08-08-2021, 09:00 AM
Update 6
সময়টা শরৎকাল । আগমণীর সুর বেজে উঠেছে পুরো শহরে। নীল আকাশে সাদা তুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। সব সময় একটা হিমেল হাওয়া শরীর স্পর্শ করে মন জুড়িয়ে দিচ্ছে। শহরের বাইরে কাশফুল ফুটে আছে। অবশ্য সেই ফুল দেখার সৌভাগ্য সুচি আর আকাশের কারোরই হয়নি।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সুচি আর আকাশের দুটি চারিত্রিক গুণ সবাই লক্ষ্য করেছে। সেগুলোকে অবশ্য গুণ না বলে বদ গুণ বলাই শ্রেয় । কারন সেগুলো হলো সুচির রাগ আর আকাশের জেদ ।
সুচি একবার রেগে গেলে সবকিছু ভুলে যায় । যার উপর রেগে যায় সে যদি তার থেকে বয়সে ছোট হয় তাহলে সে সুচির হাতের চড় খাবেই খাবে। এইতো সেদিন বিপ্লব বিচ্ছু বাদশার দিকে একটা ঢিল ছুঁড়েছিল । পশু পাখি দেখলে যেন হাত নিশপিশ করে । ঢিল ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুচির ডান হাত ঠাসসস আওয়াজ করে বিপ্লব বিচ্ছুর বাঁ গালে বসে গেল । এমন ভাবে বসলো যে চারটে আঙুলের দাগ পড়ে রইলো দু দিন। এতে অবশ্য বিপ্লব বিচ্ছু আর সুচি দুজনেই বকা খেল তাদের মা বাবার কাছে। বিপ্লব বিচ্ছু বকা খেল বাদশার গায় ঢিল ছোঁড়ার জন্য আর সুচি বকা খেল বিপ্লব কে মারার জন্য।
আর আকাশের জেদের কথা যদি বলি তাহলে মামার বিয়ে বাড়ি থেকে এসে জেদ ধরে বসলো যে তার টিভি চাই । যথারীতি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিল। দুই দিনের মধ্যে আকাশের বাবা একটা টমসন কোম্পানির নতুন বোকা বাক্স কিনে আনতে বাধ্য হলেন। অঙ্কিতা বলেছে “ টিভিতে অনেক নৃত্য অনুষ্ঠান হয়। সেই সব দেখবি । তাহলে অনেক কিছু শিখতে পারবি। „ অঙ্কিতার কথা মতো সে দিদিমার সাথে বসে বিভিন্ন রাজ্যের ক্লাসিক্যাল নৃত্য অনুষ্ঠান দেখে। দিদিমাও খুব উপভোগ করেন এই নৃত্য অনুষ্ঠান গুলো।
মহালয়ার সকাল। সুচির বাবা তার বাবার সময়ের একটা পুরানো রেডিও চালু করে মহালয়া শুনছেন । সরকারি অফিস ছুটি । তাই তিনি নিশ্চিত মনে মহালয়া শুনতে শুনতে এই পূজায় কোথায় কোথায় যাওয়া যায় সেটাই ভাবছেন । সুচি বাবার সাথে ছোটবেলা থেকেই মহালয়া শুনেছে তাই সে এবার নতুন অভিজ্ঞতার জন্য আকাশ আর দিদিমার সাথে টিভিতে মহালয়া পাঠ দেখছে ।
আকাশের মা ঘুম থেকে উঠে রাতের কাপড় বদলে সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর জন্য রান্না ঘরে এলেন । তার স্বামী এখন সবে বাথরুমে গেছেন । পূজার ছুটিতে সমস্ত কর্মচারীদের বেতনের সাথে বোনাস দিয়ে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু কোম্পানির মালিক ছুটি নেন নি। তাই আকাশের মা একটু রেগে আছেন।
