার আকাশদের ফ্ল্যাটে থাকায় সুচির বাবা অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে এখানেই চলে আসলেন।
কেক কাটার কয়েক মিনিট আগেই সঞ্জয় চলে এলো সপরিবারে। সুচি আকাশের সব আত্মীয়কেই চেনে। এক মামা ছাড়া তো আর কেউ নেই আকাশের। তাও আবার সেই মামা থাকে মুম্বাইতে। সঞ্জয়দের আগে কখনোই দেখেনি সুচি। তাই ভাবতে লাগলো ‘ এরা কারা ? ‚ গোধূলি এসেই দিদিমাকে প্রণাম করলো । দিদিমা গোধূলির কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন “ থাক মা বড়ো হও। „
দিদিমাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে আকাশের মাকে প্রণাম করার পর আকাশের মা বললেন “ কি মিষ্টি মেয়ে ! „
সুচি প্রথম থেকেই এই মেয়েটাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। একদম পছন্দ হয়নি সুচির। মনে মনে বললো ‘ নাকটা কেমন একটা থ্যাবড়ানো আর গাল দুটো লাল। কেমন একটা দেখতে ! ‚ গোধূলি যখন আকাশের পুরো পরিবারকে প্রণাম করছে তখন সুচি ভাবলো ‘ লোক দেখানো প্রণাম করছে । ‚
সত্যি সত্যি গোধূলি লোক দেখানোই কাজ করছে। রাস্তায় আসতে আসতে সঞ্জয় মেয়েকে বলেছিল “ ওখানে গিয়ে সবাইকে প্রণাম করবে। কেমন আছো জিজ্ঞাসা করবে। „ গোধূলি বাবার কথা মতোই চলছিল।
স্নেহা দেবীকে প্রণাম করার পর আকাশের বাবাকে প্রণাম করে গোধূলি জিজ্ঞাসা করলো “ কেমন আছো আঙ্কেল ? „
“ আমি ভালো আছি । তুমি কেমন আছো ? „
“ আমি খুব ভালো আছি। „ তারপর আকাশের কাছে গিয়ে হাসিমুখে আকাশকে জিজ্ঞাসা করলো “ কেমন আছো তুমি ? „
“ আমি ভালো আছি। আর তুমি ? „
“ আমিও ভালো আছি। বাবা তোমার জন্য একটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি এনেছেন । „ বলে বাবার হাতে ধরে থাকা গিফ্টটা দিয়ে দিল ।
আকাশ বললো “ আমার কাছেও আছে রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি । খেলবে ? „
“ হ্যাঁ আমারও ভালো লাগে রিমোট কন্ট্রোল কার। „
গোধূলির বলা শেষ হতেই আকাশ আর বিপ্লব গোধূলিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু স্নেহা দেবী বাধা দিয়ে বললেন “ না , এখন আর কোন খেলা নয়। আগে কেক কেটে নাও তারপর খেলো । „
মায়ের কথা মতো আকাশ টেবিলের উপর রাখা কেকের উপর বসানো তিনটে মোমবাতি ফু দিয়ে নিভিয়ে কেক কাটলো। সবাই টেবিলটাকে গোল করে ঘিরে দাড়িয়ে happy birthday to you সুর করে বলে উইশ করলো। কেক কাটার পর আকাশ প্রথম টুকরোটা মাকে খাওয়ালো। তারপর একে একে দিদিমা আর বাবাকে খাওয়ালো ।
কেক কাটার পর সবার হাতে রেস্টুরেন্ট থেকে আনা বিভিন্ন খাবারের প্লেট দেখা গেল। কেক খেয়ে গোধূলি বাদশার সাথে খেলা শুরু করলো। এটা সুচির একদম পছন্দ হলো না। হয়তো বাদশার ও পছন্দ হলো না তাই সে দিদিমা আর আকাশ যে ঘরে ঘুমায় সেই ঘরে ঢুকে নিজের মাথা দিয়ে ঠেলে দরজা ভেরিয়ে দিল ।
এই ফাঁকে সুচি আকাশকে একটা কোনায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ ওই মেয়েটা কে রে ? „
“ ও তো গোধূলি। ওই যার জন্মদিনে আগের বছর গিয়েছিলাম। „ এবার সুচির মনে পড়লো ‘ এই সেই মেয়েটা যার প্রশংসা আকাশ করছিল। আর সেই জন্য আকাশকে চড় ও মেরেছিল সে। ‚
আকাশের সাথে কথা বলার মাঝেই দিদিমা এসে বললেন “ চল আজকে সবাইকে তোর একটা নাচ দেখা। „
“ এখন ? „
“ এখন নয় তো কখন আবার ? দেখ কতো লোক এসেছে। আর আকাশের আজকে জন্মদিন। একটা নাচ শুধু। „
দিদিমার অনুরোধ সুচি ফেলতে পারলো না। বাবার কিনে দেওয়া ipad চালিয়ে বাড়িতে মাঝে মাঝে নাচের অভ্যাস করে সুচি । সেই iPad নিজের ঘর থেকে এনে সেটা চালালো। সুচি পড়েছিল একটা হলুদ রঙের চুড়িদার আর আর লাল রঙের লেগিংস। সেই ড্রেস পড়েই সুচি নাচলো ---
নাচ শেষ হতেই সবাই হাততালি দিয়ে খুব প্রশংসা করলো। গোধূলি হাততালি দিয়ে বলে উঠলো “ খুব সুন্দর নাচো তুমি। প্লিজ আর একটা গানে নাচো ! „
গোধূলি প্লিজ বললেও সুচি সেটা শুনতে পেলো না। সুচির মনে হলো সে যেন তাকে আদেশ করছে। গা জ্বলে উঠলো গোধূলির কথায়। একেই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারছিল না। এখন আবার আদেশ করছে। সুচি কিছু বলার আগেই গোধূলির মা বলে উঠলেন “ আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে এসছে। কালকে তোমার কলেজ আছে না ! এবার বাড়ি চলো। „
স্নেহা দেবী সেটা শুনতে পেয়ে বললেন “ এ মা ! কি বলছেন ! আপনারা তো কিছুই খাননি ! „বলে একটা কবিরাজির প্লেট ধরিয়ে দিলেন হাতে।
গোধূলির মায়ের খাবার সময় সুচি ভাবলো ‘ একটু দুষ্টুমি করলে কেমন হয় ! কি করা যায় ? ‚ কি করা যায় ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। মাথায় বুদ্ধিটা আসতেই ঠোঁটে একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে সে নিচে নেমে গেল। নিচে নেমে সুচি দেখলো আকাশদের জাগুয়ারের পাশেই একটা সাদা BMW দাড়িয়ে আছে। তার দুটো চাকায় সুচি হাত স্পর্শ করলো ।
কিছুক্ষণ পর সঞ্জয়, গোধূলি আর গোধূলির মা চারুলতা নেমে এলো। সঞ্জয় এসে গাড়ির দরজা খোলার সময় দেখতে পেলো ডানদিকের সামনের চাকায় একদম হাওয়া নেই। খুব অবাক হলো সঞ্জয় “ একি ? „
চারুলতা জিজ্ঞাসা করলো “ কি হলো ? „
