16-09-2021, 04:36 PM
(This post was last modified: 23-12-2021, 02:55 PM by Bumba_1. Edited 9 times in total. Edited 9 times in total.)
বুম্বার হনুমান পোষা
লেখা এবং প্রচ্ছদ :- বুম্বা
বুম্বাদের বাড়িটা বেশ বড়ো .. আগেকার জমিদার বাড়ি। পুকুর, বাগান সব আছে। আছে পেয়ারা, পেঁপে, জামরুল, ডালিম, কুল, আতা .. মাঝারি মাপের সব গাছ।
দাদু তো সর্বক্ষণই বাগান দ্যাখেন আর তাছাড়া বাগানে বারোমাস কাজ করে বদন দা। নানা রকমের ফল হয় .. পাড়াশুদ্ধ বিলি করে, নিজেরা খেয়েও ফুরায় না। আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে এলেই বুম্বাদের বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখে আর প্রশংসা করে।
কিন্তু এই বাগানের হাল বে'হাল হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। এক একদিন দল বেঁধে আসে হনুমান। আসতেই থাকে দশ .. কুড়ি .. ত্রিশ - আসার আর বিরাম নেই। গোটা পাড়াটাকে যেন কাঁপিয়ে দেয়। এ গাছ থেকে ও গাছ, এর বাগান থেকে ওর বাগান, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি .. একেবারে তুর্কি নাচ শুরু করে দেয়। গাছের ডাল ভেঙে, কচি কচি পাতাগুলো ছিঁড়ে, ফলগুলোকে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে সারা বাগান ছড়ায়। ঘরে-দোরে ঢুকে পড়ে, বড়গুলো "হুপ হুপ" করে আর ছোটগুলো "চিঁ চিঁ" করে পাড়া মাথায় তোলে।
বদন দা লাঠি নিয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু হনুমানগুলো দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসার আগেই পালায়।
বুম্বা তো ভয় নিচে নামেই না। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দেখে হনুমানের অঙ্গভঙ্গি। মাঝে মাঝে এটা-ওটা ছুঁড়ে মারে। মা বলেন "ও সব করিস না, ওরা কিন্তু লাফিয়ে এসে থাপ্পর মেরে দেবে।"
সারাদিন অত্যাচার করে ওরা একসময় সবাই চলেও যায়। কিন্তু সবথেকে বেশি বিপদ হয়ে যেদিন বীর হনুমান আসে।
বীর হনুমানগুলো যেমন বড়ো, তেমনি সাহসী। যেদিন আসে পাড়াশুদ্ধ লোকের হৃৎকম্পন ওঠে। আসলে ওরা আসেই মারমুখো হয়ে .. কাউকে মারার উদ্দেশ্য নিয়েই আসে। বুম্বা একদিন দেখেছিলো ক্লাবঘরের পিছনের বাগানে একটা বড় হনুমান একটা বাচ্চা হনুমানের পেট চিরে দিচ্ছে।
বুম্বা চিৎকার করে উঠেছিল "মা .. মা .. ইস্ .. দ্যাখো দ্যাখো।"
মা বললেন "তাড়াতাড়ি সরে আয়. কি ভয়ঙ্কর জীব রে বাবা .. একদম এসব দেখবি না।"
মেজজেঠু একদিন বলছিলেন "বীর হনুমানরা অন্য বীর হনুমানকে ছোটো অবস্থাতেই মেরে ফেলে মায়ের বুক থেকে টেনে নিয়ে।"
ছোটকাকা বলে "আমিও দেখেছি .. তবে একবার বাগে পাই .. এমন জব্দ করবো ব্যাটাদের।"
"কেমন করে জব্দ করবে ছোটকা? ওদের তো খুব শক্তি।" বড় বড় চোখ করে জানতে চায় বুম্বা।
ছোটকাকা উত্তর দেয় "দ্যাখ না কি করি .. ঘরে একটা ডান্ডা দেখেছিস তো!"