রান্না ঘরে এসে তিনি জানালাটা খুলে দিলেন। আগেই বলেছি রান্নাঘর থেকে খেলার মাঠ দেখা যায়। আর সেই খেলার মাঠ সংলগ্ন রহমত চাচার ঘুবচি ঘরটা আছে। তিনি জানলা দিয়ে দেখতে পেলেন কয়েকজন ওই ঘরের আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি সেটা দেখে অতো খেয়াল করলেন না । মহালয়ার সকাল ! হয়তো কেনাকাটা কিংবা আড্ডা দিচ্ছে। দশ মিনিট যেতে না যেতেই তিনি দেখলেন সংখ্যাটা দুই তিন জন থেকে এখন দশ বারো জন হয়ে গেছে আর একটু শোরগোল ও হচ্ছে । এবার তার মনে হলো নিশ্চয়ই কিছু গোলযোগ হয়েছে “ শুনছো ? নিচে চাচার ঘরের সামনে এতো লোকের ভিড় কেন ? একটু দেখে এসো না ! „
আকাশের বাবা তখন ব্রাশ করা শেষ করেছেন। বাইরে এসে বললেন “ কই ? „
“ এই দেখো। „ বলে আকাশের মা রান্নাঘরের জানালা দেখিয়ে দিলেন।
ততক্ষনে সুচি আকাশ দিদিমা সবাই রান্নাঘরে এসে হাজির। আকাশের বাবা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে বললেন “ সত্যি তো । এতো লোকের ভীড় কেন ? „ বলে তিনি হন্তদন্ত হয়ে নিচে চলে গেলেন।
পিছন পিছন দিদিমা সুচি আর আকাশ ও এলো। নিচে পৌঁছে আকাশের বাবা দেখলেন সংখ্যাটা এখন কুড়ি ছাড়িয়ে গেছে। আকাশের বাবা নিচে নেমে একজনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বললো “ চাচা মারা গেছেন । „
কথাটা শুনে আকাশের বাবার মনটা ভারী হয়ে উঠলো। কলেজ জীবন থেকে তিনি এই বৃদ্ধকে দেখে আসছেন। ঠিক সেই সময় তিনি দেখলেন তার শাশুড়ি আকাশ আর সুচি কে নিয়ে এদিকেই আসছেন। তিনি প্রায় দৌড়েই বীণাপাণি দেবীর কাছে গিয়ে সুচি আকাশ শুনতে না পায় এমন নীচু স্বরে বললেন “ মা তুমি এদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাও । এদের এখানে থাকা ঠিক না । „
“ কেন কি হয়েছে ? „ দিদিমার কৌতুহলি প্রশ্ন।
“ চাচা মারা গেছেন । „
কথাটা শুনেই আকাশের বাবার মতোই আকাশের দিদিমার মনটাও কেঁদে উঠলো। বুকটা মুচড়ে উঠলো। চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে সংযত করলেন । তিনি সঙ্গে সঙ্গে সুচি আর আকাশকে বললেন “ চল এখান থেকে । „
“ কি হয়েছে দিম্মা ? „ সুচি আর কৌতূহল সামলাতে পারে না।
“ উপরে চল তারপর বলছি। „ দিদিমা দুজনকেই ঘরে নিয়ে চলে এলেন। ঘরে এসে সুচি আবার জিজ্ঞেস করলো “ কি হয়েছে দিম্মা ? „
“ অতো জেনে কাজ নেই। এখানেই থাকবি । নিচে নামবি না। „ সুচিকে একটু ধমকে বললেন যাতে সে নিচে না নামে।
এই প্রথম সুচি দিম্মার কাছে ধমক খেলো। সুচি অবাক তো হলোই সাথে ধমকের জন্য দিম্মার কথার অমান্য না করার সাহসটাও পেলো না। তাই সুচি মুখটা বেজার করে সোফায় বসে রইলো। সুচিকে চুপ মেরে যেতে দেখে আকাশও শান্ত হয়ে রইলো।
সুচিকে ধমকিয়ে নিজের মেয়ের কাছে গিয়ে বললেন “ ওদের দেখবি যাতে নিচে না যায় । „
“ কেন কি হয়েছে সেটা বলবে তো ! „
“ দাদা মারা গেছেন । „ কথাটা বলতে গিয়ে বীণাপাণি দেবীর গলা বসে এলো।
কথাটা শুনে আকাশের মায়েরও মনটা খারাপ হয়ে গেল। কতো ভালোবাসতো লোকটা আকাশ আর সুচিকে। এইসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো। চোখ মুছে তিনি দেখলেন তার মা ঘরের বাইরে যেতে শুরু করেছেন ।
