Thread Rating:
  • 106 Vote(s) - 2.8 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) সমাপ্ত :---
এইভাবেই সুখে দুঃখে আরও একটা বছর কেটে গেল। আকাশ এখন চার বছরের। আকাশের দাদু মারা যাওয়ার পর স্নেহাঃশু বাবু আর কলকাতা আসেন নি। মাঝে মাঝে ফোন করে খবরাখবর দিতেন। বেশিরভাগ সময় বীণাপাণি দেবী নিজেই ফোন করে তার ছেলের খবর নিতেন। স্নেহাঃশু বাবু তেমন ফোন করতেন না। তেমনি একদিন সন্ধ্যায় আকাশের মামা তার মাকে ফোন করে কথা বলছিলেন। বীণাপাণি দেবী অবাক হয়েছিলেন ছেলের এই নিজে থেকে ফোন করায়। কিন্তু তিনি ভাবলেন হয়তো নাড়ীর টান।

“ হ্যাঁ , মা ! „

“ বল খোকা । „

“ কেমন আছো ? „

“ আমার মেয়ে জামাই আমাকে সুখেই রেখেছে। „ নিজের মেয়ের শশুর বাড়িতে থাকতে মোটেও খারাপ লাগছে না আকাশের দিদিমার। কিন্তু সব পিতা মাতার আশা থাকে বুড়ো বয়সে তাদের ছেলে তাদের দেখবে। কিন্তু আকাশের  মামা এইভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছিলেন বীণাপাণি দেবী।

কথাটা শুনে তেমন কোন রাগ হলো না আকাশের মামার। তিনি চুপচাপ মায়ের কথা শুনলেন। মা আরো বললেন “ বুড়ো বয়সে ছেলের দায়িত্বে মা বাবা থাকে। আর আমার এই পোড়া কপালে সেটা জোটেনি। „

মাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আকাশের মামা বললেন “ বলছি , এখানে চলে আসো তাহলে ! „

“ এখানে মানে কোথায় ? আমার বাড়ি বারাসাতে থাকার কথা বলছিস ? „ একটা আশার আলো দেখতে পেলেন আকাশের দিদিমা।

“ না ।  আমি মুম্বাই এর কথা বলছি ।  যখন ছেলের কাছে থাকার ইচ্ছা তখন এখানে চলে আসো । পরশু চলে আসো । আমি ঠিকানা মেসেজ করে দিচ্ছি। „ বলে ফোন কেটে দিলেন আকাশের মামা ।

রাতে যখন সবাই একসাথে খেতে বসলো তখন বীণাপাণি দেবী সুখের কথাটা বললেন “ স্নেহু ফোন করেছিল। আমাকে ওর কাছে থাকার জন্য ঢেকেছে । „

আকাশের মা তখন সবে রুটি ছিঁড়ে মাংসের বাটিতে সেই টুকরো টা ডুবিয়েছেন। ওখানেই থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “ মানে ? „

মেয়ের প্রশ্নে আকাশের দিদিমা বিশদে সব খুলে বললেন। সবকিছু শুনে আকাশের মা আকাশ কে খাইয়ে দিয়ে , নিজে খেয়ে তারপর তার ভাইকে ফোন করলেন “ তুই মাকে ডেকেছিস ? „

“ হ্যাঁ। কেন অসুবিধা আছে ? „

“ না অসুবিধা নেই। তবে আমরাও আসছি মাকে ছাড়তে । „ আকাশের মা এতোটা বলতেই অপর প্রান্ত থেকে ফোন কেটে গেল।

“ দিদিমা তুমি চলে যাবে ? „ রাতে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো আকাশ।

“ ধুর বোকা ।  আমি কোথায় যাবো ? আমি আসবো তো মাঝে মাঝে । এখন ঘুমা । অনেক রাত হয়েছে । „ আকাশকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করলেন দিদিমা। কিন্তু আকাশের চোখে জল না এলেও তার মন কিন্তু কাঁদছে। দুই বছর ধরে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। দিদিমার গায়ের গন্ধ শুঁকে তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসে। দুইদিন পর থেকে এইসব কিছুই সে আর পাবে না।