সেদিন ছিলো রিম্পার জন্মদিন। রিম্পা হলো বুম্বার মেজজেঠুর মেয়ে। বেশকিছু আত্মীয়-স্বজন এসেছে বাড়িতে। হঠাৎ "বাবাগো মাগো" বলে পড়িমরি করতে করতে ধুপ ধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো সবাই। নিচ থেকে ঠাকুমা চেঁচিয়ে বললেন "কি হলো রে .. পড়ে যাবি তো .. আস্তে নাম।"
রণি'দা বলে ওঠে "ওরে বাপরে কি বড়ো একটা হনুমান আর একটা হনুমানকে তাড়া করেছে .. বুবুদের বাড়ি থেকে এক লাফে আমাদের ছাদের চিলেকোঠার মাথায় এসে বসেছে।"
ছোটকাকা তক্ষুণি ডান্ডাটা নিয়ে ছাদে উঠতে যাচ্ছিলো। রণি'দা বলে "উঠো না ছোটমামা .. আমাদের ছাদে বসে আছে।"
"থাকুক" এইটুকু বলেই ছোটকাকা ডান্ডাটা সাঁই সাঁই করে ঘোরাতে ঘোরাতে ছাদে গেলো।
হনুমান ততক্ষণে বুম্বাদের ছাদ থেকে এক লাফে বুবুদের বারান্দায় গিয়ে বসেছে। লম্বা ল্যাজখানা ঝুলিয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। আবার দেওয়াল বেয়ে তিন লাফে ছাদে উঠে গেলো .. কি যেন খুঁজছে। ওর বিশাল ল্যাজটা ঝুলে নেমে এসেছে বুবুদের ঘরের জানলা পর্যন্ত। বুবু জানালায় দাঁড়িয়ে ছোটকাকাকে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে বললো "ও ছোটকা .. তোমাদের চিলেকোঠার ঘরে একটা মা হনুমান বাচ্চা নিয়ে ঢুকে পড়েছে।"
"অ্যাঁ .. সেকি রে" বলেই ছোটকাকা পিছন ফিরে দ্যাখে একটা লম্বা ল্যাজ চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আছে। ছোটকাকা কোনো কথা না বলে সিঁড়ির দেয়ালের গা ঘেঁষে গিয়ে প্রথমে খুব ধীরে দরজার ডানদিকের পাল্লাটা বন্ধ করে তারপর "জয় মা কালী" বলে বাঁদিকের পাল্লা টেনে দিয়ে ছিটকানি আটকে দিলো। ততক্ষণে হনুমানটা আস্তে আস্তে ল্যাজটা টেনে নিয়েছে ভেতরে। চিলেকোঠার ঘরে ছাদের দিকটা কোনো বড়ো জানলা নেই। ভিতরের দিকে একটা কুলুঙ্গি ছিলো, সেটা জানলা করা হয়েছে .. খুব ছোটো এবং উঁচুতে .. বাচ্চাদের নাগালের বাইরে। ছোটকাকা সেখান থেকে দেখতে পেলো - মা-হনুমানটা বাচ্চাটাকে বুকের ভেতর জাপ্টে ধরে আছে। ওদিকে বুবুদের ছাদে তখনও বীরহনুমানটা বসেই আছে। ছোটকাকা চুপচাপ নেমে এলো.. কাউকে কিছুই বললো না।
কিন্তু এসব খবর কি গোপন থাকে! দুপুরে বুবু নিমন্ত্রণ খেতে এসেই কথাটা জানিয়ে দিলো সকলকে। সঙ্গে সঙ্গে বুম্বা, রণি, রিম্পা, টুকু সকলে লাফিয়ে উঠলো "আমরা একটু দেখবো .. চলো ছাদে যাই।"
ছোটকাকা ধমক দিয়ে বললো "কিচ্ছু দেখবার নেই ওরা ঠিক আছে।"
সন্ধের আগেই এক এক করে সকলে চলে গেলো। ছোটকাকা বেশিরভাগ সময় চিলেকোঠার ঘরে থাকতো .. পড়াশোনা, আঁকাজোখা করতো। আজকে নিচে ঠাকুরমার ঘরে আছে। ঠাকুমা টিভি দেখছিলেন .. বন্ধ করে দিয়ে বললেন "কি রে হনুমানগুলো ছেড়ে দিসনি?"
"তুমি খেপেছো .. ছেড়ে দেবো! বীর হনুমানটা এখনো বুবুদের ছাদেই আছে। ছারলেই বাচ্চাটাকে পেট চিরে মেরে মেরে দেবে।" বলেই ছোটকাকা পড়ায় মন দেয়।
"এ আবার কি ফ্যাসাদ রে বাবা .. হনুমান কেউ ঘরে আটকে রাখে!" ঠাকুমা চলে যান অন্য ঘরে।
বুম্বার তো কিছুতেই মনে শান্তি নেই .. পড়াতেও মন নেই। দাদুর কাছে গিয়ে বসে, তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে "আচ্ছা দাদু, কেনো বলতো বীর হনুমান বাচ্চা হনুমানগুলোকে মেরে ফেলে?"