“ চাকায় হাওয়া নেই। মনে হচ্ছে পাংচার হয়ে গেছে। এখন এক্সট্রা চাকা বার করে লাগাতে হবে। „ তারপর সঞ্জয় গাড়ির ডিকি খুলে আরও একটা চাকা বার করার সময় দেখতে পেলো পিছনের বাম দিকের চাকায়ও একদম হাওয়া নেই । এবার সঞ্জয় বুঝলো এটা কেউ ইচ্ছা করে করেছে । সঞ্জয় এবার চারটে চাকাই চেক করলো। দুটো চাকার হাওয়া কেউ একজন খুলেছে সঙ্গে চেঁচামিচি শুরু করে দিল । প্রথমে আকাশের বাবাকে ফোন করে বললো “ এ কি ধরনের ইয়ার্কি বলুন তো ! „
“ কেন ? কি হয়েছে ? „
“ কি আবার হবে ? কেউ আমার দুটো চাকার ভাল্ব খুলে দিয়েছে । „ আকাশের বাবার সাথে গলার স্বর নিচে নামিয়েই কথা বললো সঞ্জয়। কিন্তু স্বরে ঝাঝ এখনও বর্তমান।
“ কি বলছো ? আমি আসছি । „
“ কি হলো ? „ আকাশের বাবা ফোনটা রাখতেই আকাশের মা জিজ্ঞাসা করলেন ।
“ কেউ একজন সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া খুলে দিয়েছে । „ বলে নিচে নেমে এলেন আকাশের বাবা । আকাশের বাবার সাথেই আকাশ , আকাশের মা, , সুচি , সুচির মা ও বাবা , সুমি , জয়শ্রী সবাই নিচে নেমে এলো ।
“ কে এমন করেছে জানতে চাই আমি । এটা কি ভদ্রলোকের পাড়া ? এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি। „ সঞ্জয়ের এইসব চেঁচামিচিতে এতক্ষণে আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবাই জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলো। আকাশের বাবা নিচে নামতেই সঞ্জয় বললো “ দেখুন কি অবস্থা ! „
চারুলতা স্বামীকে বললো “ আহা একটু শান্ত হও। „
আকাশের বাবা গাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। সত্যি সামনের ডানদিকের আর পিছনের বামদিকের চাকার হাওয়া খোলা। এতক্ষনে সুচি দিদিমা আকাশ বাকি সবাই নিচে নেমে এসে জটলা পাকিয়েছে। সুচির মুখে এখনও দুষ্টুমির হাসি।
আকাশের বাবা গাড়ির চাকা দেখার পর কোমরে দুই হাত দিয়ে দাড়িয়ে পড়লেন। সঞ্জয় তো রেগে অগ্নিশর্মা “ আমি পুলিশ ডাকবো। কে এইরকম নিচ ইয়ার্কি মারলো সেটা আমি জানতে চাই । „
পুলিশ ডাকবে শুনেই ভয়ে সুচির বুক শুকিয়ে গেল। হৃদপিণ্ড টা আরও দ্রুত চলতে শুরু করলো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেল নিমেষেই।
দিদিমার একটু সন্দেহ হয়েছিল এটা সুচি করেছে। এখন সুচির দিকে তাকিয়ে তার মুখে ভয়ের ছাপ দেখে তিনি শিওর হলেন সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া সুচিই খুলেছে। তাই তিনি সুচিকে বাঁচানোর জন্য বললেন “ এই রাত দুপুরে পুলিশ আসলে সোসাইটির লোকের অসুবিধা হবে। যে করেছে তার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । „
দিদিমা সুচির জন্য ক্ষমা চাইছেন। শুধু তার এই দুষ্টুমিরর জন্য দিদিমার মাথা নিচু হলো। লজ্জায় ঘৃণায় চোখে জল চলে এলো সুচির । এতোটা কষ্ট কখনো হয়নি সুচির। মা বাবার বকুনিতে , কলেজে টিচারের বকুনিতেও এতোটা কষ্ট হয়না যতোটা আজ হচ্ছে । নিজের উপর শুধু ঘৃণাই নয় সাথে রাগ হলো খুব। কেন করতে গেল এই কাজ ? এখন খুব অপমান বোধ ও হলো সুচির। মাথা নিচু হয়ে আছে , সেই মাথা আর তোলার ইচ্ছা হচ্ছে না ।
দিদিমার ক্ষমা চাওয়ায় সবাই একটু অবাক হলো। সুচির মা ভাবলেন ‘ সুচি কিছু করেনি তো ! ‚ তারপর চারিদিকে সুচিকে খুজলেন কিন্তু পেলেন না। কারন সুচি দিদিমার অন্যদিকে দাড়িয়ে আছে। তাই দিদিমা সুচিকে দেখতে পেলেও সুচেতা দেবী দেখতে পেলেন না। সুচিকে দেখতে না পেয়ে সুচেতা দেবী আবার ভাবলেন ‘ না, না, আমার মেয়ে এরকম করবে না। মাসিমা হয়তো প্রতিবেশীদের কাছে ছোট হওয়ার ভয়ে ক্ষমা চাইছেন। ‚
দিদিমার ক্ষমা চাওয়ায় সঞ্জয় এবার শান্ত হলো “ না , না , কোন এক ছ্যাঁচড়ার জন্য আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন ? „
সঞ্জয়ের কথা শেষ হতেই আকাশের বাবা বললেন “ এতো রাতে কোন গ্যারেজ খোলা থাকবে না। আর আশেপাশে কোন গ্যারেজ নেইও। তুমি আমার গাড়িটা নিয়ে যাও । „
এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। আকাশের বাবা উপরে উঠে জাগুয়ারের চাবি নিয়ে এসে সঞ্জয় কে দিয়ে দিলেন। সঞ্জয় আর কোন রাস্তা নেই দেখে জাগুয়ারের চাবি নিয়ে নিল। চাবি দেওয়ার সময় আকাশের বাবা বললেন “ কালকে আমি তোমার গাড়ি অফিসে নিয়ে যাবো ওখান থেকেই নিয়ে নিও । „
এতক্ষণ আশেপাশে সবার মুখে একটাই কথা ছিল “ কে এমন করলো ? আগে তো কখনো এরকম হয়নি ! এ কি শুরু হলো রে বাবা ! „ নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ ফিসফিসিয়ে কথা বলার পর যে যার মতো বাড়ি চলে গেল। সুচি বিছানায় গা এলিয়ে দিলেও ঘুম এলো না। মাথায় শুধু একটাই কথা যেটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে ‘ আজ তার এই দুষ্টুমির জন্য দিদিমাকে ক্ষমা চাইতে হলো। ‚ শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লো সুচি। যখন উঠলো তখন মাথা ভারি।
কলেজে গিয়ে পড়ায় মন বসলো না। নিজেকে এখনও ক্ষমা করতে পারেনি সে। বারবার তার মাথায় শুধু এটাই ঘুরছে যে ‘ তার জন্যেই দিদিমাকে ক্ষমা চাইতে হলো। ‚ সারাদিন গোমড়া মুখেই কাটালো সে।
কলেজ থেকে ফিরে নিজের ঘরে না গিয়ে কলেজ ড্রেস পড়া অবস্থাতেই সোজা দিদিমার ঘরে গিয়ে বসলো সুচি। দিদিমা ভাতঘুম দিয়েছিলেন। এই সবে উঠে বসেছেন । ঠিক তখনই সুচি এলো। সুচির মুখ দেখেই দিদিমা বুঝলেন সুচি কাল রাতের ঘটনার জন্য এখনও লজ্জিত। তাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন “ সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া.....
