12-09-2021, 07:44 PM
(This post was last modified: 12-09-2021, 07:48 PM by ddey333. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
ডিপ্রেসন -
কে জানে বাবা ,আমাদের দুই ভাই বোনকেই তো বাবা মা ,পাড়া-প্রতিবেশী যে যখন পেরেছে দু এক ঘা বসিয়ে দিয়েছে ,ঢাকে কাঠি ছোঁয়ানোর মতোই। কখনো কাউকে বলতেই পারিনি , আমার অন্যায়টা কি? আমাকে মারছো কেন?
বরং বলতে গেলে এক্সট্রা দুটো ফ্রি পাওয়ার চান্স থাকতো ,তাই মারের মুহূর্তে তর্ক করতে সাহসে কুলতো না। নিজের মনেই হাতের কাজ সারতে সারতে গজগজ করে চলেছে সোহিনী।
তার ক্লাস টেনের ছেলের নাকি ডিপ্রেশন আসছে।
ডিপ্রেশন ??বাংলায় যাকে বলে নিম্নচাপ?
কে জানে !!বাড়িতে কম্পিউটার , টিভি , হাতে মোবাইল ,পকেট মানি, সর্বোপরি এত প্রাইভেসি থাকা সত্ত্বেও কেন ডিপ্রেশন আসে!!
কথায় কথায় বলে, আমাকে একটু একা থাকতে দাও!!
সোহিনীর ছেলে অভিরূপ সবে মাত্র ক্লাস টেনে উঠেছে। সেই ছেলেকে জিটি রোডের ওপর দিয়ে জোরে সাইকেল চালানোর জন্য সোহিনীর স্বামী তাপস একটু বকেছে। বাবার মুখের ওপর সমানে তর্ক চালাচ্ছিল বলেই হয়তো রেগে গিয়ে তাপস দুটো থাপ্পড় মেরেছে অভিরূপকে। ব্যাস আর যায় কোথায়!! অভিরূপ সকাল থেকে গোজ হয়ে ঘরে বসে আছে।তার নাকি মারাত্মক প্রেস্টিজ হ্যাম্পার হয়েছে।
সোহিনী ভাবছিল, একবার সোহিনী ক্লাস নাইনে পেয়ারা পারতে গিয়ে পাঁচিলের কাঁচ এ হাত কেটেছিল, ওর মা মেয়ের ওই রক্তাক্ত হাত দেখে নিজে কাঁদছিলো আর সোহিনীকে পেটাচ্ছিলো। কই তখন তো সোহিনীর একবারও মনে হয়নি তার মা তাকে ভালোবাসে না। বরং এটাই মনে হচ্ছিল, সে অন্যায় করে ফেলেছে ,মা কষ্ট পেয়ে মারছে। বাবা,মা ,কলেজের টিচার কারোর কাছেই মার খেয়ে কখনো মনে হয়নি আর বেঁচে থেকে কি হবে?
যদিও সোহিনীর বাবা-মা কখনোই বেল্ট বা গরম শিক দিয়ে মারেনি কখনো।
অভিকে খেতে দিতে গিয়েছিল সোহিনী, অভি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে ,সে আর এবাড়িতে কিছু খাবে না।
মা হিসাবে সোহিনী বোঝাতে গিয়েছিল, তুই আমাদের একমাত্র সন্তান,তোর কিছু হলে আমরা বাঁচবো কি করে?
অভি মুখের ওপর বলেছে, কেন, আমি মরে গেলে তুমি আর বাবা স্বাধীনতা উপলব্ধি করবে!
আশ্চর্য ! যদি দুজনে থাকতে চাইতো তাহলে কি আর এত কষ্ট করে অভিকে মানুষ করতো?
দুম করে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেলো সোহিনী।
ওদিকে অফিসে গিয়েই তাপসের মন খারাপ। ছেলের গায়ে হাত না তুললেই হতো। একটু বুঝিয়ে বললেই চলতো!!
