31-07-2021, 04:08 PM
ফেরার প্লেনে পুকু ভাবছিল’ ‘আমার সাথেই কেন এইরকম হয় বার বার? ভালবাসার মানুষ থেকে বঞ্চিত থাকব সারা জীবন , বাবা, মা , বুচি এবার টাপুর। কেন বার বার হয়? জড়িয়ে ধরতে গেলে, ভালোবাসলে কেন হারিয়ে যায়?’। দুঃখ গারো হলে ঘুম আসে। পুকুও ঘুমিয়ে পড়ল একরাশ হতাশা আর দুঃখ বুকে। বোম্বেতে নেমে সোজা সঞ্জয়ের বাড়ি। সঞ্জয় আর তার বৌ দেখা আত্মহারা। মেয়েটি বড় হয়েছে বেশ , কলেজ যাচ্ছে। পুকু সব খুলে বলতে, পৃথা, সঞ্জয়ের বৌ “ দাদা আপনি এখানে থাকুন এখন। একা একা থাকবেন না। প্লিস” সঞ্জয় ও “ বস এখানে থাক, কোন অসুবিধা নেই, উল্টে সময় একটু ভালো কাটবে”। সঞ্জয়ের বাড়িতে খাওয়া আর মেয়েকে নিয়ে ঘোরা এই কাজ।
দিন ৫ পর
……গুরু, একটা চ্যালেঞ্জ নিবি?
…… বল শুনি
………আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, এক মাসি। স্বামির হিরের ব্যাবসা ছিল। অল্প বয়েসে মারা যান। মেয়ে বিয়ের পর আমেরিকাতে। মহিলা একা ব্যাবসা চালাচ্ছেন আর স্বামির ভাইএর ছেলেরা টুপি পরাচ্ছে। স্বামি বেঁচে থাকতে আয় ছিল বছরে সারে ৩ কোটি, সেটাই এখন নেমে ৯০ লক্ষ গত বছর।এক পুরানো মুন্সী আছেন তিনি ভালো লোক, হিরে চেনে, কাটিং বোঝে ভালো, কিন্তু ওই পর্যন্ত। আমি নিজে অডিট করেছি। মহিলা একজন বিশ্বাসী, এ্যাকাউনটস জানা কাউকে খুজছেন, । পার্টনার করে নিতে রাজি। আত্মীয় বলে আমি যাই নি, তুই যাবি?
…… চল কাল কথা বলি। কিন্তু আমি শেয়ার এর ফার্ম খুলবো ভাবছি। চল।
ভদ্রমহিলা , মল্লিকা প্যাটেল,বছর ৪৫এর আশেপাশে হবে বয়েস। ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত রুচির এবং পুকুর মনে হোল মিথ্যাবাদি নয়।
………পিনাকীবাবু, আমার মেয়ের বয়েস ২৫, আপনার কত
……….২৭, আপনি আমায় নাম ধরে তুমি বলে ডাকবেন,আর আমি আপনাকে ম্যাদাম বলব, ঠিক আছে? পুকুর হাসি মাখা উত্তর। হাসিতে ভেঙে পরলেন মহিলা
কথাবার্তা বলে যে টুকু বুঝল হীরা ইমপোর্ট আর কাটিং এর পর এক্সপোর্ট , দুই ক্ষেত্রেই টুপি পরান হচ্ছে। ভদ্রমহিলা ২০% অংশীদারি অফার করলেন। ডিটেলস কথার শেষে সেইটি হোল ৩০% । ভদ্রমহিলার উকিল দলিল তৈরি করবেন.৬ দিনের মাথায় পুকু সই করল ভদ্রমহিলার সইয়ের নীচে আর শুরু হোল পরিবর্তনের দিন। প্রথম ৩ মাস পুকু হিরে নিয়ে বই পড়া আর হিরের বাজার ঘুরে ধারনা পরিস্কার করা এই ছিল কাজ। বাজার সম্পর্কে মল্লিকা দেবীর এক বন্ধুর বর সাহায্য করলেন যথেষ্ট। আরও ৩ মাস গেল বাজারে নিজেকে পরিচিত করতে। প্রথম ডিল পুকু করল ঠিক ৬ মাসের মাথায় এক দক্ষিন আফ্রিকার ব্যাবসায়ির সাথে। ইনি আগে বড় বড় টুপি নিয়ে আসতেন। এইবার ও সেই ভেবে শুরু করতে, পুকু তাকে বোঝাল হিরের আন্তর্জাতিক বাজার পিছনের ৩ আর আগামি ৩ বছর কি ছিল আর কি হতে পারে, পুরো আধ ঘণ্টা। টুপি গুটিয়ে পুকুর কথায় এগরিমেনট এ সই করলেন বাধ্য ছেলের মতন। ব্যাবসার জগতে পুকুর প্রথম সাকসেস। ফলতে শুরু করল নরেশ মহোতার ভবিষ্যৎ বানী।৩ মাসের ভিতর প্রায় ২০ কোটির এগরিমেনট, এর সাথে পুকু শুরু করল তার নিজের শেয়ার ফার্ম। একটি মেয়েকে রেখেছে সহকারি হিসাবে দু বছর। নাম শ্রীরাধা। বাবার নাম সি, জে, ইন্দ্র। বাঙ্গালি কিন্তু এইরকম পদবি কোনদিন পুকু শোনেনি। মেয়েটি বুদ্ধিমতী, খুব তাড়াতাড়ি কাজ শিখে নিয়েছে। পুকু ডাকে শ্রী বলে। নির্ভর করে কাজের ব্যাপারে। ডিসিশন নিতে পারে সঠিক মেয়েটি।