31-08-2021, 01:55 PM
অর্পণ
#রূপান্বিতা
এ মাসেও হলো না!
প্রেগন্যান্সি কিটের দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে শুয়ে পড়ে নন্দিনী। আজ অনেক আশা নিয়ে উঠেছিল ঘুম থেকে, এত ভোরে, ফার্স্ট ইউরিনের জন্য। ভেবেছিল এবার হয়ত...
চোখে জল আর মনে ব্যথা নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকেই উঠে পড়ল নন্দিনী। আজ মেলা কাজ। ভাগ্যিস ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে, তাই সুবিধা। নইলে যতই অনাড়ম্বর ভাবে হোক, ছোট্ট গোপাল ঠাকুর আছেন বাড়িতে, তাঁকে তো ভোগ দিতেই হবে।
ভারী মন নিয়েই কাজ করছিল নন্দিনী। অফিসে আজ অনেকেই ছুটি নিয়েছে। তাই ও ছুটি নিতে পারে নি। তবে, এইচ আর ম্যানেজারকে বলে কিছুক্ষণের ব্রেক নিয়েছে।
আয়োজন সামান্যই। তবে, পায়েস টা করতে গিয়েই চোখে আবার জল এলো ওর। যদি ওর কোল জুড়ে আসত 'সে'? এমনিভাবে পায়েস, মিষ্টি... আরও কত কী রান্না করে দিত! বিকেলে বার্থডে পার্টি হতো! 'ওর' বন্ধুরা ছোটাছুটি করত আর তাদের মায়েরা বলে উঠত "আস্তে আস্তে! পড়ে যেও না যেন!" আর ও অত ব্যস্ততাতেও হাসিমুখে সব সামলাতো...
তার বদলে এখন কি আছে ওর জীবনে? খালি কাজ কাজ আর কাজ। আর দায়িত্ব। অর্ণবের সাথে দিনে পাঁচটা কথাও হয় কিনা সন্দেহ। দেড় বছর ধরে বাড়ি থেকে অফিস করছে। কোথাও বেড়াতে যাওয়া নেই, আনন্দ নেই, মজা নেই...। এমনকি.. বাবা মা ও নেই! এটা একটা জীবন!
"ধ্যাত্তেরি!" বলে পায়েসের বাটির পাশে হাতাটা নামিয়ে রাখে ও।
কিচ্ছু ভাল লাগে না।
এর চেয়ে মরে গেলেই বেশি ভাল হত।
মরে যাওয়া কি খুব খারাপ কিছু নাকি? খারাপ হলে কি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখতেন, "মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান?"
আর এই হাসিখুশি জীবন, নিত্য নতুন শাড়ি কেনা, জাঙ্ক জুয়েলারি কেনা... আর পারছে না ও। এই অভিনয়... কোনো অস্কার বিজয়িনীর চেয়ে কি কম কিছু?
এ জীবন রেখে লাভ কি?
ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় ও। 'কিভাবে', সেটা না ভেবেই।
ভেবেছিল মন হাল্কা হবে, কিন্তু আরও যেন ভারী লাগছে। চলে যেতে হবে বলেই কি?
শাশুড়ি মায়ের আমলের কাঁসার থালা, গেলাস বের করে ভোগ সাজায় সুন্দর করে নন্দিনী। তারপর নিবেদন করে।
আহা! কী সুন্দর লাগছে সিংহাসনে আসীন গোপালকে! গোপু সোনা কে!
আর দেখা হবে না!
আবার হতেও পারে। হয়ত তাঁর কাছেই যাবে ও। সবাই তো তাই যায়, শুনেছে!
চোখে জল নিয়েই পুজো সারে নন্দিনী। তারপর সোফাটায় বসে।
সামান্য কিছু কাজ আছে আজ অফিসের। কিন্তু করে কি লাভ? তারচেয়ে রেজিগনেশান দিয়ে দেবে আজ? নাঃ, তাহলেই এইচ আরের ফোন আসবে। বলবে "এই তো সব ঠিক ছিল, তুমি ব্রেক নিলে.. কি হল?"
কি উত্তর দেবে ও।
আর পারছে না? জীবন থেকে খুব ক্লান্ত? এটাই বলবে?