কিন্তু অভি যে বলে বসলো, আমি লরির তলায় গেলে তোমার কি? আমার জীবন, আমি কিভাবে কাটাবো সেটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
শুধুই অভির জীবন? বাবা হিসাবে নিজের সন্তানকে ভালো মন্দ বলার অধিকারটুকুও নেই তাপসের!!
তাহলে দিনরাত এক করে এই আই টি সেক্টরে ঘাড় গুঁজে খেটে যাচ্ছে কি শুধু নিজের পেটের ক্ষিদের জন্য ? নাকি অভির যাতে কোনো অভাব না হয় সে জন্য।
ছেলেকে এই বয়সেই কম্পিউটার, মোবাইল এসব কিনে দিয়েছিল তাপস। অনেকে বলেছিল, ছেলে উচ্ছন্নে যাবে। তাপস শোনে নি, ছেলের ওপর তার পূর্ন আস্থা ছিল। কে জানে ভুল করলো কি??
সন্ধ্যের দিকে বাড়ি ফেরার সময় প্রায়ই দেখে , গলির মোড়ে সমীরের কোচিংয়ের সামনে ছেলে মেয়েগুলো প্রেম করছে। কোচিং ক্লাসে ঢোকেনি। বাইরে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে । হয়তো স্যারের ফিজের টাকায় মুভি দেখবে। কোনটা অন্যায়, নিজের সন্তানকে বিশ্বাস করা?
মহিমদা তাপসের কাঁধে হাত দিয়ে বললো, কি রে আজ কাজে মন নেই কেন?
অভির ঘটনাটি শুনে বললো, এত এখন ঘরে ঘরে সমস্যারে। ওদের যতই প্রায়োরিটি দাও তবুও ওরা ডিপ্রেশনে ভোগে। বেশি কিছু বলতে যাস না, শুনছিস তো নিউজে ক্লাস সেভেনের, সিক্সের ছেলেরা সব সুইসাইড করছে। আবার কত আইন হয়েছে, বাবা মা মারলে নাকি শিশু নিগ্রহের কি সব ধারায় কেস করা যাচ্ছে।
বুকের ভিতরটা শুকিয়ে গেল তাপসের।
ফোনটা করেই ফেললো, সোহিনীকে।
অভি কলেজে গেছে?
সোহিনী ফিসফিস করে অপরাধীর মত গলায় বলল, কিছু খায় নি দরজা বন্ধ করে রেখেছে। ডাকলাম ,বললো,একা থাকতে দাও।
ফোনে কথা বলছিল কোনো বন্ধুর সাথে। আবছা শুনতে পেলাম, আর নাকি বাঁচতে ইচ্ছে করছে না ওর।আমাদের অত্যাচারে ও নাকি ব্যতিব্যস্ত।
হাত পা গুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তাপসের।
অভিকে ছাড়া নিজেদের ফ্ল্যাটটা কল্পনা করতেও ভয় করছে।
কদিন আগেই একটা ঘটনা শুনলো, কলেজের পিছনে সিগারেট খাচ্ছিলো দেখতে পেয়ে বাবা একটা থাপ্পর মেরেছিলো বলে, ছেলেটা নাকি সুইসাইড করেছে। ছেলেটির মা এখন মেন্টাল এসাইলামে।
অভির কিছু হয়ে গেলে সোহিনী আর তাপস বাঁচবে কি নিয়ে!!
তাপস ভাবছে নিজের ছেলেবেলাটা...
তখন তাপস কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কয়েকটা বন্ধু মিলে একদিন কলেজ কেটে মুভি দেখতে গিয়েছিল, কি করে যেন সেটা তাপসের বাবার কানে পৌঁছে যায়। তারপরই বাবা তাপসের পিঠে স্কেল দিয়ে বেদম মেরেছিলো । অত অপমানের পরেও কিন্তু তাপসের মৃত্যুচিন্তা আসেনি।
বাবা মায়েরা কি নিজের সন্তানের শত্রু?