দিদিমাকে আর বলতে দিল না সুচি। কথা শেষ হওয়ার আগেই সুচি ফুপিয়ে কেঁদে উঠে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলো “ কাল তুমি ক্ষমা চাইলে কেন ? „ সুচির চোখের জলে দিদিমার বুকের শাড়ি ভিজতে শুরু করে দিল ।
“ সঞ্জয় যে পুলিশ ডাকতো। তখন কি হতো বলতো ? „ সুচি কিছু বললো না। উত্তর না দিয়ে সুচি দিদিমাকে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। “ তোর কিছু হতে দিতে পারি আমি বল ! তোকে আমি যে খুব ভালোবাসি । „
কিছুক্ষণ সুচির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন দিদিমা । তারপর সুচির কান্না কিছুটা কমলে দিদিমা বললেন “ আর কখনো এরকম কাজ করবি ? „
কান্নার জন্য দম বন্ধ হয়ে আসছিল সুচির। বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে নিতে চোখের জল ফেলে বললো “ আর কখনো এরকম করবো না দিম্মা । এমন কিছুই করবো না যাতে তোমাকে ক্ষমা চাইতে হয় । তোমাদের মাথা নিচু হয় এরকম আর কোন কাজ করবো দিম্মা । „
“ আর কাউকে মারবি বল ? „
“ আর কাউকে মারবো না। কখনো না । „ ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো সুচি । সুচির চোখের জলে দিদিমার বুকের শাড়ি ভিজে গেছে ।
“ আমার সোনা মেয়ে। „ বলে সুচির মাথার ঘন চুলের উপরেই একটা চুমু খেয়ে মুখটা তুলে চোখের জল মুছিয়ে দিলেন “ বোকা মেয়ে কাঁদছে দেখো। আর কাঁদে না। একদম না। „ তারপর কিছুক্ষণ সুচির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে সুচির মাথায় নিজের থুতনি রেখে দিদিমা আরও, বললেন “ বড়ো হয়েছিস তুই। এখন আর তুই আমার সেই ছোট্ট সুচি নেই। আর কোন দুষ্টুমি করিস না। দুষ্টুমি করার বয়স পেরিয়ে গেছে তোর। মা বাবার খেয়াল রাখ । নিজের যত্ন নে। এইসব দুষ্টুমি ছেড়ে এবার পড়াশোনায় মন দে। .......
দিদিমার কথায় সুচি কান্না থামালো । দিদিমাকে জড়িয়ে ধরেই মনে মনে প্রতিঙ্গা করলো ‘ আর কখনো এমন কাজ করবো না যার জন্য তোমাদের ক্ষমা চাইতে হয়। ‚
কয়েক দিন ধরেই সবাই লক্ষ্য করছে বাদশা আগের থেকেও বেশি শান্ত হয়ে গেছে। সারাদিন চুপচাপ একটা জায়গায় শুয়ে থাকে। আগের মতো খায় না আর। বাদশার অবস্থা দেখে সুচি নিজের মন শক্ত করতে শুরু করলো।
একদিন সকালবেলা উঠে যে যার নিত্যদিনের কাজ করতে লাগলো। স্নেহা দেবী সকালের ব্রেকফাস্ট বানাতে লেগে গেলেন। আকাশের বাবা স্নানে চলে গেছেন। আকাশ সকাল সকাল উঠে টিভি দেখতে বসে গেছে। দিদিমা বাসি বিছানা গুছিয়ে এসে আকাশকে বললেন “ সকাল সকাল তুই টিভি দেখতে বসে গেলি ? মা বকবে কিন্তু ! পড়তে বস গিয়ে। „
দিদিমার কথায় আকাশ পড়তে বসলো। কিছুক্ষণ পর রোদ প্রখর হয়ে উঠলে দিদিমা আকাশকে নিয়ে তার দুটো আচারের বয়াম গুলো ছাদে শুকোতে নিয়ে গেলেন। কাচের বয়াম গুলো অবশ্য আকাশ নিয়ে গেল। সুচি আচার খাওয়ার ওস্তাদ বলা যায়। নিমেষেই একটা বড়ো জামবাটি খালি করে দেয়। দিদিমা সুচির জন্যেই সারা বছরে কোন না কোন আচার বানান।
ছাদের একটা কোনায় বয়াম গুলো রাখার সময় আকাশের খেয়াল হলো --- আজকে বাদশা তো উপরে এলো না।
বয়াম রাখার পর দিদিমা আর আকাশ নিচে নেমে গেল। নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে “ বাদশা বাদশা „ বলে ডাকতে ডাকতে লিভিংরুমে যেখানে বাদশা ঘুমায় সেখানে চলে গেল। আকাশ কিন্তু বাদশার কোন সাড়াশব্দ পেলো না ।
বাদশার জন্য একটা বড়ো বাস্কেটে একটা তোয়ালে বিছিয়ে রেখে ঘুমানোর উপযুক্ত বানানো হয়েছে। বাদশা সেখানেই ঘুমিয়ে আছে।
বাদশার কাছে গিয়ে আকাশ দেখলো বাদশার মুখ খোলা আর মুখের ভিতর কয়েকটা পিঁপড়ে। সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে দিদিমার কাছে গিয়ে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল। স্নেহা দেবী ছেলের কান্না দেখে জিজ্ঞাসা করলেন “ কাঁদছিস কেন ? „
আকাশ কিছু বললো না কাঁদতে কাঁদতে শুধু আঙুল দিয়ে বাদশার দিকে দেখিয়ে দিল । স্নেহা দেবী সেখানে গিয়ে দেখলেন বাদশার শরীর পড়ে আছে। প্রান নেই সেই শরীরে। বাদশার মৃত দেহ দেখে স্নেহা দেবীর মনটা ভারী হয়ে এলো। কম করে হলেও এগারো বছর বাদশা এই পরিবারের এক সদস্য ছিল।
আকাশের বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথার ভেজা চুল মুছতে মুছতে বাদশাকে দেখলেন। কিছুক্ষণ পর সুচি এলো। ঘরে ঢুকতেই বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। মন কু ডাক ডাকলো। বাদশার কাছে গিয়ে দেখলো বাদশার মৃত শরীর । সুচি কাঁদলো না। এরকম হবে সেটা আন্দাজ করেছিল। তাই মন শক্ত করতে শুরু করে দিয়েছিল আগে থেকেই।
