17-09-2021, 06:29 PM
#আশীর্বাদ
#অনামিকা
'এই নে, এই বালা জোড়াটা তোর।' মোটা মকরমুখী সোনারবালা জোড়াটা ছোটমেয়ের হাতে তুলে দিয়ে ফাঁকা বাক্সটা কোলের উপরে রাখলেন রতনবাবু। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাঁপা কাঁপা হাতে পরম যত্নে বাক্সটার গায়ে হাত বুলালেন। বন্ধ চোখের কোল দিয়ে নেমে এলো দু ফোঁটা চোখের জল। আস্তে আস্তে সেই জলের ফোটা মুক্তাবিন্দুর মতো ঝরে পড়লো গয়নার বাক্সটার উপরে। ' অনেক বেলা হলো দাদু। স্নানে যাবেনা?''চোখের জলটা মুছে সামনের দিকে তাকিয়ে রতনবাবু দেখলেন, ওর বাড়ীর কাজের মেয়ে মিনা। রতনবাবুকে নিরুত্তর দেখে মিনা ঝুঁকে পড়েছে রতনবাবুর দিকে। রতনবাবুর মিনার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বললো,' শোন, আজ আর চান করবো না। অনেক বেলা হয়ে গেছে। তুই বরং অল্প করে একটু ভাত বেড়ে দে। গা-টা খুব ম্যাজম্যাজ করছে। একটু ঘুমোবো। মিনা একটা তেলের বোতল থেকে খানিকটা তেল ঢালে। তারপর রতনবাবুর মাথায় এসে তেলটা থুপতে থুপতে বলে স্নান না করলে, তোমার আরো শরীর খারাপ হবে দাদু। আমি সকালেই তোমার চানের জলটা রোদে দিয়েছি। সেটা এখন আগুনের মতো গরম হয়ে আছে। চলো স্নান করবে।' এবার রতনবাবুর মুখ তুলে তাকায় মিনার দিকে। ছলছল চোখে বলে আর এতো যত্ন করে কি করবি রে? বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে কি এগুলো পাবো? মিনা বিষণ্ণ হেসে বলে,' কেন পাবে না দাদু? ওখানে তো সব ট্রেনিং পাওয়া মানুষজন। আমার মতো আনাড়ী তো নয়।' রতনবাবু খাট থেকে নামতে নামতে বলে,' থাক আর বলে কাজ নেই। চল কোথায় স্নানের জল রেখেছিস তা দেখা। ' মিনা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরাতে গেলে রতনবাবু বলেন,' শোন, এই নে, তোর দিদার গয়নার বাক্সটা। ভর্তি তো আর দিতে পারলাম না! ফাঁকাটাই নে।' কথাগুলো বলে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে যায় রতনবাবু। মিনা পরম যত্নে রতনবাবুর দেওয়া কাঠের ছোট গয়নার বাক্সটা হাতে নিয়ে কপালে ছোঁয়ায়।' একটু আগের ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মিনা তখন এই ঘরে দাদুর জিনিসপত্রগুলো গোছাচ্ছিলো। তখনই রতনবাবুর দুই মেয়ে আর দুই ছেলের বৌ এই ঘরে আসে। বড়বৌমা নন্দিনী এক বান্ডিল কাপড় এনে রতনবাবুর বিছানায় রেখে বলে,' এগুলো মা-য়ের শাড়ী। এগুলো এ বাড়ীতে রেখে কি হবে? তার থেকে আমরা নিয়ে যাই?' রতনবাবু বলেন,' অবশ্যই নিয়ে যাবে। ও শাড়ীর তো আর আমি কিছু বুঝিনা! তোমরাই ভাগ করে নেও। তবে তার আগে দাঁড়াও। আমি আমি একটু আসছি। ' বলে উঠে গিয়েছিলেন উনি। তারপর এই গয়নার বাক্সটা হাতে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। বাক্স খুলে একে একে বের করে এনেছিলেন মূল্যবান অলংকারগুলোকে। তারপর একে একে সবগুলো ভাগ করে দিয়েছিলেন তার ছেলের বৌ,মেয়ে, নাতনিদের মধ্যে। মিনার চোখের সামনে দিয়ে একে একে ভাগ হয়ে গেল, ওর দিদার সিতাহার, মবচেন, বালা, বাউটি, কানপাশাসহ সব গয়নাগুলো।একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেই গয়নাগুলো দেখতে দেখতে মিনার চোখের সামনে সিনেমার রিলের মতো করে একে একে ভেসে আসছিল টুকরো টুকরো ছবিগুলো। নববর্ষের সকালে পাটভাঙা তাঁতের শাড়ীর সাথে মবচেন, কানপাশা আর মকরমুখী বালার সাথে ভোরের সূর্যের মতো লাল সিঁদুরের টিপ পরা দিদার ছবি, দুর্গাপূজার দশমীর দিন গরদের শাড়ীর সাথে ঝুমকো, মটর হার আর মানতাসা পরা দিদার সিঁদুর রাঙা মুখ আবার সরস্বতী পূজার দিন হলুদ শাড়ি ও নিজের গায়ের গয়না দিয়ে মিনাকে সাজানোর পরে আলোর রোশনাই মাখা দিদার মুখ। অথচ কী অদ্ভুত ভাবে এক রাতের মধ্যে শেষ হয়ে গেল সব কিছু। স্মৃতির মনিমুক্তো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভুলেই গিয়েছিল মিনা যে পারিবারিক সম্পত্তি ভাগের সময় ওর মতো আশ্রিতের থাকতে নেই। ' এই তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস রে? যা ভাগ'। দাদুর বড়মেয়ের গলার স্বরে চমকে ওঠে মিনা। চোখের জল মুছে ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে। কিন্তু তখনই রতনবাবুর গলার স্বর শোনে সে। রতনবাবু দৃঢ় গলায় বলে,' মিনা কোথাও যাবে না। ' তারপর মিনার দিকে তাকিয়ে বলেন,' তুই তোর কাজ সেরে নে।' দাদুর কথা অমান্য করার ক্ষমতা মিনার নেই। তাই আবার ঘরে এসে হাতের কাজ সারতে লেগে পড়েছিল সে।
একটু আগে রতনবাবু শেষে বারের মতো ওই বাড়ী ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেলেন। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পরে রতনবাবুর বড়ছেলে অবশ্য রতনবাবুকে বলেছিল, ' বাবা, তোমাকে কিন্তু আমরা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চাইনি। এখনও সময় আছে। তুমি চাইলে আমাদের সবার বাড়ীতেই পালা করে থাকতে পারো। আমরা সবাই মিলেই তোমার দায়িত্ব নিতে রাজি।' রতনবাবু বিষণ্ণ হেসে বলেছিলেন,' তোমরা কেন পাঠাবে? আমি কী করবো, তার দায়িত্ব তো আমার। এই বুড়ো বয়সে আর এই শহর থেকে অন্য শহরে যেতে মন চায়না রে। তার থেকে এই ভালো। এই বাড়ীতে না থাকতে পারলেও এই শহরে তো থাকবো।' দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন রতনবাবু। তারপর আর কোন কথা বলেননি তিনি। এমন কী বিকেলে উনি চলে যাওয়ার সময় মিনাকে কাঁদতে দেখেও কিছু বলেননি রতনবাবু। শুধু বাড়ীর ভিতর থেকে ধমকে যখন মিনাকে বাইরে বের করে দিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো, তখন যেন ওনার চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠেছিল। মিনার অবশ্য এসব দেখার মতো মন ছিলনা। সে গেটের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় উদাস নয়নে তাকিয়ে ছিল। চোখের সামনে দিয়ে রতনবাবুকে নিয়ে গাড়ীটা দ্রুত বেগে চলে গিয়েছিল। নিমেষের মধ্যেই গাড়ীটা একটা ছোট্ট কালো বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছিল। অস্তগামী সূর্যের লাল রং এসে লেগেছিল মিনার মুখের উপরে। দিনান্তের সূর্য কিরণের লালিমার সাথে মিশে গিয়েছিল মিনার চোখের থেকে নেমে আসা নোনতা জলের ধারা। একটু একটু করে নিজেকে যখন সামলে নিচ্ছিলো ও তখনই কৃষ্ণচূড়া গাছটা মাথার উপরে দুটো আগুনরঙা পাঁপড়ি ফেলে বিদায় জানিয়েছিল ওকে।
এখন বেশ রাত। অনেকদিন পরে নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো মিনার। মা মারা যাওয়ার পরে তো আর এই বিছানায় ঘুমোয়নি ও। একে একে মনের মাঝে পুরোনো কথারা এসে দল বাঁধছিল। স্মৃতির সরণী বেয়ে সে পিছিয়ে যাচ্ছিলো অনেক অনেক বছর পিছনে। মিনার জন্মের কিছুদিন পরেই ওর বাবা মারা যায়। ছোট্ট মিনাকে নিয়ে দিশেহারা ওর মা ছায়া,পরিচারিকার ঠিকে কাজ নিয়ে সংসার চালাতে শুরু করে। নানা বাড়ী ঘুরে সে কাজ নেয় রতনবাবুর ওখানে। রতনবাবুর ছেলেমেয়েরা তখন সবাই অন্য শহরে প্রতিষ্ঠিত। বিশাল