সোহিনী হাতের কাজ ফেলে রেখে বারবার যাচ্ছে ছেলের ঘরের দরজায় কান পেতে দেখতে।
জানালার ফাঁকে চোখ রেখে খুঁজছে সেই বছর ষোলো আগে জন্মানো কচি মাংসপিন্ডটাকে।
অভির যখন দাঁত উঠছিল,অভি খুব জোরে কামড়ে দিয়েছিল, সোহিনীর আঙুল। সেই ব্যাথা লাগাটাও বড্ড আনন্দের ছিল সোহিনীর কাছে। কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে শুধু অভির মুখের দিকে তাকিয়ে। এগুলো অভির কাছে বলতে গেলে হয়তো ও বলবে, ওভার এক্টিং বন্ধ কর। সব মায়েরাই এগুলো করে!! নিশ্চয় করে ,মায়েরাই তো আত্মত্যাগ করে।
ওই কচি শিশুটা কবে বড় হয়ে বাবা মায়ের দায়িত্ব নেবে !নাকি আদৌ কোনো সম্পর্ক রাখবে না ,সে কথা না ভাবেই বাবা,মায়েরা তাকে বড় করে।
আঙুল ধরে খুব সাবধানে শক্ত মাটিতে হাঁটতে শেখায়।
নিজেদের প্রিয় খাবার ,নিজেদের পছন্দগুলো আস্তে আস্তে পরিবর্তীত হয়ে যায় সন্তানের পছন্দ মত .
অভি...এই অভি...
সোহিনী ডাকছে...
ঘুমিয়ে গেল নাকি ছেলেটা!! কিছু না খেয়ে খালি পেটে ই ঘুমিয়ে গেল!!
বার চারেক নক করার পর অভি বিরক্ত মুখে দরজাটা খুলে বললো, তোমাকে বললাম না,আমাকে ডিস্টার্ব করো না।
আমি বাঁচতে চাই না। এত ডিপ্রেশন নিয়ে বাঁচার ইচ্ছে আমার নেই।
সোহিনী বললো, চল অভি ,আমরা একটা জায়গায় যাবো।
অভি বিরক্ত মুখে বললো, আমি যাবো না।
সোহিনী দৃঢ় স্বরে বললো, রেডি হয়ে নে.. আমরা যাবো।
মায়ের চোখের চাহনিটা একটু অস্বাভাবিক লাগলো বলেই হয়তো অভি কথা না বলে জামা বদলে এসে বললো, এখন বলো ,কোথায় যাবো?
ওটা সারপ্রাইজ !!
এখন বিকেল পাঁচটা, বাবা বাড়ি ফিরবে সন্ধ্যে সাতটায়।মা এই সময় সাধারণত বাড়ি থেকে কোথাও বেরোয় না। হঠাৎ অভিকে নিয়ে কোথায় যেতে চায় মা !!
বাইরে বেরিয়েই একটা ট্যাক্সি নিলো সোহিনী।
না ,একটা কথাও বলছে না সোহিনী।
অভির মনের মধ্যে তখন একটা অনুভুতি , সে আর বাঁচতে চায়না। বাবা, মা তাকে ভালোবাসে না বলেই আজ মেরেছে।
সে মরে গিয়ে দেখাতে চায়, সে মৃত্যুকে ভয় পায় না!!
রাতের অন্ধকারে সকলে যখন ঘুমাবে তখনই অভি সোজা সাইকেল নিয়ে চলে যাবে রেল লাইনে...
তারপর ভোর হতেই মা বাবা খুঁজবে...সাড়া জীবন শুধু ভাববে কেন মেরেছিলাম অভিকে।
অজান্তেই নিজের মৃত্যুচিন্তায় হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেছে অভির।
সোহিনীর ফোনে আবার তাপসের ফোন।
আমি বাড়ি ফিরে গেছি,তোমরা কোথায়?
আজ আর অফিসে ভালো লাগছিলো না। ছেলেটার জন্য চিকেন বার্গার আনলাম, অভি খেতে ভালোবাসে। তুমি বললে ,ও নাকি সারাদিন কিছু খায়নি তাই...
সোহিনী বললো, তুমি চাবি খুলে বাড়িতে ঢোক। আমি অভিকে নিয়ে একটু বেরিয়েছি।
এই যে দাদা,ডানদিকে...