সত্যি বলতে কি, ও তো কাউন্সেলিং ট্রাই করেছে। কিন্তু কন্টিনিউ করে নি। চিকিৎসা চলাকালীন এভাবে পিছিয়ে আসা ঠিক নয় জেনেও কন্টিনিউ করেনি। শুধু মিউজিক থেরাপির জন্য দেওয়া গানগুলো এখনও শোনে ও...
আজকাল খুব রাগ হয়। খুব, খুব রাগ! ভেঙেচুরে দিতে ইচ্ছে করে সব। অর্ণব বেশ কয়েকবার অ্যাডাপশানের কথা বলেছে, কিন্তু ও গা করেনি। বারবার মনে হয়েছে, কেন পারবে না ও, বায়োলজিক্যাল মাদার হতে? ওর মধ্যে কি নেই?
ও কি মা হবার যোগ্য না?
এই কথা গুলো মনে পড়তেই যেন আরও ক্লান্ত লাগে ওর। আজ উপোস করে আছে ও। খেতেই ইচ্ছে করছে না!
মাথাটা এলিয়ে দেয় সোফায়। আইস স্কেটিং রিংক থেকে কেনা সোফা! ভেবেছিল ভাল হবে না.. কিন্তু বড্ড নরম গদি। চোখ বুজে আসে যেন, আবেশে।
হয়ত এইই শেষ শোওয়া এখানে...
"তোমার কাছে আমি নেই বলেই তুমি কাঁদছ? তুমি জানো, আমাকে কত কী সহ্য করতে হয়েছে? জন্মের সাথে সাথেই বোনের মৃত্যু... তার দায় আমার কাছে আসেনি? পরেও... নিজের মামাকে হত্যা করেছি আমি, বাধ্য হয়েই। কিন্তু বালক মাত্র ছিলাম আমি, কষ্ট কি হয়নি? গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, ভাইতে ভাইতে যুদ্ধ, সব দেখেছি, লড়েওছি! প্রেম ভেঙেছে, মন ও ভেঙেছিল, কিন্তু সেখবর রেখেছে ক'জন? আমার নামেও কি কুকথা হয়নি? কিন্তু আমি কি হেরে গেছিলাম, মা? হারলে কি আজ আমাকে পেতে? তুমি তো জানো, আমি সবার মধ্যে আছি, তবে কি আমি তোমার মধ্যেও নেই?"
ধড়মড়িয়ে ওঠে নন্দিনী... কথা ক'টি কানে লেগে আছে এখনও।
কে বলল এত কথা?
তিনিই কি... যিনি সব শিশুর মধ্যে ননীচোরা রূপে, সব কিশোরের প্রেমে মদনমোহন হয়ে, সব যুবকের মনে শ্রীকৃষ্ণ রূপে আর প্রৌঢ় মনে জীবন সারথি রূপে বিরাজমান? যিনি প্রেমময় এবং সাক্ষাৎ প্রেম?
তিনিই বললেন ওর মাঝে তিনি আছেন? তবে কি তাঁর মাঝেও ও আছে?
ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল ও।
ক'দিন আগেই একটি বলিউডের সিনেমায় দেখেছিল প্রায় আঠেরো মিলিয়ন শিশু এই মুহূর্তে অনাথ সারা বিশ্বে। তার থেকে একজনকে যদি কোলে পায় ও? যেমনি যশোদা মা পেয়েছিলেন তাঁকে?
তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে প্রণাম করে গোপালকে। তারপর, ল্যাপটপে সার্চ করতে থাকে দত্তক নেবার সরকারী ওয়েবসাইটটি। মুখে হাসি, চোখ জল নিয়ে।
স্বয়ং বিদ্যাপতি বলেছেন -
"তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ বাহির নহ মুঞি ছার।।
কিএ মানুস পসু পাখিয়ে জনমিয়ে
অথবা কীট পতঙ্গ।"
যিনি কীট পতঙ্গ, সব্বার প্রতি দয়াশীল, ক্ষমাশীল, যিনি জগতের নাথ... তিনি ওঁকে ক্ষমা করবেন না? আশীর্বাদ করবেন না? তা কি হয়?
অন্তর থেকে টইটুম্বুর মনে হাসে নন্দিনী, অনেকদিন পর।
তিনি আসছেন যে...