সিঁড়ি দিয়ে নিচের নামার সময় তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। এই কান্না ডুকরে কিংবা ফুঁপিয়ে কান্না নয়। এটা হৃদয়ের কান্না। এতে মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ হয় না। শুধু দুই গাল বেয়ে বয়ে চলে অজস্র অশ্রুধারা।
নিচে নেমে তিনি লোকের মুখে যেটা শুনলেন সেটা হলো --- রোজ ভারের দিকেই রহমত চাচা উঠে পড়েন । কিন্তু আজ ওঠেন নি। তাই রাতে যে লোকটা পাহারা দেয় তার মনে সন্দেহ হলো। যে লোকটা রোজ ভোরে উঠে পড়ে সে আজ উঠলো না কেন ? তারপর সে এসে দরজা ধাক্কা দেয়। কিন্তু ভিতর থেকে কোন সাড়া শব্দ পায় না। তখন সে লোকজন ডেকে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখে , খাটে রহমত চাচার মৃতদেহ পরে আছে । ডাক্তার কিছুক্ষণ আগে এসে দেখে চলে গেছেন। ডাক্তারের কথায় চাচা মহালয়া শুরু হওয়ার পর দুচোখ এক করেছেন।
সব শুনে দিদিমা একবার দেখে এলেন মৃত মানুষটাকে। চোখ বুজে শুয়ে আছে। মুখে অতৃপ্তির কোন আভাস নেই। মুখটা দেখে দিদিমা ভাবলেন --- হারানো পরিবারকে পেয়ে গেছেন ।
তারপর দুপুরের দিকে আশেপাশের কয়েকজন . এসে নিজেদের কাজ করে চাচাকে স্নান করিয়ে কবর দিয়ে দিলেন । কবরস্থানে এই সোসাইটির বেশিরভাগ সদস্য গেলেন । কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় চার কাঁধের মধ্যে সুচি আর আকাশের বাবার কাঁধ ও ছিল।
দুপুরে সোসাইটি তে এতো .দের ভিড় দেখে আর বিকালে সোসাইটির গেটের পাশে দাদুকে চেয়ারে বসে থাকতে না দেখে সুচি ঠিক বুঝলো যে দাদু মারা গেছে। তাই সে আর দিম্মাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলো না। দাদুর মৃত্যুর দুঃখ নয় বছরের সুচি ঠিক ভাবে অনুভব করতে পারলো না। অনুভব করতে পারলে হয়তো সে কাঁদতো । আর তার কান্নার জন্য রহমত চাচার আত্মা কষ্ট পেত। তাই হয়তো বিধাতা সুচিকে প্রিয়জন হারানোর দুঃখ বোঝার ক্ষমতা এখনও দেয়নি।
চাচার মৃত্যুতে মহালয়ার পর থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত সোসাইটি তে শোকের ছায়া রইলো। যারা রহমত চাচার আমলে বড়ো হয়েছিলেন তাদের মুখটা কালো হয়ে রইলো। কিন্তু সোসাইটির বাচ্চাদের আনন্দ আর খুশীতে কিছুটা হলেও মুখে হাঁসি দেখা দিল ।
বিজয়ার পর চাচার ঘর বন্ধ করার সময় ঘরের ভিতর থেকে একটা ভাঙা টিনের বাক্স , কয়েকটা জামা কাপড় , একটা স্টোভ আর দুটো চেয়ার পাওয়া গেল। সেইসব বিক্রি করে দেওয়া হলো। যেটা বিক্রি করা গেল না সেটা হলো রহমত চাচার এতদিনের জমানো টাকা। প্রায় সাত থেকে আট হাজার টাকা তিনি রেখে গেছেন। আর তার কোন উত্তরাধিকারী নেই। তাই কমিউনিটি হলে সন্ধ্যার সময় সমস্ত কমিটি মেম্বার আর কয়েকজন কে নিয়ে একটা মিটিং বসলো। সেখানে কয়েকজন বললো---- টাকাটা সোসাইটির উন্নতির কাজে আসুক। কয়েকজন চাইলেন একটা---- শোকসভা করা হোক । ( যাতে পুরো টাকাটাই তাদের পেটে যেতে পারে।)