বড় বাড়ীতে নিঃসঙ্গ দুটি মানুষ ছোট্ট মিনাকে পেয়ে একাকীত্বের জ্বালা ভুলে যায়। ওকে নিয়েই মেতে ওঠেন রতনবাবু ও তার স্ত্রী নীলিমা দেবী। মিনাকে, রতনবাবুর বাড়ীতে রেখেই মিনার মা কাজ করতে বের হতো। আর ছোট্ট মিনা, রতনবাবু ও তার স্ত্রীর ভালোবাসা ও যত্নে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছিল। একটু বড় হতেই রতনবাবু, মিনাকে কলেজে ভর্তি করে দিল। রতনবাবুর কড়া নজরে মিনার পড়াশোনা চলতে লাগলো। দেখতে দেখতে মিনা কলেজ ছেড়ে কলেজে উঠলো। এমন সময় হঠাৎ করেই তিনদিনের জ্বরে মিনার মা মারা যায়। এই বিশাল পৃথিবীতে মিনা পুরোপুরি অনাথ হয়ে পড়ে। এমন সময় রতনবাবু আর ওনার স্ত্রী মিনাকে আঁকড়ে ধরে। ওদের স্নেহ ভালোবাসায় মিনা কলেজের পড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভিন রাজ্যে চলে যায়। দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো মিনার। মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়ী এলে রতন বাবু আর ওনার স্ত্রীর যত্নে দিন কাটতো। দিদার কাছেই ও শিখেছিলো, টুকিটাকি রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, এমন অনেককিছুই। রতনবাবুই মিনার পড়াশোনার খরচ যোগাতেন। কিন্তু জন্ম থেকেই ভাগ্যবিড়াম্বিত মিনার কপালে এইটুকু সুখও সইলো না। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন রতনবাবুর স্ত্রী। খবরটা পেয়ে পাগলের মতো দৌড়ে এসেছিল মিনা। দিন, রাত এককার করে সেবা করেছিল ওর দিদার। কিন্তু বাঁচতে পারে নি। এর পর রতনবাবুর ছেলেমেয়েরা আর রতনবাবুকে অতো বড়ো বাড়ীতে একা রাখতে সাহস পায়নি। তবে ছেলেমেয়েদের বাড়ী ঘুরে ঘুরে থাকা রতনবাবুরও পছন্দ হয় নি। তাই মিনার সাহায্যে নিজেই পছন্দ করে একটা বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেলেন উনি। এই বিরাট পৃথিবীতে মিনা এখন একা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে মিনার। বুকের কাছে রতনবাবুর দেওয়া গয়নার বাক্সটা চেপে ধরে ও। হঠাৎ করেই টুক করে গয়নার বাক্সটা হাতের থেকে পড়ে যায় ওর। মাটির থেকে তুলতে গিয়ে দেখে বাক্সের ভিতরের চোরা কুঠুরিটা খুলে গেছে। এতোক্ষণে হুঁশ ফেরে মিনার। এবার মনে পড়ে ওর। আরে এই কুটুরিটার মধ্যেই তো দিদা, তার মৃত বাবা-মায়ের পায়ের ছাপ রেখে দিয়েছিল। রোজ সকালে স্নান করে গয়নার বাক্সটাকে বের করতো দিদা, তারপর ওই ছাপগুলোকে বের করে নমস্কার করতো। মিনা অনেকবার বলেছে, ' দিদা, দেওনা আমি এই ছাপ দুটোকে বাঁধিয়ে আনি। এমনিতেই তো হলুদ হয়ে গেছে কাগজটা। যদি ছিঁড়ে যায়।' কিন্তু উনি কিছু বলতেন না। খালি হাসতেন। তারপর একদিন রতনবাবুকে কারণটা জিজ্ঞেস করেছিল মিনা। রতনবাবু বলেছিলেন,' আমাদের বাড়ীর দেওয়ালে তোর দিদার বাবা-মায়ের শেষ চিহ্ন ঝুলবে, সেটা আমার মা, মানে তোর দিদার শাশুড়ী , কোনদিনও চাইনি রে। তাই তো তোর দিদা অভিমান করে ওগুলো লুকিয়ে রেখেছে।' পুরোনো কথা মনে পড়তে দুচোখ ছাপিয়ে জল এলো মিনার। কিছুক্ষণ পরে চোখের জল মুছে মিনা ঠিক করলো, চোরা কুঠুরি থেকে দিদার বাবা-মায়ের পায়ের ছাপ বের করে বাঁধাবে ও। সেই ভেবে চোরা কুঠুরির কাগজগুলো বের করলো ও। তারপর একে একে কাগজগুলো বিছানায় মেলে রাখতে লাগলো। পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া কাগজগুলোর মাঝে একটা নতুন কাগজ দেখে একটু অবাকই হয়ে যায় মিনা। কাগজটা হাতে নিয়ে একটু