12-09-2021, 02:37 PM
গল্প -ভূমি
লেখক ও প্রচ্ছদ - বাবান
এই! এই ছেলে..... ফুলগুলো ছিড়লে কেন?
হটাৎ পেছন থেকে বকুনি শুনে চমকে উঠেছিলাম. পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে... আমরাই বয়সী. কি মিষ্টি দেখতে. ফর্সা টুকটুকে আর কোঁকড়ানো ঘন লম্বা চুল. পরনে শুধু সবুজ শাড়ী. আসলে আমার তখন যা বয়স ওই বয়সে অন্য কোনো চিন্তা আসার কথাও নয়.. ভাগ্গিস... নইলে আজকের দিনে ওরকম কাউকে দেখলে.... যাই হোক.... বাচ্চা মেয়েটা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে.
আমাকে কিছু বললে তুমি? আমি জিজ্ঞেস করলাম.
মেয়েটা মুখ বেঁকিয়ে বললো - আমাকে কিছু বললে তুমি? ঢং... এখানে তুমি ছাড়া আর আছে কে শুনি হুম?
আমি হেসে - কেন তুমি হিহিহিহি
মেয়েটি আরও রেগে গেলো. আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল- ইয়ার্কি হচ্ছে? হ্যা? আমার সাথে ইয়ার্কি? দাড়াও হচ্ছে তোমার.
আমি ভয় পায়নি সেদিন মোটেও. কেন পাবো? সেওতো আমারই বয়সী একটা পুচকে ছিল. কেনই বা ভয় পাবো?
এসেই আমার কান ধরে বললো - এই ছেলে ছিড়লে কেন ওগুলো? ইশ কত কষ্ট পেলো বলোতো ওরা.
আমি তো অবাক. এই মেয়ের কি সাহস রে বাবা! চেনেনা জানেনা... এসেই আমার কান ধরলো. আর কার কষ্টের কথা বলছে রে?
আমি - এই তুমি কার কষ্টের কথা বলছো?
মেয়েটি - কার আবার যাদের কাছ থেকে তুমি ওদের সন্তান কেড়ে নিলে তাদের কথা বলছি.
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম. এই মেয়ে বলে কি? আমি একটা নিজেই বাচ্চা.... আমি আবার কার বাচ্চা কারলাম রে বাবা?
এই কোন বাচ্চা? কার বাচ্চা? কিসব বলছো?
মেয়েটি আমার কান ছেড়ে ফুলগাছটার কাছে গিয়ে যে কাজটা করলো তাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম. এ মেয়ে করে কি?
ওকে ক্ষমা করে দাও তোমরা....... ও জেনে বুঝে করেনি.... ওকে তোমরা ক্ষমা করে দাও. এই ছেলে..... এদিকে এসো... ক্ষমা চাও ওদের কাছে!!
পাগল নাকি? ওরে বাবা.... কেন যে মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে এই ভেতরে আসলাম.
এই ছেলে? এদিকে এসো.
আমি এগিয়ে গেলাম. বললাম - ক.... ক.... কি বলো?
-হাত জড়ো করে ক্ষমা চাও
-কার কাছে চাইবো?
-কার আবার? এই গাছের কাছে.... নাও হাত জড়ো করো
পুরো পাগল মেয়ে... কার বাড়ির মেয়ে এ? যাইহোক বাবা.... যা বলছে করি. হাত জোর করে ক্ষমা চাইলাম. আমি ওর কথা শুনতেই ওর মুখচোখ পাল্টে গেলো. মুখে হাসি ফুটে উঠলো.
-এগুলো ছিড়লে কেন?
-মাকে দেবো বলে..... ঠাম্মিকে দেবো... পুজো দেবে তাই আমি...
-ওহ.... পুজোর জন্য.... তাহলে ঠিক আছে..... ক্ষমা করে দিলুম... এমনি এমনি যদি ছিড়তে না... তাহলে....
তা..... তা...তাহলে কি?
-কিছুনা..... এই তোমার নাম কি?
কি মিষ্টি কণ্ঠ মেয়েটার... দেখতেও কি মিষ্টি. আমি উত্তর দিলাম - আমার নাম অয়ন চ্যাটার্জি..... তুমি?
মেয়েটি বললো - আমি? আমি হলাম ভূমি
ভূমি? ভূমি কি?