কিছুক্ষণ বাদশার সোনালী দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখের ভিতর পিঁপড়ে গুলো সরিয়ে দিতে লাগলো। বাদশার শরীরে পিঁপড়ে দেখে তার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।
সুচির তখন চার বছর বয়স। তখনও সে তোতলায়। আকাশ সবে হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করেছে। সকালে আকাশের সাথে খেলা করার পর সুচি বাদশাকে নিয়ে নিচে পার্কে চলে যেত খেলতে। তেমনি একদিন সুচি আর জয়শ্রী মাটি দিয়ে বানানো বিভিন্ন বাসনপত্র নিয়ে রান্নাঘর খেলছিল পার্কের মধ্যে। বিভিন্ন পাতা কুচি কুচি করে শাকসব্জি বানিয়ে ছিল। বাদশার তার ছোট শরীর নিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে এদিক এদিক দৌড়োচ্ছিল ।
হঠাৎ একটা ফড়িং দেখতে পেয়ে সেটাকেই তাড়া করলো বাদশা । কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ফড়িং টাকে তাড়া করার পর বাদশার পা গিয়ে পড়লো পিঁপড়ের ঢিবির উপর । সঙ্গে সঙ্গে লাল পিঁপড়ে ছেকে ধরলো বাদশার পা। অজস্র কামড়ের জ্বালায় ঘেউ ঘেউ ডাক আরও বেড়ে গেল , আর স্বরটা আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো ।
সুচি আর জয়শ্রী এগিয়ে এসে বাদশার পা থেকে পিঁপড়ে গুলো সরিয়ে ফেলে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সুচি বাদশাকে বললো “ লাল পিপলে দুষ্তু হয়। কালো পিপলে ভালো হয়। লাল পিপলেল কাছে যাবি না , ওলা সুধু কামলায় । „ সুচির কথা বাদশা বোঝে নি। কিন্তু পিঁপড়ের জ্বালা থেকে মুক্তি পেয়ে বাদশা সুচির ছোট সুন্দর কোমল মুখটা চেটে দিল।
এই ঘটনা মনে পড়তেই সুচির চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো। সাথে আরো অজস্র ঘটনা মনে পড়তেই কেঁদে ফেললো সুচি।
আকাশের বাবা অর্ধেক দিনের ছুটি নিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন বাদশাকে কোন একটা খালে গিয়ে ফেলে আসবেন কিন্তু সেটা করলে সুচি আকাশ দুজনেই দুঃখ পাবে। তাই তিনি বাচ্চাদের পার্কের একটা কোনায় বাদশাকে কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
দুপুরে স্নান খাওয়ার আগে সুচি আকাশ আর আকাশের বাবা পার্কের একটা কোনায় বাদশাকে কবর দিয়ে দিল। সুচি আর আকাশ কবরের উপরে একটা গোলাপ চারা লাগিয়ে দিল। এই চারা একদিন বড়ো হয়ে গাছ হবে। সেই গাছে ফুটবে সুন্দর সুন্দর গোলাপ ফুল। ভালোবাসার প্রতীক এই গোলাপ ফুল।
সঞ্জয়কে কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার বানানোর পর কোম্পানির লাভ হয়েছে খুব। এতে আকাশের বাবা খুব খুশি। এমনকি এতদিনে যে সঞ্জয়ের চরিত্রের কোন বদ গুন তিনি দেখতে পাননি তাতে আরো বেশি খুশি।
একদিন বিকালে অফিসে বসে লাভের হিসাব করার সময় লাভের অঙ্ক দেখে শুভাশীষ বাবুর মুড ভালো হয়ে গেল। সঞ্জয়কে একটা ট্রিট দেওয়ার ইচ্ছা হলো আকাশের বাবার । ঠিক তখনই মনে পড়লো কয়েকদিন পর আকাশের জন্মদিন “ সামনের সোমবার আকাশের জন্মদিন। সন্ধ্যায় আমরা খুব ছোট করে উদযাপন করছি । তোমার পুরো পরিবারকে আসতে হবে কিন্তু ! „ গোধূলির জন্মদিনে সঞ্জয় তাকে সপরিবারে নেমন্তন্ন করেছিল তাই তিনিও সঞ্জয়ের পুরো পরিবারকেই আমন্ত্রণ দিয়ে দিলেন ।
কথাটা শুনেই সঞ্জয়ের চোখ জ্বলে উঠলো । নিজের মেয়ের সাথে আকাশের সম্পর্ক গড়ার যে পরিকল্পনা সে করেছিল তা সফল হতে দেখতে পেলো সঞ্জয় “ অবশ্যই আসবো। আপনি বলছেন আর আমি আসবো না ! এটা কখনো হয় ! „
আকাশের বাবা সঞ্জয় কে তুমি করে বললেও সঞ্জয় এখনও শুভাশীষ বাবুকে আপনি করেই সম্বোধন করে। সঞ্জয় আমন্ত্রণ গ্রহণ করায় আকাশের বাবার ঠোঁটের হাসিটা আরও বড়ো হয়ে গেল।
সোমবার আকাশ কলেজ ছুটি করলো। দুপুর বেলা স্নান করে দিদিমা যে পায়েস বানিয়েছিলেন সেটা সুচি আর সুচির বাবা বাদে সবাই খাইয়ে আশীর্বাদ করলো। কারন সুচি গেছে কলেজে আর সমরেশ বাবু গেছেন অফিসে। সুচি কলেজ থেকে ফিরলেই আকাশ , দিদিমা , আর সুচি আকাশদের ফ্ল্যাটের লিভিংরুম সাজাতে শুরু করলো। লাল নীল হলুদ রঙের তিনটে করে বেলুন দিয়ে সব জায়গায় বাঁধলো। সরু লম্বা রঙিন কাগজ টাঙালো । লিভিংরুমটাকে পুরো অনুষ্ঠান বাড়ির মতো সাজিয়ে তুললো।