সময় নেড়েচেড়ে নিয়ে, ভাঁজটা খোলে সে। আর তারপরেই অবাক হয়ে দেখে ওই কাগজটা আসলে দাদুর হাতে লেখা একটা চিরকুট। কৌতূহলী হলে পড়ে দেখে দাদু মিনাকে, তার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন। বন্ধুর ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। মিনা কি করবে বুঝতে পারে না। দাদুকে কী ফোন করবে? সাতপাঁচ ভাবনার মাঝেই দাদুকে বার কয়েক ফোন করলো সে। কিন্তু প্রতিবারই ফোন নট রিচেবেল বললো। এর মধ্যেই আর একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন এলো। মিনা ফোনটা ধরলে, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এক ভদ্রলোক বলেন, সে মিনার দাদু রতনবাবুর বন্ধু, প্রভাস মিত্র। মিনা যেন পরের রবিবার অবশ্যই ওনার সাথে দেখা করেন।
আজ তিন বছর হয়ে গেছে রতনবাবু বাড়ী ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেছেন। আজ দাদুর বাড়ীর মালকিন মিনা। রতনবাবু ওই বাড়ী মিনায় নামে দানপত্র করে, তার দলিল ওনার ওই উকিল বন্ধু প্রভাসবাবুর কাছে রেখে এসেছিলেন। বাড়ীর ভাগ না পাওয়ায় রতনবাবুর ছেলেমেয়েরা রাগ করে ওনার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছে।
মিনা এখন পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকরি করে। আজ বহুদিন বাদে সে লেডিস হোস্টেলের পাট চুকিয়ে দিয়ে দাদুর বাড়ীতে এসে উঠেছে। বাড়ীটাকে আজ ফুল, বাহারী আলো, মালায় সাজানো হয়েছে। বিকেলবেলা একটা গাড়ী এসে থামলো মিনার বাড়ীর সামনে থামলো । সাথে সাথেই বাড়ীর গেট খুলে বেরিয়ে মিনা হাসিমুখে এগিয়ে এসে গাড়ীর দরজা খুললো। তারপর রতনবাবুকে অভ্যর্থনা করে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গেল। বারান্দায় ওঠার আগে একটা গোলাপফুল লাগানো কাঁচি রতন বাবুর হাতে দিয়ে বলেন,' নাও, দাদু! এবার কাঁচি দিয়ে লালফিতেটা কেটে বৃদ্ধাশ্রমের উদ্ধোধন করো দেখি।' রতনবাবু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন, দরজার উপরে তার স্ত্রীর নামাঙ্কিত বৃদ্ধাশ্রমের হেডিং জ্বলজ্বল করছে। বহুদিন পরে ভালোলাগার আবেশে কেঁদে ফেলেন রতন বাবু। সেই দেখে মিনা বলে,' আমি জানি দাদু এই বাড়ী ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে তুমি শান্তি পাবে না। তাই তো তোমার দেওয়া বাড়ীতে এই বৃদ্ধাশ্রমটা শুরু করলাম। এই সব কিছুর পরিচালনার ভার তোমার। আমরা শুধু তোমার আদেশ পালন করবো।' কথাগুলো বলে মিটমিট করে হাসতে থাকে মিনা। মিনার কথা শুনে রতনবাবু বললেন, ' এই বয়সে এসব কিছুর ঝক্কি কি আমি নিতে পারবো রে?' মিনা বলে, ' পারবে না কেন? আমরা তো আছি তোমার সাথে। আর তুমিই তো বলতে, যেকোন বয়সেই নতুন করে জীবন শুরু করা যায়, তাহলে?' রতনবাবু বলতে যাচ্ছিলেন, ' সে তো তুই বড়ো হয়ে গিয়েছিলি বলে, ছোটদের সাথে কলেজে যেতে চাইছিলি না বলে বলছিলাম।' কিন্তু তার আগেই পায়ের উপরে কিসের যেন একটা স্পর্শ পেলেন রতন বাবু। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওনার স্ত্রীর লাগানো বেলি ফুল গাছটা থেকে একটা ফুল এসে ওনার পায়ের উপরে পড়েছে। মূহুর্তে ওনার মনে পড়ে গেল, ওনার কোন কাজ পছন্দ হলেই ওনার স্ত্রীর কাছ থেকে বেলিফুল উপহার পেতেন। এবার আর ওনার মনে কোন দ্বিধা রইলো না। মিনাকে বললেন,' চল আবার নতুন করে শুরু করি।' মিনা রতন বাবুর হাতটা জড়িয়ে ধরলো। রতন বাবুর চোখ থেকে আনন্দ অশ্রু এসে ভিজিয়ে দিল মিনার দুটো হাত।
