22-08-2021, 10:02 PM
Chapter-01
প্রথম প্রেম
আমার বয়স তখন ১৭, ক্লাস ১০ এ পড়ি। আমাদের পাড়ায় আমার বাবার ছোটবেলার এক বন্ধু থাকতেন। স্বামী স্ত্রী আর তাদের এক ছেলে সুব্রতকে নিয়ে তাদের সংসার। সুব্রতকে দেখতে হ্যান্ডসাম হলেও, ওকে খুব কেবলা আর লাজুক প্রকৃতির মনে হতো। ওরা মাঝে মাঝে সপরিবারে আমাদের বাড়িতে গল্প করতে আসত, আর আমরাও বাবা মায়ের সাথে ওদের বাড়ি যেতাম।
আমরা দু-ভাই দু-বোন, আমি সবার ছোট। বাড়িতে দাদা দিদিদের সাথে একসাথে বড় হবার জন্য আমি ওই বয়েসেই বেশ পাকা ছিলাম। সুব্রতকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম কেবলা বলে। রাস্তায় দেখা হলে আমার সাথে দাড়িয়ে কথা বলার মত সাহস-ও তার ছিল না। আমি দেখতাম আমাদের ক্লাসের অনেক মেয়েই প্রেম করছে, আর যারা প্রেম করত তারা নিজেদের মধ্যে কি সব আলোচনা করত আর খুব হাসাহাসি করতো। আমি বা যারা প্রেম করত না, তারা ওই সময় ওদের কাছে গেলে ওরা আলোচনার বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে যে অন্য কথায় চলে যেত, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারতাম। খুব রাগও হত ওদের উপর মাঝে মাঝে। আমারও ওদেরকে দেখে প্রেম করার খুব ইচ্ছা করত, কিন্তু কাউকে সে রকম মনের মতন পেতাম না। তাছাড়া আমাদের বাড়ির সবাই একটু রক্ষণশীল প্রকৃতির। দাদা দিদির চোখে পড়ার ভয়ে কোন ছেলের সাথে রাস্তায় দাড়িয়ে কথা বলার সাহসও ছিল না। সে দাদার বন্ধুই হোক বা আমার বান্ধবীদের দাদা অথবা অন্য কোন চেনা লোকই হোক।
মাঝে মাঝে সুব্রত আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কোথায় যেন যেত আর আমাদের বাড়ির দিকে ঘুরে ঘুরে দেখত। আমরা জানলার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম আর হাসাহাসি করতাম ওকে নিয়ে। একদিন আমি আমার কলেজের বান্ধবীদের সাথে বাড়ি ফিরছি, এমন সময় রাস্তায় সুব্রতর সাথে দেখা। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম, সুব্রতও হাসল কিন্তু কোন কথা না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বান্ধবীরা আমাকে বলল কি ব্যাপার রে তুই হাসলি ছেলেটাও হাসল। আমি বললাম কোন ব্যাপার নেইরে, বাবার বন্ধুর ছেলে। জিজ্ঞাসা করল কি নাম রে ছেলেটার? আমি বললাম সুব্রত। দুই দিন যেতে না যেতেই আমি দেখি কলেজে রটে গেছে যে আমি নাকি সুব্রতর সাথে প্রেম করছি।
আমি প্রথমে খুব বিব্রত বোধ করতাম, কিন্তু কিছুদিন পর থেকে আমি নিজেই কেমন সুব্রতর উপর একটা দুর্বলতা অনুভব করতে লাগলাম। আমদের বাড়ীতে ভালো কিছু খাবার তৈরি হলে মা সুব্রতদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিতেন, ওরাও তাই করতো। একদিন দাদা দিদিরা বাড়ীতে কেউ নেই, মা আমাকে বলল দীপালী ওদের বাড়ীতে এই টিফিন বক্সটা দিয়ে আয় তো। হঠাৎ মাথায় কি ভূত চাপল, খাতার একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নিয়ে একটা চিঠি লিখে ফেললাম। তারপর সেটা বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আর টিফিন বাক্সটা হাতে নিয়ে ওদের বাড়ি গেলাম। ওদের বাড়ি গিয়ে সুব্রতর মায়ের হাতে টিফিন বাক্সটা দিয়ে গল্প করতে লাগলাম। সুব্রতকে দেখছি না, কিছুক্ষণ পর সুব্রত বাড়ি ফিরল, মাসিমা বললেন দীপালী একটু দরজাটা খুলে দিয়ে আসবি সুব্রত এসেছে। আমি বললাম মাসিমা আমি ওকে দরজাটা খুলে দিয়ে আর উঠবো না, বাড়ি যাব। এই বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। সুব্রত ঢুকতেই আমি চিঠিটা ওর হাতে দিয়ে বললাম এটা লুকিয়ে পড়বে, এই বলেই দৌড়ে ওদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ি ফিরে এলাম।
চিঠিতে লিখেছিলাম,
প্রিয় সুব্রত,
অনেকদিন ধরে লক্ষ করছি যে তুমি আমাদের বাড়ির পাশে খুব ঘুরঘুর করছ। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় ঘুরে ঘুরে দেখছ। একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছ। এর মানে কি? আমাকে এইভাবে বিব্রত করার অর্থ কি? আমার বান্ধবীরা তোমাকে আমার দিকে তাকিয়ে ওই ভাবে মুচকে মুচকে হাসতে দেখে তো আমার পিছনে আদা জল খেয়ে পরে গেছে। আমি লজ্জায় কলেজে মুখ দেখাতে পারছি না। যদি কিছু বলতে চাও তো সরাসরি বললেই হয়। এইভাবে আমাকে বিপদে ফেলার কি অর্থ। আমি আজ সন্ধে ৬ টার সময় পড়তে যাবো। তোমার কিছু বলার থাকলে যেখানে কলেজ থেকে ফেরার সময় আমাদের দেখা হয়েছিল সেখানে এসে বলতে পারো। উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি -
দীপালী
সেদিন রাতে আর ঘুমোতে পারলাম না। খালি চিন্তা হচ্ছিল সুব্রত কি কাল আসবে, ওকি বুঝবে আমার মনের কথা, না ওর মা বাবাকে বলে দেবে, তা হলেতো আমার কপালে রাম পিটুনি আছে। পরদিন সময় আর কাটে না কখন ৬ টা বাজবে, একটু আগেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে গেলাম, কিন্তু এখানে তো দাড়িয়ে থাকা যায় না বেশিক্ষণ। এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলাম। নানা রকম চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুর-পাক খাচ্ছিল। আমাকে কি তাহলে ও প্রত্যাখ্যান করল। সুব্রত এলো না দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কোন রকমে চোখের জল মুছে পড়তে গেলাম। কি যে পড়াল কিছুই মাথায় ঢুকল না। স্যার বললেন দীপালী তোমার কি শরীর খারাপ। আমি বললাম হ্যাঁ, জ্বর জ্বর লাগছে। পড়া শেষ হতে বাড়ি ফিরছি, মনে হল একটা লোক আমাকে অনুসরণ করছে। অন্ধকার হয়ে গেছে, রাস্তার এই দিকটা কিছুটা ফাঁকা। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল। আমি হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম, পিছনের লোকটাও মনে হচ্ছে আরও জোরে এগিয়ে আসছে। কি করবো দৌড়ব, দৌড়াতে যাব এমন সময় মনে হল কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। কান পেতে শুনলাম হ্যাঁ আমাকেই তো ডাকছে, পিছন ফিরে দেখি সুব্রত। আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে কোথায় যেন ভানিস হয়ে গেল। চিঠিটা হাতে পেয়ে আমি চলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। পা থাকে মাথা পর্যন্ত একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। বুকের মধ্যে চিঠিটা ঢুকিয়ে এক ছুটে বাড়ি পৌছে গেলাম। বই খাতা রেখে বাথরুমে ঢুকলাম। বুকের ভিতর থেকে চিঠিটা বার করে পড়তে লাগলাম।
দু পাতার চিঠি। বেশ গুছিয়ে লেখা, আবার প্রেমের কবিতার উদ্ধৃতি ও রয়েছে। একবার পুরোটা পরে আবার একবার পড়লাম। আনন্দে চিঠিটাকে দু-চারটে চুমু খেয়ে নিলাম। তারপর ভাজ করে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে বাথরুম থেকে বেরলাম। খালি মনে হচ্ছিল কখন গিয়ে বন্ধুদের বলবো। ঠিক করলাম আগে প্রতিমাকে বলবো। ওই আমার সবথেকে কাছের বন্ধু। প্রতিমা বেশ পাকা মেয়ে, প্রেম ও করে কিন্তু আমাকে সেরকম কিছু জানায় নি। কলেজের টিফিনের সময় সব কিছু উজাড় করে ওকে বললাম। সেদিন কলেজের পর সুব্রত আমাকে দেখা করতে বলেছে। প্রতিমাকে আমার দরকার, একা সুব্রতর সাথে ঘোরার সাহস পাচ্ছিলাম না। প্রতিমাকে রাজী করিয়ে আমি ওকে নিয়ে বেরলাম সুব্রতর সাথে দেখা করতে। আজ সুব্রত আগেই এসে গেছে। পাশাপাশি হাটছি কারোর মুখে কোন কথা নেই। আমিই কথা শুরু করলাম। বললাম সপ্তাহে একদিনের বেশী দেখা করবো না। আর মাঝে মাঝে চিঠি আদান প্রদান করবো। এই ভাবে কয়েক মাস কেটে গেল।
হঠাৎ আমার অঙ্কের মাস্টার বদলি হয়ে গেলেন। আমার প্রাইভেট পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সুব্রতর সাথে দেখা করাটাও সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। দেখলাম আমি সুব্রতকে যেরকম কেবলা ভাবতাম মোটেই সে রকম নয়। আমার অঙ্ক নিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। বাবা অফিস থেকে ফিরে মাঝে মাঝে দেখিয়ে দিতেন, আবার মাঝে মাঝে বিরক্ত ও হতেন। আমার জন্মদিনের দিন সুব্রতর মা আমাদের বাড়ীতে এলেন। কথায় কথায় আমার পড়ার কথা উঠল। মা বললেন আপনার সন্ধানে কোন ভালো অঙ্কের মাস্টার আছে কি না? উনি বললেন সুব্রত যার কাছে পড়তে যায় সে অনেক দূরে থাকে, আর কাছাকাছি ভাল কাউকে আমি চিনি না। দীপালী বাচ্চা মেয়ে ওর পক্ষে অত দুর পড়তে যাওয়া অসুবিধা। তার থেকে তুমি যতদিন মাস্টার না পাচ্ছ ততদিন দীপালী তো সুব্রতর কাছে গিয়ে পড়তে পারে। সুব্রত আরও কিছু ওদের ক্লাসের ছেলেদের অঙ্ক করায়। আমি বললাম কবে থেকে পড়তে যাবো। মাসিমা বললেন আজ আমার সাথে চল, সুব্রত বাড়িতেই আছে। ওর কাছেই জেনে নিবি কবে থেকে আর কখন পড়াবে। আমি আমার ঘরে গিয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। তাড়াতাড়ি বই খাতা নিয়ে চললাম মাসিমার সাথে ওদের বাড়ি।