ট্যাক্সিড্রাইভার অবাক হয়ে বলছে ,ম্যাডাম ওটা তো মহাশ্মশান !
অলরেডি নেমে পড়েছে সোহিনী। সাথে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অভি।
সোহিনী বললো, চল অভি তোকে একটা জিনিস দেখাই।
একদিকে ইলেট্রিক আরেকদিকে কাঠের চুল্লিতে দাহ কার্য চলছে। মৃতের বাড়ির লোকেরা মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে।
এমন জায়গায় অভি এই প্রথম এসেছে।
কেমন একটা ভয় ভয় করছে ওর।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে,ছাই উড়ছে..একটা শরীর মুহূর্তে ছাই হয়ে যাচ্ছে....
অভি অন্যমনস্ক ভাবে মায়ের হাতটা চেপে ধরেছে।
একদল শ্মশানযাত্রী ফিরে যাচ্ছে, এই মাত্র দাহ হয়েছে ওদের খুব প্রিয়জন।অভি দেখেছে ওই মহিলা একটু আগেই খুব কাঁদছিলো। হয়তো ওরও সন্তান সুইসাইড করেছে!!নাকি স্বামী মারা গেছে!! অভি বুঝতে পারছে না কিছুই। কেমন যেন অবসন্ন লাগছে ওর।
ওই মহিলা এখন কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়েই হয়তো চুপ করে গেছে।
শ্মশানের পিছনেই খাবার হোটেলে ঢুকেছে ওরা।
ঝগড়া করছে হোটেলের লোকদের সাথে, ভাতেটা শক্ত আছে বলে।মাছটা চালানে কিনা ভালো করে বুঝে নিচ্ছে।
একটু আগেই গঙ্গায় স্নান করে উঠে এখন হোটেলে ঢুকেছে তারা, সকলে খাচ্ছে।
ফিরেও আর তাকাচ্ছে না শ্মশানে ছাই হয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটি কোথায় গেল ,তার সন্ধানে।
অভি আস্তে আস্তে বললো, মা বাড়ি চলো। আমার ক্ষিদে পেয়েছে।
সোহিনী বললো, জানিস অভি যে মারা গেল সে হারিয়েই গেল। বৃদ্ধ বয়েসে মারা গেলে তো ঠিকই আছে, কিন্তু যে নিজের ইচ্ছায় নিজের জীবনটাকে শেষ করলো, তার পরিণতিও কিন্তু ওই আগুনে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।
কতদিন আর মানুষ দুঃখ করবে তাকে নিয়ে! সে হারিয়েই গেল। হেরে গেল সে জীবন যুদ্ধে। ভীতু মানুষদের মৃত্যুতে কেউ শোক প্রকাশ করে না।
অভি আবার বললো,মা বাড়ি চলো।
বাড়িতে ফিরেই বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে অভি।
আর কখনো জিটি রোডে জোরে সাইকেল চালাবো না বাবাই।
আজও বাবা ওর পছন্দের চিকেন বার্গার এনেছে দেখে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছিল।
শাসন করা মানেই সে ভালোবাসে না এই ধরণের ধারণাটাই সব থেকে ভুল। ছেলেমেয়েদের থেকে বাবা মায়েরা শিক্ষিত না হলেও অভিজ্ঞতায় অনেকটা বেশি জানেন। জীবনকে তারা অনেকটা কাছ থেকে দেখেছেন। জীবনের অনেক প্রতারণা, অনেক লড়াই এর তারা প্রত্যক্ষদর্শী, তাই বাবা-মায়ের কথা একটু আধটু শুনলে প্রেস্টিজ হ্যাম্পার হয় না। বরং দেখা যাবে ভবিষ্যতে ভালোই হবে।
প্রেমে বিফলতা মানেই সুইসাইড, বাবা মায়ের শাসন মানতে না পেরে সুইসাইড এগুলো তো শুধু হেরে যাওয়া মানুষরাই করে। ডিপ্রেশন বা নিম্নচাপকে গুরুত্ব না দিলেই সে আর ধারে কাছে ঘেঁষতে সাহস পাবে না।
কে জানে বাবা ,আমাদের দুই ভাই বোনকেই তো বাবা মা ,পাড়া-প্রতিবেশী যে যখন পেরেছে দু এক ঘা বসিয়ে দিয়েছে ,ঢাকে কাঠি ছোঁয়ানোর মতোই। কখনো কাউকে বলতেই পারিনি , আমার অন্যায়টা কি? আমাকে মারছো কেন?