সকালে যখন সুচি বাদশার সাথে খেলতে এলো তখন আকাশ তাকে বললো “ জানিস ? দিদিমা চলে যাবে ? „

কথাটা শুনতেই সুচির চোখে জল চলে এলো “ দিম্মা তুমি চলে যাবে ? „

“ বোকা মেয়ে কাঁদছে দেখো। কাঁদিস না , আমি মাঝে মাঝে এসে তোর সাথে দেখা করে যাবো । „ বলে সুচির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু খেলেন দিম্মা ।

দুই দিন পর সকালে সুচেতা দেবীকে বাদশা , বাদশার ডগ ফুড আর ঘরের চাবি দিয়ে পুরো পরিবার কয়েক দিনের জামাকাপড় নিয়ে একটা ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্ট চলে এলো । আসার আগে বীণাপাণি দেবী রহমত চাচার সাথে শেষ কথা বলে এলেন । রহমত চাচা কাঁদলেন না। তিনি তার সব আপনজনকে হারিয়েছেন। এখন আপনজন কে হারানো যেন অভ্যাস হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে এসে তারা মুম্বাইগামী প্লেনে চেপে বসলো। আকাশ এই প্রথম প্লেনে উঠলো তাই তার উৎসাহ দেখার মতো। এক জায়গায় স্থির থাকছিল না। মায়ের বকুনি খেয়ে চুপচাপ প্লেনের জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলো । পরপর তিনজন পাশাপাশি বসেছিলেন। জানলাতে আকাশ। তারপাশে তার মা আর মায়ের পাশে দিদিমা। জানলা দিয়ে তাকিয়ে আকাশ মেঘ দেখলো। মেঘের উপর দিয়ে চলেছে তারা। নিচের পাহাড় কতো ছোট ছোট দেখাচ্ছে। আর নদী গুলো যেন সুতোর মতো সরু। এইসব দেখতে দেখতেই সে পৌছে গেল মুম্বাই। এয়ারপোর্টে নেমে তারা আকাশের মামার দেওয়া ঠিকানা বলে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলো ।

আকাশের মামার দেওয়া ঠিকানায় যখন তারা পৌছুলো তখন বেশ বিকাল হয়ে এসছে । ট্যাক্সি থেকে নেমে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করতে ট্যাক্সি ড্রাইভার সামনের বহুতল বিল্ডিংটা দেখিয়ে দিয়ে বললো “ এহি হে আপকা পাতা হ্যা। „

তারপর সবাই মিলে সেই বহুতল বিল্ডিংটায় ঢুকতেই আকাশের মামা এগিয়ে এলেন। তিনি যেন হাওয়ার মধ্যে থেকে হঠাৎ ভেসে এলেন। সাথে একটা মেয়েও এগিয়ে এলো । মেয়েটা সুন্দরী। ফর্সা, লম্বা চুল। স্লিম ফিগার। বয়স খুব জোড় 25-26 হবে।

মেয়েটা এগিয়ে এসে সবাইকে একটা প্রণাম করলো তারপর চার বছরের আকাশকে কোলে তুলে নিয়ে মেয়েটা আদুরে গলায় বললো “ আপনারা এখন এলেন ? আমরা কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি আপনাদের জন্য। „ মেয়েটার কথা শুনে তো সবাই রীতিমতো বাকরুদ্ধ। মেয়েটা আরো বললো “ আসুন ভিতরে আসুন বাবা মা অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। „

