26-08-2021, 10:22 AM
#সেঁজুতি
একটানা কাজ করতে করতে ঘাড়ে পিঠে ব্যথা হয়ে গেছে শিবানীর। তাও আদ্ধেক কাজ ও হয়নি এখনও! এমনিতেই এই ব্লাউজের হেম করার কাজ খুব ভজঘট একটা কাজ। চোখের দৃষ্টি ভাল না হলে মুশকিল। যে কারখানা থেকে মাল নিয়ে আসে, তার কাছে গালমন্দ শুনতে হয়। পয়সা কেটে নেয়... সে অনেক হ্যাপা। আর পয়সা কেটে নেবার মতো আতান্তর, ওদের মতো পরিবারে, আর কিই বা হতে পারে! এক টাকারও অনেক দাম ওদের মা মেয়ের কাছে।
ভাবতে ভাবতেই মেঝেতে বসে বসে ঠোঙা বানানো মেয়ের দিকে নজর গেল শিবানীর। আঠা আর কাগজের বান্ডিল নিয়ে বসেছে মেয়েও। আহা, সেই সকাল থেকেই বসেছে, ওর ও নিশ্চয়ই ঘাড় আর হাত টনটন করছে, ওর মতোই।
"কি রে মাতু, একটু চা খাবি? করব?" বলেন শিবানী। মেয়ে খেলে নিজেরও খাওয়া হয় একটু। একটানা কাজের ফাঁকে একটু চা.. এই একটাই বিলাসিতা ওঁদের। পয়সা কই বিলাসিতার! সকালে চা মুড়ি, দুপুরে সেদ্ধ ভাত, রাতেও তাই। মাঝে মাঝে এই চা! ব্যস। মাছ, ডিম খুব কম হয় ওদের। আগে তবু হতো। তারপর গেলবছর আর এবছর দু'দুবার যা লকডাউন না কি, হয়ে গেল, তাতে হাতে জমা সামান্য ক'টা টাকাও শেষ। এখন তাই আরও হিসেবী হয়েছে ওরা মা মেয়ে। বলা যায় না, কখন কি হয়। এই বুধবার কারখানায় মাল দিতে গিয়ে শুনল আবার নাকি রোগটা বাড়ছে, মাসখানেকের মধ্যে নাকি আবার ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়বে।
শুনে ভয় আরো বেড়েছে।
এর আগের দুবার তবু বেঁচে গেছে, এবার কি আর পারবে? কুড়িটা ব্লাউজের হেম করলে একশো টাকা পাওয়া যায়! কিন্তু কুড়িটা করতে গেলেই প্রান বেরিয়ে যায়! ঠোঙা বানাতেও মেলা কষ্ট! হাল্কা জিনিস, এক কেজি মাল হতে না হতেই, দিন কাবার হয়ে যায়। রাতে মা মেয়ে যখন ঘুমোতে যায়, দুজনেই ব্যথায় এবং বেদনাতেও, কাতর থাকে।
শুধু যদি সেই লোকটা এরকম না হতো! সোয়ামীর মতো হতো... বাপের মতো হতো!
অ্যাই যা! আঁধার করে এলো। "বিষ্টি আসবে এক্ষুণি, সব জামা ভিজিয়ে দেবে.." বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন শিবানী। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে নজরে পড়ল, নইলে শুকনো জামা ভিজে একশা হয়ে যেত!
"অ বৌমা, বলি বাড়িতে আছো নাকি?" ডাক শুনে তাকিয়ে দেখেন বাঁড়ুজ্জে বাবু। এই পাড়ার শেষের দিকে থাকেন। ঘটকবৃত্তি করে পেট চালান। তা, উনি হঠাৎ, এখেনে?
"এই তো কাকাবাবু, ভাল আছেন?"
"হ্যাঁ, তা আছি। একটু কথা ছিল গো বৌমা।"
"আসুন না কাকাবাবু। চা খাবেন?"
"চা? তা হলে মন্দ হয় না, তবে যে খবর দেব, সেটা শুধু চায়ের না, এক্কেবারে মিষ্টি খাওয়াতে হবে! হা হা হা!"
"কি খবর কাকাবাবু?" কথার থই খুঁজে পাচ্ছিলেন না শিবানী।
"বলচি বলচি... সবুর করো। বলি, মেয়ের তোমার বয়স যেন কত হল?"
"আজ্ঞে, এই কুড়িতে পড়বে আশ্বিন মাসে।" কেমন বুক ধুকপুক করছে শিবানীর!