দাদু একটা গল্পের বই পড়ছিলেন। বুম্বাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলেন "কেনো মারে শুনবি? প্রথমে একটা কথা জানতে হবে যে ওরা কিন্তু সব বাচ্চাকে মারে না। যে বাচ্চাগুলো বড় হলে বীর হনুমান হবে অর্থাৎ সেগুলোকেই শুধু মেরে ফ্যালে।"
বুম্বা কেঁদে ফেলার মতো করে বলে "কেনো গো .. মেরে ফ্যালে?"
দাদু বলেন "ওরা একদমই চায়না যে, আর কোনো বীর হনুমান ওর প্রতিপক্ষ হোক।"
বুম্বা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে "প্রতিপক্ষ মানে কি গো দাদু?"
দাদু বলেন "প্রতিপক্ষ মানে বিরুদ্ধপক্ষ .. তোকে তো বোঝানো মুশকিল। আসলে হনুমানরা তো দল বেঁধে থাকে। সব দলেই একটা করে বীর হনুমান থাকে, ওদের দারুন শক্তি। রামায়ণের গল্পে পরিসনি .. বালী আর সুগ্রীব দুজনেই ভীষণ বীর ছিলো। একজন মরলো, তবে আরেকজন রাজা হলো।"
বুম্বা বললো "ওহো, তাই .. বুঝতে পেরেছি .. বাচ্চা হনুমানটাকে রাজা হতে দেবে না, এই তো!"
দাদু বলেন "দ্যাখ .. তোর ছোটকা কি করে।"
সারা দিনের ক্লান্তিতে সন্ধ্যেবেলা বুম্বা ঘুমিয়ে পড়েছিলো। রাত্রে মা ডেকে খাবার টেবিলে নিয়ে বসালেন। বুম্বা মা'কে চুপি চুপি বলে "মা, জানো তো.. ছোটকা হনুমান পুষছে।"
মা বলেন "সেকি রে বিলু .. হনুমান গুলোকে ছাড়িসনি? অবলা জীবকে এভাবে আটকে রেখেছিস কেনো?"
ঠাকুমা বললেন "শুধু কি তাই.. কিছু খেতে দেয়নি দুটোকে.. কোনো সাড়াশব্দ নেই।"
মেজোজেঠি বলেন "মরে যায়েনি তো?"
"হনুমান বা বাঁদর ধরে মেরে ফেললে কিন্তু কেস হবে" খেতে খেতে বললেন বাবা।
ঠাকুমা তৎক্ষণাৎ রেগে গিয়ে বললেন "জানিনা বাপু, এসব উদ্ভট শখ কেনো! ওদিকে ঘরটার কি অবস্থা হচ্ছে কে জানে। - হনুমান মেরে বাড়িসুদ্ধ লোকের হাতে হাতকড়া পরাবে বলে মনে হচ্ছে।"
ছোটকাকা এতক্ষণ চুপচাপ খাচ্ছিলো। এবার বললো "আচ্ছা মা .. তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! একদিন না খেলে কেউ মরে? তারপরে আবার হনুমান .. মানুষের পূর্বপুরুষ। মানুষই কতদিন না খেয়ে বেঁচে থাকে .. তাছাড়া আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য সাইকোলজিকাল ট্রিটমেন্ট করছি .."
সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়ে মেজজেঠু বললেন "এখানেও তোর সাইকোলজিকাল ট্রিটমেন্ট!! তুই না হয় হিউম্যান সাইকোলজি বুঝিস। কিন্তু এ্যানিমাল সাইকোলজি কি তোর জানা আছে?"