সবাই বিস্ময়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো । মেয়েটা এমন ভাবে কথা বলছে যেন কতদিনের চেনা। কিন্তু আকাশের পরিবার মেয়েটার নামটাও জানে না। আকাশের বাবা মা দিদিমা যে ইশারায় স্নেহাংশু বাবু কে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন তারও উপায় নেই। কারন আকাশের মামা মাথা নিচু করে আছেন । কারোর দিকেই তাকাচ্ছেন না। তারপর তারা বিল্ডিং টায় ঢুকে এলিভেটরে উঠে , নয় তলায় থামলো। বিল্ডিংটা বেশ বড়ো জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের আন্দাজে বারো থেকে তেরো তলা তো হবেই। তারপর এলিভেটরের বাইরে এসে মেয়েটা একটা দরজার কলিং বেল বাজালো । সঙ্গে সঙ্গে এক বয়স্কা মহিলা দরজা খুললেন “ আসুন , আসুন। „

তারপর সবাই ভিতরে ঢুকলো । ফ্ল্যাট টা কতো বড়ো সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মেঝেতে মার্বেল বসানো। দেওয়ালে প্লাস্টার করা আর দিনের বেলায়ও লাইট জ্বালায়ি রাখা। ওই বয়স্কা মহিলা লিভিং রুমে নিয়ে গিয়ে একটা সোফা দেখিয়ে বললেন “ বসুন বসুন। „

আকাশের মা বাবা দিদিমা সবাই লক্ষ্য করলো একটা সোফাতে আগে থেকেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক আগে থেকেই বসে আছেন । সোফাতে বসতেই তিনি বললেন “ বসুন , বসুন। আপনারা এতো দেরি করে এলেন । তবুও সময়ের আগে আসতে পেরেছেন এই অনেক। „

লোকটা বলে কি ? সবাই আগে থেকে বাকরুদ্ধ তো ছিলেনই। এখন যেন বোবা হয়ে গেলেন । সময়ের আগে আসতে পেরেছেন মানে কিছুই বুঝতে পারছেন না কেউ ।

ওই ভদ্রলোক আরো বললেন “ আপনারা যে ঘরজামাই এর কথাটা মেনে নেবেন সেটা ভাবতেই পারি নি। বুঝতেই পারছেন ! একটাই মেয়ে তাই কোল ছাড়া করতে বুক ফাটে । „

এবার আকাশ বাদে কারোরই বুঝতে বাকি রইলো না যে এখানে কি হচ্ছে ! আকাশের মামা আদেও বীণাপাণি দেবীকে এখানে রাখার জন্য ডাকেনি। ডেকেছে নিজের বিয়ের জন্য। যে মেয়েটা প্রণাম করলো সে হলো পাত্রী আর এই বয়স্কা বৃদ্ধ বৃদ্ধা হলো পাত্রীর মা বাবা । ব্যাপারটা বুঝতেই সবার চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। আকাশের মা আকাশের বাবার দিকে তাকালেন। সবাই সবার মুখের দিকে তাকালেন । তারপর আকাশের মা বাবা আর দিদিমা আকাশের মামার দিকে তাকালেন। আকাশের মামা তখনও মাথা নিচু করে বসে আছেন।

ঠিক সেই সময়ে পরিস্থিতি বুঝে আকাশের মামা বললেন “ আঙ্কেল ! মা , দিদি অনেক দূর থেকে এসছে .....

স্নেহাংশু বাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই পাত্রীর বাবা বললেন  “ হ্যাঁ হ্যাঁ আপনারা রেস্ট নিন। অনেক সময় আছে কথা বলার। „

তারপর আকাশের মামা সবাইকে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটায় একটা বড়ো কিং সাইজের খাট আর বসার জন্য দুটো সোফা আছে । আকাশের বাবা আর মাম সোফা দুটোয় বসলেন আর আকাশের মা দিদা খাটে বসলেন। সেই ঘরে পাত্রীও এসছিল। আকাশের মামা তাকে কিছু জল খাবার আনার জন্য অন্য জায়গায় চলে যেতে বললো । পাত্রী যেতেই আকাশের মামা আকাশের দিদিমার কোলে পড়ে বলতে শুরু করলেন “ মা প্লিজ তুমি কোন বাধা দিও না। আমি নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। পাত্রী ভালো। „