ভূমি কি মানে? শুধুই ভূমি ব্যাস.
ওহ..... তুমি থাকো কোথায় ভূমি?
যেখানে পারি সেখানেই.... এই পুরো জঙ্গল গাছপালা পশু পাখি নদী নালা সব তো আমার থাকার জায়গা.
ও.... তোমার বাবা এখানকার মালিক?
ধ্যাৎ.... বোকা ছেলে.... আমিই আমার মালিক... এইসব জায়গা আমার.
এ?
এ নয় হ্যা বুঝলে বুদ্ধু......তোমরা কি এখানে বেড়াতে এসেছো?
হ্যা .....ওই জমিদার বাড়ি আমাদেরই....
তুমি জমিদার বাড়ির ছেলে?
হ্যা.... কিন্তু আমি প্রথম এলাম এখানে.... আমি অনেক দূরে থাকি.
কোথায়?
কলকাতা .... আমি ওখানেই জন্মেছি
কলকাতা ? এ আবার কোন জায়গা গো?
হিহিহিহি.... তুমি কিচ্ছু জানোনা... আমি বুদ্ধু না... তুমি বুদ্ধু.
মোটেও না...... বুদ্ধু তুমি....আসলে আমি তো এখানেই থাকি... আমি আর কোথাও যাইনা.... তাই আমার কোথাও যাওয়া হয়না .
তারপরে চমকে পেছনে কি যেন দেখলো... আমিও তাকালাম. ওদিকের জঙ্গলটা কেমন নড়ছে একটু একটু. হটাৎ ও আমার হাত ধরে বললো - চলো এখান থেকে. আমার হাত ধরে ওই জায়গা থেকে টেনে সরিয়ে আনলো কিছুটা দূরে. তারপরে একটা অশ্বথ্য গাছের সামনে এনে আবার বকা দিলো- এই ছেলে.... তুমি এতদূর একা একা এসেছিলে কেন? জানোনা এটা জঙ্গল.
আমি তো হরি কাকুর সাথে এসেছিলাম. সাথে বাবা মাও ছিল. আমি ওদের সাথেই ছিলাম. একটা খরগোশ হটাৎ দেখতে পেলাম. ভাবলাম ওটা নিয়ে গিয়ে পুষবো. তাই তো ওটা ধরতে গেলাম. কিন্তু পালিয়ে গেলো. আমি ওটার পিছু নিলাম আর ওটা পালতে লাগলো. তারপরে হটাৎ দেখি ওই খানে পৌঁছে গেছি. তারপরে ওই ফুলগুলো দেখে ভাবলাম মায়ের জন্য নিয়ে যাবো. ঠাম্মিও খুব খুশি হবে...আমার কি দোষ বলো?
আমার কি দোষ বলো.. বুদ্ধুরাম একটা? জানো ওখানে আর কিছুক্ষন থাকলে কি হতো?
ক..... ক... কি হতো ভূমি? ওই জঙ্গলের ঐদিকে কি ছিল গো?
ভূমি মুচকি হেসে বললো - যাই থাক... তার থেকে আমরা অনেক দূরে. এবার চলো আমার সাথে.
আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন নিজের মধ্যে ছিলাম না...... অতটা গভীর জঙ্গল পার করে আমরা এতো দ্রুত এখানে কিকরে চলে এলাম?
যাইহোক. আমি পকেট থেকে একটা টফি বার করে ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম - থ্যাংক ইয়ু আমায় বাঁচানোর জন্য... এই নাও.
এটা কি?
টফি
সেটা আবার কি?
খেয়েই দেখোনা.
মুখে দিয়েই চোখ বুজে এলো আমার নতুন বন্ধুটার. যেন জীবনে প্রথমবার খেলো সে টফি. আচ্ছা...... ও বললো ও এই জঙ্গলের মালকিন.... তাহলে ও নিশ্চই অনেক বড়োলোক... কিন্তু.... কিন্তু ওকে দেখতে খুব মিষ্টি হলেও ওর সাজ পোশাক তো বড়লোকদের মতো নয়. গ্রামের মেয়েদের মতোই.
উমমমমম.... খুব সুন্দর তো খেতে.....
তুমি আগে খাওনি টফি?
মুখ গোমড়া করে বললো - নাতো... সবাই খালি আমায় দুধ দেয় আর মিষ্টি দেয়... কেউ আমায় টফি দেয়না. তুমিই প্রথম দিলে. তোমায় ধন্যবাদ.