"মাধব বহুত মিনতি করি তোয়..."
#রূপান্বিতা
এ মাসেও হলো না!
প্রেগন্যান্সি কিটের দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে শুয়ে পড়ে নন্দিনী। আজ অনেক আশা নিয়ে উঠেছিল ঘুম থেকে, এত ভোরে, ফার্স্ট ইউরিনের জন্য। ভেবেছিল এবার হয়ত...
চোখে জল আর মনে ব্যথা নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকেই উঠে পড়ল নন্দিনী। আজ মেলা কাজ। ভাগ্যিস ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে, তাই সুবিধা। নইলে যতই অনাড়ম্বর ভাবে হোক, ছোট্ট গোপাল ঠাকুর আছেন বাড়িতে, তাঁকে তো ভোগ দিতেই হবে।
ভারী মন নিয়েই কাজ করছিল নন্দিনী। অফিসে আজ অনেকেই ছুটি নিয়েছে। তাই ও ছুটি নিতে পারে নি। তবে, এইচ আর ম্যানেজারকে বলে কিছুক্ষণের ব্রেক নিয়েছে।
আয়োজন সামান্যই। তবে, পায়েস টা করতে গিয়েই চোখে আবার জল এলো ওর। যদি ওর কোল জুড়ে আসত 'সে'? এমনিভাবে পায়েস, মিষ্টি... আরও কত কী রান্না করে দিত! বিকেলে বার্থডে পার্টি হতো! 'ওর' বন্ধুরা ছোটাছুটি করত আর তাদের মায়েরা বলে উঠত "আস্তে আস্তে! পড়ে যেও না যেন!" আর ও অত ব্যস্ততাতেও হাসিমুখে সব সামলাতো...
তার বদলে এখন কি আছে ওর জীবনে? খালি কাজ কাজ আর কাজ। আর দায়িত্ব। অর্ণবের সাথে দিনে পাঁচটা কথাও হয় কিনা সন্দেহ। দেড় বছর ধরে বাড়ি থেকে অফিস করছে। কোথাও বেড়াতে যাওয়া নেই, আনন্দ নেই, মজা নেই...। এমনকি.. বাবা মা ও নেই! এটা একটা জীবন!
"ধ্যাত্তেরি!" বলে পায়েসের বাটির পাশে হাতাটা নামিয়ে রাখে ও।
কিচ্ছু ভাল লাগে না।
এর চেয়ে মরে গেলেই বেশি ভাল হত।
মরে যাওয়া কি খুব খারাপ কিছু নাকি? খারাপ হলে কি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখতেন, "মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান?"
আর এই হাসিখুশি জীবন, নিত্য নতুন শাড়ি কেনা, জাঙ্ক জুয়েলারি কেনা... আর পারছে না ও। এই অভিনয়... কোনো অস্কার বিজয়িনীর চেয়ে কি কম কিছু?
এ জীবন রেখে লাভ কি?
ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় ও। 'কিভাবে', সেটা না ভেবেই।
ভেবেছিল মন হাল্কা হবে, কিন্তু আরও যেন ভারী লাগছে। চলে যেতে হবে বলেই কি?
শাশুড়ি মায়ের আমলের কাঁসার থালা, গেলাস বের করে ভোগ সাজায় সুন্দর করে নন্দিনী। তারপর নিবেদন করে।
আহা! কী সুন্দর লাগছে সিংহাসনে আসীন গোপালকে! গোপু সোনা কে!
আর দেখা হবে না!
আবার হতেও পারে। হয়ত তাঁর কাছেই যাবে ও। সবাই তো তাই যায়, শুনেছে!
চোখে জল নিয়েই পুজো সারে নন্দিনী। তারপর সোফাটায় বসে।
সামান্য কিছু কাজ আছে আজ অফিসের। কিন্তু করে কি লাভ? তারচেয়ে রেজিগনেশান দিয়ে দেবে আজ? নাঃ, তাহলেই এইচ আরের ফোন আসবে। বলবে "এই তো সব ঠিক ছিল, তুমি ব্রেক নিলে.. কি হল?"
কি উত্তর দেবে ও।
আর পারছে না? জীবন থেকে খুব ক্লান্ত? এটাই বলবে?