আকাশের মামার এতদূর কথা শেষ হতেই আকাশের মা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন “ জানোয়ার । নিজের বিয়ের কথা নিজেই বললি। আবার বানিয়ে বানিয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা না করেই আমার সম্মতি ও দিয়ে দিলি।  তুই এখানে মাকে ডেকেছিস বিয়ে করবি বলে ? আর মা স্বপ্ন দেখছে তার ছেলে তার কাছে রাখবে। „  কথা গুলো বলে ভাইকে মারতে যাচ্ছিলেন ।  কিন্তু আকাশের বাবা ধরে ফেললেন “ থাক এখানে আর এইসব করো না। „

আকাশের মামা স্নেহাংশু বাবু এবার দিদির দিকে তাকিয়ে বললেন “ আমার বয়স উনত্রিশ হয়ে গেছে। কখনো খেয়াল করেছিস আমার কি চাই , কি চাই না। সব সময় মেরেছিস। শাসন করেছিস। কখনও আদর করেছিস ? আমি নিজের বিয়ে করছি। এখানে আর বাঁধা দিস না। „

আকাশের মামা কখনো তার দিদির সাথে এই ভাবে কথা বলেন নি। তাই যখন ভাইয়ের মুখে এই কথা শুনলেন তখন তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে তার ভাই তার বাবার মৃত্যুর দিনের চড়ের কথা গুলোই বলছে।

তারপর সবাই শান্ত হলে আকাশের বাবা জিজ্ঞেস করলেন “ মেয়েটা কে ? „

“ মেয়েটার নাম তিলোত্তমা বসু । „

“ কবে থেকে চলছে এইসব ? „

“ কলেজে দেখা হয়েছিল। তখন থেকেই পরিচয় তারপর প্রেম। একই কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিই। পরিবার ভালো। বাঙালী পরিবার পনের বছর ধরে এখানে আছে। আমার খুব যত্ন করে। „

এবার আকাশের মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন “ কলেজ থেকে প্রেম করছিস আর আমাদের একবারও বলিস নি ? „

“ থাক বকিস না ওকে ।  „ আকাশের দিদিমা তার মেয়েকে থামিয়ে দিলেন ।  তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন “ তুই আমাকে এখানে তোর বিয়ের জন্য ডেকেছিস ঠিক আছে। কিন্তু তারপর আর একদিনও থাকবো না। বিয়ের পর আমি  তোর মুখ দেখবো না কখনো  „ তারপর আকাশের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন “ তুমি ফেরার টিকিট কাটো। „ তার চোখে জল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। একজন মা কতোটা দুঃখে কথাটা বলতে পারে সেটা আকাশের মা খুব ভালো করে বুঝলেন। তাই তার চোখেও জল দেখা দিল।

রাতে আকাশের বাবা মা একটা ঘরে আর দিদিমা আর আকাশ আর একটা ঘরে ঘুমালো। রোজ রাতে গল্প শুনে ঘুমায় আকাশ। কিন্তু আজ দিদিমা কোন গল্প শোনাচ্ছে না। তাই তার ঘুমও আসছে না। খাটের শোওয়ার কিছুক্ষণ পর সে শুনতে পেল দিদিমা কাঁদছে। সে জিজ্ঞেস করলো “ দিদিমা তুমি কাঁদছো কেন ? „

“ কই , আমি তো কাঁদছি না। বোকা কোথাকার ।  „ বলে নিজের চোখের জল মুছে নিলেন। আকাশ তাকে আরো ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরলো।

ওদিকে স্বামিকে  জড়িয়ে ধরে আকাশের মা নিজের মনেই অনেক কিছু ভাবছিলেন। ভাইয়ের ব্যবহার, তাদের ছোটবেলা। বাবার মৃত্যুর দিন সবার সামনে চড় মারা। এইসব মনে হতে কিছুটা অনুশোচনা হলো আকাশের মায়ের।

