24-07-2021, 08:08 PM
অণুগল্প
কোমরটা একটু স্ট্রেচ করে নিল ঈশিতা। সকাল থেকে যা ঝড় বয়ে যায়, বাবা! এই এতক্ষণে একটু ফাঁকা হল, এবার একটু আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে কফি খাবে। তারপর স্নান করতে যাবে। চাট্টি খেতে না খেতেই তো আবার বিকেলের কাজ শুরু হয়ে যাবে। সে শেষ হতে হতে সেই রাত বারোটা।
ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই একটু হাসল ও। এক বছর হতে চলল প্রায়!
গতবছরের বিশ্বজোড়া অতিমারি তে আরও অনেকের মতো চাকরি চলে গেছিল ওর ও। প্রথম তিনমাস ওয়ার্ক ফ্রম হোম তাই কম মাইনে, তারপর তো একটা মেইলেই পিংক স্লিপ!
কানাঘুষো চলছিল কদিন ধরেই। টানা তিনমাস ধরে কোনো ব্যবসা হয়নি, এদিকে অফিসের ভাড়া গুনতে হচ্ছে, তাই বোধহয় ছাঁটাই হবে। কিন্তু, দু বছর ধরে এক জায়গায় কাজ করার পরেও যে এরকম ভাবে একটা মেইল করে 'আর আসতে হবে না' বলা যায়, ও ভাবতেই পারেনি। আর তাই হয়ত অভিঘাত টাও বেশি হয়েছিল। এখনও মনে আছে, জুলাই মাস ই ছিল... প্রচন্ড রোদ ছিল। মেইলটা দেখে রাস্তায় বেরিয়ে গেছিল ও। খালি একটাই কথা ভাবছিল... এবার, এবার কি হবে? মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, রেজাল্ট ও সাদামাটা। বিয়ে থা করে সংসারী হবে ভেবে রেখেছিল, কিন্তু কলেজ পাশের পরে চাকরী করতে করতেই বাবার রাজরোগ ধরা পড়ল! ক্যানসার! স্টেজ থ্রি থেকে ফোর হতে সময় লাগেনি বিশেষ। কেমো, রে, ওরাল কেমো ইত্যাদির পরেও বাবা রইলেন মাত্র বছর খানেক। বাবা চলে গেলেন, সঞ্চয়টুকুও চলে গেল। তাও ভাগ্যিস, মাথার ওপরে ছাদ টা ছিল! তখনও মনে হত, একটা ভাল চাকরি হলে, দাঁড়িয়ে যাবে ঠিক... চাকরিটা পেয়ে মনে হয়েছিল এই তো, এবার আস্তে আস্তে জমাতে হবে টাকা...আর দুটো বছর...।
কিন্তু হায় হতোস্মি! দুবছর কাটার আগেই এসে গেল হাহাকারের দিন। আর... চাকরিটাও চলে গেল।
আজ ভাবতে দ্বিধা নেই, সেদিন মাকে "একটু আসছি দোকান থেকে" বলে বেরিয়ে এসেছিল ও। মাথা কাজ করছিল না তখন। বারবার মনে হচ্ছিল মাত্র কুড়ি হাজার আটশো টাকা জমা আছে অ্যাকাউন্টে... এটা শেষ হতে কতদিন আর? আর তারপর? তারপর? তারচেয়ে... কোনো চলন্ত বাসের সামনে যদি পড়ে যায়? বাস...ট্যাক্সি...যা হোক... এই টেনশান... 'কি হবে, কি হবে' র হাত থেকে তো মুক্তি পাওয়া যাবে! ভাবতে ভাবতেই চোখ কড়কড় করে উঠেছিল ওর...মা! মায়ের কি হবে! বাবা চলে গেছেন... ও এইভাবে চলে গেলে মা কি সামলাতে পারবেন? মা যে এমনিতেই একা হয়ে গেছেন বড্ড। অফিস থেকে ফিরতে ওর সামান্য দেরি হলেই চিন্তা করতেন, ফোন করে করে পাগল করে দিতেন... মায়ের কি হবে... উফ, কেন যে একটা ভাই, দাদা, দিদি, বোন... কিচ্ছু নেই ওর? কেন যে এত সাধারণ ও? নাচ গান ছবি আঁকা... কিচ্ছু পারে না! কোনোদিন আগ্রহও ছিল না এসবে। শুধু মায়ের দেখাদেখি রান্নাটা করতে ভালবাসত ও। বড় হয়ে 'বেলা দে' র রান্নার বই কিনে এনেছিল... তখন কতরকম রকমারি রান্না করেছে! চাকরি পাবার তিনমাস পরে একটা মাইক্রোওয়েভ ও কিনেছিল এইজন্য। ওদের সাদা কালো সংসারে একমাত্র রঙিন জিনিস!
ফাঁকা রাস্তা, লক ডাউন উঠে গেলেও বাস খুব কম চলছিল। তারমধ্যেও বারবার মনে হচ্ছিল ফুটপাথ থেকে নেমে যাই রাস্তায়... বাস টাস কিছু এসে ধাক্কা মারুক... মা কে মামারা দেখবেন না?