বীণাপাণি দেবী এই ধরনের প্রস্তাব শুনে আর থাকতে না পেরে বললেন “ আমি জানি ওই টাকা দাদা কার জন্য রেখে গেছেন। আমি জানি ওই টাকার উত্তরাধিকারীর নাম। „
একজন ব্যঙ্গ করে বললো “ সেই উত্তরাধিকারী নিশ্চয়ই আপনি। „
দিদিমা না রেগে শান্ত কন্ঠে বললেন “ দাদা ওই টাকা রেখে গেছেন সুচির জন্য। এটা উনি নিজে একবার আমাকে বলেছিলেন। সুচির বিশেষ দিনের জন্য উনি টাকা জমাচ্ছেন। „
কথাটা শুনে সুচির বাবার মুখ হাঁ হয়ে গেল । তিনি কি বলবেন সেটাই ভেবে পেলেন না।
সুচির বাবার মতোই আর সবাইও কিছু বলতে পারলো না। কারন সোসাইটির সবাই জানে রহমত চাচা সুচিকে কতোটা ভালবাসতেন। একটা লোভী মুখ কিছু বলার জন্য উঠছিল কিন্তু যখন সে দেখলো বীণাপাণি দেবীর কথায় তার জামাই সম্মতি সূচক মাথা নাড়ছেন তখন আর কিছু বলতে পারলো না। সোসাইটির সবাই এই রাশভারী , অহংকারী , গম্ভীর স্বভাবের লোকটাকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। কারন মানুষটার স্বভাব আগে থেকে কিছুই আঁচ করা যায় না। কখন কি করে বসে কেউ জানে না।
ফলস্বরূপ বীণাপাণি দেবীর কথামতো রহমত চাচার পুরো টাকাটাই চলে গেল সমরেশ বাবুর ব্যাঙ্কে FD হয়ে।
দুর্গাপূজা শেষ হয়ে কালীপূজা চলে এলো , সাথে সুচির বাড়িতে অতিথি হয়ে তার বড়ো মামার পরিবারও এলো। সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু বড়ো মামার ছোট মেয়েটার জন্য সুচি আর ওই বাড়িতে থাকতে পারছে না। মেয়েটার বয়স পাঁচ আর নাম পৌলমী। একটু মোটা। প্রথমেই সে এসে সুচির পুতুল গুলোর দিকে নজর দিল। পুতুল গুলো একটা বড়ো গামছার মতো কাপড়ের উপর শোয়ানো ছিল । পৌলমী এসে তার মধ্যে থেকে একটা পুতুল তুলে নিল। যেন সে দোকানে রাখা হরেকরকম পুতুলের মধ্যে থেকে একটা বেছে নিয়েছে ।
সুমি পড়ে নবম শ্রেণীতে । সে বুদ্ধিমান মেয়ে , সে ঠিক বুঝলো এই পুতুল গুলোর জন্য পৌলমী বায়না করবেই। তাই সে বোনকে ডেকে চুপিচুপি বললো “ পুতুল গুলো কোথাও একটা লুকিয়ে রাখ। পৌলমী নিয়ে নেবে। „
দিদির কথায় সুচি ভয় পেয়ে গেল। তাই পৌলমী যখন একটু অন্যমনস্ক হয়ে মামীর কাছে গেল তখন সে সমস্ত পুতুল এবং আর খেলনার জিনিস পত্র সব চুপিচুপি দিদিমা আর আকাশের ঘরের খাটের নিচে রেখে দিল । দিদিমা সুচিকে এইভাবে কিছু একটা লুকিয়ে রাখতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন “ কি লুকিয়ে রাখছিস রে ? আবার কোন বদমাইশি করছিস নিশ্চয়ই ! „
নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দিম্মাকে থামিয়ে দিয়ে সুচি বললো “ চুপ , ও শুনতে পাবে। তখন সব পুতুল নিয়ে নেবে। „
“ কে শুনতে পাবে ? আর কে পুতুল নিয়ে নেবে ? „ দিম্মার কৌতুহলী প্রশ্ন।
“ পৌলমী নিয়ে নেবে । „ বলে সে পাশের ফ্ল্যাটে চলে গেল ।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না । কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌলমী বুঝতে পারলো তার পছন্দ করা পুতুল নেই। সে তার মায়ের কাছে বায়না ধরলো “ মা আবার পুতুল চাই । „