পর দিন সকাল থেকেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। অনেক কাজ আগে থেকেই করা ছিল। যেমন সবাইকে নেমন্তন্ন করা। এই বিল্ডিং এর নিজস্ব কমিউনিটি হলে বিয়ের সাজ সরঞ্জাম করা। খাওয়া দাওয়া ডেকরেটার্স সবকিছুরই বন্দোবস্ত আগে থেকেই করা ছিল। শুধু স্নেহাংশু বাবুর পরিবার আসার অপেক্ষা ছিল। কারন গোপন কথা হলো পাত্রীর বাবা শর্ত দিয়েছিলেন পাত্রের পরিবারের উপস্থিতি চাই। এই শর্তের জন্যেই তিনি মাকে ডাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। না হলে তার চিন্তা ছিল একা একাই বিয়েটা করার।

চারদিন পর বিয়ে। তাই সাজো সাজো রব। আকাশের বাবা পাত্রের পক্ষ থেকে যতটা করা যায় তার বেশিই করলেন ।

এখানে আসার পর থেকে আকাশ দিদিমার আর মায়ের কোল ছাড়া হয়নি। দুই দিন এর মধ্যেই তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠতে লাগলো। যে ছেলে সারাদিন সোসাইটির আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে সুচি, বাদশা, জয়শ্রী, বিপ্লব বিচ্ছুর সাথে খেলা করতো সে এই দুই দিন একবারও খেলে নি। এখানে যে তার সমবয়সী বাংলা ভাষী কেউ নেই। প্রতিবেশী একজন আছে কিন্তু সে হিন্দি ছাড়া কিছু বলতে পারে না আর আকাশ বাংলা ছাড়া কিছু বলতে, পারে না। তাই তাদের ভাব হয়নি। মাঝে মাঝে তার হবু মামী তিলোত্তমা ওর সাথে খেলেছে কিন্তু তার সাথেও তেমন জমেনি । তাই তার সুচি , বাদশার কথা খুব মনে পড়তে লাগলো।

এদিকে তিন দিন যেতে না যতেই সুচির খেলাধুলায় মন নেই। চার বছরে মাত্র একটা রাত বাদে কখনোই সুচি আকাশের থেকে এতোটা দূরে থাকে নি। এখানে তো তিন দিনের বিরহ হয়ে গেল একটানা। সুচি খেলছে না দেখে জয়শ্রীও খেলছে না। আকাশ নেই বলে বিপ্লব বিচ্ছুর ও খেলায় মন নেই। ডমিনো এফেক্টে পুরো সোসাইটি নিঝুম। সুচিত্রার খেলার সাথে নাচেও মন নেই। সপ্তাহে দুই দিন নাচ শেখে। শনিবার আর রবিবার। শনিবার বিকালে যখন অঙ্কিতার কাছে যখন নাচ শিখছিল তখন বিভিন্ন মুদ্রা ভুল করছিল। সব জানা মুদ্রা । সেটা দেখে অঙ্কিতা তো বলেই বসলো “ সব জানা মুদ্রা। অনেকবার অভ্যাস করেছিস। এখন কেন ভুল করছিস ? তোর partner in crime এখানে নেই বলে ? „

কথাটা সুচি একটুও বোঝেনি । তাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। সেটা দেখে অঙ্কিতা বললো “ নে , অভ্যাস কর মন দিয়ে। দশ বছর হলেই কিন্তু তোকে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে ! মনে রাখিস ! „

রাতে যখন সুচির বাবা ফিরলেন তখন সুচি তার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে মায়ের দেওয়া নাম্বার নিয়ে সে আকাশকে ফোন করলো । কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর অপর প্রান্তে আকাশের বাবা বললেন “ হ্যালো । „

“ হ্যা কাকু , আমি সুচি বলছি। আকাশ আছে ?