সন্ধ্যা সাতটায় কেক কাটার আগেই সোসাইটির যাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তারা চলে এলো । বিপ্লব আর জয়শ্রী ও এলো। বিপ্লব এসেই আকাশের সাথে কয়েকটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি নিয়ে খেলতে শুরু করে দিল।
সুচির মা তো স্নেহা দেবীকে সাহায্য করছিলেন। আর পুরো পরিবার আকাশদের ফ্ল্যাটে থাকায় সুচির বাবা অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে এখানেই চলে আসলেন।
কেক কাটার কয়েক মিনিট আগেই সঞ্জয় চলে এলো সপরিবারে। সুচি আকাশের সব আত্মীয়কেই চেনে। এক মামা ছাড়া তো আর কেউ নেই আকাশের। তাও আবার সেই মামা থাকে মুম্বাইতে। সঞ্জয়দের আগে কখনোই দেখেনি সুচি। তাই ভাবতে লাগলো ‘ এরা কারা ? ‚ গোধূলি এসেই দিদিমাকে প্রণাম করলো । দিদিমা গোধূলির কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন “ থাক মা বড়ো হও। „
দিদিমাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে আকাশের মাকে প্রণাম করার পর আকাশের মা বললেন “ কি মিষ্টি মেয়ে ! „
সুচি প্রথম থেকেই এই মেয়েটাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। একদম পছন্দ হয়নি সুচির। মনে মনে বললো ‘ নাকটা কেমন একটা থ্যাবড়ানো আর গাল দুটো লাল। কেমন একটা দেখতে ! ‚ গোধূলি যখন আকাশের পুরো পরিবারকে প্রণাম করছে তখন সুচি ভাবলো ‘ লোক দেখানো প্রণাম করছে । ‚
সত্যি সত্যি গোধূলি লোক দেখানোই কাজ করছে। রাস্তায় আসতে আসতে সঞ্জয় মেয়েকে বলেছিল “ ওখানে গিয়ে সবাইকে প্রণাম করবে। কেমন আছো জিজ্ঞাসা করবে। „ গোধূলি বাবার কথা মতোই চলছিল।
স্নেহা দেবীকে প্রণাম করার পর আকাশের বাবাকে প্রণাম করে গোধূলি জিজ্ঞাসা করলো “ কেমন আছো আঙ্কেল ? „
“ আমি ভালো আছি । তুমি কেমন আছো ? „
“ আমি খুব ভালো আছি। „ তারপর আকাশের কাছে গিয়ে হাসিমুখে আকাশকে জিজ্ঞাসা করলো “ কেমন আছো তুমি ? „
“ আমি ভালো আছি। আর তুমি ? „
“ আমিও ভালো আছি। বাবা তোমার জন্য একটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি এনেছেন । „ বলে বাবার হাতে ধরে থাকা গিফ্টটা দিয়ে দিল ।
আকাশ বললো “ আমার কাছেও আছে রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি । খেলবে ? „
“ হ্যাঁ আমারও ভালো লাগে রিমোট কন্ট্রোল কার। „
গোধূলির বলা শেষ হতেই আকাশ আর বিপ্লব গোধূলিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু স্নেহা দেবী বাধা দিয়ে বললেন “ না , এখন আর কোন খেলা নয়। আগে কেক কেটে নাও তারপর খেলো । „
মায়ের কথা মতো আকাশ টেবিলের উপর রাখা কেকের উপর বসানো তিনটে মোমবাতি ফু দিয়ে নিভিয়ে কেক কাটলো। সবাই টেবিলটাকে গোল করে ঘিরে দাড়িয়ে happy birthday to you সুর করে বলে উইশ করলো। কেক কাটার পর আকাশ প্রথম টুকরোটা মাকে খাওয়ালো। তারপর একে একে দিদিমা আর বাবাকে খাওয়ালো ।
কেক কাটার পর সবার হাতে রেস্টুরেন্ট থেকে আনা বিভিন্ন খাবারের প্লেট দেখা গেল। কেক খেয়ে গোধূলি বাদশার সাথে খেলা শুরু করলো। এটা সুচির একদম পছন্দ হলো না। হয়তো বাদশার ও পছন্দ হলো না তাই সে দিদিমা আর আকাশ যে ঘরে ঘুমায় সেই ঘরে ঢুকে নিজের মাথা দিয়ে ঠেলে দরজা ভেরিয়ে দিল ।
এই ফাঁকে সুচি আকাশকে একটা কোনায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ ওই মেয়েটা কে রে ? „
“ ও তো গোধূলি। ওই যার জন্মদিনে আগের বছর গিয়েছিলাম। „ এবার সুচির মনে পড়লো ‘ এই সেই মেয়েটা যার প্রশংসা আকাশ করছিল। আর সেই জন্য আকাশকে চড় ও মেরেছিল সে। ‚
আকাশের সাথে কথা বলার মাঝেই দিদিমা এসে বললেন “ চল আজকে সবাইকে তোর একটা নাচ দেখা। „
“ এখন ? „
“ এখন নয় তো কখন আবার ? দেখ কতো লোক এসেছে। আর আকাশের আজকে জন্মদিন। একটা নাচ শুধু। „
দিদিমার অনুরোধ সুচি ফেলতে পারলো না। বাবার কিনে দেওয়া ipad চালিয়ে বাড়িতে মাঝে মাঝে নাচের অভ্যাস করে সুচি । সেই iPad নিজের ঘর থেকে এনে সেটা চালালো। সুচি পড়েছিল একটা হলুদ রঙের চুড়িদার আর আর লাল রঙের লেগিংস। সেই ড্রেস পড়েই সুচি নাচলো ---
ফাগুনেরও মোহনায়
ফাগুনেরও মোহনায় মন মাতানো মহুয়ায়
রঙ্গীন এ বিহুর নেশা কোন আকাশে নিয়ে যায়
ফাগুনেরও মোহনায়
ফাগুনেরও মোহনায় মন মাতানো মহুয়ায়
রঙ্গীন এ বিহুর নেশা কোন আকাশে নিয়ে যায়
ফাগুনেরও মোহনায়