"দ্যাখো মেজদা, সবই এক .. শুধু বুঝে নিতে হয়।" বলে ছোটকাকা খেতে থাকে। আর কেউ কিচ্ছু বলে না।
রাতে সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ মাঝ রাতে চিলেকোঠার ঘর থেকে ভেসে এলো প্রচন্ড জোরে আওয়াজ। "হুপ হুপ" আর তার সঙ্গে নানারকম শব্দ। তার মানে বড় হনুমানটা ক্ষেপে গিয়েছে। খিদে তৃষ্ণায় সে অস্থির হচ্ছে .. একবার চৌকিতে উঠছে, আবার নিচে নামছে। হয়তো জানলার কাছে যাচ্ছে, আবার লাফ দিচ্ছে। আর ঘন ঘন ডাক ছাড়ছে।
বুম্বা ঠাকুমার কাছে শুয়েছে। আজ বাড়িতে লোক আছে তাই ছোটকাও শুয়েছে এই ঘরে। কেউ শুনুক বা না শুনুক, বুম্বার কিন্তু ঘুম ভেঙে গেছে এবং সে সব শুনতে পেয়েছে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ - অনুভব করছে ছোটকা বিছানায় উঠে বসেছে, মশারি তুললো, বাইরে পা বাড়াচ্ছে।
বুম্বা তৎক্ষণাৎ বিছানায় উঠে বসে। "ছাদে যাচ্ছো ছোটকা?" গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
অবাক হয়ে ছোটকাকা ফিস্ ফিস্ করে বলে "সেকি রে, তুই জেগে আছিস? চুপচাপ শুয়ে থাক।"
বুম্বা ততক্ষণে বিছানা থেকে নেমে পড়েছে .. অন্ধকার ঘর। "আমাকেও নিয়ে চলো ছোটকা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি।"
ঘরে কি ঘটছে ঠাকুরমা বুঝতে পারছেন কিন্তু ঘুমের ওষুধের ঘোরে ব্যাপারটা কি হচ্ছে ধরতে পারছেন না। "বাথরুমে যাবি বুম্বা?" ঘুমচোখে জিজ্ঞাসা করলেন ঠাকুমা।
"ছোটকার সঙ্গে যাচ্ছি।" তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো বুম্বা।
হনুমানটার দাপাদাপি বেড়েই চলেছে। ঘরে একটা জিরো পাওয়ারের আলো জ্বললেও টর্চ জ্বেলে ছোটকাকা দেখলো রাত সাড়ে তিনটে। "আচ্ছা চল .."
বুম্বা ছোটকাকার সঙ্গে সঙ্গে ছাদে ওঠে। ছোটকার হাতে লাঠি, অন্ধকার চারিদিক। নিঃশব্দে ওরা ছাদে উঠলো। খুব সাবধানে ছোটকা চিলেকোঠার দরজার ছিটকানিটা টেনে ডানদিকের পাল্লাটা খুলে দিলো, তারপর নিজেরা দুজনেই দরজার আড়ালে লুকিয়ে গেলো।
বড় হনুমানটা তখন পাগলের মতো "হিসহিস .. হুপ হুপ" শব্দ করে চৌকিতে উঠছে আর নামছে। যেই না দরজা খোলা দেখেছে - এক লাফে সে এসে বসলো ছাদের মাঝখানে। সেখানে এক মুহূর্ত থেকেই লাফ দিলো বুবুদের ছাদে .. বসলো গিয়ে জল ট্যাঙ্কের উপরে। তারপর ছাদের কার্নিশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে একেবারে ক্লাবের পিছনের বাগানে অন্তর্হিত হলো।
ছোটকাকা বললো "ভয় নেই, ভোরের আগে অন্ধকার একটু গাঢ় হয়, একটু পরেই সকাল হয়ে যাবে। চল শুবি চল .. কাল থেকে শুরু আমাদের হনুমান পোষা। তারপর আস্তে করে দরজাটা টেনে দিয়ে ছিটকিনি বন্ধ করে দেয় ছোটকা।
"ওর মা আর আসবে না?" ব্যাকুল কন্ঠে প্রশ্ন করে বুম্বা।
"ও আর যেচে বন্দী হতে আসবে কি? এখন তো বাঁচুক .. চল।" ছোটকাকা বুম্বাকে নিয়ে নিচে নেমে আসে।
বুম্বার ঘুম ভাঙলো বেশ দেরিতে, মায়ের ডাকে। চোখ কচলে উঠেই দৌড়ে ছাদে গেলো। গিয়ে দ্যাখে .. চিলেকোঠার দরজার ফাঁক দিয়ে ছোটকা বাচ্চা হনুমানটাকে ডাকছে - "আয় আয় .. চুক চুক।"