বরং বলতে গেলে এক্সট্রা দুটো ফ্রি পাওয়ার চান্স থাকতো ,তাই মারের মুহূর্তে তর্ক করতে সাহসে কুলতো না। নিজের মনেই হাতের কাজ সারতে সারতে গজগজ করে চলেছে সোহিনী।
তার ক্লাস টেনের ছেলের নাকি ডিপ্রেশন আসছে।
ডিপ্রেশন ??বাংলায় যাকে বলে নিম্নচাপ?
কে জানে !!বাড়িতে কম্পিউটার , টিভি , হাতে মোবাইল ,পকেট মানি, সর্বোপরি এত প্রাইভেসি থাকা সত্ত্বেও কেন ডিপ্রেশন আসে!!
কথায় কথায় বলে, আমাকে একটু একা থাকতে দাও!!
সোহিনীর ছেলে অভিরূপ সবে মাত্র ক্লাস টেনে উঠেছে। সেই ছেলেকে জিটি রোডের ওপর দিয়ে জোরে সাইকেল চালানোর জন্য সোহিনীর স্বামী তাপস একটু বকেছে। বাবার মুখের ওপর সমানে তর্ক চালাচ্ছিল বলেই হয়তো রেগে গিয়ে তাপস দুটো থাপ্পড় মেরেছে অভিরূপকে। ব্যাস আর যায় কোথায়!! অভিরূপ সকাল থেকে গোজ হয়ে ঘরে বসে আছে।তার নাকি মারাত্মক প্রেস্টিজ হ্যাম্পার হয়েছে।
সোহিনী ভাবছিল, একবার সোহিনী ক্লাস নাইনে পেয়ারা পারতে গিয়ে পাঁচিলের কাঁচ এ হাত কেটেছিল, ওর মা মেয়ের ওই রক্তাক্ত হাত দেখে নিজে কাঁদছিলো আর সোহিনীকে পেটাচ্ছিলো। কই তখন তো সোহিনীর একবারও মনে হয়নি তার মা তাকে ভালোবাসে না। বরং এটাই মনে হচ্ছিল, সে অন্যায় করে ফেলেছে ,মা কষ্ট পেয়ে মারছে। বাবা,মা ,কলেজের টিচার কারোর কাছেই মার খেয়ে কখনো মনে হয়নি আর বেঁচে থেকে কি হবে?
যদিও সোহিনীর বাবা-মা কখনোই বেল্ট বা গরম শিক দিয়ে মারেনি কখনো।
অভিকে খেতে দিতে গিয়েছিল সোহিনী, অভি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে ,সে আর এবাড়িতে কিছু খাবে না।
মা হিসাবে সোহিনী বোঝাতে গিয়েছিল, তুই আমাদের একমাত্র সন্তান,তোর কিছু হলে আমরা বাঁচবো কি করে?
অভি মুখের ওপর বলেছে, কেন, আমি মরে গেলে তুমি আর বাবা স্বাধীনতা উপলব্ধি করবে!
আশ্চর্য ! যদি দুজনে থাকতে চাইতো তাহলে কি আর এত কষ্ট করে অভিকে মানুষ করতো?
দুম করে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেলো সোহিনী।
ওদিকে অফিসে গিয়েই তাপসের মন খারাপ। ছেলের গায়ে হাত না তুললেই হতো। একটু বুঝিয়ে বললেই চলতো!!
কিন্তু অভি যে বলে বসলো, আমি লরির তলায় গেলে তোমার কি? আমার জীবন, আমি কিভাবে কাটাবো সেটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
শুধুই অভির জীবন? বাবা হিসাবে নিজের সন্তানকে ভালো মন্দ বলার অধিকারটুকুও নেই তাপসের!!