নাচ শেষ হতেই সবাই হাততালি দিয়ে খুব প্রশংসা করলো। গোধূলি হাততালি দিয়ে বলে উঠলো “ খুব সুন্দর নাচো তুমি। প্লিজ আর একটা গানে নাচো ! „
গোধূলি প্লিজ বললেও সুচি সেটা শুনতে পেলো না। সুচির মনে হলো সে যেন তাকে আদেশ করছে। গা জ্বলে উঠলো গোধূলির কথায়। একেই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারছিল না। এখন আবার আদেশ করছে। সুচি কিছু বলার আগেই গোধূলির মা বলে উঠলেন “ আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে এসছে। কালকে তোমার কলেজ আছে না ! এবার বাড়ি চলো। „
স্নেহা দেবী সেটা শুনতে পেয়ে বললেন “ এ মা ! কি বলছেন ! আপনারা তো কিছুই খাননি ! „বলে একটা কবিরাজির প্লেট ধরিয়ে দিলেন হাতে।
গোধূলির মায়ের খাবার সময় সুচি ভাবলো ‘ একটু দুষ্টুমি করলে কেমন হয় ! কি করা যায় ? ‚ কি করা যায় ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। মাথায় বুদ্ধিটা আসতেই ঠোঁটে একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে সে নিচে নেমে গেল। নিচে নেমে সুচি দেখলো আকাশদের জাগুয়ারের পাশেই একটা সাদা BMW দাড়িয়ে আছে। তার দুটো চাকায় সুচি হাত স্পর্শ করলো ।
কিছুক্ষণ পর সঞ্জয়, গোধূলি আর গোধূলির মা চারুলতা নেমে এলো। সঞ্জয় এসে গাড়ির দরজা খোলার সময় দেখতে পেলো ডানদিকের সামনের চাকায় একদম হাওয়া নেই। খুব অবাক হলো সঞ্জয় “ একি ? „
চারুলতা জিজ্ঞাসা করলো “ কি হলো ? „
“ চাকায় হাওয়া নেই। মনে হচ্ছে পাংচার হয়ে গেছে। এখন এক্সট্রা চাকা বার করে লাগাতে হবে। „ তারপর সঞ্জয় গাড়ির ডিকি খুলে আরও একটা চাকা বার করার সময় দেখতে পেলো পিছনের বাম দিকের চাকায়ও একদম হাওয়া নেই । এবার সঞ্জয় বুঝলো এটা কেউ ইচ্ছা করে করেছে । সঞ্জয় এবার চারটে চাকাই চেক করলো। দুটো চাকার হাওয়া কেউ একজন খুলেছে সঙ্গে চেঁচামিচি শুরু করে দিল । প্রথমে আকাশের বাবাকে ফোন করে বললো “ এ কি ধরনের ইয়ার্কি বলুন তো ! „
“ কেন ? কি হয়েছে ? „
“ কি আবার হবে ? কেউ আমার দুটো চাকার ভাল্ব খুলে দিয়েছে । „ আকাশের বাবার সাথে গলার স্বর নিচে নামিয়েই কথা বললো সঞ্জয়। কিন্তু স্বরে ঝাঝ এখনও বর্তমান।
“ কি বলছো ? আমি আসছি । „
“ কি হলো ? „ আকাশের বাবা ফোনটা রাখতেই আকাশের মা জিজ্ঞাসা করলেন ।
“ কেউ একজন সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া খুলে দিয়েছে । „ বলে নিচে নেমে এলেন আকাশের বাবা । আকাশের বাবার সাথেই আকাশ , আকাশের মা, , সুচি , সুচির মা ও বাবা , সুমি , জয়শ্রী সবাই নিচে নেমে এলো ।
“ কে এমন করেছে জানতে চাই আমি । এটা কি ভদ্রলোকের পাড়া ? এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি। „ সঞ্জয়ের এইসব চেঁচামিচিতে এতক্ষণে আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবাই জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলো। আকাশের বাবা নিচে নামতেই সঞ্জয় বললো “ দেখুন কি অবস্থা ! „
চারুলতা স্বামীকে বললো “ আহা একটু শান্ত হও। „
আকাশের বাবা গাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। সত্যি সামনের ডানদিকের আর পিছনের বামদিকের চাকার হাওয়া খোলা। এতক্ষনে সুচি দিদিমা আকাশ বাকি সবাই নিচে নেমে এসে জটলা পাকিয়েছে। সুচির মুখে এখনও দুষ্টুমির হাসি।
আকাশের বাবা গাড়ির চাকা দেখার পর কোমরে দুই হাত দিয়ে দাড়িয়ে পড়লেন। সঞ্জয় তো রেগে অগ্নিশর্মা “ আমি পুলিশ ডাকবো। কে এইরকম নিচ ইয়ার্কি মারলো সেটা আমি জানতে চাই । „
পুলিশ ডাকবে শুনেই ভয়ে সুচির বুক শুকিয়ে গেল। হৃদপিণ্ড টা আরও দ্রুত চলতে শুরু করলো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেল নিমেষেই।
দিদিমার একটু সন্দেহ হয়েছিল এটা সুচি করেছে। এখন সুচির দিকে তাকিয়ে তার মুখে ভয়ের ছাপ দেখে তিনি শিওর হলেন সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া সুচিই খুলেছে। তাই তিনি সুচিকে বাঁচানোর জন্য বললেন “ এই রাত দুপুরে পুলিশ আসলে সোসাইটির লোকের অসুবিধা হবে। যে করেছে তার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । „
দিদিমা সুচির জন্য ক্ষমা চাইছেন। শুধু তার এই দুষ্টুমিরর জন্য দিদিমার মাথা নিচু হলো। লজ্জায় ঘৃণায় চোখে জল চলে এলো সুচির । এতোটা কষ্ট কখনো হয়নি সুচির। মা বাবার বকুনিতে , কলেজে টিচারের বকুনিতেও এতোটা কষ্ট হয়না যতোটা আজ হচ্ছে । নিজের উপর শুধু ঘৃণাই নয় সাথে রাগ হলো খুব। কেন করতে গেল এই কাজ ? এখন খুব অপমান বোধ ও হলো সুচির। মাথা নিচু হয়ে আছে , সেই মাথা আর তোলার ইচ্ছা হচ্ছে না ।