কিন্তু বাচ্চাটা ভয় চৌকির তলায় ওই যে গিয়ে ঢুকেছে আর বেরোবার নাম নেই। ডাকাডাকির ফলে আরো ভয় একেবারে ঘরের কোণে ঢুকে যাচ্ছে ও। ঘরটা তখনও বেশ অন্ধকার। ছোট কাকা পা টিপে টিপে কোনরকমে চৌকিতে গিয়ে উঠলো। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের জানলাটা খুলে দিয়েই এক লাফে বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর বুম্বাকে বললো "থাক খাবারগুলো .. ও ক্ষিদে পেলেই খাবে, ওর ভয় কাটতে দেরি আছে .. চল .." ওরা নিচে নেমে গেলো।
বেশ কয়েক দিন কেটে গেছে। বুম্বা রিম্পি কলেজে যাচ্ছে .. খেলছে বন্ধুদের সঙ্গে .. খাচ্ছে-দাচ্ছে ঘুমোচ্ছে সবই ঠিক আছে - কিন্তু তাদের মনে খুবই দুঃখ নিজেদের পোষাক হনুমানটাকে একটিবার চোখের দেখাও দেখতে পাচ্ছে না। একে তো কুলুঙ্গির জানালাটা বেশ উঁচু, তার উপর বাচ্চা হনুমানটা চৌকির নিচে থেকে বাইরে আসতেই চায় না। কখন যে খেয়ে যায়, তাও কেউ জানতে পারে না।
দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের জানলাটা একদম সোজাসুজি পিঙ্কিদের বাড়ির দিকে। মাঝখানে চওড়া রাস্তা, এই যা তফাৎ। একদিন পিঙ্কি বললো "বুম্বা, তোদের পোষা হনুমানটা একটু বড় হয়েছে রে .. জানলার কাছে এসে বসেছে দেখলাম।
বুম্বা খবরটা ছোটকা কে জানায়। ছোটকা বলে "বড় তো হবেই, দেখতে দেখতে দেড় মাস হয়ে গেলো .. এখন আর দরজা খোলা যাবে না .. জানলা দিয়ে খাবার নেবার অভ্যাস করাতে হবে।"
প্রথম প্রথম বাচ্চাটা যখন খুব ছোটো ছিলো .. গায়ের চামড়া ছিলো তুলতুলে পাতলা, কোঁচকানো, লাল-গোলাপী মেশানো রঙের। চোখ দুটো ছিলো লোমে ঢাকা পিটপিটে চাউনি। বদন দা তখন এক ফাঁকে ঘর পরিষ্কার করে দিতো। চিলেকোঠার ঘরের জিনিসপত্র বদন দাই এক এক করে নামিয়ে এনেছিলো।
কিন্তু এখন বদন দা বলে "বাবা রে .. আর ও ঘরে যাতি পারবো নি .. কেমন ডাগর ডাঁসা চেহারা .. কামড় মারে যদি.."
তবুও অতিকষ্টে ঝাড়ু দিয়ে ঘর পরিষ্কার রাখে বদন দা। এখন কুলুঙ্গির জানলার উপরে কলা, পেঁপে, রুটি, বিস্কুট, গাছপাতা .. যাই রাখা যাক না কেনো .. হনুমানটা ঠিক নামিয়ে নেয়। সেদিন ছোটকার হাত থেকেও একটা কলা নিয়েছিলো .. আসলে ছোটকা কে ও চিনে গেছে তো।
ওদিকে পিঙ্কিদের ছাদে প্রায়ই দেখা যায় বাচ্চাদের ভিড় -
"এই হনুমান কলা খাবি / জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি" .. হনুমান থোড়াই দ্যাখে! ও কেবল চৌকি থেকে ওঠে আর নামে। মাঝে মাঝে চিলেকোঠার ঘরের ছাদের দেওয়ালটা ধরার জন্য লাফ দেয়।
বুম্বা সেদিন ছোটকাকা কে বললো "ছোটকা ওর কোনো নাম রাখবে না?"
ছোটকা বলে "দেখি .. আর ক'দিন যাক।"
বুম্বা আবার বলে "আচ্ছা ছোটকা, ওকে একটু একটু করে খেলা শেখালে হয় না? ও তো পোষ মেনে গিয়েছে।
ছোটকা বলে "দাঁড়া আর ক'দিন যাক।"
বুম্বা অধৈর্য হয়ে বলে "আর ক'দিন যাবে?"