#অনামিকা
'এই নে, এই বালা জোড়াটা তোর।' মোটা মকরমুখী সোনারবালা জোড়াটা ছোটমেয়ের হাতে তুলে দিয়ে ফাঁকা বাক্সটা কোলের উপরে রাখলেন রতনবাবু। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাঁপা কাঁপা হাতে পরম যত্নে বাক্সটার গায়ে হাত বুলালেন। বন্ধ চোখের কোল দিয়ে নেমে এলো দু ফোঁটা চোখের জল। আস্তে আস্তে সেই জলের ফোটা মুক্তাবিন্দুর মতো ঝরে পড়লো গয়নার বাক্সটার উপরে। ' অনেক বেলা হলো দাদু। স্নানে যাবেনা?''চোখের জলটা মুছে সামনের দিকে তাকিয়ে রতনবাবু দেখলেন, ওর বাড়ীর কাজের মেয়ে মিনা। রতনবাবুকে নিরুত্তর দেখে মিনা ঝুঁকে পড়েছে রতনবাবুর দিকে। রতনবাবুর মিনার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বললো,' শোন, আজ আর চান করবো না। অনেক বেলা হয়ে গেছে। তুই বরং অল্প করে একটু ভাত বেড়ে দে। গা-টা খুব ম্যাজম্যাজ করছে। একটু ঘুমোবো। মিনা একটা তেলের বোতল থেকে খানিকটা তেল ঢালে। তারপর রতনবাবুর মাথায় এসে তেলটা থুপতে থুপতে বলে স্নান না করলে, তোমার আরো শরীর খারাপ হবে দাদু। আমি সকালেই তোমার চানের জলটা রোদে দিয়েছি। সেটা এখন আগুনের মতো গরম হয়ে আছে। চলো স্নান করবে।' এবার রতনবাবুর মুখ তুলে তাকায় মিনার দিকে। ছলছল চোখে বলে আর এতো যত্ন করে কি করবি রে? বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে কি এগুলো পাবো? মিনা বিষণ্ণ হেসে বলে,' কেন পাবে না দাদু? ওখানে তো সব ট্রেনিং পাওয়া মানুষজন। আমার মতো আনাড়ী তো নয়।' রতনবাবু খাট থেকে নামতে নামতে বলে,' থাক আর বলে কাজ নেই। চল কোথায় স্নানের জল রেখেছিস তা দেখা। ' মিনা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরাতে গেলে রতনবাবু বলেন,' শোন, এই নে, তোর দিদার গয়নার বাক্সটা। ভর্তি তো আর দিতে পারলাম না! ফাঁকাটাই নে।' কথাগুলো বলে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে যায় রতনবাবু। মিনা পরম যত্নে রতনবাবুর দেওয়া কাঠের ছোট গয়নার বাক্সটা হাতে নিয়ে কপালে ছোঁয়ায়।' একটু আগের ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মিনা তখন এই ঘরে দাদুর জিনিসপত্রগুলো গোছাচ্ছিলো। তখনই রতনবাবুর দুই মেয়ে আর দুই ছেলের বৌ এই ঘরে আসে। বড়বৌমা নন্দিনী এক বান্ডিল কাপড় এনে রতনবাবুর বিছানায় রেখে বলে,' এগুলো মা-য়ের শাড়ী। এগুলো এ বাড়ীতে রেখে কি হবে? তার থেকে আমরা নিয়ে যাই?' রতনবাবু বলেন,' অবশ্যই নিয়ে যাবে। ও শাড়ীর তো আর আমি কিছু বুঝিনা! তোমরাই ভাগ করে নেও। তবে তার আগে দাঁড়াও। আমি আমি একটু আসছি। ' বলে উঠে গিয়েছিলেন উনি। তারপর এই গয়নার বাক্সটা হাতে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। বাক্স খুলে একে একে বের করে এনেছিলেন মূল্যবান অলংকারগুলোকে। তারপর একে একে সবগুলো ভাগ করে দিয়েছিলেন তার ছেলের বৌ,মেয়ে, নাতনিদের মধ্যে। মিনার চোখের সামনে দিয়ে একে একে ভাগ হয়ে গেল, ওর দিদার সিতাহার, মবচেন, বালা, বাউটি, কানপাশাসহ সব গয়নাগুলো।একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেই গয়নাগুলো দেখতে দেখতে মিনার চোখের সামনে সিনেমার রিলের মতো করে একে একে ভেসে আসছিল টুকরো টুকরো ছবিগুলো। নববর্ষের সকালে পাটভাঙা তাঁতের শাড়ীর সাথে মবচেন, কানপাশা আর মকরমুখী বালার সাথে ভোরের সূর্যের মতো লাল সিঁদুরের টিপ পরা দিদার ছবি, দুর্গাপূজার দশমীর দিন গরদের শাড়ীর সাথে ঝুমকো, মটর হার আর মানতাসা পরা দিদার সিঁদুর রাঙা মুখ আবার সরস্বতী পূজার দিন হলুদ শাড়ি ও নিজের গায়ের গয়না দিয়ে মিনাকে সাজানোর পরে আলোর রোশনাই মাখা দিদার মুখ। অথচ কী অদ্ভুত ভাবে এক রাতের মধ্যে শেষ হয়ে গেল সব কিছু। স্মৃতির মনিমুক্তো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভুলেই গিয়েছিল মিনা যে পারিবারিক সম্পত্তি ভাগের সময় ওর মতো আশ্রিতের থাকতে নেই। ' এই তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস রে? যা ভাগ'। দাদুর বড়মেয়ের গলার স্বরে চমকে ওঠে মিনা। চোখের জল মুছে ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে। কিন্তু তখনই রতনবাবুর গলার স্বর শোনে সে। রতনবাবু দৃঢ় গলায় বলে,' মিনা কোথাও যাবে না। ' তারপর মিনার দিকে তাকিয়ে বলেন,' তুই তোর কাজ সেরে নে।' দাদুর কথা অমান্য করার ক্ষমতা মিনার নেই। তাই আবার ঘরে এসে হাতের কাজ সারতে লেগে পড়েছিল সে।
একটু আগে রতনবাবু শেষে বারের মতো ওই বাড়ী ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেলেন। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পরে রতনবাবুর বড়ছেলে অবশ্য রতনবাবুকে বলেছিল, ' বাবা, তোমাকে কিন্তু আমরা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চাইনি। এখনও সময় আছে। তুমি চাইলে আমাদের সবার বাড়ীতেই পালা করে থাকতে পারো। আমরা সবাই মিলেই তোমার দায়িত্ব নিতে রাজি।' রতনবাবু বিষণ্ণ হেসে বলেছিলেন,' তোমরা কেন পাঠাবে? আমি কী করবো, তার দায়িত্ব তো আমার। এই বুড়ো বয়সে আর এই শহর থেকে অন্য শহরে যেতে মন চায়না রে। তার থেকে এই ভালো। এই বাড়ীতে না থাকতে পারলেও এই শহরে তো থাকবো।' দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন রতনবাবু। তারপর আর কোন কথা বলেননি তিনি। এমন কী বিকেলে উনি চলে যাওয়ার সময় মিনাকে কাঁদতে দেখেও কিছু বলেননি রতনবাবু। শুধু বাড়ীর ভিতর থেকে ধমকে যখন মিনাকে বাইরে বের করে দিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো, তখন যেন ওনার চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠেছিল। মিনার অবশ্য এসব দেখার মতো মন ছিলনা। সে গেটের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় উদাস নয়নে তাকিয়ে ছিল। চোখের সামনে দিয়ে রতনবাবুকে নিয়ে গাড়ীটা দ্রুত বেগে চলে গিয়েছিল। নিমেষের মধ্যেই গাড়ীটা একটা ছোট্ট কালো বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছিল। অস্তগামী সূর্যের লাল রং এসে লেগেছিল মিনার মুখের উপরে। দিনান্তের সূর্য কিরণের লালিমার সাথে মিশে গিয়েছিল মিনার চোখের থেকে নেমে আসা নোনতা জলের ধারা। একটু একটু করে নিজেকে যখন সামলে নিচ্ছিলো ও তখনই কৃষ্ণচূড়া গাছটা মাথার উপরে দুটো আগুনরঙা পাঁপড়ি ফেলে বিদায় জানিয়েছিল ওকে।
এখন বেশ রাত। অনেকদিন পরে নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো মিনার। মা মারা যাওয়ার পরে তো আর এই বিছানায় ঘুমোয়নি ও। একে একে মনের মাঝে পুরোনো কথারা এসে দল বাঁধছিল। স্মৃতির সরণী বেয়ে সে পিছিয়ে যাচ্ছিলো অনেক অনেক বছর পিছনে। মিনার জন্মের কিছুদিন পরেই ওর বাবা মারা যায়। ছোট্ট মিনাকে নিয়ে দিশেহারা ওর মা ছায়া,পরিচারিকার ঠিকে কাজ নিয়ে সংসার চালাতে শুরু করে। নানা বাড়ী ঘুরে সে কাজ নেয় রতনবাবুর ওখানে। রতনবাবুর ছেলেমেয়েরা তখন সবাই অন্য শহরে প্রতিষ্ঠিত। বিশাল বড় বাড়ীতে