দিদিমার ক্ষমা চাওয়ায় সবাই একটু অবাক হলো। সুচির মা ভাবলেন ‘ সুচি কিছু করেনি তো ! ‚ তারপর চারিদিকে সুচিকে খুজলেন কিন্তু পেলেন না। কারন সুচি দিদিমার অন্যদিকে দাড়িয়ে আছে। তাই দিদিমা সুচিকে দেখতে পেলেও সুচেতা দেবী দেখতে পেলেন না। সুচিকে দেখতে না পেয়ে সুচেতা দেবী আবার ভাবলেন ‘ না, না, আমার মেয়ে এরকম করবে না। মাসিমা হয়তো প্রতিবেশীদের কাছে ছোট হওয়ার ভয়ে ক্ষমা চাইছেন। ‚
দিদিমার ক্ষমা চাওয়ায় সঞ্জয় এবার শান্ত হলো “ না , না , কোন এক ছ্যাঁচড়ার জন্য আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন ? „
সঞ্জয়ের কথা শেষ হতেই আকাশের বাবা বললেন “ এতো রাতে কোন গ্যারেজ খোলা থাকবে না। আর আশেপাশে কোন গ্যারেজ নেইও। তুমি আমার গাড়িটা নিয়ে যাও । „
এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। আকাশের বাবা উপরে উঠে জাগুয়ারের চাবি নিয়ে এসে সঞ্জয় কে দিয়ে দিলেন। সঞ্জয় আর কোন রাস্তা নেই দেখে জাগুয়ারের চাবি নিয়ে নিল। চাবি দেওয়ার সময় আকাশের বাবা বললেন “ কালকে আমি তোমার গাড়ি অফিসে নিয়ে যাবো ওখান থেকেই নিয়ে নিও । „
এতক্ষণ আশেপাশে সবার মুখে একটাই কথা ছিল “ কে এমন করলো ? আগে তো কখনো এরকম হয়নি ! এ কি শুরু হলো রে বাবা ! „ নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ ফিসফিসিয়ে কথা বলার পর যে যার মতো বাড়ি চলে গেল। সুচি বিছানায় গা এলিয়ে দিলেও ঘুম এলো না। মাথায় শুধু একটাই কথা যেটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে ‘ আজ তার এই দুষ্টুমির জন্য দিদিমাকে ক্ষমা চাইতে হলো। ‚ শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লো সুচি। যখন উঠলো তখন মাথা ভারি।
কলেজে গিয়ে পড়ায় মন বসলো না। নিজেকে এখনও ক্ষমা করতে পারেনি সে। বারবার তার মাথায় শুধু এটাই ঘুরছে যে ‘ তার জন্যেই দিদিমাকে ক্ষমা চাইতে হলো। ‚ সারাদিন গোমড়া মুখেই কাটালো সে।
কলেজ থেকে ফিরে নিজের ঘরে না গিয়ে কলেজ ড্রেস পড়া অবস্থাতেই সোজা দিদিমার ঘরে গিয়ে বসলো সুচি। দিদিমা ভাতঘুম দিয়েছিলেন। এই সবে উঠে বসেছেন । ঠিক তখনই সুচি এলো। সুচির মুখ দেখেই দিদিমা বুঝলেন সুচি কাল রাতের ঘটনার জন্য এখনও লজ্জিত। তাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন “ সঞ্জয়ের গাড়ির চাকার হাওয়া.....
দিদিমাকে আর বলতে দিল না সুচি। কথা শেষ হওয়ার আগেই সুচি ফুপিয়ে কেঁদে উঠে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলো “ কাল তুমি ক্ষমা চাইলে কেন ? „ সুচির চোখের জলে দিদিমার বুকের শাড়ি ভিজতে শুরু করে দিল ।
“ সঞ্জয় যে পুলিশ ডাকতো। তখন কি হতো বলতো ? „ সুচি কিছু বললো না। উত্তর না দিয়ে সুচি দিদিমাকে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। “ তোর কিছু হতে দিতে পারি আমি বল ! তোকে আমি যে খুব ভালোবাসি । „
কিছুক্ষণ সুচির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন দিদিমা । তারপর সুচির কান্না কিছুটা কমলে দিদিমা বললেন “ আর কখনো এরকম কাজ করবি ? „
কান্নার জন্য দম বন্ধ হয়ে আসছিল সুচির। বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে নিতে চোখের জল ফেলে বললো “ আর কখনো এরকম করবো না দিম্মা । এমন কিছুই করবো না যাতে তোমাকে ক্ষমা চাইতে হয় । তোমাদের মাথা নিচু হয় এরকম আর কোন কাজ করবো দিম্মা । „
“ আর কাউকে মারবি বল ? „
“ আর কাউকে মারবো না। কখনো না । „ ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো সুচি । সুচির চোখের জলে দিদিমার বুকের শাড়ি ভিজে গেছে ।
“ আমার সোনা মেয়ে। „ বলে সুচির মাথার ঘন চুলের উপরেই একটা চুমু খেয়ে মুখটা তুলে চোখের জল মুছিয়ে দিলেন “ বোকা মেয়ে কাঁদছে দেখো। আর কাঁদে না। একদম না। „ তারপর কিছুক্ষণ সুচির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে সুচির মাথায় নিজের থুতনি রেখে দিদিমা আরও, বললেন “ বড়ো হয়েছিস তুই। এখন আর তুই আমার সেই ছোট্ট সুচি নেই। আর কোন দুষ্টুমি করিস না। দুষ্টুমি করার বয়স পেরিয়ে গেছে তোর। মা বাবার খেয়াল রাখ । নিজের যত্ন নে। এইসব দুষ্টুমি ছেড়ে এবার পড়াশোনায় মন দে। .......