“ আকাশ তো এখন ওর মায়ের সাথে। ও আসলে আমি ওকে দিচ্ছি ঠিক আছে ! „

“ হ্যাঁ কাকু । „ বলে ফোনটা রেখে দিল সুচি। রাত পোহালেই বিয়ে। তাই কিছুক্ষণ পর বিয়ের চাপে শুভাশীষ বাবু ভুলে গেলেন যে সুচি ফোন করেছিল।

পরের দিন বিয়ে হয়ে স্নেহাংশু বাবু আর তিলোত্তমা বসু সাত পাকে বাধা পড়ার পর। আকাশ তার দিদিমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে সুচির বাবার নাম্বারে ফোন করলো। বাড়িতে দুটো ফোন। একটা বাবার কাছে থাকে আর একটা মায়ের কাছে থাকে। খুব কম সময়ের জন্যেই আকাশের মায়ের ফোনটা দিদিমার কাছে আসতেই সে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভালো না। সুচির বাবার ফোন ধরে বললেন “ হ্যালো । „

“ হ্যালো জ্যাঠু আমি আকাশ। সুচি আছে ? „

“ সুচি তো ওর মায়ের সাথে বাইরে দোকানে গেছে। আসলে ওকে বলছি। ঠিক আছে ! „

“ আচ্ছা জেঠু  । „

আকাশ ফোন রাখতেই সমরেশ বাবুর এক অফিস কলিগ ফোন করলেন। সেই ফোনের কথাবার্তা চললো দশ মিনিট পর্যন্ত। তাতে তিনি আকাশের ফোন করার কথা ভুলে গেলেন।

বিয়ের পর আর একদিন থেকে তারা সবাই কলকাতা চলে এলেন। বৈশিষ্ট্য বাবু বলেছিলেন থেকে যেতে আর কয়েকদিন। তার উত্তরে আকাশের বাবা বললেন “ ওদিকে অনেক কাজ আছে বুঝতেই পারছেন। কাজ ছেড়ে এসছি। „

এয়ারপোর্ট থেকে যখন তাদের ট্যাক্সি সোসাইটির সামনে দাঁড়ালো তখন বেশ বেলা হয়ে এসছে। রহমত চাচা সবে নিজের দিনের ডিউটি শুরু করেছেন। ট্যাক্সিটা সোসাইটির বড়ো লোহার গেটের সামনে দাঁড়াতে তিনি গেট খুলে দিলেন। যখন দেখলেন আকাশের মা বাবার সাথে তার দিদিমাও ফিরে এসছেন তখন তিনি বেশ খুশিই হলেন।

বাড়ি ফিরে সবাই রেস্ট নিলেন। সুচি কলেজ থেকে ফিরতেই দেখতে পেলো আকাশদের দরজায় তালা নেই। ঘরে ঢুকে দেখলো বাদশা নেই। তারপর জামা কাপড় বদলে সে আকাশদের ঘরে চলে এলো এসেই দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলো “ তুমি চলে এসছো । „

“ হ্যাঁ রে বোকা মেয়ে ।  তোকে ছাড়া কি থাকতে পারি ? তোর জন্যেই চলে এলাম। „ তারপর সুচি দিম্মার সাথে অনেক কথা বললো কিন্তু আকাশের সাথে কথাই বললো না।  আকাশ কথা বলতে এলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল সুচি। চার বছরের আকাশ এর কারন বুঝলো না । সুচির রাগ হয়েছে সেটা দিদিমা বুঝলেন কিন্তু কেন রাগ হয়েছে সেটা বুঝলেন না।

সেই দিন রাতে জয়শ্রীর বাবা জয়শ্রীর জন্য একটা সাইকেল কিনে আনলেন। ব্যালেন্স এর জন্য যে চাকা লাগানো থাকে সেটা নেই। কারন জয়শ্রী সাইকেল চালাতে জানে। সকালে যখন সে তার সাইকেল টা নিয়ে সোসাইটির রাস্তায় চালাচ্ছিল তখন সুচি দেখে বললো “ দে চালাই । „

“ তুই পারবি না । পড়ে যাবি । „ জয়শ্রী সুচিকে সাবধান করে দিল।

“ তুই দে না ।  „ জোড় করেই সুচি নিয়ে নিল সাইকেল টা । তারপর তাতে উঠে প্যাডেল চালাতে শুরু করলো। পিছনে জয়শ্রী ধরে রইলো। কয়েক মিটার গিয়ে জয়শ্রীকে হাত ছেড়ে দিত বললো সুচি “ তুই ছেড়ে দে। আমি পারবো। „

