Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
বেআক্কেলে আবদার 
******************
চার পাঁচ দিন ধরেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে একটা ঢাকঢাক গুড়গুড় চলছিল।  কিছুতেই ঠাওর করা যাচ্ছিল না ব্যাপারটা কি। সকালে কলেজ শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ক্লাস নাইন আর টেনের চারটে সেকশনের চারজন ক্লাস টিচার ছুটলেন হেড মাস্টারমশাইয়ের ঘরের দিকে। কারণ, প্রতিদিনের মতো ছেলেমেয়েরা ক্লাসে এসেছে ঠিকই কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। এমনকি রোল কলের সময়ও কেউ সাড়া দেয় নি। সব্বাই এক্কেবারে বোবা হয়ে বসে আছে। সেকি? হেড মাস্টারমশাইয়ের জোড়া ভুরু সেকেন্ড ব্র্যাকেটের চেহারা নিল। কিন্তু গেঁড়োটা হল ছেলেমেয়েদের এই চুপ থাকো আন্দোলনটা যে কিসের জন্য সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। প্রথমে ধমক ধামক তারপর কলেজ থেকে তাড়ানোর হুমকি আর শেষমেশ বাবা বাছা। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। মহা জ্বালা। আর কোন রাস্তা খুঁজে না পেয়ে ছেলেমেয়েদের বাবা মাকে ফোন করে ডেকে পাঠানো হল। সব বাবা মা ই পুরোপুরি অন্ধকারে, এরকম বিটকেল ব্যবহারের কারণ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। শেষ পর্যন্ত এক ছাত্রীর দাদুর কাছ থেকে জানা গেল, সমস্যাটা বিনীতবাবুর সায়েন্স ক্লাস না নেওয়া নিয়ে।     
গত তিন চার বছর যাবত উঁচু ক্লাসের ফিজিক্যাল সায়েন্স টিচারের পদটা খালিই পড়ে আছে। নিরুপায় হেড মাস্টারমশাই শেষমেশ নিচু ক্লাসের অঙ্কের টিচার বিনীতবাবুকেই ওটা পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বিনীতবাবু সাধারণ সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। সুতরাং তিনি উঁচু ক্লাসে পড়ানোর যোগ্য নন। কিন্তু কি আর করা যাবে। কলেজের তো ছুঁচো গেলা অবস্থা, টিচার নেই অথচ সায়েন্সও পড়াতে হবে। তাই বিনীতবাবুকে দিয়েই ঠেকনা দেওয়ার কাজটা চলছিল। 
মাত্র দিন দশেক হল ফিজিক্যাল সায়েন্সের একজন যোগ্য টিচার পাওয়া গেছে, ইন্দ্র রায়। তাই বিনীতবাবু এখন আর নাইন টেনের ক্লাস নিচ্ছেন না আর সেটাই হল ছেলেমেয়েদের গোঁসার কারণ।    
এদিকে বিনীতবাবুর অবস্থা ধরণী দ্বিধা হও গোছের, মুখ লুকোবার জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। এমনিতেই ভদ্রলোকের স্বভাবটা তাঁর নামের সাথে এক্কেবারে মানানসই। নিজেকে আড়ালে রাখতে পারলেই যেন স্বস্তি পান। সেখানে সারা কলেজের চোখ এখন তার ওপর। তাঁকে বেশিরভাগ টিচারই কখনো ধর্তব্যের মধ্যে রাখেন না। এমন কি তিনি যে আছেন এটাই অনেকের অনেক সময় খেয়াল থাকে না। আর সেই বিনীতবাবুই কিনা রাতারাতি ছেলেমেয়েদের এতো আপনার হয়ে উঠলেন যে তাঁকে কেন্দ্র করে এরকম একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড বেঁধে গেল? কারোই মাথায় কিছু ঢুকছিল না। এছাড়াও একটা জ্বলুনি তো হচ্ছিলই। আর সেটা অনেক টিচারই চাপতে না পেরে ঠারেঠোরে বুঝিয়েও দিচ্ছিলেন হাওয়ায় দু চারটে বাঁকা কথা ছুঁড়ে দিয়ে।   
কিন্তু ছেলেমেয়েদের এই চুপ থাকো আন্দোলন থামাতে তো হবে। উপায় খুঁজতে হেড মাস্টারমশাই টিচারদের নিয়ে মিটিঙে বসলেন। মিটিঙের শুরুই হল বিনীতবাবুর দিকে তাক করে ছোঁড়া প্রশ্ন দিয়ে 
কি ব্যাপার, ছেলেমেয়েরা হঠাৎ এরকম বেআক্কেলে আবদার করছে কেন? 
বিনীতবাবু মিনমিনে গলায় বললেন
আমি তো কিছু জানিনা। আমি কি করে বলব বলুন?