আচ্ছা ভূমি তোমার বাড়ি কোথায়?
ঐযে দূরে একটা মন্দিরের চূড়া দেখতে পাচ্ছ? ওখানেই
ওহ ওই মন্দিরটার কাছেই তোমার বাড়ি....
হুমমম.... ওই মন্দিরেই আমি থাকি.....
তুমি মন্দিরে থাকো? তোমার কেউ নেই?
হুমম.... সবাই আছে... সব গ্রামবাসীরাই তো আমার প্রিয়জন. তোমার দাদু ঠাম্মি তারাও তো আমার আপনজন.
সবাই তোমায় চেনে? তুমি খুব বড়োলোক বুঝি?
পরিচিত হতে গেলে বড়োলোক হতে হয় কে বললো? আপনারে যে বড়ো বলে... বড়ো সে নয়.... লোকে যারে বড়ো বলে... বড়ো সেই হয়.. বুঝলে... বুদ্ধুরাম.
বাব্বা.... কি বিজ্ঞ মেয়েরে.... এদিকে বয়স তো আমার মতোই.
তারপরে আরও অনেকটা ফাঁকা জায়গা আসতেই সে আমায় বললো - যাও.... এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যাও...... মন্দিরের সামনেই তোমার আপনজনদের দেখতে পাবে... যাও.
ওমা? তুমি কিকরে জানলে ওরা সবাই ওখানেই আছে?
আমি জানি.... তুমি যাও....
আমি চলেই যাচ্ছিলাম... হটাৎ কি মনে করে আবার ওর কাছে এসে ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে পকেট থেকে অনেক গুলো টফি দিয়ে বললাম - এগুলো তোমার... তুমি খাও....
এগুলো সব আমার?
হ্যা.... ভূমি? আমার বন্ধু হবে?
ভূমি আমার দিকে তাকিয়ে রইলো. ওর চোখে হালকা জল. ও আমার হাত ধরে বললো - তুমি আমার বন্ধু? এই প্রথম কেউ আমায় নিজের বন্ধু বললো. সবাই আমায় ভালোবাসে কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ আমায় বন্ধু হতে চায়নি.
তাতে কি? আমি তোমার বন্ধু.... আমরা যতদিন আছি.... তুমি আর আমি রোজ খেলতে আসবো.
ভূমি হেসে বললো - ঠিকাছে.... তুমি যাও বন্ধু.... তোমার বাবা মা...... সবাই চিন্তা করছে.
আমি চলে আসতে লাগলাম. মন্দিরের কাছে আসতেই দেখি সত্যিই বাবা মা হরি কাকু সবাই মন্দিরের সামনে আমার নাম ধরে ডাকছে. আমি কাছে যেতেই মা জড়িয়ে ধরলো... বাবা হালকা বকা দিলো.... হরি কাকু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো - কোথায় ছিলে তুমি বাবা? তোমায় সেই কখন থেকে খুঁজছি?
আমি সব বললাম. কিভাবে হারিয়ে গেছিলাম. কিভাবে একজন আমাকে সাহায্য করলো... আমার নতুন বন্ধু সব.
হরি কাকু অবাক হয়ে বাবাকে বললেন - কোন মেয়ের কথা বলছে ও?
বাবা - আরে হবে কোনো গ্রামের মেয়ে.....
হরি কাকু - এদিকটায় সেইভাবে কেউ আসেনা.... তাছাড়া ও যা বলছে ওতো দক্ষিনের জঙ্গলে চলে গেছিল.... ওদিকটা তো ভয়ঙ্কর.... হিংস্র সব প্রাণীদের বাস.... সেখান থেকে কে ওকে বার করে আনলো.. তাও আবার ওর মতোই বাচ্চা মেয়ে? তাহলে কি.......... আচ্ছা বাবা? ওকে কেমন দেখতে গো? নাম কি?
আমি ওর বর্ণনা দিলাম আর বললাম - ও খুব ভালো কাকু.... আমার নতুন বন্ধু..... ওর নাম ভূমি.... শুধুই ভূমি.