“ বাড়ি চলো কিনে দেবো । „ বললেন বড়ো মামী।
“ না আমার সুচিদির কাছে যে পুতুল আছে , সেটা চাই । „ বলে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুললো ।
“ কি হয়েছে বৌদি ও কাঁদছে কেন ? „ ভাইঝির কান্না দেখে সুচির জিজ্ঞাসা করলেন।
“ দেখো না ! বলছে সুচির পুতুল চাই । „
“ কোন পুতুলটা রে ? „
পৌলমী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উত্তর দিল “ সুচিদির কাছে আছে । „
সুচির মা সুচিকে জিজ্ঞাসা করলেন “ তোর সব পুতুল গুলো কোথায় রে ? „
সুচি এই কথার কোন উত্তর দেয় না। মুখটা গোমরা করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুচিকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মা আরও বললেন “ যা আন । তোর কাছে তো অনেক আছে । „ বলে চোখ বড়ো বড়ো করে একটা রাগি দৃষ্টি দিয়ে শাসন করলেন ।
ফলস্বরূপ সুচি দিম্মার খাটের তলা থেকে তার সব পুতুল আনতে বাধ্য হলো। এবং তার মধ্যে থেকে আগে থেকে পছন্দ করা পুতুলটা পৌলমী নিয়ে বাড়ি চলে গেল। সুচির রাগ হলো খুব। কিন্তু সে মায়ের জন্য কিছুই করতে পারলো না। ইচ্ছা করছিল পৌলমীর গালে দুটো চড় বসিয়ে সম্ভ্রম শেখায় কিন্তু মায়ের জন্য সেই শিক্ষকতা করার সুযোগ সুবিধা কোনটাই সে পেল না।
দেখতে দেখতে আকাশের কলেজ যাওয়া বয়স হয়ে এলো । সাথে বিপ্লব বিচ্ছুর ও। কারন আকাশ আর বিপ্লব সমবয়সী। বিপ্লব সুচির কলেজেই ভর্তি হবে। কিন্তু আকাশের বাবা আকাশের জন্য মহানগরীর সেরা কলেজের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছেন । একদিন রাতে আকাশের বাবা অফিস থেকে আসার পর স্নেহা দেবীর সাথে এই নিয়ে আলোচনা করছেন “ দুটো ভালো কলেজ পেয়েছি। যোগাযোগ করেছি। একটু দূরে এই যা ! „
“ হোক দূরে । একটা মাত্র ছেলে আমার । „ বললেন আকাশের মা।
আকাশ তার বাবা আর মায়ের এই আলোচনার কিছু অংশ শুনতে পেলো । তাই সে রাতে ঘুমানোর সময় দিদিমা কে জিজ্ঞেস করলো “ দিদিমা আমি কলেজে যাবো ? „
“ হ্যাঁ যাবি তো। পরের বছর থেকেই তো কলেজে যাবি। কেন ! খুশি না তুই ? „ আকাশকে কাছে টেনে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন দিদিমা।
“ খুব আনন্দ হবে তাই না ! „ বলে দিদিমাকে আরো ভালো করে জড়িয়ে ধরলো আকাশ ।
“ খুব আনন্দ হয় কলেজে। সাথে পড়াশোনাও করতে হয়। „
পরের দিন যথারীতি আকাশ সুচিকে খবর টা দিল “ আমি তোর থেকেও ভালো কলেজে ভর্তি হবো । „ ভুরু নাঁচিয়ে বললো আকাশ।
সুচির খুব ইচ্ছা ছিল সে তার দিদির সাথে কলেজে যাবে। কিন্তু সেই ইচ্ছা কখনোই পূরন হয় নি। আকাশ তার সাথে কলেজে যাবে না শুনে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল । আকাশ যাতে ওর সাথে কলেজে যায় তার জন্য কিছু একটা করতে হবে। কি করতে হবে সেটা সে ভেবে নিল। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে সে বললো “ যা । কিন্তু ওখানে আমাকে পাবি না বাঁচানোর জন্য । „