সুচির কথায় জয়শ্রী হাত ছাড়তেই  সুচি ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে পরে গেল। আর ডান পায়ের হাঁটুতে বেশ বড়ো ছড়ে গিয়ে রক্ত বার হলো আর সঙ্গে সঙ্গে জ্বালায় কেঁদে উঠলো। আকাশ , বিপ্লব বিচ্ছু আরো কয়েকজন ক্রিকেট খেলছিল। সুচিকে পরে যেতে দেখে বাদশা আর আকাশ দৌড়ে এলো সাথে রহমত চাচাও এলেন। রহমত চাচা এসে সুচিকে তুলে দাঁড় করালেন। আকাশ এসে বললো “ চল , দিদিমার কাছে। ডেটল আছে লাগিয়ে দেবে। „

“ হ্যাঁ ওটাই ভালো হবে। আমার কাছে ডেটল নেই। থাকলে আমিই লাগিয়ে দিতাম। „ বললেন রহমত চাচা।

তারপর আকাশ আর জয়শ্রী মিলে সুচিকে উপরে নিয়ে গেল। রহমত চাচা পিছন থেকে দেখতে লাগলেন কতোটা যত্ন করে আকাশ সুচিকে উপরে নিজেদের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকে দেখলো মা রান্নার কাজে ব্যাস্ত। সে দিদিমা ডেকে চুপিচুপি বললো “ সুচির কেটে গেছে । „

“ কোথায় ? কীভাবে ? „ আকাশের মতোই তিনিও নীচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ।

সুচি নিজের ফ্রগ তুলে দেখালো ডান পায়ে হাঁটুতে বেশ কিছুটা ছড়ে গেছে “ সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে গেছি দিম্মা। „ ছড়ে যাওয়ার জ্বালায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদতে কাদতে বললো সুচি।

সেটা দেখে দিদিমা বললেন “ আয় এদিকে। কাঁদিস না। তুই না বড়ো হয়ে গেছিস। „ তারপর বাথরুম থেকে ডেটলটা নিয়ে এসে একটা তুলো নিয়ে ক্ষতস্থানে রক্ত মুছে দিলেন। ডেটল লাগাতেই জ্বালা হওয়ায় সুচি বললো “ মা বকবে । „ 

“ তুই কেটে যাওয়ার জন্য কাঁদছিস ? নাকি মা বকবে বলে ? „ জিজ্ঞেস করলেন দিদিমা।

ক্ষতস্থান পরিচর্যা করার পর আরো কয়েক ঘন্টা সুচি দিদিমার ঘরেই ছিল। সেই সুযোগে আকাশ তার মুম্বাইয়ের সব অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করলো। ওখানে ও টিভি দেখেছে। এরোপ্লেন চেপেছে আমাদের থেকেও বড়ো বড়ো বাড়ি আছে ওখানে। কিন্তু খেলার জন্য কোন মাঠ নেই। বন্ধু নেই। এইসব কথাবার্তায় তাদের আবার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আর পায়ের ক্ষতের জ্বালায় সুচি পাঁচ দিনের বিরহ এবং আকাশের একবারও ফোন না করার কথা সে ভুলে গেল।

সেদিন বিকালে যখন আকাশ সুচি বাদশা আরো সবাই খেলছিল তখন রহমত চাচা পাশের দোকান থেকে কয়েকটা ক্যাটবেরি কিনে এনে তাদের কে দিলেন। সবাই চকলেট পেয়ে দৌড় দিল কিন্তু সুচি আর আকাশ গেল না। রহমত চাচা তখন তাদেরকে খুব শান্ত মিষ্টি মাখা গলায় বললেন “ আজ যেমন সুচির কেটে গেছিল তুমি যত্ন করে নিয়ে গেলে। ঠিক তেমনি সবসময় তোমরা একে অপরের যত্ন নেবে। „ 
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) চলছে :--- - by Bichitro - 31-07-2021, 09:02 AM



Users browsing this thread: 159 Guest(s)