সব শুনে কাকুর চোখ জলে ভোরে উঠল. ঠোঁট কাঁপছে. মন্দিরের দিকে তাকিয়ে হাত দুটো উঁচু করে মাথায় ঠেকিয়ে কয়েকবার মা মা করে কেঁদে ফেললেন. আমি তো অবাক. বাবা মাও অবাক. তারপরে উনি আমাদের সাথে নিয়ে ফিরে এলেন. সব ঘটনা দাদুও শুনলো.... তারপরে আমাকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে বাবার সাথে আর মায়ের সাথে কি কথা বলতে লাগলেন. মনে হলো ভূমির ব্যাপারেই. আমি সেদিন সত্যিই ভেবেছিলাম ভূমি ঠিকই বলেছিলো ওকে সবাই চেনে.... সত্যিই বুদ্ধুরাম ছিলাম.
এতটুকু বলে সামান্য হেসে একটু বিরতি নিলাম.
- তারপরে?
প্রিয়া জিজ্ঞেস করলো আমায়. আমি, প্রিয়া,সুনির্মল, আনন্দ... সব বন্ধুরা কলেজের ছুটিতে এতো বছর পর আজ সকালেই বেড়াতে এসেছি আমাদের গ্রামে. বাবা মাও এসেছে. আজ আর দাদু নেই হরি কাকুও নেই.... আছে শুধু পুরানো সেই স্মৃতি গুলো. রাতের খাবার খেয়ে বাইরে বসে আগুন জ্বেলে সব বন্ধুরা বসে আর আমি তাদের শোনাচ্ছিলাম আমার সেই স্মৃতির কথা.
কি হলো? তারপরে কি হলো বল?
তারপরে? জানিস... ছোটবেলা হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়.... না শুধু খেলাধুলার জন্য নয়... কারণ ওই একটা এমন সময় যখন মানুষ অনেক কিছু থেকেই অজানা থাকে.... অজ্ঞ থাকে.... তাই ঠিক ভুলের বিচার যেমন সে বোঝেনা.. তেমনি লালসা নোংরামির ছায়াও আশেপাশে থাকেনা. দুস্টুমি করলেও তার মধ্যে শয়তানি থাকেনা, লোভ থাকলেও তাতে লালসা থাকেনা, মন্দ থাকলেও তা অনেক পবিত্র. তাই সেরকমই এক অজ্ঞ আমি জানতাম না বা জানতেও চাইনি কোনোদিন ভূমি কে.... তার পরিচয়. আমার কাছে সেই মিষ্টি মেয়েটা আমার বন্ধু. সেদিনের পর দুদিন ওর দেখা পাইনি. তারপরে তৃতীয় দিন বারান্দায় বসে ফুটবল নিয়ে খেলছি হটাৎ সেই ডাক শুনতে পেলাম - এই বুদ্ধুরাম. সামনে তাকাতেই মনটা আনন্দে ভোরে উঠেছিল. আমার বন্ধু ঠিক তার কথা রেখেছে. সে এসেছে আমার সাথে খেলতে. ও আমার সাথে খেলেছিল সেদিন বেশ কিছুক্ষন. জানিনা কেন... সেই সময় টুকুর জন্য কেউ আসেনি বারান্দায় আমায় দেখতে.
কাল দুপুরে ঘুমিওনা কিন্তু... আমি আসবো... তোমায় এই গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবো.
কিন্তু বাবা মা জানতে পারলে খুব বকবে ভূমি.
আরে ওরাও তো তোমার সাথে ঘুমোবে. তুমি আবার ফিরে এসে ওনাদের সাথে শুইয়ে পড়ো... কেউ জানবেনা.
কিন্তু বাবা মা যদি উঠে দেখে আমি নেই.....?
ভূমি মুচকি হেসে বলেছিল - কেউ উঠবেনা.