পুকু শেয়ারের ফার্ম চালায় তার নিজের ফ্লাট থেকে। দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করে। এক ঘেয়েমি লাগলে ভিতরে বক্সিং এর ব্যাগ ঝুলিএছে তাতে মিনিট ৫ পাঞ্চ করে। নিজেকে ফিট রাখার জন্য ও বোরডুম কাটাতে। এই ভাবে ২ বছরের মাথায় পুকু বুঝল সে এখন ধনী হতে চলেছে। প্রথম ফ্লাট কেনা দিয়ে শুরু। ২ বছর শেষে টার্ন ওভার বেরেছে ৬ গুন। শুধু চুরি বন্ধ করে। মুনাফা ৯০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি ৫৪ লক্ষ।এ বাদে হিরের কাটিঙের সময় কুচো হীরে বেরয় অনেক। মল্লিকার ভাশুর এর ছেলেরা পুরো মেরে দিত। পুকু আসায় সেইটা বন্ধ হয়েছে আর তার ফলে দেশের বাজারে সেই হিরের জোগান দিচ্ছে পুকু। শেয়ার বাজার ২০০৪ থেকে ওপরে চড়া শুরু হয়েছে। পুকু শুরু করল তার অধিগত বিদ্যা কাজে লাগান। ২০০৫ থেকে ২০০৮ অবধি পুকু আয় করলো কল্পনাতীত।শ্রাবণের ধারার মতো আসলো টাকা।মাঝে মাঝে পুকু নিজেই অবাক হয়ে যায় কি করে এতো টাকা আসছে। পুকু ইনভেস্ত করলো রিয়েলএস্টেটে আর ব্লুচিপ শেয়ারে, বাধ্য করলো মল্লিকাকেও ওর কথামতো লগ্নি করতে ।কিন্তু পুকু হিরে ইমপোর্ট কমিয়ে দিয়ে নজর দিল দেশীয় বাজার দখলে। তার ষষ্ট ইন্দ্রিয় জানিয়েছিল, এই রকম বেশিদিন চলবে না। এর মাঝে হঠাৎ আমেরিকার সাবপ্রাইম এর খবরে বিচলিত হোল পুকু। আরও ভিতর ঢুকে পড়ল খোজে। ৭ দিন বাদে শেয়ার বিক্রি শুরু করল আর মল্লিকাকে বাধ্য করল বিক্রি করতে। ১ মাস বাদে মল্লিকা উপলব্ধি করলো পুকুর দূরদৃষ্টির। গালে চুমু দিয়ে
………তুই আমার ছেলে পিনাকী , না হলে আমাকে জোর করে কেউ বিক্রি করাত না। তুই ভালো ছেলে রে……… পুকুর মনে পড়ল বুচির কথা “ সারা জীবন কখনও বেইমানি করবি না, পুকু, বেইমানি খুব খারাপ”।
মল্লিকার সাথে পুকুর সম্পর্ক শুধু বিজনেস পার্টনার না, মল্লিকার নির্ভরতা পুকু। আপনি থেকে তুমি, ম্যাদাম থেকে দিদি।
………দিদি, তোমার বয়েস খুব বেশি না ৪৫এর আশেপাশে কি একটু হয়ত বেশি , তা আবার বিয়ে করলে না কেন?
………মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। আর বিয়ে কে দেবে? মা বাবা নেই। ভাই বোনেরা গা বাঁচিয়ে চলে। এ ছাড়া সমাজ।
………ধুর। বাজে সব। তুমি কোনদিন প্রেম করনি?
………কেন তুই কি আমার বিয়ে দিবি? তুই নিজে বিয়ে কর। খুজে দেখ ওই মেয়েটাকে, কি নাম যেন টাপুর না কি, কলকাতা গিয়ে খোঁজ তাকে।
………তাড়াতাড়ি যাব, একটু কাজ আছে। কিন্তু তুমি প্রেম করনি সত্যি?
…… করেছিলাম রে। মারাঠি ছেলে। কলেজে পরার সময়।দুর্দান্ত লেখাপড়ায়। কিন্তু মারাঠি বলে বাড়ি থেকে দিল না
………কি নাম
……সুপ্রিয় সুলতানকার। তুই কি ঘটকালি করবি?
……এমনি জিজ্ঞাসা করছি?
রাতেই ইন্টার নেট থেকে ৩ জন সুপ্রিয় সুলতানকার পেল। নিশ্চিত হয়ে একজনকে ট্যাগ করলো। সোশ্যাল স্যাএন্স এর বিশাল নাম। এক বিশাল নামকরা প্রথিস্তান এ আছেন। খোজ নিয়ে জানল, বিয়ে করেননি, কোন নারী সঙ্গ নেই। পরের দিন সোজা কাজের জায়গায়
………স্যার আসব?
………হ্যাঁ।
………কি ব্যাপার, কি আপনার পরিচয়?
……কিছু না স্যার। আমি আপনার সাবজেক্ট সম্পর্কে আগ্রহি। ওই মাইগ্রান্ট লেবার নিয়ে আপনার যে কাজ, কিছু পড়েছি আর আমি নিজেও একজন ওই ক্লাসের। তাই দু দিন আগে আমার বিজনেস পার্টনার মল্লিকা প্যাটেল কে বলছিলাম যে তিনি কাউকে চেনেন কিনা, যিনি এই ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারেন। তিনি বললেন “ সুপ্রিয়র সাথে দেখা করতে পারিস, ও খুব ভালো এই ব্যাপারে”।
ভদ্রলোক গভীর ভাবে লক্ষ করে
……তোমার পরিচয় কি?