নিঃসঙ্গ দুটি মানুষ ছোট্ট মিনাকে পেয়ে একাকীত্বের জ্বালা ভুলে যায়। ওকে নিয়েই মেতে ওঠেন রতনবাবু ও তার স্ত্রী নীলিমা দেবী। মিনাকে, রতনবাবুর বাড়ীতে রেখেই মিনার মা কাজ করতে বের হতো। আর ছোট্ট মিনা, রতনবাবু ও তার স্ত্রীর ভালোবাসা ও যত্নে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছিল। একটু বড় হতেই রতনবাবু, মিনাকে কলেজে ভর্তি করে দিল। রতনবাবুর কড়া নজরে মিনার পড়াশোনা চলতে লাগলো। দেখতে দেখতে মিনা কলেজ ছেড়ে কলেজে উঠলো। এমন সময় হঠাৎ করেই তিনদিনের জ্বরে মিনার মা মারা যায়। এই বিশাল পৃথিবীতে মিনা পুরোপুরি অনাথ হয়ে পড়ে। এমন সময় রতনবাবু আর ওনার স্ত্রী মিনাকে আঁকড়ে ধরে। ওদের স্নেহ ভালোবাসায় মিনা কলেজের পড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভিন রাজ্যে চলে যায়। দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো মিনার। মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়ী এলে রতন বাবু আর ওনার স্ত্রীর যত্নে দিন কাটতো। দিদার কাছেই ও শিখেছিলো, টুকিটাকি রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, এমন অনেককিছুই। রতনবাবুই মিনার পড়াশোনার খরচ যোগাতেন। কিন্তু জন্ম থেকেই ভাগ্যবিড়াম্বিত মিনার কপালে এইটুকু সুখও সইলো না। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন রতনবাবুর স্ত্রী। খবরটা পেয়ে পাগলের মতো দৌড়ে এসেছিল মিনা। দিন, রাত এককার করে সেবা করেছিল ওর দিদার। কিন্তু বাঁচতে পারে নি। এর পর রতনবাবুর ছেলেমেয়েরা আর রতনবাবুকে অতো বড়ো বাড়ীতে একা রাখতে সাহস পায়নি। তবে ছেলেমেয়েদের বাড়ী ঘুরে ঘুরে থাকা রতনবাবুরও পছন্দ হয় নি। তাই মিনার সাহায্যে নিজেই পছন্দ করে একটা বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেলেন উনি। এই বিরাট পৃথিবীতে মিনা এখন একা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে মিনার। বুকের কাছে রতনবাবুর দেওয়া গয়নার বাক্সটা চেপে ধরে ও। হঠাৎ করেই টুক করে গয়নার বাক্সটা হাতের থেকে পড়ে যায় ওর। মাটির থেকে তুলতে গিয়ে দেখে বাক্সের ভিতরের চোরা কুঠুরিটা খুলে গেছে। এতোক্ষণে হুঁশ ফেরে মিনার। এবার মনে পড়ে ওর। আরে এই কুটুরিটার মধ্যেই তো দিদা, তার মৃত বাবা-মায়ের পায়ের ছাপ রেখে দিয়েছিল। রোজ সকালে স্নান করে গয়নার বাক্সটাকে বের করতো দিদা, তারপর ওই ছাপগুলোকে বের করে নমস্কার করতো। মিনা অনেকবার বলেছে, ' দিদা, দেওনা আমি এই ছাপ দুটোকে বাঁধিয়ে আনি। এমনিতেই তো হলুদ হয়ে গেছে কাগজটা। যদি ছিঁড়ে যায়।' কিন্তু উনি কিছু বলতেন না। খালি হাসতেন। তারপর একদিন রতনবাবুকে কারণটা জিজ্ঞেস করেছিল মিনা। রতনবাবু বলেছিলেন,' আমাদের বাড়ীর দেওয়ালে তোর দিদার বাবা-মায়ের শেষ চিহ্ন ঝুলবে, সেটা আমার মা, মানে তোর দিদার শাশুড়ী , কোনদিনও চাইনি রে। তাই তো তোর দিদা অভিমান করে ওগুলো লুকিয়ে রেখেছে।' পুরোনো কথা মনে পড়তে দুচোখ ছাপিয়ে জল এলো মিনার। কিছুক্ষণ পরে চোখের জল মুছে মিনা ঠিক করলো, চোরা কুঠুরি থেকে দিদার বাবা-মায়ের পায়ের ছাপ বের করে বাঁধাবে ও। সেই ভেবে চোরা কুঠুরির কাগজগুলো বের করলো ও। তারপর একে একে কাগজগুলো বিছানায় মেলে রাখতে লাগলো। পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া কাগজগুলোর মাঝে একটা নতুন কাগজ দেখে একটু অবাকই হয়ে যায় মিনা। কাগজটা হাতে নিয়ে একটু সময় নেড়েচেড়ে