অনেক অনুরোধ উপরোধ, তর্জনগর্জন আর ট্যারাবেঁকা মন্তব্যের পরেও বিনীতবাবুর সেই একই কথা। 
শেষমেশ ঠিক হল ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকেই দু একজন আসুক, বলুক তারা চায়টা কি? ছেলেমানুষি আব্দার করলেই তো হবে না। 
কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। কেউ এলো না। হতচ্ছাড়া হতচ্ছাড়িগুলো সিট ছেড়ে নড়বে না। এমন কি টিফিন টাইমে টিফিনটা পর্যন্ত খায় নি কেউ! ঠায় বসে আছে! শুধু প্রকৃতির ডাকে এক আধবার সিট ছেড়ে উঠতে হচ্ছে, কিন্তু ওইটুকুই। কথায় বলে ঠ্যালায় পড়ে ঢ্যালায় সেলাম। তাই শেষ পর্যন্ত হেড মাস্টারমশাইয়ের নেতৃত্বে টিচার বাহিনীই চললেন ক্লাসে। অনেক বাবা বাছা করে গোটা ক্লাস টেনকে একটা ঘরে জড়ো করা গেল। হেড মাস্টারমশাই মাথার টাকে বার দুই আঙুল চালিয়ে, তিনবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন 
তোমরা বড় হয়েছ, তোমরা তো বোঝ কলেজের একটা নিয়ম আছে। তোমরা কেন আমরাও ইচ্ছে করলেই সেই নিয়ম ভাঙতে পারি না। পরের বাক্যটা শুরু করতে যাবেন আর ঠিক তক্ষুনি পিছন থেকে একটা প্রশ্ন ধেয়ে এলো
স্যার, নিয়ম কি আমাদের ভালোর জন্য নাকি শুধুই চোখকান বুঁজে মানার জন্য? সেটা যদি একটু বলেন। 
গলাটা সুদীপের। ত্যাঁদড় দ্য গ্রেট। ঠোক্কর খেতে খেতে ক্লাস টেন অব্দি পৌঁছেছে, মাধ্যমিকটা টপকাতে পারবে কিনা স্বয়ং ঈশ্বরই জানেন। প্রথম ধাক্কার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াটা সামলে নিয়ে অঙ্কের কাঠখোট্টা হরেনবাবু ধমকে উঠলেন 
চুপ হতভাগা। বছর বছর গাড্ডা মারছে, তার মুখে আবার বড় বড় লেকচার।
জানেন স্যার, আপনি ক্লাস না নিলেও না আমাদের কিস্যু আসবে যাবে না কিন্তু বিনীতস্যার ক্লাস না নিলে আমরা যেমন বসে আছি তেমনই বসে থাকব। আচ্ছা স্যার, ক্লাস নাইন থেকে অঙ্কে ফেল করতে করতে তো আমি পুরো হেদিয়ে গেছি কিন্তু ফিজিক্যাল সায়েন্সে একবারও কেন ফেল করলাম না বলুন তো? 
হরেনবাবু তখন তার দিকে তেড়ে আসা ভয়ঙ্কর অঙ্কটার উত্তর হাঁটকাচ্ছেন। অবস্থা সামাল দিতে হেড মাস্টারমশাই বলে উঠলেন
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তারপর ফার্স্ট গার্ল নয়নার দিকে তাকিয়ে বললেন 
নয়না, তুমি বলতো নতুন স্যারের কাছে পড়তে তোমাদের এতো আপত্তি কেন?