"বেশ, বেশ! মেয়ের গড়ন পিটন ভাল। সেদিন কার্তিকের বাড়ি ঠোঙা দিতে গেছিল, দেকলাম। তা দেকে একটু বড় বলেই মনে হয় কিন্তু!"
"না, কাকাবাবু, আমার কাছে ওর জন্মের সাট্টিফিকেট আছে তো... হাসপাতালের।"
"অ! তা মেয়ের এবার কপাল খুলে গেছে গো মা। মেয়ে এবার রাজরানি হবে!" দেঁতো হেসে বলেন বাঁড়ুজ্জে কাকাবাবু।
রাজরানি! মেয়ে... মানে মাতু? কিভাবে?
ওর হতভম্ব ভাব দেখে একটু হাসেন ঘটক মশাই। মেয়েদের বাড়ি সম্বন্ধ নিয়ে গেলে এমনি ভাব হয় বাবা মা দের। উনি জানেন।
"শোনো বৌমা, বড় ঘরের সম্বন্ধ এসেছে। যেচে স্বয়ং লক্ষ্মী এসেছেন তোমাদের কাছে।"
"আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কাকাবাবু.."
"বলি, আমাদের দক্ষিণপাড়ায় বাবার মন্দিরটা আছে জানো তো? বিরাট অবস্থা ওদের! ফি বচর বড় করে বচরের উৎসব হয়। তাচাড়া পুজো আচ্চা তো লেগেই আচে! চাল-কলা-ফল-দক্ষিণা, মায় শাড়ি কাপড় অব্দি দেদার পায়। সেই বাড়ির গিন্নিমার তোমার মেয়েকে মনে ধরেচে গো! আমাকে ডেকে বলে 'ঠাকুরপো, ওরা গরীব, কিন্তু লোকের বাড়ি তো কাজ করে না! পালটি ঘর! আপনি বলে আসুন গিয়ে, শাঁখা সিঁদুরেই মেয়েকে নেব খন। বাপ থেকেও নেই, মেয়েটার ও তো গতি করতে হবে!' তা আমিও বললাম এ খুব ভাল কতা গিন্নিমা, আমি আজ ই যাব!" বলতে বলতে একগাল হাসলেন উনি। বাজিমাতের হাসি।
"মন্দিরবাড়ির ছেলে? কিন্তু সে তো... মানে অনেক কথাই তো কানে আসে কাকাবাবু.." শঙ্কিত গলায় বলেন শিবানী। হতভম্ব ভাবটা এখনও কাটছে না।
"ও কোনো ব্যাপার না। ওসব বিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যায় বৌমা। নেশাভাং তো করেনা! ওসব রটনা সব! ছেলে খুব ই ভাল। ওসব খচরামি করে বদলোকের রটানো.." জোর দিয়ে বলেন বাঁড়ুজ্জে বাবু।
শিবানী চুপ করে আছেন দেখে বলে চলেন "মেয়েকে একবস্তর পরিয়ে বিদেয় করার এমন সুযোগ আর পাবে না বৌমা। মেয়ের বাপ তো কবেই তোমাকে ছেড়ে পালিয়েছে, তার দুটো বিয়ে! এইরকম একটা বাড়ি থেকে ডাক এসেচে এ কি কম ভাগ্য নাকি! বাকি, মেয়েকে একটু সোয়ামীকে আঁচলে বাঁধা শিখিয়ে দিও, মেয়ের গড়ন ভাল...সব ঠিক হয়ে যাবে..." বাঁড়ুজ্জে কাকাবাবুর কথাগুলো বড় অশ্লীল লাগল শিবানীর।
তারপর নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠল "ও, মেয়ের বাবার দুটো বিয়ে, তাই মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না তাই না? তাই একজন... এমন একজন যে শুধু ছেলেদের পছন্দ করে, গোটা পাড়া জানে, তার গলায় ঝুলিয়ে দিতে হবে? দুজনের জীবন ই নষ্ট করতে হবে?"