ছোটকাকা তেমন ভাবলেশহীন ভাবেই বলে "দ্যাখ না আর ক'দিন যায়.."
সেদিন শেষ রাতে .. হয়তো ভোরের দিকেই হবে .. হঠাৎ বাড়ি কাঁপিয়ে ভীষণ রকম শব্দ উঠলো "হুপ হুপ"। বুম্বার ঘুম ভেঙে গেলো .. আবার শব্দ "হুপ হুপ"। বুম্বা উঠে বসেছে বিছানায় "ছোটকা ছোটকা .. বাচ্চা হনুমানটা ডাকছে .. ওই শোনো।"
ছোট কাকা ততক্ষণে উঠে পড়েছে "শুনেছি শুনেছি.." টর্চ জ্বালিয়ে দ্যাখে চার'টে বাজে .. ভোর হয়ে এসেছে। বুম্বা সেদিনের পর থেকে ঠাকুমার কাছেই শুচ্ছে .. আর মায়ের কাছে শোয় নি এই ক'মাস।
চিলেকোঠার দরজায় আঁচড়ানোর শব্দ .. হনুমানটা দরজাটা আঁচড়াচ্ছে।
ঠাকুমা জেগে গেছেন, দাদুও জেগে গেছে। কাল রাতে পিসি আর রণিদা এসেছে .. ওরাও জেগে গেছে। ছোট কাকা বললো "মা, দেখবে তো এসো .. হনুমানটাকে ছেড়ে দিচ্ছি.."
কাঁদো কাঁদো স্বরে বুম্বা জিজ্ঞাসা করলো "ছেড়ে দেবে?"
ছোটকাকা বলে "হ্যাঁ .. দেবোই তো।"
বুম্বার বিস্ময়ের সীমা রইলো না "ছেড়েই যদি দেবে তাহলে পুষতে গেলে কেনো?"
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ছোটকা বললো "আরে বোকা .. ছেড়ে দেবো বলেই তো পুষলাম ওকে .. ওহো .. দাঁড়া .. ক্যামেরাটা নিয়ে আসি, কয়েকটা ছবি তুলে রাখবো।"
ওদিকে হনুমানের দাপাদাপি চরমে উঠেছে, দরজাটা যেনো ভেঙে ফেলবে। তার সঙ্গে "হুপ হুপ" করে অনবরত ডাকছে।
আজকে আর ভয় ভয় নয় .. ছোটকাকা সোজা গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে বীরদর্পে এক পা এক পা ফেলে ঘর থেকে বের হলো বিশাল এক হনুমান। গিয়ে বসলো ছাদের মাঝখানটায়। একটু এদিক-ওদিক তাকিয়েই দিলো এক লাফ। গিয়ে বসলো বুবুদের চিলেকোঠার ছাদে। বিশাল লম্বা ল্যাজ ঝুলে আছে জানলার কাছ বরাবর। সেই মুহূর্তে ছোটকাকা ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।
হনুমানটা ছাদের কার্নিশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ক্লাবের পিছনের বাগানের দিকের দেওয়াল বরাবর নেমে গেলো .. তারপর হঠাৎ করেই কোথায় যেনো অদৃশ্য হয়ে গেলো।
অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বুম্বা বলে উঠলো "যাঃ .. চলে গেলো!"
রণি বললো "কিরে বুম্বা কাঁদছিস নাকি? তোর চোখে জল.."
বুম্বা আর থাকতে পারলো না, এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেললো। ছোটকা এসে জড়িয়ে ধরে বললো "দেখলি তো বলেছিলাম না ব্যাটাদের জব্দ করবো .. কেমন বীর করে পাঠিয়ে দিলাম হনুমানটাকে।
বুম্বা প্রশ্ন করে ওঠে "ও এবার ঠিক রাজা হবে .. বলো?"
ছোটকা বলে "হতে পারে .. আবার নাও হতে পারে.. হয়তো এখানেই ফিরে আসতে পারে.. কিছুই বলা যায় না।"
"সত্যি!!" বুম্বার চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
ঠাকুমা বললেন "হয়েছে .. এবার সব নিচে নাম। বদন কে দিয়ে ঘরের হাল ফেরাই। তিন মাস ধরে জ্বালিয়ে খেলে।"
সবাই আস্তে আস্তে নিচে নেমে গেলো।