তাহলে দিনরাত এক করে এই আই টি সেক্টরে ঘাড় গুঁজে খেটে যাচ্ছে কি শুধু নিজের পেটের ক্ষিদের জন্য ? নাকি অভির যাতে কোনো অভাব না হয় সে জন্য।
ছেলেকে এই বয়সেই কম্পিউটার, মোবাইল এসব কিনে দিয়েছিল তাপস। অনেকে বলেছিল, ছেলে উচ্ছন্নে যাবে। তাপস শোনে নি, ছেলের ওপর তার পূর্ন আস্থা ছিল। কে জানে ভুল করলো কি??
সন্ধ্যের দিকে বাড়ি ফেরার সময় প্রায়ই দেখে , গলির মোড়ে সমীরের কোচিংয়ের সামনে ছেলে মেয়েগুলো প্রেম করছে। কোচিং ক্লাসে ঢোকেনি। বাইরে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে । হয়তো স্যারের ফিজের টাকায় মুভি দেখবে। কোনটা অন্যায়, নিজের সন্তানকে বিশ্বাস করা?
মহিমদা তাপসের কাঁধে হাত দিয়ে বললো, কি রে আজ কাজে মন নেই কেন?
অভির ঘটনাটি শুনে বললো, এত এখন ঘরে ঘরে সমস্যারে। ওদের যতই প্রায়োরিটি দাও তবুও ওরা ডিপ্রেশনে ভোগে। বেশি কিছু বলতে যাস না, শুনছিস তো নিউজে ক্লাস সেভেনের, সিক্সের ছেলেরা সব সুইসাইড করছে। আবার কত আইন হয়েছে, বাবা মা মারলে নাকি শিশু নিগ্রহের কি সব ধারায় কেস করা যাচ্ছে।
বুকের ভিতরটা শুকিয়ে গেল তাপসের।
ফোনটা করেই ফেললো, সোহিনীকে।
অভি কলেজে গেছে?
সোহিনী ফিসফিস করে অপরাধীর মত গলায় বলল, কিছু খায় নি দরজা বন্ধ করে রেখেছে। ডাকলাম ,বললো,একা থাকতে দাও।
ফোনে কথা বলছিল কোনো বন্ধুর সাথে। আবছা শুনতে পেলাম, আর নাকি বাঁচতে ইচ্ছে করছে না ওর।আমাদের অত্যাচারে ও নাকি ব্যতিব্যস্ত।
হাত পা গুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তাপসের।
অভিকে ছাড়া নিজেদের ফ্ল্যাটটা কল্পনা করতেও ভয় করছে।
কদিন আগেই একটা ঘটনা শুনলো, কলেজের পিছনে সিগারেট খাচ্ছিলো দেখতে পেয়ে বাবা একটা থাপ্পর মেরেছিলো বলে, ছেলেটা নাকি সুইসাইড করেছে। ছেলেটির মা এখন মেন্টাল এসাইলামে।
অভির কিছু হয়ে গেলে সোহিনী আর তাপস বাঁচবে কি নিয়ে!!
তাপস ভাবছে নিজের ছেলেবেলাটা...
তখন তাপস কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কয়েকটা বন্ধু মিলে একদিন কলেজ কেটে মুভি দেখতে গিয়েছিল, কি করে যেন সেটা তাপসের বাবার কানে পৌঁছে যায়। তারপরই বাবা তাপসের পিঠে স্কেল দিয়ে বেদম মেরেছিলো । অত অপমানের পরেও কিন্তু তাপসের মৃত্যুচিন্তা আসেনি।
বাবা মায়েরা কি নিজের সন্তানের শত্রু?