নিয়ে, ভাঁজটা খোলে সে। আর তারপরেই অবাক হয়ে দেখে ওই কাগজটা আসলে দাদুর হাতে লেখা একটা চিরকুট। কৌতূহলী হলে পড়ে দেখে দাদু মিনাকে, তার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন। বন্ধুর ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। মিনা কি করবে বুঝতে পারে না। দাদুকে কী ফোন করবে? সাতপাঁচ ভাবনার মাঝেই দাদুকে বার কয়েক ফোন করলো সে। কিন্তু প্রতিবারই ফোন নট রিচেবেল বললো। এর মধ্যেই আর একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন এলো। মিনা ফোনটা ধরলে, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এক ভদ্রলোক বলেন, সে মিনার দাদু রতনবাবুর বন্ধু, প্রভাস মিত্র। মিনা যেন পরের রবিবার অবশ্যই ওনার সাথে দেখা করেন।
আজ তিন বছর হয়ে গেছে রতনবাবু বাড়ী ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেছেন। আজ দাদুর বাড়ীর মালকিন মিনা। রতনবাবু ওই বাড়ী মিনায় নামে দানপত্র করে, তার দলিল ওনার ওই উকিল বন্ধু প্রভাসবাবুর কাছে রেখে এসেছিলেন। বাড়ীর ভাগ না পাওয়ায় রতনবাবুর ছেলেমেয়েরা রাগ করে ওনার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছে।
মিনা এখন পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকরি করে। আজ বহুদিন বাদে সে লেডিস হোস্টেলের পাট চুকিয়ে দিয়ে দাদুর বাড়ীতে এসে উঠেছে। বাড়ীটাকে আজ ফুল, বাহারী আলো, মালায় সাজানো হয়েছে। বিকেলবেলা একটা গাড়ী এসে থামলো মিনার বাড়ীর সামনে থামলো । সাথে সাথেই বাড়ীর গেট খুলে বেরিয়ে মিনা হাসিমুখে এগিয়ে এসে গাড়ীর দরজা খুললো। তারপর রতনবাবুকে অভ্যর্থনা করে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গেল। বারান্দায় ওঠার আগে একটা গোলাপফুল লাগানো কাঁচি রতন বাবুর হাতে দিয়ে বলেন,' নাও, দাদু! এবার কাঁচি দিয়ে লালফিতেটা কেটে বৃদ্ধাশ্রমের উদ্ধোধন করো দেখি।' রতনবাবু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন, দরজার উপরে তার স্ত্রীর নামাঙ্কিত বৃদ্ধাশ্রমের হেডিং জ্বলজ্বল করছে। বহুদিন পরে ভালোলাগার আবেশে কেঁদে ফেলেন রতন বাবু। সেই দেখে মিনা বলে,' আমি জানি দাদু এই বাড়ী ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে তুমি শান্তি পাবে না। তাই তো তোমার দেওয়া বাড়ীতে এই বৃদ্ধাশ্রমটা শুরু করলাম। এই সব কিছুর পরিচালনার ভার তোমার। আমরা শুধু তোমার আদেশ পালন করবো।' কথাগুলো বলে মিটমিট করে হাসতে থাকে মিনা। মিনার কথা শুনে রতনবাবু বললেন, ' এই বয়সে এসব কিছুর ঝক্কি কি আমি নিতে পারবো রে?' মিনা বলে, ' পারবে না কেন? আমরা তো আছি তোমার সাথে। আর তুমিই তো বলতে, যেকোন বয়সেই নতুন করে জীবন শুরু করা যায়, তাহলে?' রতনবাবু বলতে যাচ্ছিলেন, ' সে তো তুই বড়ো হয়ে গিয়েছিলি বলে, ছোটদের সাথে কলেজে যেতে চাইছিলি না বলে বলছিলাম।' কিন্তু তার আগেই পায়ের উপরে কিসের যেন একটা স্পর্শ পেলেন রতন বাবু। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওনার স্ত্রীর লাগানো বেলি ফুল গাছটা থেকে একটা ফুল এসে ওনার পায়ের উপরে পড়েছে। মূহুর্তে ওনার মনে পড়ে গেল, ওনার কোন কাজ পছন্দ হলেই ওনার স্ত্রীর কাছ থেকে বেলিফুল উপহার পেতেন। এবার আর ওনার মনে কোন দ্বিধা রইলো না। মিনাকে বললেন,' চল আবার নতুন করে শুরু করি।' মিনা রতন বাবুর হাতটা জড়িয়ে ধরলো। রতন বাবুর চোখ থেকে আনন্দ অশ্রু এসে ভিজিয়ে দিল মিনার দুটো হাত।