সত্যি বলতে কি, ও তো কাউন্সেলিং ট্রাই করেছে। কিন্তু কন্টিনিউ করে নি। চিকিৎসা চলাকালীন এভাবে পিছিয়ে আসা ঠিক নয় জেনেও কন্টিনিউ করেনি। শুধু মিউজিক থেরাপির জন্য দেওয়া গানগুলো এখনও শোনে ও...
আজকাল খুব রাগ হয়। খুব, খুব রাগ! ভেঙেচুরে দিতে ইচ্ছে করে সব। অর্ণব বেশ কয়েকবার অ্যাডাপশানের কথা বলেছে, কিন্তু ও গা করেনি। বারবার মনে হয়েছে, কেন পারবে না ও, বায়োলজিক্যাল মাদার হতে? ওর মধ্যে কি নেই?
ও কি মা হবার যোগ্য না?
এই কথা গুলো মনে পড়তেই যেন আরও ক্লান্ত লাগে ওর। আজ উপোস করে আছে ও। খেতেই ইচ্ছে করছে না!
মাথাটা এলিয়ে দেয় সোফায়। আইস স্কেটিং রিংক থেকে কেনা সোফা! ভেবেছিল ভাল হবে না.. কিন্তু বড্ড নরম গদি। চোখ বুজে আসে যেন, আবেশে।
হয়ত এইই শেষ শোওয়া এখানে...
"তোমার কাছে আমি নেই বলেই তুমি কাঁদছ? তুমি জানো, আমাকে কত কী সহ্য করতে হয়েছে? জন্মের সাথে সাথেই বোনের মৃত্যু... তার দায় আমার কাছে আসেনি? পরেও... নিজের মামাকে হত্যা করেছি আমি, বাধ্য হয়েই। কিন্তু বালক মাত্র ছিলাম আমি, কষ্ট কি হয়নি? গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, ভাইতে ভাইতে যুদ্ধ, সব দেখেছি, লড়েওছি! প্রেম ভেঙেছে, মন ও ভেঙেছিল, কিন্তু সেখবর রেখেছে ক'জন? আমার নামেও কি কুকথা হয়নি? কিন্তু আমি কি হেরে গেছিলাম, মা? হারলে কি আজ আমাকে পেতে? তুমি তো জানো, আমি সবার মধ্যে আছি, তবে কি আমি তোমার মধ্যেও নেই?"
ধড়মড়িয়ে ওঠে নন্দিনী... কথা ক'টি কানে লেগে আছে এখনও।
কে বলল এত কথা?
তিনিই কি... যিনি সব শিশুর মধ্যে ননীচোরা রূপে, সব কিশোরের প্রেমে মদনমোহন হয়ে, সব যুবকের মনে শ্রীকৃষ্ণ রূপে আর প্রৌঢ় মনে জীবন সারথি রূপে বিরাজমান? যিনি প্রেমময় এবং সাক্ষাৎ প্রেম?
তিনিই বললেন ওর মাঝে তিনি আছেন? তবে কি তাঁর মাঝেও ও আছে?
ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল ও।
ক'দিন আগেই একটি বলিউডের সিনেমায় দেখেছিল প্রায় আঠেরো মিলিয়ন শিশু এই মুহূর্তে অনাথ সারা বিশ্বে। তার থেকে একজনকে যদি কোলে পায় ও? যেমনি যশোদা মা পেয়েছিলেন তাঁকে?
তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে প্রণাম করে গোপালকে। তারপর, ল্যাপটপে সার্চ করতে থাকে দত্তক নেবার সরকারী ওয়েবসাইটটি। মুখে হাসি, চোখ জল নিয়ে।
স্বয়ং বিদ্যাপতি বলেছেন -
"তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ বাহির নহ মুঞি ছার।।
কিএ মানুস পসু পাখিয়ে জনমিয়ে
অথবা কীট পতঙ্গ।"
যিনি কীট পতঙ্গ, সব্বার প্রতি দয়াশীল, ক্ষমাশীল, যিনি জগতের নাথ... তিনি ওঁকে ক্ষমা করবেন না? আশীর্বাদ করবেন না? তা কি হয়?
অন্তর থেকে টইটুম্বুর মনে হাসে নন্দিনী, অনেকদিন পর।
তিনি আসছেন যে...
"মাধব বহুত মিনতি করি তোয়..."