26-08-2021, 01:57 PM
#অন্য_রূপকথা
আজ খুব দরকারে একটু বেরিয়েছিলাম, আর অনেএএক দিন পরে মেট্রোয় চড়লাম। কী যে মজা হল!
কিন্তু নেমেই দেখি, অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। আর তখনই মনে পড়ল "নেবো, নেবো" ভেবেও ছাতা না নিয়েই চলে এসেছি। মাস দুয়েক আগে কোভিড, তারপর নিউমোনিয়া, তারও পর ভাইরাল জ্বরে ভুগেছি, তারমধ্যে বৃষ্টিতে ভিজলে তো আর রক্ষে নেই! বেজার মুখে তাই মেট্রো স্টেশানের শেডটির নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মতো অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ওখানে। ওঁদের দেখতে দেখতে ভাবছিলাম "হুঁ হুঁ বাবা, আমি একা না! অনেকেই ছাতা নিতে ভুলে যান..."।
মাস্কের আড়ালে বেশ আত্মপ্রসাদী হেসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ দেখি, ভিড়ের মধ্যে এক চেনা মুখ!
একজন বয়স্ক মানুষ। অনেক বয়স... সত্তরোর্ধ তো হবেন ই। ময়লাটে সাদা রং এর ফতুয়া আর পাজামা পরা, চোখে খুব পুরু কাঁচের চশমা, হাতে একটি তোবড়ানো বাটি এবং, অন্যহাতে একটি সরু লাঠি। উনি দমদম মেট্রো স্টেশানের এক নম্বর গেটের সামনে ভিক্ষা করেন। যাতায়াতের পথে অনেকবার দেখেছি। কারো কাছে কিছু চান না, বসেন ও না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকেন।
বৃষ্টিভেজা এই দিনে...কী যে হল...বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে। মনে হচ্ছিল, এত দুঃখ কেন, চারিদিকে? এত দৈন্য কেন? কেন দু মুঠো খাদ্যের জন্য এত কষ্ট পেতে হয়?
পরিবেশ, পরিস্থিতির কত্ত তফাৎ, তাও, আমার আকাশের তারা হয়ে যাওয়া বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। প্রতিবছর আমার আর দিদির জন্মদিনে বাবা আমাদের নিয়ে টালিগঞ্জ ট্রেন স্টেশানে যেতেন। চাল, ডাল, আলু -এইসব নিয়ে। সেইই ছিল আমাদের জন্মদিনের উৎসব। তখন একটু একটু কষ্ট হতো, সবার মতো 'হ্যাপি বার্থডে' না হওয়ায়... কিন্তু পরে যখন বুঝতে শিখলাম, মনে হতো, বছরে দু' তিনবার কেন হয় না জন্মদিন?
আজ সেই কথাগুলো মনে পড়ছিল বড্ড। তাই, ওই দাদুর কাছে এগিয়ে গেলাম। ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট নিয়ে দিলাম ওনাকে। তারপর, চলে আসার জন্য ঘুরেছি, হঠাৎ পিছন থেকে উনি ডাকলেন "এই যে, ও মামনি?"
ঘুরে তাকিয়ে দেখি, বেগুনী রঙা নোটটি ওনার হাতে। বললেন, "এত টাকা কেন দিলে মা গো?"
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম "ও কিছু না দাদু..."
"না মা, দিনকাল খারাপ, নিজের জন্যেও রাখতে হয়। আমাকে কম করে দাও কিছু।"
চমকে উঠেছিলাম।
এভাবেও বলা যায়? ভাবা যায়?
আমার সামান্য সাধ্যে আমার মাসিক রোজগারের একটি অংশ আমি দান করি সেই কলেজবেলা থেকেই। বদলে পাই অপার শান্তি। কিন্তু এভাবে কেউ আমাকে নিজের জন্য রাখতে বলেননি। এত আপন কেউ ভাবেননি। কারণ এই কথা গুলো খুব আপনার জনকেই তো শুধু বলা যায়...
আর কত বড় হৃদয় থাকলে এভাবে অচেনা একজনকে বলা যায়?
কথা বলতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়ে, ঠিক গড়িয়াহাটে দরদাম করার ভঙ্গিতে বললাম "এই যে দাদু, তোমার কথাও থাক, আমারটাও থাক। এটা নাও তবে?"
উনি নিলেন...
আমি ধন্য হলাম।
কদিন আগেই ছিল বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরুর 'দান' আমার খুব প্রিয় কবিতা। ঠিক সেই কবিতার মতোই অলৌকিক আনন্দ পাচ্ছিলাম আমি। মনে হচ্ছিল নিজেকে আরও, আরও আরও...সবটুকু দিয়ে উজাড় করে দিই, যাতে আনন্দটুকু আরও টইটুম্বুর করতে পারে...
এত যে শুনি, এ নাকি এক পোড়া সময়... তাহলে এত ভাল মানুষ এখনও আছেন কিভাবে? ওঁরা আছেন, তাই তো আমরাও আছি...আলোতে, ভালোতে...
"অসতো মা সৎ গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়"
"অসৎ থেকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমরত্বে নিয়ে যাও, সর্বত্র শান্তি বিরাজ করুক"।
ঠিক আমার ভরে যাওয়া মনের মতো শান্তি....
(পুনশ্চ - এই দাদুর নাম জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি, কিন্তু আসেন গুমা থেকে। কেউ দমদম থেকে মেট্রো বা ট্রেনে উঠলে, বা ওই পথ দিয়ে গেলে, সাধ্যমতো কিছু দিয়ে যদি সাহায্য করতে পারেন...উনি মেট্রোর এক নম্বর গেটের সামনেই দাঁড়ান। একটু কুঁজো হয়ে, হাতে একটি সরু লাঠি, চোখে পুরু চশমা...)