……এই যে স্যার। পকেট থেকে কার্ড বার করে দিতে, একটু চোখ বুলিয়ে
………মিথ্যা কথা বলছ। তুমি কি জন্য এসেছ বলত? মল্লিকা আমার খোজ কি করে জানবে। আজ ২৫ বছর যোগাযোগ নেই। আমি ৩ বছর হোল বম্বে এসেছি
……… দিদি আজ ১০ বছরের ওপর একা। স্বামী মারা গেছেন , মেয়ে বাইরে, আত্মীয়রা পাস কাটিয়ে যায়। খুব একা। এখন আমি আসাতে উনি একটু হাফ ছেড়েছেন । ফোন করুননা
…… তোমাকে কি মল্লিকা পাঠিয়েছে? মল্লিকা সেইরকমের মেয়ে নয়। তুমি কেন এসেছ, সত্যি করে বল।
………দিদি জানেনা আমি এসেছি। দিদি খুব একা, খোজ নিয়েছি আপনিও একা। আর কিছু না হোক, আড্ডা মারার জন্যও দুজনে ফোনালাপ করতে পারেন। হাত জোর করে বলছি, আমার কথা বলবেন না। খুব দুঃখ পাবেন, সন্তানের মতন দ্যাখেন আমায়। ………দু হাত মাথার পিছনে দিয়ে চুপ করে দেখল
……তুমি কিছু জান মনে হচ্ছে। কি হবে, তোমাদের কবির কথায় 'হৃদয় খুড়ে রক্ত ঝরিয়ে'।
………স্যার আমার জীবনে, বাবা মা কে পাই নি বললেই চলে। এক কাজের মহিলা মানুষ করেছেন। যে প্রেমিকার জন্যও এখনও অপেখ্যা করছি, সে কোথায় জানিনা। তবুও জীবন জীবনই, থেমে থাকে না। আমার প্রেমিকাকে না পেলে আপনার মতন জীবন কাটাব, কিন্তু কোনদিন যদি পাই, মৃত্যুর আগের দিন পেলেও দু হাতে বুকে নেব। আমি দিদির ফোন নম্বর দিলাম। কি করবেন আপনার ব্যাপার, প্লিস আমার নাম নেবেন না। উনি আমাকে সন্তান স্নেহ দিয়ে থাকেন, …… পুকু উঠে দাঁড়াল
……… আরে বস ইওং ম্যান, বস। কফি খাবে?......।ফ্লাস্ক থেকে দু কাপ কফি ঢেলে নিজে আর পুকু কে দিয়ে প্রথম চুমুক দিয়ে
………ভিতু মেয়ে। অনেকবার বলেছিলাম, সাহস পেলনা। ফোন নম্বর রাখলাম ভেবে দেখব। ……মুখে হাসি। পুকু বুঝল মিশন সাকশেসফুল। সিগারেট অফার করে পুকুর সব খবর নিয়ে
………দু এক দিনের ভিতর কিছু করবো বা করবো না।অনেকদিন পর হালকা লাগল পুকুর নিজেকে।
কয়েকদিন পর
………পিনাকী, তুই সুপ্রিয়র কাছে কি করতে গেছিলি?
……তোমায় কে বলল?
………সুপ্রিয়।
………ওনার সাবজেক্ট নিয়ে একটু কথা, এই আর কি
………গুল মারছিস, মিথ্যুক, তোর কারসাজি সব
………তোমার লিপস্টিক এর এই শেড আগে দেখিনি তো, কে দিল? ……ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না এই রকম মুখে।……… হাতের পেন্সিল ছুড়ে
………মারবো তোকে, খুব মারবো………হাঁসিতে উজ্জ্বল মল্লিকা। পুকু এগিয়ে দু হাতে জড়িয়ে ধরল মল্লিকাকে
………মার দিদি, শাসন করো, কেউ তো নেই, তুমিই না হয় করলে
শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি বম্বেতে, মানে ঘরে ফেরার মানুষের ভোগান্তির এক শেষ। আজ দুপুরে ৩ ঘণ্টা বৃষ্টিতে পথ ঘাট সব থই থই। শ্রী আটকে পড়েছে, যেতে পারছে না। পুকু সঙ্গ দিচ্ছে। শ্রী উঠে চা করে পাঁপড় ভেঁজে এনেছে দু বার। খাওয়া শেষ। গল্প করতে করতে রাত ৯ টা।
………চলো তোমাকে এগিয়ে দি। ………বেরিয়ে এক অটো পেল । বেশ দূর শ্রীর বাড়ি। অটোতে অনেক পথ পেরিয়ে বুঝল হাটা ছাড়া উপায় নেই
……… স্যার, চলুন না একটু সমুদ্রের ধারে………মাথা ঝেঁকে হ্যাঁ বলে দুজনে সমুদ্রের পাড়ে। রেলিং এ ঝুকে পুকু……শ্রী একটু ইতস্তত করছে
……… কিছু বলবে?.........শ্রী চুপ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে
………কোন আঘাত দেবার জন্য নয় একটা কথা বলতে চাই, পারমিসন চাইছি
পুকু একটু বিরক্ত হোল। ঘাড় নেড়ে সায় দিতে, শ্রী খুব আস্তে, ধীরে ধীরে
………আমার বাবার নাম সি, জে, ইন্দ্র। ইন্দ্রজিত চক্রবর্তী। আপনার বাবা………প্লিস আমায় ক্ষমা করবেন………কান্না ভেজা গলা শ্রীর।
কয়েক মুহূর্ত পুকুর মাথা কাজ করলো না, তারপর এক বিরাট চিৎকার “ না………”না, না না । মা মা বুচি বুচি, আমি চাই না, চাই না, চাই না। “ পাগলের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পুকু দৌড়াতে শুরু করলো। খানিকটা দৌড়ে এগিয়ে আবার ফিরে এসে, শুন্যে ঘুসি চালাচ্ছে, একটু দৌড়ে যাচ্ছে আবার ফিরে এসে শ্রীর চোখে আগুন চোখে তাকিয়ে আবার , কাঁধ , ঝাকাচ্ছে, ‘আই হেট হিম আই হেট হিম’ । এ একেবারে অন্য পুকু। দু হাতে নিজের মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আর না না ,এই ভাবে কিছু সময় পর রেলিং এ হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে”
……… মা , মা মা বুচি বুচি আমি কি করবো। আবার।আমার সাথে কেন এমন হয়?
হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ল। দু একজন দাঁড়িয়ে গেছে , কি হয়েছে দেখবার জন্যও। রুমালে মুখ চেপে কেঁদে যাচ্ছে শ্রী। কান্না, ভিতরের সব জ্বালা, ক্ষেদ, ঘৃণা দুঃখ, বেদনা, ব্যাথা জুড়িয়ে দেয়। কান্না ধুয়ে দেয় সব কিছু, হালকা হয় প্রান। পুকুরও তাই হোল। প্রায় ২০ মিনিট পর। শান্ত পুকু সিগারেটের প্যাকেট বার করে সিগারেট ধরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে। শ্রী লক্ষ করলো দুই চোখে জলের ধারা। ৪ টে সিগারেট চলছে, শ্রী একেবারে অপ্রস্তুত।পাশে গিয়ে
………আমি এখন আসি। রাত প্রায় ১১ টা। ক্ষমা করবেন ……পাস কাটিয়ে এগিয়ে যাবে, ডান হাত বাড়িয়ে খপ করে শ্রীর হাত ধরে টেনে নিল কাছে
……শোন শ্রী, উনি আমার কেউ নন। আই হেট হিম, আই হেট হিম। উনি তোমার বাবা কিন্তু আমার কেউ নন। আমি কোনদিন তাকে ক্ষমা করতে পারব না। কোনদিন না। যদি আগের মতন আমার সাথে কাজ করতে চাও তাহলে তুমি আর কোনদিন আমার সামনে তার নাম উল্লেখ করবে না।
……শ্রী নিজেকে সামলে নিয়েছে, বুদ্ধিমতী মেয়ে
……… তাই হবে। শুনুন, আমার কোন ভাই বোন, কোন ধরনের কোন আত্মীয় কোথাও নেই, তাই একবার, শুধু একবার একটু জড়িয়ে ধরতে দেবেন, প্লিস?...... পুকু চেয়ে রইল কিছু সময়, তারপর দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঠোটের কোনে অল্প হাসি দিতে, আবেগে শ্রী দু হাতে জড়িয়ে
……… আমি বুঝি , এ কি যন্ত্রণা, কি অপমান, আমি বুঝি……ঝাঁকিয়ে উঠলো পুকু
……… না কেউ বোঝেনা, কেউ না। একটা বাচ্চা ছেলে কলেজ থেকে দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি আসছে ফার্স্ট হয়েছে বাবাকে দেখাবে বলে। বাড়ি শুন্য। রাস্তায় ষে কোন ঝাঁকড়া চূলের লম্বা লোক দেখলে ছূটে গিয়ে দেখেছি বাবা? বার বার মন ভেঙ্গেছে। বুকের ভিতর পাখির ডানা ঝাঁপটা মারে, হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খোঁজা , মায়ের গুমরে গুমরে কান্না। সবাই বাবার সাথে যায়, আর আমি অসহায় চোখে খালি খুজে বেড়াই সেই বড় চওড়া বুকটা। এটা ষার না হয়েছে সে বুঝবে না ।যাকে ভালবাসতাম সে বুঝত কেননা তার মা ও পালিয়ে গেছে। ষে অপমান মা সারা জীবন বুকে বয়ে বেড়িয়েছে , আমি সেই অপমান মাফ করতে পারব না প্লিস।
শ্রী আরও নিবিড় করে জাপটে “কথা দিলাম কোনদিন বলবনা, কথা দিলাম” ।
পুকু হাত ছাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল শুধু মেঘে ঢাকা তারা। একটু ধরে থাকল, শ্রীকে। হাত ছাড়িয়ে আবার পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে
……শ্রী, কাল খুব সকালে আসতে পারবে, ৫ টার ভিতর? কাল থেকে তোমায় ৭-১০ দিন অফিস চালাতে হবে, সকালে আসলে ফ্লাট আর অফিসের চাবি তোমায় দিয়ে কলকাতায় যাব, ফ্লাটে থেকে যেতে পার এ কদিন যদি ইচ্ছা হয়। আমার মন এখন বিক্ষিপ্ত। কাল প্রায় ৩ বছর পর কলকাতায় যাব। ফ্লাট কিনেছি। রেজিসট্রেসন বাকি আছে। এ ছাড়া মায়ের বাড়িটা দেব আমাদের পাড়ার ক্লাবকে । অসিমদা চালাবে মায়ের নামে ক্লাবটা। এই যে আমি আজ এখানে, তার পিছনে অসিমদার ভুমিকা বলে শেষ করা যাবে না। তাই গুরু দক্ষিনা বলতে পার । অসহায় বাচ্চা আর কাজের লোক কে নানা উপদ্রব থেকে বিরাট গাছের মতন আড়াল করে রেখেছিলেন অসিম দা। এ ছাড়া একজনের খোঁজ করতে হবে, সে কেন আমার থেকে লুকিয়ে , সেইটা বার করতেই হবে।
দিন ৫ পর
……গুরু, একটা চ্যালেঞ্জ নিবি?