সত্যিই পরেরদিন দুপুরে বাবা মা আমাকে নিয়ে শুয়ে পড়লে আমি ঘুমের নাটক করে শুইয়ে ছিলাম. একটু পরে উঠে দেখি ওরা ঘুমিয়ে কাদা. আমিও ধীরে ধীরে সাবধানে উঠে বাইরে বেরিয়ে আসি. আশ্চর্য! বাড়ির দরজা খোলা কেন? ওকি? ঐতো ভূমি দাঁড়িয়ে বাইরে. আমি ছুট্টে চলেছে যাই ওর কাছে. ও হাসিমুখে আমার হাত ধরে আমায় নিয়ে চলে বাইরের জগতের সাথে আমায় পরিচয় করাতে. এই গ্রাম ঘুরে দেখা আমার সেই বন্ধুর সাথেই. সেই খেত, সেই নিমাই ডাক্তারের বাড়ি, সেই কান্তা ঠাম্মির বাড়ির পাশের বিশাল মাঠ, সেই ভোলাদের পুকুর.... সব ভূমি আমায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেনাতো. ও বলতো ও এদের সবাইকে চেনে.... আর ওকেও এরা সবাই চেনে. আমাকে গাছে চড়তে শিখিয়েছিল সেই বন্ধু. আমাকে শিখিয়েছে সব প্রাণের সম্মান করতে. তা সে উচ্চমানের হোক... বা নিম্নমানের. আমি ওর সাথে ঘুরে বেরিয়ে আবার ফিরে আসতাম. ওই আমায় হাত ধরে নিয়ে আসতো তারপরে ও পরেরদিন আসবে বলে চলে যেত. আমিও আবার চুপচাপ এসে বাবা মায়ের মাঝে শুয়ে পড়তাম... যেন কিছুই হয়নি.
এইরকমই আনন্দে কাটাতাম সেই দিন গুলো. আমার একমাত্র বন্ধুটার সাথে. কাউকে কিছু বলিনি. ওই বলতো কাউকে না বলতে. মনে আছে আমাদের এই ঘুরে বেড়ানোর তৃতীয় দিনের সেই ঘটনাটা. ভূমি একটা বহু পুরোনো বট গাছের গুড়ির সাথে ঝুলে দোল খাচ্ছে আর আমি ওকে দোলাচ্ছি.... খেয়াল করিনি আমার খুব কাছেই একটা কুকুর ঘুমোচ্ছিলো. বেখেয়ালের বশে আমার একটা পা গিয়ে পরে ওই কুকুরটার লেজে আর অমনি ব্যাটা লাফিয়ে উঠে দাঁত খিচিয়ে আমায় দেখতে থাকে আর গরর গররর করতে থাকে. আমিও ভয় পেয়ে নিজেকে বাঁচাতে সামনে পরে থাকা একটা ইটের ভাঙা টুকরো তুলে নি.... তেড়ে আসলেই মারবো মাথা লক্ষ্য করে. কিন্তু আমায় ঐভাবে দেখেই ভূমি না বন্ধু বলে চিৎকার করে নেমে এসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো কুকুরটাকে আড়াল করে. যেন জন্তুটার কোনো ক্ষতি ও হতে দেবেনা.
তুমি ওটা ফেলে দাও বন্ধু.... ওটা ওকে মেরোনা
কিন্তু.... ও ঐভাবেই আমায় দেখে গর্জন করছে... ও আমায় তেড়ে এলে নিজেকে রক্ষা করতে আমায় তো...
আমার কথার মাঝেই ও বললো - হিংসার বদলে হিংসা আর একে ওপরের ক্ষতি করলে শুধুই পাপ হয় বন্ধু...... ক্ষতি নয়..... পুন্য কে বেছে নাও.... ফেলে দাও ওটা বন্ধু.
কিন্তু ও তেড়ে এলে....!
আমি আছি না তোমার সাথে.... তোমার কোনো ক্ষতি হবেনা... এসো আমার সাথে. এইবলে ও যেটা করলো তাতে একমুহূর্তের জন্য আমি ভয় পেয়েছিলাম. আমি ওটা ফেলে দিতেই ও আমায় সাথে নিয়ে ওই কুকুরটার কাছে এগিয়ে আসে. আমি তো বুঝেই গেছি.. আজ এ হয় আমি নয়তো ভূমি বেচারিকে কামড়ে ছাড়বে. কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে ভূমি নিজের একটা হাত ওই জন্তুটার দিকে বা বলা উচিত ওই ক্ষিপ্ত জন্তুটার দিকে বাড়িয়ে দিলো.
কি করছো ভূমি!! আমি চিল্লিয়ে উঠলাম কিন্তু একি!! আমাকে অবাক করে দিলো সামনের দৃশ্য! কুকুরটা যে একটু আগেও ভয়ানক ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিলো এখন সেই চোখে কোনো রাগ নেই... বরং কি মায়া ভরা সেই চোখ.... কান দুটো নিচে নামিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে আদর খাচ্ছে ভূমির হাতে. আমি হা করে দেখছি. কি সাহস মেয়েটার!