সোহিনী হাতের কাজ ফেলে রেখে বারবার যাচ্ছে ছেলের ঘরের দরজায় কান পেতে দেখতে।
জানালার ফাঁকে চোখ রেখে খুঁজছে সেই বছর ষোলো আগে জন্মানো কচি মাংসপিন্ডটাকে।
অভির যখন দাঁত উঠছিল,অভি খুব জোরে কামড়ে দিয়েছিল, সোহিনীর আঙুল। সেই ব্যাথা লাগাটাও বড্ড আনন্দের ছিল সোহিনীর কাছে। কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে শুধু অভির মুখের দিকে তাকিয়ে। এগুলো অভির কাছে বলতে গেলে হয়তো ও বলবে, ওভার এক্টিং বন্ধ কর। সব মায়েরাই এগুলো করে!! নিশ্চয় করে ,মায়েরাই তো আত্মত্যাগ করে।
ওই কচি শিশুটা কবে বড় হয়ে বাবা মায়ের দায়িত্ব নেবে !নাকি আদৌ কোনো সম্পর্ক রাখবে না ,সে কথা না ভাবেই বাবা,মায়েরা তাকে বড় করে।
আঙুল ধরে খুব সাবধানে শক্ত মাটিতে হাঁটতে শেখায়।
নিজেদের প্রিয় খাবার ,নিজেদের পছন্দগুলো আস্তে আস্তে পরিবর্তীত হয়ে যায় সন্তানের পছন্দ মত .
অভি...এই অভি...
সোহিনী ডাকছে...
ঘুমিয়ে গেল নাকি ছেলেটা!! কিছু না খেয়ে খালি পেটে ই ঘুমিয়ে গেল!!
বার চারেক নক করার পর অভি বিরক্ত মুখে দরজাটা খুলে বললো, তোমাকে বললাম না,আমাকে ডিস্টার্ব করো না।
আমি বাঁচতে চাই না। এত ডিপ্রেশন নিয়ে বাঁচার ইচ্ছে আমার নেই।
সোহিনী বললো, চল অভি ,আমরা একটা জায়গায় যাবো।
অভি বিরক্ত মুখে বললো, আমি যাবো না।
সোহিনী দৃঢ় স্বরে বললো, রেডি হয়ে নে.. আমরা যাবো।
মায়ের চোখের চাহনিটা একটু অস্বাভাবিক লাগলো বলেই হয়তো অভি কথা না বলে জামা বদলে এসে বললো, এখন বলো ,কোথায় যাবো?
ওটা সারপ্রাইজ !!
এখন বিকেল পাঁচটা, বাবা বাড়ি ফিরবে সন্ধ্যে সাতটায়।মা এই সময় সাধারণত বাড়ি থেকে কোথাও বেরোয় না। হঠাৎ অভিকে নিয়ে কোথায় যেতে চায় মা !!
বাইরে বেরিয়েই একটা ট্যাক্সি নিলো সোহিনী।
না ,একটা কথাও বলছে না সোহিনী।
অভির মনের মধ্যে তখন একটা অনুভুতি , সে আর বাঁচতে চায়না। বাবা, মা তাকে ভালোবাসে না বলেই আজ মেরেছে।
সে মরে গিয়ে দেখাতে চায়, সে মৃত্যুকে ভয় পায় না!!
রাতের অন্ধকারে সকলে যখন ঘুমাবে তখনই অভি সোজা সাইকেল নিয়ে চলে যাবে রেল লাইনে...
তারপর ভোর হতেই মা বাবা খুঁজবে...সাড়া জীবন শুধু ভাববে কেন মেরেছিলাম অভিকে।
অজান্তেই নিজের মৃত্যুচিন্তায় হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেছে অভির।
সোহিনীর ফোনে আবার তাপসের ফোন।
আমি বাড়ি ফিরে গেছি,তোমরা কোথায়?
আজ আর অফিসে ভালো লাগছিলো না। ছেলেটার জন্য চিকেন বার্গার আনলাম, অভি খেতে ভালোবাসে। তুমি বললে ,ও নাকি সারাদিন কিছু খায়নি তাই...
সোহিনী বললো, তুমি চাবি খুলে বাড়িতে ঢোক। আমি অভিকে নিয়ে একটু বেরিয়েছি।
এই যে দাদা,ডানদিকে...