…… বল শুনি
………আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, এক মাসি। স্বামির হিরের ব্যাবসা ছিল। অল্প বয়েসে মারা যান। মেয়ে বিয়ের পর আমেরিকাতে। মহিলা একা ব্যাবসা চালাচ্ছেন আর স্বামির ভাইএর ছেলেরা টুপি পরাচ্ছে। স্বামি বেঁচে থাকতে আয় ছিল বছরে সারে ৩ কোটি, সেটাই এখন নেমে ৯০ লক্ষ গত বছর।এক পুরানো মুন্সী আছেন তিনি ভালো লোক, হিরে চেনে, কাটিং বোঝে ভালো, কিন্তু ওই পর্যন্ত। আমি নিজে অডিট করেছি। মহিলা একজন বিশ্বাসী, এ্যাকাউনটস জানা কাউকে খুজছেন, । পার্টনার করে নিতে রাজি। আত্মীয় বলে আমি যাই নি, তুই যাবি?
…… চল কাল কথা বলি। কিন্তু আমি শেয়ার এর ফার্ম খুলবো ভাবছি। চল।
ভদ্রমহিলা , মল্লিকা প্যাটেল,বছর ৪৫এর আশেপাশে হবে বয়েস। ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত রুচির এবং পুকুর মনে হোল মিথ্যাবাদি নয়।
………পিনাকীবাবু, আমার মেয়ের বয়েস ২৫, আপনার কত
……….২৭, আপনি আমায় নাম ধরে তুমি বলে ডাকবেন,আর আমি আপনাকে ম্যাদাম বলব, ঠিক আছে? পুকুর হাসি মাখা উত্তর। হাসিতে ভেঙে পরলেন মহিলা
কথাবার্তা বলে যে টুকু বুঝল হীরা ইমপোর্ট আর কাটিং এর পর এক্সপোর্ট , দুই ক্ষেত্রেই টুপি পরান হচ্ছে। ভদ্রমহিলা ২০% অংশীদারি অফার করলেন। ডিটেলস কথার শেষে সেইটি হোল ৩০% । ভদ্রমহিলার উকিল দলিল তৈরি করবেন.৬ দিনের মাথায় পুকু সই করল ভদ্রমহিলার সইয়ের নীচে আর শুরু হোল পরিবর্তনের দিন। প্রথম ৩ মাস পুকু হিরে নিয়ে বই পড়া আর হিরের বাজার ঘুরে ধারনা পরিস্কার করা এই ছিল কাজ। বাজার সম্পর্কে মল্লিকা দেবীর এক বন্ধুর বর সাহায্য করলেন যথেষ্ট। আরও ৩ মাস গেল বাজারে নিজেকে পরিচিত করতে। প্রথম ডিল পুকু করল ঠিক ৬ মাসের মাথায় এক দক্ষিন আফ্রিকার ব্যাবসায়ির সাথে। ইনি আগে বড় বড় টুপি নিয়ে আসতেন। এইবার ও সেই ভেবে শুরু করতে, পুকু তাকে বোঝাল হিরের আন্তর্জাতিক বাজার পিছনের ৩ আর আগামি ৩ বছর কি ছিল আর কি হতে পারে, পুরো আধ ঘণ্টা। টুপি গুটিয়ে পুকুর কথায় এগরিমেনট এ সই করলেন বাধ্য ছেলের মতন। ব্যাবসার জগতে পুকুর প্রথম সাকসেস। ফলতে শুরু করল নরেশ মহোতার ভবিষ্যৎ বানী।৩ মাসের ভিতর প্রায় ২০ কোটির এগরিমেনট, এর সাথে পুকু শুরু করল তার নিজের শেয়ার ফার্ম। একটি মেয়েকে রেখেছে সহকারি হিসাবে দু বছর। নাম শ্রীরাধা। বাবার নাম সি, জে, ইন্দ্র। বাঙ্গালি কিন্তু এইরকম পদবি কোনদিন পুকু শোনেনি। মেয়েটি বুদ্ধিমতী, খুব তাড়াতাড়ি কাজ শিখে নিয়েছে। পুকু ডাকে শ্রী বলে। নির্ভর করে কাজের ব্যাপারে। ডিসিশন নিতে পারে সঠিক মেয়েটি।পুকু শেয়ারের ফার্ম চালায় তার নিজের ফ্লাট থেকে। দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করে। এক ঘেয়েমি লাগলে ভিতরে বক্সিং এর ব্যাগ ঝুলিএছে তাতে মিনিট ৫ পাঞ্চ করে। নিজেকে ফিট রাখার জন্য ও বোরডুম কাটাতে। এই ভাবে ২ বছরের মাথায় পুকু বুঝল সে এখন ধনী হতে চলেছে। প্রথম ফ্লাট কেনা দিয়ে শুরু। ২ বছর শেষে টার্ন ওভার বেরেছে ৬ গুন। শুধু চুরি বন্ধ করে। মুনাফা ৯০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি ৫৪ লক্ষ।