অমনি সুদীপ আবার লাফিয়ে উঠল     
ও কি করে বলবে স্যার? বইয়ের কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই কি হক কথা বলতে পারা যায়? তাই আমি বলছি স্যার। বিনীতস্যার প্রথম যেদিন সায়েন্স ক্লাস নিতে ঢুকলেন সেদিন পড়ান শুরু করার আগে বলেছিলেন, দ্যাখ একটা হাঁটতে না শেখা বাচ্চার সামনে সব্বাই যদি গ্যাঁট হয়ে বসে শুধু মুখে বলে যায়, হাঁট, হাঁট, তাহলে ও কোনদিন হাঁটতে শিখবে না। কারণ ও তো জানেই না হাঁটা কাকে বলে। ওর সামনে সবাই যখন হাঁটবে তখন ও প্রথম হাঁটা দেখবে, ওর হাঁটা ব্যাপারটাকে মজার মনে হবে, ভাল লাগবে। তখন ও নিজে হাঁটার চেষ্টা করবে আর তারপরেই দেখবি হাঁটছে। তেমনি সায়েন্সটাকে আগে চোখ দিয়ে দ্যাখ, দেখলেই মজা পাবি, মজা পেলেই ভাল লাগবে, ভাল লাগলেই পড়বি আর পড়তে পড়তেই শিখে যাবি। হ্যাঁ, কোন কোন বাচ্চা যেমন হাঁটা দেখতে দেখতেই শিখে যায় কাউকে কাউকে আবার দুদিন হাত ধরে হাঁটাতেও হয় কারণ সে পড়ে যাওয়ার ভয় পায়। তার ভয়টা ভেঙে দিতে হয়। সেইরকম তোদের মধ্যেও কারো কারো পারব না’র ভয়টা আছে। তাদেরও, ওই পারব না’র ভয়টা ভেঙে দিতে, দুদিন হাত ধরে পারিয়ে দিতে হবে। ব্যস। শোন ভাল স্টুডেন্ট মন্দ স্টুডেন্ট বলে কিচ্ছু নেই রে আছে শুধু ভয় না পাওয়া স্টুডেন্ট আর ভয় পাওয়া স্টুডেন্ট। বিকলাঙ্গ ছাড়া কোন বাচ্চা দেখাতে পারবি যে হাঁটা শেখেনি। তেমনি তোরাও সবাই সায়েন্স শিখে যাবি। সব্বাই। স্যার সেদিন প্রথম মনে হয়েছিল আমিও পারব। স্যার, কাউকে কাউকে যে দুদিন হাত ধরে হাঁটিয়ে, পড়ে যাওয়ার ভয়টা ভেঙে দিতে হয়, এটা আর কোন স্যার কি কখনো ভেবেছেন? এবার আপনিই বলুন, কেন বিনীতস্যারকে চাইব না?      
বাঃ, এই ফেলু ছেলেটা যে এতো সুন্দর গুছিয়ে বলতে পারে খেয়াল করেন নি তো কোনদিন! কিন্তু ও যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল তার উত্তর তো হেডমাস্টার নিকুঞ্জবাবুর কাছেও নেই। তাই সামাল দিতেই বলতে হল  
দেখ, ইন্দ্রস্যার কতো কোয়ালিফাইড, কতো কিছু জানেন...
ব্যস, অমনি আবার তিড়িং করে উঠে দাঁড়ালো সুদীপ   
স্যার, উনি কতো কোয়ালিফাইড আর কতো জানেন সেটা  বেশি জরুরি না আমরা কতোটা সহজে শিখলাম, সেটা বেশি জরুরি? স্যার ইন্দ্রস্যার পড়ান টু এভরি অ্যাকশন দেয়ার ইজ অ্যান ইকুয়াল এন্ড ওপোজিট রিঅ্যাকশন, নাইট্রোজেনের ভ্যালেন্সি তিন আর হাইড্রোজেনের এক তাই অ্যামোনিয়ার ফর্মুলা NH3। ওই খটমটে কথাগুলো কানে ঢোকে ঠিকই কিন্তু মাথায় ঢোকে না, স্যার। অথচ সেটাই বিনীতস্যার যখন পড়ান, যেমন কম্ম তেমনি ফল, যত জোরে দেওয়ালে মাথা ঠুকবি দেওয়ালও ততো জোরে তোর মাথায় ব্যাথা দেবে। অথবা নাইট্রোজেনের তিন তিনটে হাত কিন্তু হাইড্রোজেনের যে একটা মোটে হাত তাই নাইট্রোজেনটা তিনটে হাত দিয়ে তিনটে হাইড্রোজেনকে ধরে। কিন্তু এতো কথা লিখবে কে? তাই ছোট্ট করে লিখলাম NH3 আর ওটার নাম দিলাম অ্যামোনিয়া। তখন কই খটমটে লাগে না তো, টুক করে মাথায় ঢুকে যায়।          
ইন্দ্রবাবু রে রে করে উঠলেন, এ সব কি? এসব তো ওভার সিমপ্লিফিকেশন। যেটা যা সেটাকে সেভাবেই শিখতে হবে। এ কি সাহিত্য নাকি যে যাহোক একটা অ্যান্যাল্যাজি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম আর হয়ে গেল?  
এদিকে বাকি যাঁরা ইন্দ্রবাবুর হয়ে মুখ খুলবেন ভেবেছিলেন তাঁরা ততোক্ষণে, সুদীপের প্রশ্নের ঘায়ে হরেনবাবুকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখে, বেইজ্জতির ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। 
শুধু হেডমাস্টার নিকুঞ্জবাবুর তখন মনে পড়ছে সেই কলেজ জীবনের কথা। খুব ইচ্ছে ছিল সায়েন্স পড়ার। কিন্তু ইচ্ছের ঘাড়ে ভয় চেপে বসেছিল। তাই ইচ্ছেটা ইচ্ছে হয়েই থেকে গেছে। ইস, তিনি যদি কোন বিনীতস্যার পেতেন।

লেখক এর নাম জানা নেই৷

(সংগৃহীত)
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by dada_of_india - 11-09-2021, 03:49 PM



Users browsing this thread: 21 Guest(s)