আজ খুব দরকারে একটু বেরিয়েছিলাম, আর অনেএএক দিন পরে মেট্রোয় চড়লাম। কী যে মজা হল!
কিন্তু নেমেই দেখি, অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। আর তখনই মনে পড়ল "নেবো, নেবো" ভেবেও ছাতা না নিয়েই চলে এসেছি। মাস দুয়েক আগে কোভিড, তারপর নিউমোনিয়া, তারও পর ভাইরাল জ্বরে ভুগেছি, তারমধ্যে বৃষ্টিতে ভিজলে তো আর রক্ষে নেই! বেজার মুখে তাই মেট্রো স্টেশানের শেডটির নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মতো অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ওখানে। ওঁদের দেখতে দেখতে ভাবছিলাম "হুঁ হুঁ বাবা, আমি একা না! অনেকেই ছাতা নিতে ভুলে যান..."।
মাস্কের আড়ালে বেশ আত্মপ্রসাদী হেসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ দেখি, ভিড়ের মধ্যে এক চেনা মুখ!
একজন বয়স্ক মানুষ। অনেক বয়স... সত্তরোর্ধ তো হবেন ই। ময়লাটে সাদা রং এর ফতুয়া আর পাজামা পরা, চোখে খুব পুরু কাঁচের চশমা, হাতে একটি তোবড়ানো বাটি এবং, অন্যহাতে একটি সরু লাঠি। উনি দমদম মেট্রো স্টেশানের এক নম্বর গেটের সামনে ভিক্ষা করেন। যাতায়াতের পথে অনেকবার দেখেছি। কারো কাছে কিছু চান না, বসেন ও না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকেন।
বৃষ্টিভেজা এই দিনে...কী যে হল...বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে। মনে হচ্ছিল, এত দুঃখ কেন, চারিদিকে? এত দৈন্য কেন? কেন দু মুঠো খাদ্যের জন্য এত কষ্ট পেতে হয়?
পরিবেশ, পরিস্থিতির কত্ত তফাৎ, তাও, আমার আকাশের তারা হয়ে যাওয়া বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। প্রতিবছর আমার আর দিদির জন্মদিনে বাবা আমাদের নিয়ে টালিগঞ্জ ট্রেন স্টেশানে যেতেন। চাল, ডাল, আলু -এইসব নিয়ে। সেইই ছিল আমাদের জন্মদিনের উৎসব। তখন একটু একটু কষ্ট হতো, সবার মতো 'হ্যাপি বার্থডে' না হওয়ায়... কিন্তু পরে যখন বুঝতে শিখলাম, মনে হতো, বছরে দু' তিনবার কেন হয় না জন্মদিন?
আজ সেই কথাগুলো মনে পড়ছিল বড্ড। তাই, ওই দাদুর কাছে এগিয়ে গেলাম। ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট নিয়ে দিলাম ওনাকে। তারপর, চলে আসার জন্য ঘুরেছি, হঠাৎ পিছন থেকে উনি ডাকলেন "এই যে, ও মামনি?"
ঘুরে তাকিয়ে দেখি, বেগুনী রঙা নোটটি ওনার হাতে। বললেন, "এত টাকা কেন দিলে মা গো?"
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম "ও কিছু না দাদু..."
"না মা, দিনকাল খারাপ, নিজের জন্যেও রাখতে হয়। আমাকে কম করে দাও কিছু।"
চমকে উঠেছিলাম।
এভাবেও বলা যায়? ভাবা যায়?
আমার সামান্য সাধ্যে আমার মাসিক রোজগারের একটি অংশ আমি দান করি সেই কলেজবেলা থেকেই। বদলে পাই অপার শান্তি। কিন্তু এভাবে কেউ আমাকে নিজের জন্য রাখতে বলেননি। এত আপন কেউ ভাবেননি। কারণ এই কথা গুলো খুব আপনার জনকেই তো শুধু বলা যায়...
আর কত বড় হৃদয় থাকলে এভাবে অচেনা একজনকে বলা যায়?
কথা বলতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়ে, ঠিক গড়িয়াহাটে দরদাম করার ভঙ্গিতে বললাম "এই যে দাদু, তোমার কথাও থাক, আমারটাও থাক। এটা নাও তবে?"
উনি নিলেন...
আমি ধন্য হলাম।
কদিন আগেই ছিল বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরুর 'দান' আমার খুব প্রিয় কবিতা। ঠিক সেই কবিতার মতোই অলৌকিক আনন্দ পাচ্ছিলাম আমি। মনে হচ্ছিল নিজেকে আরও, আরও আরও...সবটুকু দিয়ে উজাড় করে দিই, যাতে আনন্দটুকু আরও টইটুম্বুর করতে পারে...
এত যে শুনি, এ নাকি এক পোড়া সময়... তাহলে এত ভাল মানুষ এখনও আছেন কিভাবে? ওঁরা আছেন, তাই তো আমরাও আছি...আলোতে, ভালোতে...
"অসতো মা সৎ গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়"
"অসৎ থেকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমরত্বে নিয়ে যাও, সর্বত্র শান্তি বিরাজ করুক"।
ঠিক আমার ভরে যাওয়া মনের মতো শান্তি....
(পুনশ্চ - এই দাদুর নাম জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি, কিন্তু আসেন গুমা থেকে। কেউ দমদম থেকে মেট্রো বা ট্রেনে উঠলে, বা ওই পথ দিয়ে গেলে, সাধ্যমতো কিছু দিয়ে যদি সাহায্য করতে পারেন...উনি মেট্রোর এক নম্বর গেটের সামনেই দাঁড়ান। একটু কুঁজো হয়ে, হাতে একটি সরু লাঠি, চোখে পুরু চশমা...)