এ বাদে হিরের কাটিঙের সময় কুচো হীরে বেরয় অনেক। মল্লিকার ভাশুর এর ছেলেরা পুরো মেরে দিত। পুকু আসায় সেইটা বন্ধ হয়েছে আর তার ফলে দেশের বাজারে সেই হিরের জোগান দিচ্ছে পুকু। শেয়ার বাজার ২০০৪ থেকে ওপরে চড়া শুরু হয়েছে। পুকু শুরু করল তার অধিগত বিদ্যা কাজে লাগান। ২০০৫ থেকে ২০০৮ অবধি পুকু আয় করলো কল্পনাতীত।শ্রাবণের ধারার মতো আসলো টাকা।মাঝে মাঝে পুকু নিজেই অবাক হয়ে যায় কি করে এতো টাকা আসছে। পুকু ইনভেস্ত করলো রিয়েলএস্টেটে আর ব্লুচিপ শেয়ারে, বাধ্য করলো মল্লিকাকেও ওর কথামতো লগ্নি করতে ।কিন্তু পুকু হিরে ইমপোর্ট কমিয়ে দিয়ে নজর দিল দেশীয় বাজার দখলে। তার ষষ্ট ইন্দ্রিয় জানিয়েছিল, এই রকম বেশিদিন চলবে না। এর মাঝে হঠাৎ আমেরিকার সাবপ্রাইম এর খবরে বিচলিত হোল পুকু। আরও ভিতর ঢুকে পড়ল খোজে। ৭ দিন বাদে শেয়ার বিক্রি শুরু করল আর মল্লিকাকে বাধ্য করল বিক্রি করতে। ১ মাস বাদে মল্লিকা উপলব্ধি করলো পুকুর দূরদৃষ্টির। গালে চুমু দিয়ে
………তুই আমার ছেলে পিনাকী , না হলে আমাকে জোর করে কেউ বিক্রি করাত না। তুই ভালো ছেলে রে……… পুকুর মনে পড়ল বুচির কথা “ সারা জীবন কখনও বেইমানি করবি না, পুকু, বেইমানি খুব খারাপ”।
মল্লিকার সাথে পুকুর সম্পর্ক শুধু বিজনেস পার্টনার না, মল্লিকার নির্ভরতা পুকু। আপনি থেকে তুমি, ম্যাদাম থেকে দিদি।
………দিদি, তোমার বয়েস খুব বেশি না ৪৫এর আশেপাশে কি একটু হয়ত বেশি , তা আবার বিয়ে করলে না কেন?
………মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। আর বিয়ে কে দেবে? মা বাবা নেই। ভাই বোনেরা গা বাঁচিয়ে চলে। এ ছাড়া সমাজ।
………ধুর। বাজে সব। তুমি কোনদিন প্রেম করনি?
………কেন তুই কি আমার বিয়ে দিবি? তুই নিজে বিয়ে কর। খুজে দেখ ওই মেয়েটাকে, কি নাম যেন টাপুর না কি, কলকাতা গিয়ে খোঁজ তাকে।
………তাড়াতাড়ি যাব, একটু কাজ আছে। কিন্তু তুমি প্রেম করনি সত্যি?
…… করেছিলাম রে। মারাঠি ছেলে। কলেজে পরার সময়।দুর্দান্ত লেখাপড়ায়। কিন্তু মারাঠি বলে বাড়ি থেকে দিল না
………কি নাম
……সুপ্রিয় সুলতানকার। তুই কি ঘটকালি করবি?
……এমনি জিজ্ঞাসা করছি?
রাতেই ইন্টার নেট থেকে ৩ জন সুপ্রিয় সুলতানকার পেল। নিশ্চিত হয়ে একজনকে ট্যাগ করলো। সোশ্যাল স্যাএন্স এর বিশাল নাম। এক বিশাল নামকরা প্রথিস্তান এ আছেন। খোজ নিয়ে জানল, বিয়ে করেননি, কোন নারী সঙ্গ নেই। পরের দিন সোজা কাজের জায়গায়
………স্যার আসব?
………হ্যাঁ।
………কি ব্যাপার, কি আপনার পরিচয়?
……কিছু না স্যার। আমি আপনার সাবজেক্ট সম্পর্কে আগ্রহি। ওই মাইগ্রান্ট লেবার নিয়ে আপনার যে কাজ, কিছু পড়েছি আর আমি নিজেও একজন ওই ক্লাসের। তাই দু দিন আগে আমার বিজনেস পার্টনার মল্লিকা প্যাটেল কে বলছিলাম যে তিনি কাউকে চেনেন কিনা, যিনি এই ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারেন। তিনি বললেন “ সুপ্রিয়র সাথে দেখা করতে পারিস, ও খুব ভালো এই ব্যাপারে”।
ভদ্রলোক গভীর ভাবে লক্ষ করে
……তোমার পরিচয় কি?