" এ কি বলছ বৌমা, ওটা একটা রোগ। বিয়ে হলেই সেরে যাবে। আর, অন্তত, মেয়ে তোমার খেয়ে পড়ে তো বাঁচবে? মাথার ওপর ছাদ থাকবে। মেয়েমানুষের আর কি চাই? সব কি পাওয়া যায়?" হিসহিসে গলায় বলেন উনি।
মাথায় আগুন জ্বলে যায় শিবানীর। সেই অমানুষটা যখন আটমাসের মেয়েকে ছেড়ে, ওকে ছেড়ে, চলে গেছিল, পাড়ায় কানাকানি হয়েছিল অনেক। প্রথমে সহানুভূতি, আর তারপরে মস্করা। পাড়ার বৌ ঝিয়েরা "সোয়ামীকে বেঁধে না রাখতে পারলে আর কি হবে!" বলে কম কুমীরের কান্না করে নি! আর, এক ই কারণে কোনো মেয়ে যদি কাউকে ছেড়ে যায়? এই ভদ্দরলোকেদের সমাজ সেটা মেনে নেবে? ছিছিক্কার ফেলে দেবে না?
"বাঁড়ুজ্জে কাকা আপনি আসুন। আপনার গিন্নিমাকে বলে দেবেন, মেয়ের বাবার দুই বিয়ে হলে মেয়ের দোষ হয় না। আর ওনার ছেলের এটা কোনো রোগ না। এরকম হয়। আমি যে কারখানায় মাল দিই, সেখানে শুনেছি। ছেলে যখন ভাল, অবস্থাও যখন ভাল, তখন বাবা মায়ের চিন্তা কি! তবে কোনো মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দুজনের জীবন নষ্ট করবেন না। "
একসাথে এতগুলো কথা বলে জোরে শ্বাস নেন শিবানী। আহ, বুকের ভেতর এতগুলো বছর ধরে ধিকিধিকি জ্বলা কথাগুলো বলতে পেরেছেন। মেয়েদের ও ইচ্ছে আর অনিচ্ছে থাকে, চাহিদা থাকে, কেউ সেটা মানতেই চায় না! যুগে যুগে এইভাবেই তো মেয়েদের বলি দেওয়া হয়েছে!
চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল শিবানীর। হঠাৎ টের পান মেয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে... "ভাগ্যিস তুমি 'না' করলে মা! আমরা দুজনে একটু কষ্ট করে চলি ঠিক ই, কিন্তু আমরা ভাল আছি মা..." বলে মেয়ে...
চোখ বন্ধ করেন মা।
কষ্টের মধ্যেও ভাল থাকার, লোভ জয় করার, ওই সেদ্ধভাত টুকু খাবার যে আনন্দ ই আলাদা...
একটানা কাজ করতে করতে ঘাড়ে পিঠে ব্যথা হয়ে গেছে শিবানীর। তাও আদ্ধেক কাজ ও হয়নি এখনও! এমনিতেই এই ব্লাউজের হেম করার কাজ খুব ভজঘট একটা কাজ। চোখের দৃষ্টি ভাল না হলে মুশকিল। যে কারখানা থেকে মাল নিয়ে আসে, তার কাছে গালমন্দ শুনতে হয়। পয়সা কেটে নেয়... সে অনেক হ্যাপা। আর পয়সা কেটে নেবার মতো আতান্তর, ওদের মতো পরিবারে, আর কিই বা হতে পারে! এক টাকারও অনেক দাম ওদের মা মেয়ের কাছে।
ভাবতে ভাবতেই মেঝেতে বসে বসে ঠোঙা বানানো মেয়ের দিকে নজর গেল শিবানীর। আঠা আর কাগজের বান্ডিল নিয়ে বসেছে মেয়েও। আহা, সেই সকাল থেকেই বসেছে, ওর ও নিশ্চয়ই ঘাড় আর হাত টনটন করছে, ওর মতোই।
"কি রে মাতু, একটু চা খাবি? করব?" বলেন শিবানী। মেয়ে খেলে নিজেরও খাওয়া হয় একটু। একটানা কাজের ফাঁকে একটু চা.. এই একটাই বিলাসিতা ওঁদের। পয়সা কই বিলাসিতার! সকালে চা মুড়ি, দুপুরে সেদ্ধ ভাত, রাতেও তাই। মাঝে মাঝে এই চা! ব্যস। মাছ, ডিম খুব কম হয় ওদের। আগে তবু হতো। তারপর গেলবছর আর এবছর দু'দুবার যা লকডাউন না কি, হয়ে গেল, তাতে হাতে জমা সামান্য ক'টা টাকাও শেষ। এখন তাই আরও হিসেবী হয়েছে ওরা মা মেয়ে। বলা যায় না, কখন কি হয়। এই বুধবার কারখানায় মাল দিতে গিয়ে শুনল আবার নাকি রোগটা বাড়ছে, মাসখানেকের মধ্যে নাকি আবার ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়বে।
শুনে ভয় আরো বেড়েছে।
এর আগের দুবার তবু বেঁচে গেছে, এবার কি আর পারবে? কুড়িটা ব্লাউজের হেম করলে একশো টাকা পাওয়া যায়! কিন্তু কুড়িটা করতে গেলেই প্রান বেরিয়ে যায়! ঠোঙা বানাতেও মেলা কষ্ট! হাল্কা জিনিস, এক কেজি মাল হতে না হতেই, দিন কাবার হয়ে যায়। রাতে মা মেয়ে যখন ঘুমোতে যায়, দুজনেই ব্যথায় এবং বেদনাতেও, কাতর থাকে।
শুধু যদি সেই লোকটা এরকম না হতো! সোয়ামীর মতো হতো... বাপের মতো হতো!