ট্যাক্সিড্রাইভার অবাক হয়ে বলছে ,ম্যাডাম ওটা তো মহাশ্মশান !
অলরেডি নেমে পড়েছে সোহিনী। সাথে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অভি।
সোহিনী বললো, চল অভি তোকে একটা জিনিস দেখাই।
একদিকে ইলেট্রিক আরেকদিকে কাঠের চুল্লিতে দাহ কার্য চলছে। মৃতের বাড়ির লোকেরা মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদছে।
এমন জায়গায় অভি এই প্রথম এসেছে।
কেমন একটা ভয় ভয় করছে ওর।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে,ছাই উড়ছে..একটা শরীর মুহূর্তে ছাই হয়ে যাচ্ছে....
অভি অন্যমনস্ক ভাবে মায়ের হাতটা চেপে ধরেছে।
একদল শ্মশানযাত্রী ফিরে যাচ্ছে, এই মাত্র দাহ হয়েছে ওদের খুব প্রিয়জন।অভি দেখেছে ওই মহিলা একটু আগেই খুব কাঁদছিলো। হয়তো ওরও সন্তান সুইসাইড করেছে!!নাকি স্বামী মারা গেছে!! অভি বুঝতে পারছে না কিছুই। কেমন যেন অবসন্ন লাগছে ওর।
ওই মহিলা এখন কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়েই হয়তো চুপ করে গেছে।
শ্মশানের পিছনেই খাবার হোটেলে ঢুকেছে ওরা।
ঝগড়া করছে হোটেলের লোকদের সাথে, ভাতেটা শক্ত আছে বলে।মাছটা চালানে কিনা ভালো করে বুঝে নিচ্ছে।
একটু আগেই গঙ্গায় স্নান করে উঠে এখন হোটেলে ঢুকেছে তারা, সকলে খাচ্ছে।
ফিরেও আর তাকাচ্ছে না শ্মশানে ছাই হয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটি কোথায় গেল ,তার সন্ধানে।
অভি আস্তে আস্তে বললো, মা বাড়ি চলো। আমার ক্ষিদে পেয়েছে।
সোহিনী বললো, জানিস অভি যে মারা গেল সে হারিয়েই গেল। বৃদ্ধ বয়েসে মারা গেলে তো ঠিকই আছে, কিন্তু যে নিজের ইচ্ছায় নিজের জীবনটাকে শেষ করলো, তার পরিণতিও কিন্তু ওই আগুনে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।
কতদিন আর মানুষ দুঃখ করবে তাকে নিয়ে! সে হারিয়েই গেল। হেরে গেল সে জীবন যুদ্ধে। ভীতু মানুষদের মৃত্যুতে কেউ শোক প্রকাশ করে না।
অভি আবার বললো,মা বাড়ি চলো।
বাড়িতে ফিরেই বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে অভি।
আর কখনো জিটি রোডে জোরে সাইকেল চালাবো না বাবাই।
আজও বাবা ওর পছন্দের চিকেন বার্গার এনেছে দেখে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছিল।
শাসন করা মানেই সে ভালোবাসে না এই ধরণের ধারণাটাই সব থেকে ভুল। ছেলেমেয়েদের থেকে বাবা মায়েরা শিক্ষিত না হলেও অভিজ্ঞতায় অনেকটা বেশি জানেন। জীবনকে তারা অনেকটা কাছ থেকে দেখেছেন। জীবনের অনেক প্রতারণা, অনেক লড়াই এর তারা প্রত্যক্ষদর্শী, তাই বাবা-মায়ের কথা একটু আধটু শুনলে প্রেস্টিজ হ্যাম্পার হয় না। বরং দেখা যাবে ভবিষ্যতে ভালোই হবে।
প্রেমে বিফলতা মানেই সুইসাইড, বাবা মায়ের শাসন মানতে না পেরে সুইসাইড এগুলো তো শুধু হেরে যাওয়া মানুষরাই করে। ডিপ্রেশন বা নিম্নচাপকে গুরুত্ব না দিলেই সে আর ধারে কাছে ঘেঁষতে সাহস পাবে না।