……এই যে স্যার। পকেট থেকে কার্ড বার করে দিতে, একটু চোখ বুলিয়ে
………মিথ্যা কথা বলছ। তুমি কি জন্য এসেছ বলত? মল্লিকা আমার খোজ কি করে জানবে। আজ ২৫ বছর যোগাযোগ নেই। আমি ৩ বছর হোল বম্বে এসেছি
……… দিদি আজ ১০ বছরের ওপর একা। স্বামী মারা গেছেন , মেয়ে বাইরে, আত্মীয়রা পাস কাটিয়ে যায়। খুব একা। এখন আমি আসাতে উনি একটু হাফ ছেড়েছেন । ফোন করুননা
…… তোমাকে কি মল্লিকা পাঠিয়েছে? মল্লিকা সেইরকমের মেয়ে নয়। তুমি কেন এসেছ, সত্যি করে বল।
………দিদি জানেনা আমি এসেছি। দিদি খুব একা, খোজ নিয়েছি আপনিও একা। আর কিছু না হোক, আড্ডা মারার জন্যও দুজনে ফোনালাপ করতে পারেন। হাত জোর করে বলছি, আমার কথা বলবেন না। খুব দুঃখ পাবেন, সন্তানের মতন দ্যাখেন আমায়। ………দু হাত মাথার পিছনে দিয়ে চুপ করে দেখল
……তুমি কিছু জান মনে হচ্ছে। কি হবে, তোমাদের কবির কথায় 'হৃদয় খুড়ে রক্ত ঝরিয়ে'।
………স্যার আমার জীবনে, বাবা মা কে পাই নি বললেই চলে। এক কাজের মহিলা মানুষ করেছেন। যে প্রেমিকার জন্যও এখনও অপেখ্যা করছি, সে কোথায় জানিনা। তবুও জীবন জীবনই, থেমে থাকে না। আমার প্রেমিকাকে না পেলে আপনার মতন জীবন কাটাব, কিন্তু কোনদিন যদি পাই, মৃত্যুর আগের দিন পেলেও দু হাতে বুকে নেব। আমি দিদির ফোন নম্বর দিলাম। কি করবেন আপনার ব্যাপার, প্লিস আমার নাম নেবেন না। উনি আমাকে সন্তান স্নেহ দিয়ে থাকেন, …… পুকু উঠে দাঁড়াল
……… আরে বস ইওং ম্যান, বস। কফি খাবে?......।ফ্লাস্ক থেকে দু কাপ কফি ঢেলে নিজে আর পুকু কে দিয়ে প্রথম চুমুক দিয়ে
………ভিতু মেয়ে। অনেকবার বলেছিলাম, সাহস পেলনা। ফোন নম্বর রাখলাম ভেবে দেখব। ……মুখে হাসি। পুকু বুঝল মিশন সাকশেসফুল। সিগারেট অফার করে পুকুর সব খবর নিয়ে
………দু এক দিনের ভিতর কিছু করবো বা করবো না।অনেকদিন পর হালকা লাগল পুকুর নিজেকে।
কয়েকদিন পর
………পিনাকী, তুই সুপ্রিয়র কাছে কি করতে গেছিলি?
……তোমায় কে বলল?
………সুপ্রিয়।
………ওনার সাবজেক্ট নিয়ে একটু কথা, এই আর কি
………গুল মারছিস, মিথ্যুক, তোর কারসাজি সব
………তোমার লিপস্টিক এর এই শেড আগে দেখিনি তো, কে দিল? ……ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না এই রকম মুখে।……… হাতের পেন্সিল ছুড়ে
………মারবো তোকে, খুব মারবো………হাঁসিতে উজ্জ্বল মল্লিকা। পুকু এগিয়ে দু হাতে জড়িয়ে ধরল মল্লিকাকে
………মার দিদি, শাসন করো, কেউ তো নেই, তুমিই না হয় করলে
শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি বম্বেতে, মানে ঘরে ফেরার মানুষের ভোগান্তির এক শেষ। আজ দুপুরে ৩ ঘণ্টা বৃষ্টিতে পথ ঘাট সব থই থই। শ্রী আটকে পড়েছে, যেতে পারছে না। পুকু সঙ্গ দিচ্ছে। শ্রী উঠে চা করে পাঁপড় ভেঁজে এনেছে দু বার। খাওয়া শেষ। গল্প করতে করতে রাত ৯ টা।
………চলো তোমাকে এগিয়ে দি। ………বেরিয়ে এক অটো পেল । বেশ দূর শ্রীর বাড়ি। অটোতে অনেক পথ পেরিয়ে বুঝল হাটা ছাড়া উপায় নেই
……… স্যার, চলুন না একটু সমুদ্রের ধারে………মাথা ঝেঁকে হ্যাঁ বলে দুজনে সমুদ্রের পাড়ে। রেলিং এ ঝুকে পুকু……শ্রী একটু ইতস্তত করছে
……… কিছু বলবে?.........শ্রী চুপ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে
………কোন আঘাত দেবার জন্য নয় একটা কথা বলতে চাই, পারমিসন চাইছি
পুকু একটু বিরক্ত হোল। ঘাড় নেড়ে সায় দিতে, শ্রী খুব আস্তে, ধীরে ধীরে
………আমার বাবার নাম সি, জে, ইন্দ্র। ইন্দ্রজিত চক্রবর্তী। আপনার বাবা………প্লিস আমায় ক্ষমা করবেন………কান্না ভেজা গলা শ্রীর।
কয়েক মুহূর্ত পুকুর মাথা কাজ করলো না, তারপর এক বিরাট চিৎকার “ না………”না, না না । মা মা বুচি বুচি, আমি চাই না, চাই না, চাই না। “ পাগলের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পুকু দৌড়াতে শুরু করলো। খানিকটা দৌড়ে এগিয়ে আবার ফিরে এসে, শুন্যে ঘুসি চালাচ্ছে, একটু দৌড়ে যাচ্ছে আবার ফিরে এসে শ্রীর চোখে আগুন চোখে তাকিয়ে আবার , কাঁধ , ঝাকাচ্ছে, ‘আই হেট হিম আই হেট হিম’ । এ একেবারে অন্য পুকু। দু হাতে নিজের মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আর না না ,এই ভাবে কিছু সময় পর রেলিং এ হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে”
……… মা , মা মা বুচি বুচি আমি কি করবো। আবার।আমার সাথে কেন এমন হয়?
হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ল। দু একজন দাঁড়িয়ে গেছে , কি হয়েছে দেখবার জন্যও। রুমালে মুখ চেপে কেঁদে যাচ্ছে শ্রী। কান্না, ভিতরের সব জ্বালা, ক্ষেদ, ঘৃণা দুঃখ, বেদনা, ব্যাথা জুড়িয়ে দেয়। কান্না ধুয়ে দেয় সব কিছু, হালকা হয় প্রান। পুকুরও তাই হোল। প্রায় ২০ মিনিট পর। শান্ত পুকু সিগারেটের প্যাকেট বার করে সিগারেট ধরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে। শ্রী লক্ষ করলো দুই চোখে জলের ধারা। ৪ টে সিগারেট চলছে, শ্রী একেবারে অপ্রস্তুত।পাশে গিয়ে
………আমি এখন আসি। রাত প্রায় ১১ টা। ক্ষমা করবেন ……পাস কাটিয়ে এগিয়ে যাবে, ডান হাত বাড়িয়ে খপ করে শ্রীর হাত ধরে টেনে নিল কাছে
……শোন শ্রী, উনি আমার কেউ নন। আই হেট হিম, আই হেট হিম। উনি তোমার বাবা কিন্তু আমার কেউ নন। আমি কোনদিন তাকে ক্ষমা করতে পারব না। কোনদিন না। যদি আগের মতন আমার সাথে কাজ করতে চাও তাহলে তুমি আর কোনদিন আমার সামনে তার নাম উল্লেখ করবে না।
……শ্রী নিজেকে সামলে নিয়েছে, বুদ্ধিমতী মেয়ে
……… তাই হবে। শুনুন, আমার কোন ভাই বোন, কোন ধরনের কোন আত্মীয় কোথাও নেই, তাই একবার, শুধু একবার একটু জড়িয়ে ধরতে দেবেন, প্লিস?...... পুকু চেয়ে রইল কিছু সময়, তারপর দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঠোটের কোনে অল্প হাসি দিতে, আবেগে শ্রী দু হাতে জড়িয়ে
……… আমি বুঝি , এ কি যন্ত্রণা, কি অপমান, আমি বুঝি……ঝাঁকিয়ে উঠলো পুকু
……… না কেউ বোঝেনা, কেউ না। একটা বাচ্চা ছেলে কলেজ থেকে দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি আসছে ফার্স্ট হয়েছে বাবাকে দেখাবে বলে। বাড়ি শুন্য। রাস্তায় ষে কোন ঝাঁকড়া চূলের লম্বা লোক দেখলে ছূটে গিয়ে দেখেছি বাবা? বার বার মন ভেঙ্গেছে। বুকের ভিতর পাখির ডানা ঝাঁপটা মারে, হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খোঁজা , মায়ের গুমরে গুমরে কান্না। সবাই বাবার সাথে যায়, আর আমি অসহায় চোখে খালি খুজে বেড়াই সেই বড় চওড়া বুকটা। এটা ষার না হয়েছে সে বুঝবে না ।যাকে ভালবাসতাম সে বুঝত কেননা তার মা ও পালিয়ে গেছে। ষে অপমান মা সারা জীবন বুকে বয়ে বেড়িয়েছে , আমি সেই অপমান মাফ করতে পারব না প্লিস।
শ্রী আরও নিবিড় করে জাপটে “কথা দিলাম কোনদিন বলবনা, কথা দিলাম” ।
পুকু হাত ছাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল শুধু মেঘে ঢাকা তারা। একটু ধরে থাকল, শ্রীকে। হাত ছাড়িয়ে আবার পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে
……শ্রী, কাল খুব সকালে আসতে পারবে, ৫ টার ভিতর? কাল থেকে তোমায় ৭-১০ দিন অফিস চালাতে হবে, সকালে আসলে ফ্লাট আর অফিসের চাবি তোমায় দিয়ে কলকাতায় যাব, ফ্লাটে থেকে যেতে পার এ কদিন যদি ইচ্ছা হয়। আমার মন এখন বিক্ষিপ্ত। কাল প্রায় ৩ বছর পর কলকাতায় যাব। ফ্লাট কিনেছি। রেজিসট্রেসন বাকি আছে। এ ছাড়া মায়ের বাড়িটা দেব আমাদের পাড়ার ক্লাবকে । অসিমদা চালাবে মায়ের নামে ক্লাবটা। এই যে আমি আজ এখানে, তার পিছনে অসিমদার ভুমিকা বলে শেষ করা যাবে না। তাই গুরু দক্ষিনা বলতে পার । অসহায় বাচ্চা আর কাজের লোক কে নানা উপদ্রব থেকে বিরাট গাছের মতন আড়াল করে রেখেছিলেন অসিম দা। এ ছাড়া একজনের খোঁজ করতে হবে, সে কেন আমার থেকে লুকিয়ে , সেইটা বার করতেই হবে।