অ্যাই যা! আঁধার করে এলো। "বিষ্টি আসবে এক্ষুণি, সব জামা ভিজিয়ে দেবে.." বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন শিবানী। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে নজরে পড়ল, নইলে শুকনো জামা ভিজে একশা হয়ে যেত!
"অ বৌমা, বলি বাড়িতে আছো নাকি?" ডাক শুনে তাকিয়ে দেখেন বাঁড়ুজ্জে বাবু। এই পাড়ার শেষের দিকে থাকেন। ঘটকবৃত্তি করে পেট চালান। তা, উনি হঠাৎ, এখেনে?
"এই তো কাকাবাবু, ভাল আছেন?"
"হ্যাঁ, তা আছি। একটু কথা ছিল গো বৌমা।"
"আসুন না কাকাবাবু। চা খাবেন?"
"চা? তা হলে মন্দ হয় না, তবে যে খবর দেব, সেটা শুধু চায়ের না, এক্কেবারে মিষ্টি খাওয়াতে হবে! হা হা হা!"
"কি খবর কাকাবাবু?" কথার থই খুঁজে পাচ্ছিলেন না শিবানী।
"বলচি বলচি... সবুর করো। বলি, মেয়ের তোমার বয়স যেন কত হল?"
"আজ্ঞে, এই কুড়িতে পড়বে আশ্বিন মাসে।" কেমন বুক ধুকপুক করছে শিবানীর!
"বেশ, বেশ! মেয়ের গড়ন পিটন ভাল। সেদিন কার্তিকের বাড়ি ঠোঙা দিতে গেছিল, দেকলাম। তা দেকে একটু বড় বলেই মনে হয় কিন্তু!"
"না, কাকাবাবু, আমার কাছে ওর জন্মের সাট্টিফিকেট আছে তো... হাসপাতালের।"
"অ! তা মেয়ের এবার কপাল খুলে গেছে গো মা। মেয়ে এবার রাজরানি হবে!" দেঁতো হেসে বলেন বাঁড়ুজ্জে কাকাবাবু।
রাজরানি! মেয়ে... মানে মাতু? কিভাবে?
ওর হতভম্ব ভাব দেখে একটু হাসেন ঘটক মশাই। মেয়েদের বাড়ি সম্বন্ধ নিয়ে গেলে এমনি ভাব হয় বাবা মা দের। উনি জানেন।
"শোনো বৌমা, বড় ঘরের সম্বন্ধ এসেছে। যেচে স্বয়ং লক্ষ্মী এসেছেন তোমাদের কাছে।"
"আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কাকাবাবু.."