“ মানে ? „ বাঁচা মরার কথা শুনে আকাশের মুখ হাঁ হয়ে গেল। পাঁচ বছরের আকাশ সুচির কথায় ভয় পেয়ে গেল।
গলাটা যতোটা সম্ভব তীক্ষ্ণ করা যায় ততোটা তীক্ষ্ণ করে ভয় দেখিয়ে বললো “ মানে কলেজে কি হয় জানিস তুই ? „
আকাশকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নয় বছরের সুচি চোখ বড়ো বড়ো করে আরো বললো “ জানিস , কলেজে বড়ো দাদারা বাচ্চাদের ধরে ধরে মারে। তাদের খাবার কেরে খেয়ে নেয় । কোন বন্ধু হয় না । „
এইসব শুনে আকাশের চোখ আরও বড়ো হয়ে গেল। বুকটা ঢিবঢিব করতে শুরু করলো । আকাশকে ওই ভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুচি দুই গালে দুটো গর্ত করে আর ঠোঁটের কোনায় একটা হাঁসি নিয়ে বললো “ তাই বলছি আমার কলেজে ভর্তি হ। বিপ্লব ও তো ওখানেই ভর্তি হচ্ছে । একসাথে পড়বি। আর আমি তো আছি। „
আকাশ কে তবুও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো “ যা দিম্মা কে গিয়ে বল আমার কলেজেই ভর্তি হবি। „
সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দৌড়ে আকাশ নিজের ঘরে গিয়ে দিদিমা কে বললো “ আমি সুচির কলেজে ভর্তি হবো । „
“ হঠাৎ এই কথা। সুচি বলেছে বুঝি। „
আকাশ কোন উত্তর নি দিয়ে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলো। এটা দেখে দিদিমা ঠোঁটের কোণায় একটা হাঁসি নিয়ে বললেন “ বুঝেছি। আজ রাতে তোর বাবা আসুক । „
মেয়েকে তিনি আগেই রাজী করিয়ে নিয়ে ছিলেন। শুধু জামাইকে মানানো বাকি। তাই রাতে শুভাশীষ বাবু এসে ফ্রেশ হয়ে নিলে বীণাপাণি দেবী কথাটা পাড়লেন “ আকাশের ইচ্ছা ও সুচির সাথে কলেজে যাবে। একমাত্র দাদুভাই আমার । ওকে তুমি সুচির কলেজেই দাও। „
আকাশের বাবা শুধু বললেন “ ঠিক আছে। ওকে সুচিত্রার কলেজেই ভর্তি করাবো । „ আকাশের বাবা মাঝে মাঝে আকাশের এই ইচ্ছা পূরণের অদ্ভুত উপায় দেখে খুব খুশি হন। ওনার কাছে যদি এরকম একজন দিদিমা থাকতো। তাহলে হয়তো কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকতো না।
সেই কথা মতো আকাশের বাবা আকাশকে সুচির কলেজেই ভর্তি করালেন। সুচি এই বছর উঠলো চতুর্থ শ্রেণীতে। সুমি পদন্নোতি করলো দশম শ্রেণীতে। আকাশ আর বিপ্লব বিচ্ছু kg অর্থাৎ kindergarten এ। কলেজের প্রথম দিনে স্নেহা দেবী আকাশকে স্নান করিয়ে মাথায় তেল মাখিয়ে চুল বাঁ দিকে সিঁথি কেটে তৈরি করে দিলেন। কলেজের জামা কাপড়ের রং সুচির মতোই। শুধু সুচির লাল স্কার্টের জায়গায় আকাশের লাল প্যান্ট। কলেজে যাওয়ার আগে স্নেহা দেবী তার ছেলের কপালে কাজল দিয়ে একটা কালো টিপ পড়িয়ে দিলেন । আকাশের বাবা ঘুমিয়ে থাকার জন্য তিনি আর সুচেতা দেবী মিলে সুচি আর আকাশকে কলেজে দিয়ে এলেন। রাস্তায় সুচি আর আকাশ হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কলেজে গেল।