এসো বন্ধু.... তুমিও এসো..
ওরে বাবা!! নানা আমি না..
খিলখিল করে হেসে ভূমি বলেছিলো - বুদ্ধুরাম শুধু নয়, ভীতুরাম.... কোনো ভয় নেই... এসো..... এসো বলছি.
আমি এগিয়ে আসতেই ও বললো - নাও হাত দাও...
যদি...... যদি আমায় কামড়ে দেয়.
দেবেনা বন্ধু... নিশ্চিন্ত থাকো.... তখন এই প্রাণীও অন্য ছিল আর তুমিও অন্য ছিলে.... কিন্তু এখন পুনরায় তুমি তুমিতে পরিণত হয়েছো আর এও.
কি বললে? কিছুই তো বুঝলাম না গো?
হিহিহিহি.... ওতো বুঝতে হবেনা.. এসো হাত দাও দেখিনি... এই বলে সে নিজেই আমার হাত ওই কুকুরটার মাথায় রাখলো. ভয় ভয় হাত বোলাতে লাগলাম. কিন্তু একই! সত্যিই তো... আর তো ভয় করছেনা একে! একটু আগেও এই হিংস্র রূপ দেখে আমি ভয় পেয়ে একেটা ভুল কাজ করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ভাগ্গিস ভূমি আমায় থামিয়ে দিলো... সত্যিই কি মিষ্টি এই কুকুরটা.... কেমন চোখ বুজে আমার খাচ্ছে দেখো. আমিও ওটার সামনে বসেই আদর করতে লাগলাম আর কুকুরটা জিভ দিয়ে আমার গাল চেটে দিতে লাগলো.
সেদিন আমি শিখেছিলাম হিংস্রতার বদলে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিলে তার ফলাফল কত সুন্দর হতে পারে. ভূমি আমায় এটা শিখিয়েছিল. শান্ত মানে তুমি কমজোর নও, শান্ত মানে তুমি নিজের জোর নিয়ন্ত্রণ করতে জানো. ভাবতে জানো, বুঝতে জানো. ধন্যবাদ দিয়েছিলাম সেদিন ভূমিকে. আর ফেরার পথে সেই টফি. টফি পেলেই মেয়েটা কি খুশি হতো. একটা নিষ্পাপ হাসি ফুটে উঠতো মুখে.
আরেকদিনের কথা মনে আছে......... আমাদের ফিরে আসার দুদিন আগের ঘটনা. আমি আর ভূমি হাটছি. হটাৎ কি একটা দেখে ও ছুট্টে এগিয়ে গেলো. আমিও ওর পিছে এসে দেখি একটি ছোট্ট পাখির বাচ্চা পড়ে মাটিতে. একটা গাছের নিচে. ভূমি ওটাকে তুলে নিলো পরম স্নেহে. আমি ওপরে তাকালাম. নিশ্চই বাসা থেকে পড়ে গেছে. ঐযে....... বাসাটা দেখা যাচ্ছে.
ভূমি দাড়াও আমায় ওটা দাও... আমি গাছের ওপর গিয়ে ওটাকে আবার রেখে আসছি. ভূমি কি আমার কথা শুনতে পেলোনা? আমি আবার বললাম... ভূমি? দাও ওটা আমায় আমি রেখে আসি.
ও চুপ করে দাঁড়িয়ে. আমি এগিয়ে গেলাম ওর কাছে. ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বাচ্চাটার দিকে.
কি হলো দাও ওটা?
ও আমার হাতে দিলো সেটিকে. হাতের মুঠোয় নিলাম নরম শরীরটা. শান্ত..... নিস্পন্দন স্তব্ধ....... সব শেষ!
খুব কান্না পেয়েছিলো সেদিন. কেন জানিনা খুব কান্না. আমার চোখের জল মুছিয়ে ভূমি আমায় শিখিয়েছিল জীবনের ক্রুর বাস্তব কি. জীবনের বিপরীত কি. শুনে তো ছিলাম বহুবার মৃত্যু কি... ফিলমিও বহুবার দেখেছি... কিন্তু প্রথমবার মৃত্যুকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বুঝেছিলাম তার আসল রূপ. সে কখনো নিষ্ঠুর আবার চরম বাস্তব. ঐখানেই হাত দিয়ে মাটি তুলে ওই শান্ত শরীরটাকে রেখে ওপরে মাটির চাদর চাপা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছিলাম প্রাণীটাকে. সেদিন আরেকটা জিনিস শিখেছিলাম....... জীবনের গুরুত্ব.