"বলি, আমাদের দক্ষিণপাড়ায় বাবার মন্দিরটা আছে জানো তো? বিরাট অবস্থা ওদের! ফি বচর বড় করে বচরের উৎসব হয়। তাচাড়া পুজো আচ্চা তো লেগেই আচে! চাল-কলা-ফল-দক্ষিণা, মায় শাড়ি কাপড় অব্দি দেদার পায়। সেই বাড়ির গিন্নিমার তোমার মেয়েকে মনে ধরেচে গো! আমাকে ডেকে বলে 'ঠাকুরপো, ওরা গরীব, কিন্তু লোকের বাড়ি তো কাজ করে না! পালটি ঘর! আপনি বলে আসুন গিয়ে, শাঁখা সিঁদুরেই মেয়েকে নেব খন। বাপ থেকেও নেই, মেয়েটার ও তো গতি করতে হবে!' তা আমিও বললাম এ খুব ভাল কতা গিন্নিমা, আমি আজ ই যাব!" বলতে বলতে একগাল হাসলেন উনি। বাজিমাতের হাসি।
"মন্দিরবাড়ির ছেলে? কিন্তু সে তো... মানে অনেক কথাই তো কানে আসে কাকাবাবু.." শঙ্কিত গলায় বলেন শিবানী। হতভম্ব ভাবটা এখনও কাটছে না।
"ও কোনো ব্যাপার না। ওসব বিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যায় বৌমা। নেশাভাং তো করেনা! ওসব রটনা সব! ছেলে খুব ই ভাল। ওসব খচরামি করে বদলোকের রটানো.." জোর দিয়ে বলেন বাঁড়ুজ্জে বাবু।
শিবানী চুপ করে আছেন দেখে বলে চলেন "মেয়েকে একবস্তর পরিয়ে বিদেয় করার এমন সুযোগ আর পাবে না বৌমা। মেয়ের বাপ তো কবেই তোমাকে ছেড়ে পালিয়েছে, তার দুটো বিয়ে! এইরকম একটা বাড়ি থেকে ডাক এসেচে এ কি কম ভাগ্য নাকি! বাকি, মেয়েকে একটু সোয়ামীকে আঁচলে বাঁধা শিখিয়ে দিও, মেয়ের গড়ন ভাল...সব ঠিক হয়ে যাবে..." বাঁড়ুজ্জে কাকাবাবুর কথাগুলো বড় অশ্লীল লাগল শিবানীর।
তারপর নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠল "ও, মেয়ের বাবার দুটো বিয়ে, তাই মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না তাই না? তাই একজন... এমন একজন যে শুধু ছেলেদের পছন্দ করে, গোটা পাড়া জানে, তার গলায় ঝুলিয়ে দিতে হবে? দুজনের জীবন ই নষ্ট করতে হবে?"
" এ কি বলছ বৌমা, ওটা একটা রোগ। বিয়ে হলেই সেরে যাবে। আর, অন্তত, মেয়ে তোমার খেয়ে পড়ে তো বাঁচবে? মাথার ওপর ছাদ থাকবে। মেয়েমানুষের আর কি চাই? সব কি পাওয়া যায়?" হিসহিসে গলায় বলেন উনি।
মাথায় আগুন জ্বলে যায় শিবানীর। সেই অমানুষটা যখন আটমাসের মেয়েকে ছেড়ে, ওকে ছেড়ে, চলে গেছিল, পাড়ায় কানাকানি হয়েছিল অনেক। প্রথমে সহানুভূতি, আর তারপরে মস্করা। পাড়ার বৌ ঝিয়েরা "সোয়ামীকে বেঁধে না রাখতে পারলে আর কি হবে!" বলে কম কুমীরের কান্না করে নি! আর, এক ই কারণে কোনো মেয়ে যদি কাউকে ছেড়ে যায়? এই ভদ্দরলোকেদের সমাজ সেটা মেনে নেবে? ছিছিক্কার ফেলে দেবে না?
"বাঁড়ুজ্জে কাকা আপনি আসুন। আপনার গিন্নিমাকে বলে দেবেন, মেয়ের বাবার দুই বিয়ে হলে মেয়ের দোষ হয় না। আর ওনার ছেলের এটা কোনো রোগ না। এরকম হয়। আমি যে কারখানায় মাল দিই, সেখানে শুনেছি। ছেলে যখন ভাল, অবস্থাও যখন ভাল, তখন বাবা মায়ের চিন্তা কি! তবে কোনো মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দুজনের জীবন নষ্ট করবেন না। "
একসাথে এতগুলো কথা বলে জোরে শ্বাস নেন শিবানী। আহ, বুকের ভেতর এতগুলো বছর ধরে ধিকিধিকি জ্বলা কথাগুলো বলতে পেরেছেন। মেয়েদের ও ইচ্ছে আর অনিচ্ছে থাকে, চাহিদা থাকে, কেউ সেটা মানতেই চায় না! যুগে যুগে এইভাবেই তো মেয়েদের বলি দেওয়া হয়েছে!
চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল শিবানীর। হঠাৎ টের পান মেয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে... "ভাগ্যিস তুমি 'না' করলে মা! আমরা দুজনে একটু কষ্ট করে চলি ঠিক ই, কিন্তু আমরা ভাল আছি মা..." বলে মেয়ে...
চোখ বন্ধ করেন মা।
কষ্টের মধ্যেও ভাল থাকার, লোভ জয় করার, ওই সেদ্ধভাত টুকু খাবার যে আনন্দ ই আলাদা...