কলেজ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আকাশ বুঝলো কলেজ অতোটাও খারাপ যায়গা না । তাই অনেক বন্ধু বানালো সে। আর আগের বন্ধু বিপ্লব বিচ্ছু তো ছিলোই। কলেজ থেকে এসে রোজ দিদিমা কে সেদিনের কলেজে ঘটা ঘটনা শোনায়।
এইভাবে কয়েক সপ্তাহ যাওয়া পর একদিন টিফিন ব্রেকে সুচি নিচে নামলো। সুচির ক্লাস ঘর দু তলায় আর আকাশের নিচে। যেটাকে গ্রাউন্ড ফ্লোর বলে সেখানেই। সুচি নিচে নেমে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলো ক্লাসের বাইরে আকাশ আর একটা মেয়ে , বাইরে রাখা একটা পরিত্যক্ত কলেজের টেবিলে বসে টিফিন খাচ্ছে। মেয়েটার নাম মৌ। মৌ নিজে খেতে পারছে না কারন তার ডান হাত ভাঙা। তাই আকাশ তার নিজের টিফিন থেকে রুটি আলুভাজা নিয়ে পরম তৃপ্তি করে নিজের হাতে মৌ কে খাইয়ে দিচ্ছে।
আকাশ সুচিকে দেখলো। কিন্তু এটা টিফিন ব্রেক । টিফিন খেতে হবে। কথা বলার সময় সারাদিন আছে। তাই আকাশ সুচিকে একবার দেখে মৌ কে আবার খাইয়ে দিতে লাগলো।
এটা দেখে সুচি রেগে গেল। ঠিক পৌলমী ওর পুতুল নিয়ে নেওয়ার সময় যেমন রাগ হয়েছিল ঠিক তেমন রাগ। রেগে গিয়ে তার দুই চোখের ভুরু কুঁচকে গেল। পৌলমী যখন পুতুল নিচ্ছিল তখন তার মা সামনে ছিলেন , তাই সে কিছুই পারে নি। কিন্তু এখন আশেপাশে আকাশের ক্লাসের বাচ্চা ছাড়া বড়ো কেউ নেই। সুচি রেগে গেলে সবকিছু ভুলে যায়। কি করবে সেটাও মাথায় আসে না। এখনও এলো না। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে যেই আকাশ একটা রুটি ছিঁড়ে মৌ এর মুখে রুটির টুকরো দিতে গেছে অমনি সুচি আকাশের হাতে কামড় বসিয়ে দিল।
কব্জির কিছুটা উপরে সুচির দাঁতের দাগ বসে গেল । প্রচন্ড ব্যাথা আর জ্বালায় আকাশ ডুকরে চিল্লিয়ে কেঁদে উঠলো। আকাশকে কাঁদতে দেখে সুচি হাতটা ছেড়ে দিল।
যথারীতি ক্লাসের দিদিমনি দুজনকেই প্রিন্সিপাল অফিস নিয়ে গেলেন। সেখানে আকাশের পরিচর্যা করা হলো। ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হলো এবং দুজনেরই বাড়িতে ফোন করা হলো। সুচির বাড়িতে সুচির বাবা তখন অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। আর আকাশের বাবা অফিস বেরিয়ে গেছেন। তাই প্রিন্সিপাল এর ফোন এবং সব শুনে সুচি আর আকাশের মা কলেজে এলেন। কলেজে এসে প্রিন্সিপাল এর অফিসে এসে বসতেই সুচির মাকে উদ্দেশ্য করে প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন “ আমি প্রায় দশ বারোবার জিজ্ঞাসা করেছি ওকে। কিন্তু কোন উত্তর পাইনি। আপনিই দেখুন। „
সুচির দিকে তাকিয়ে সুচেতা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন “ কামড়ালি কেন ওকে ? „ কিন্তু সুচি কোন উত্তর দেয় না । সে কিভাবে বলবে যে আকাশ মৌ কে খাইয়ে দিচ্ছিল বলে সে রেগে গেছিল। কিছু বলতে না পেরে সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো ।