দিদিমার কথায় সুচি কান্না থামালো । দিদিমাকে জড়িয়ে ধরেই মনে মনে প্রতিঙ্গা করলো ‘ আর কখনো এমন কাজ করবো না যার জন্য তোমাদের ক্ষমা চাইতে হয়। ‚
কয়েক দিন ধরেই সবাই লক্ষ্য করছে বাদশা আগের থেকেও বেশি শান্ত হয়ে গেছে। সারাদিন চুপচাপ একটা জায়গায় শুয়ে থাকে। আগের মতো খায় না আর। বাদশার অবস্থা দেখে সুচি নিজের মন শক্ত করতে শুরু করলো।
একদিন সকালবেলা উঠে যে যার নিত্যদিনের কাজ করতে লাগলো। স্নেহা দেবী সকালের ব্রেকফাস্ট বানাতে লেগে গেলেন। আকাশের বাবা স্নানে চলে গেছেন। আকাশ সকাল সকাল উঠে টিভি দেখতে বসে গেছে। দিদিমা বাসি বিছানা গুছিয়ে এসে আকাশকে বললেন “ সকাল সকাল তুই টিভি দেখতে বসে গেলি ? মা বকবে কিন্তু ! পড়তে বস গিয়ে। „
দিদিমার কথায় আকাশ পড়তে বসলো। কিছুক্ষণ পর রোদ প্রখর হয়ে উঠলে দিদিমা আকাশকে নিয়ে তার দুটো আচারের বয়াম গুলো ছাদে শুকোতে নিয়ে গেলেন। কাচের বয়াম গুলো অবশ্য আকাশ নিয়ে গেল। সুচি আচার খাওয়ার ওস্তাদ বলা যায়। নিমেষেই একটা বড়ো জামবাটি খালি করে দেয়। দিদিমা সুচির জন্যেই সারা বছরে কোন না কোন আচার বানান।
ছাদের একটা কোনায় বয়াম গুলো রাখার সময় আকাশের খেয়াল হলো --- আজকে বাদশা তো উপরে এলো না।
বয়াম রাখার পর দিদিমা আর আকাশ নিচে নেমে গেল। নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে “ বাদশা বাদশা „ বলে ডাকতে ডাকতে লিভিংরুমে যেখানে বাদশা ঘুমায় সেখানে চলে গেল। আকাশ কিন্তু বাদশার কোন সাড়াশব্দ পেলো না ।
বাদশার জন্য একটা বড়ো বাস্কেটে একটা তোয়ালে বিছিয়ে রেখে ঘুমানোর উপযুক্ত বানানো হয়েছে। বাদশা সেখানেই ঘুমিয়ে আছে।
বাদশার কাছে গিয়ে আকাশ দেখলো বাদশার মুখ খোলা আর মুখের ভিতর কয়েকটা পিঁপড়ে। সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে দিদিমার কাছে গিয়ে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল। স্নেহা দেবী ছেলের কান্না দেখে জিজ্ঞাসা করলেন “ কাঁদছিস কেন ? „
আকাশ কিছু বললো না কাঁদতে কাঁদতে শুধু আঙুল দিয়ে বাদশার দিকে দেখিয়ে দিল । স্নেহা দেবী সেখানে গিয়ে দেখলেন বাদশার শরীর পড়ে আছে। প্রান নেই সেই শরীরে। বাদশার মৃত দেহ দেখে স্নেহা দেবীর মনটা ভারী হয়ে এলো। কম করে হলেও এগারো বছর বাদশা এই পরিবারের এক সদস্য ছিল।
আকাশের বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথার ভেজা চুল মুছতে মুছতে বাদশাকে দেখলেন। কিছুক্ষণ পর সুচি এলো। ঘরে ঢুকতেই বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। মন কু ডাক ডাকলো। বাদশার কাছে গিয়ে দেখলো বাদশার মৃত শরীর । সুচি কাঁদলো না। এরকম হবে সেটা আন্দাজ করেছিল। তাই মন শক্ত করতে শুরু করে দিয়েছিল আগে থেকেই।
কিছুক্ষণ বাদশার সোনালী দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখের ভিতর পিঁপড়ে গুলো সরিয়ে দিতে লাগলো। বাদশার শরীরে পিঁপড়ে দেখে তার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।
সুচির তখন চার বছর বয়স। তখনও সে তোতলায়। আকাশ সবে হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করেছে। সকালে আকাশের সাথে খেলা করার পর সুচি বাদশাকে নিয়ে নিচে পার্কে চলে যেত খেলতে। তেমনি একদিন সুচি আর জয়শ্রী মাটি দিয়ে বানানো বিভিন্ন বাসনপত্র নিয়ে রান্নাঘর খেলছিল পার্কের মধ্যে। বিভিন্ন পাতা কুচি কুচি করে শাকসব্জি বানিয়ে ছিল। বাদশার তার ছোট শরীর নিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে এদিক এদিক দৌড়োচ্ছিল ।
হঠাৎ একটা ফড়িং দেখতে পেয়ে সেটাকেই তাড়া করলো বাদশা । কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ফড়িং টাকে তাড়া করার পর বাদশার পা গিয়ে পড়লো পিঁপড়ের ঢিবির উপর । সঙ্গে সঙ্গে লাল পিঁপড়ে ছেকে ধরলো বাদশার পা। অজস্র কামড়ের জ্বালায় ঘেউ ঘেউ ডাক আরও বেড়ে গেল , আর স্বরটা আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো ।
সুচি আর জয়শ্রী এগিয়ে এসে বাদশার পা থেকে পিঁপড়ে গুলো সরিয়ে ফেলে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সুচি বাদশাকে বললো “ লাল পিপলে দুষ্তু হয়। কালো পিপলে ভালো হয়। লাল পিপলেল কাছে যাবি না , ওলা সুধু কামলায় । „ সুচির কথা বাদশা বোঝে নি। কিন্তু পিঁপড়ের জ্বালা থেকে মুক্তি পেয়ে বাদশা সুচির ছোট সুন্দর কোমল মুখটা চেটে দিল।
এই ঘটনা মনে পড়তেই সুচির চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো। সাথে আরো অজস্র ঘটনা মনে পড়তেই কেঁদে ফেললো সুচি।
আকাশের বাবা অর্ধেক দিনের ছুটি নিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন বাদশাকে কোন একটা খালে গিয়ে ফেলে আসবেন কিন্তু সেটা করলে সুচি আকাশ দুজনেই দুঃখ পাবে। তাই তিনি বাচ্চাদের পার্কের একটা কোনায় বাদশাকে কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
দুপুরে স্নান খাওয়ার আগে সুচি আকাশ আর আকাশের বাবা পার্কের একটা কোনায় বাদশাকে কবর দিয়ে দিল। সুচি আর আকাশ কবরের উপরে একটা গোলাপ চারা লাগিয়ে দিল। এই চারা একদিন বড়ো হয়ে গাছ হবে। সেই গাছে ফুটবে সুন্দর সুন্দর গোলাপ ফুল। ভালোবাসার প্রতীক এই গোলাপ ফুল।