ফিরে আসার সময়ই ভূমিকে বলেছিলাম আমাদের আবার ফিরে যাবার কথা. শুনে ও মাথা নিচু করে বলেছিলো - তুমি আবার কবে আসবে বন্ধু?
- জানিনা ভূমি..... কিন্তু আসবো একদিন ঠিক... আমার এই প্রিয় বন্ধুটার কাছে.... হাত বাড়াও ভূমি.
ও হাত বাড়াতেই... ওর হাতে আমার আনা সবকটা টফি দিয়ে বলেছিলাম - এগুলো সব তোমার বন্ধু...... আমি কোনোদিন তোমায় ভুলবোনা.... কোনোদিন না...
ভূমি মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো - সবসময় ভালো থেকো.... খুশি থেকো.. আর সকলকে খুশিতে রেখো. তা সে মানুষ হোক বা অন্য প্রাণী... যদি তুমি সবাইকে সমান চোখে সম্মান করতে পারো তবেই তুমি হয়ে উঠবে মানুষ... বুঝলে বন্ধু?
কোনোরকমে নিজের চোখের জল আটকে বলেছিলাম - হুম...
আমি আসি তাহলে কেমন...... এই বলে আমার সেই বন্ধুটি সেদিন ওই জঙ্গলের দিকে চলে গেছিলো.... আর কোনোদিন দেখা পাইনি তার....... আর এর দুদিন পরেই আমরা ফিরে যাই........ এই ছিল আমার আর সেই ভূমির বন্ধুত্বের কাহিনী.
প্রিয়া - হুমমম.....বুঝলাম.....আচ্ছা অয়ন ? একটা কথা বলতো? তুই তখন দুপুরে একা আমাদের রেখে কোথায় গেছিলি ?
আমি মুচকি হেসে - ওই একটু ঘুরতে... জায়গাটা একটু একা ঘুরতে আর.....
প্রিয়া - আর?
আমি - ওই.... মন্দিরের কাছে
প্রিয়া - যেখানে ভূমি বলেছিলো ও থাকে?
আমি - হুমম... কিন্তু দেখা পেলাম নাতো....যাইহোক... চল চল..... অনেক গল্প শুনলি.. রাত কত হলো জানিস? চল ওঠ তোরা...
সবাই যে যার মতো উঠে ঘরের দিকে যেতে লাগলো. কিন্তু আমি.....আমি নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি....... মুখে একটা হালকা হাসি. আমি জানি.... সে আসবে..... কারণ আমি যে তার জন্য............
হেসে উঠলাম. দুপুরের সেই মুহূর্ত মনে পড়ে গেলো. মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি. ভেতরের মাতৃমূর্তি. আচ্ছা? এই কি সে? জানিনা..... জানতেও চাইনা..... আমি চিনি ভূমিকে.... আমার ছোটবেলার বন্ধুকে. পকেট থেকে একটা জিনিস বার করে মন্দিরের সিঁড়ির ওপর রেখে চুপচাপ চলে এসেছিলাম..... আমি জানি... ওটা দেখেই ও ঠিক আসবে.... ও বুঝবে.... আমি ফিরে এসেছি.... ওর বন্ধু ওকে ভোলেনি.
এইযে বুদ্ধুরাম..........
পেছন থেকে এটা শুনেই আমার হাসিটা গাল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো. ঘুরে তাকালাম. ঐতো.... ঐতো সে এসেছে...... আমার বন্ধু ভূমি..... সেই একই রূপে.... সেই ছোট্টবেলার ভূমি. আমি বড়ো হয়ে গেছি কিন্তু আমার প্রিয় বন্ধুটা সেই আগের মতোই আছে....সেই ছোট্ট মেয়েটি, মুখে তার নিষ্পাপ হাসি.... একহাত বাড়িয়ে.
সেই হাতে রয়েছে আমারই আনা ও সকালে সিঁড়ির ওপরে রেখে আসা একটা .... টফি.
||সমাপ্ত||
কেমন লাগলো এই ছোট গল্পটি?
জানাবেন কিন্তু বন্ধুরা