স্নেহা দেবীর সুচির ওই করুন মুখটা দেখে মায়া হলো । তিনি বললেন “ ছাড়ো। বাচ্চা মেয়ে । বেশি কিছু তো হয়নি। „ হ্যাঁ সত্যি বেশি কিছু হয়নি। শুধু আকাশের হাতের ব্যান্ডেজের তলায় আটটা দাঁতের দাগ ছাড়া। যেটা আকাশের মা দেখতে পারছেন না ব্যান্ডেজের জন্য।
সুচির কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সুচেতা দেবী গম্ভীর হয়ে গেলেন। গালে দুটো চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু পারলেন না। কারন তিনি এখন প্রিন্সিপাল এর অফিসে। বাড়ি ফেরার সময় তিনি সুচিকে বললেন “ আজ তোর বাবা আসুক। সব বাঁদরামি ঘুচিয়ে দেবো। „
স্নেহা দেবী ছেলেকে নিয়ে ফেরার সময় সব শুনলেন। কিন্তু তিনি আকাশ পাতাল ভেবে কিছুই কূলকিনারা পেলেন না।
বাড়ি ফিরে আকাশের দিদিমা আকাশকে জিজ্ঞাসা করলেন “ কি হয়েছিল বলতো দাদু ভাই ? সুচি তোর হাত কাঁমড়ালো কেন? নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিলি। „
“ আমি কিছু করিনি দিদিমা । ওই ক্ষ্যাপা খেপে গিয়ে হাত কামড়ে ধরলো । „
“ ক্ষ্যাপাটা কে ? „ বীণাপাণি দেবী যেন আকাশ থেকে পড়লেন ।
“ ওই যে আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই থাকে আর কথা বলার সময় গালে গর্ত হয়ে যায় । „ বলে দুই হাতের তর্জনী দিয়ে দুই গালের মাঝখানে ঢুকিয়ে গালে গর্ত করে দেখালো ।
দিদিমা তো হেঁসেই খুন “ বুঝেছি , তুই সুচিকে ক্ষ্যাপা বলছিস। এবার বলতো কি হয়েছিল ? সব বলবি। „
আকাশ বেশ উৎসাহের সাথে সবকিছু বললো --- মৌ এর হাত ভেঙে গিয়েছিল । তাই সে ওকে খাইয়ে দিচ্ছিল তারপর সুচি এসে হাত কাঁমড়ে ধরলো। ঘটনাটা দিদিমা দুবার শুনলেন। সুচির মা ও আকাশের মা বুঝতে না পারলেও দিদিমা ঠিক বুঝলেন সুচি কেন আকাশের হাত কাঁমড়ে ছিল। সেই মুহুর্ত থেকে ধীরে ধীরে বীণাপাণি দেবী সুচি আর আকাশের সম্পর্ক কে অন্য ভাবে দেখতে শুরু করলেন। এবং যতদিন গেল তার এই অন্য দৃষ্টি যে সঠিক সেটা প্রমাণিত হলো।
রাতে সুচির বাবা বাড়ি ফিরলে সুচির মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন “ সামলাও তোমার মেয়েকে। তোমার আশকারা পেয়েই এমন জানোয়ার তৈরি হচ্ছে। ওই টুকু ছেলের হাত কাঁমড়িয়ে দিয়েছে। „
সবকিছু শুনে সমরেশ বাবু মেয়েকে কোলে বসিয়ে শান্ত নরম সুরে বললেন “ আকাশরা বড়লোক। ওদের অনেক টাকা আছে , গাড়ি আছে । অনেক ক্ষমতা আছে। ওদের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয় না। কিন্তু আমরা পাশাপাশি থাকি , তাইতো ! তাই তুমি আকাশের সাথে খেলো কিন্তু কখনো ওর গায় হাত তুলো না । তাহলে কিন্তু আমি আকাশের বাবার সামনে কখনো মুখ দেখাতে পারবো না। মনে থাকবে ?
সুচি তার বাবার কথা একটুও বোঝে নি। ধনী গরিবের পার্থক্য সে বুঝলেও আকাশ আর তার মধ্যে এই ধনী গরিবের পার্থক্য কোথা থেকে এলো সেটা সে কিছুতেই বুঝলো না । কিন্তু বাবার কথায় সব সময় হ্যাঁ বলতে হয় তাই সে একটা সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো । সেটা দেখে সুচির বাবা সুচির কপালে একটা চুমু খেলেন।