এইসব এতাল বেতাল ভাবনার মাঝেই জোরে ধাক্কা লেগেছিল একটা। একটি ছেলের সাথে। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে দেখে ছেলেটি কাউকে বলছে "হ্যাঁ দাদা, এই তো আমি গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে গেলাম, আপনি কোথায় আছেন...আচ্ছা...কোনো দোকান দেখতে পাচ্ছেন?" আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লাল জামা পরা ফুড ডেলিভারি অ্যাপের একটি ছেলে এসে ফোনে কথা বলা ছেলেটির হাতে কয়েকটি খাবারের প্যাকেট তুলে দিল। ছেলেটিও "থ্যাংকইউ দাদা" বলে চলে গেল।
...আজ একটি বছর পরে, ঈশিতা ভাবে, সেদিন ভাগ্যিস উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেছিল! তাই তো মাথায় আইডিয়াটা এসেছিল!
সেদিন বাড়ি ফিরে মা কে সব বলেছিল ও। চাকরি চলে যাবার ব্যাপার... আর নতুন পরিকল্পনার বিষয়ও। আর তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই শুরু করে দিয়েছিল "ঈশিতার রান্নাঘর"। প্রথমে সাধারণ মাছ, ডিম আর মুরগীর মাংসের থালি দিয়ে কাজ শুরু করেছিল। ভাত, ডাল, আলুভাজা, একটি তরকারি আর মাছ, ডিম বা মাংস...সাথে সামান্য স্যালাড...এই ছিল থালির উপকরণ। প্রথম প্রথম মা রান্না করতেন ও নিজেই কলেজজীবনে কেনা 'লেডিবার্ড' সাইকেল নিয়ে ডেলিভারি দিতে যেত। পাড়ার প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে সস্তার হলুদ কাগজে কালো হরফে লেখা "ঈশিতার রান্নাঘর" এর পোস্টার ছাপিয়ে রাতের অন্ধকারে লাগিয়েছিল নিজেই। তারপর আস্তে আস্তে নাম হল। শনিবার - রবিবার খবরের কাগজের সাথে মেনুকার্ড পাঠাত। ফেসবুক, ইউটিউবে নিজের নামে চ্যানেল খুলে লাইভে রান্না দেখাত, মায়ের হাতে মোবাইল টা দিয়ে। মাস তিনেক এইভাবে চালানোর পরে ফুড ডেলিভারি অ্যাপের সাথেও পার্টনারশিপ হয়ে গেল । এখন একজন দিদি ও আছেন, যিনি কুটনো কুটে, বাটিতে বাটিতে খাবার ভরে প্যাকিং এর কাজে সাহায্য করেন। সকাল থেকেই এখন বড্ড ব্যস্ত থাকে ওরা সবাই। মা ও সব অবসাদ ঝেড়ে ফেলেছেন। সাধ্যমত সাহায্য করেন ওকে। রাতে মা মেয়ে যখন ঘুমোতে যান, শত ক্লান্তির মাঝেও তখন দুজনের মুখেই হাসি লেগে থাকে... সৎ মানুষের, হেরে না যাওয়া মানুষের জয়ের গর্ব লেপা থাকে সেই হাসিতে।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নিজের ফোনটা টেনে নেয় ঈশিতা। তারপর গুগল থেকে খুঁজতে থাকে রন্ধনশিল্পীর ছবি। আর মনে মনে বলতে থাকে -
"গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু
গুরু দেব মহেশ্বর I
গুরু সাক্ষাত পর্ ব্রহ্মা
তাস্মাই শ্রী গুরুরেব নমঃ II"
যাঁর বই পড়ে, শিখে আজ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছে... গুরুপূর্ণিমার দিনে তাঁকে সম্মান না জানালে হয়?
কোমরটা একটু স্ট্রেচ করে নিল ঈশিতা। সকাল থেকে যা ঝড় বয়ে যায়, বাবা! এই এতক্ষণে একটু ফাঁকা হল, এবার একটু আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে কফি খাবে। তারপর স্নান করতে যাবে। চাট্টি খেতে না খেতেই তো আবার বিকেলের কাজ শুরু হয়ে যাবে। সে শেষ হতে হতে সেই রাত বারোটা।
ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই একটু হাসল ও। এক বছর হতে চলল প্রায়!
গতবছরের বিশ্বজোড়া অতিমারি তে আরও অনেকের মতো চাকরি চলে গেছিল ওর ও। প্রথম তিনমাস ওয়ার্ক ফ্রম হোম তাই কম মাইনে, তারপর তো একটা মেইলেই পিংক স্লিপ!
কানাঘুষো চলছিল কদিন ধরেই। টানা তিনমাস ধরে কোনো ব্যবসা হয়নি, এদিকে অফিসের ভাড়া গুনতে হচ্ছে, তাই বোধহয় ছাঁটাই হবে। কিন্তু, দু বছর ধরে এক জায়গায় কাজ করার পরেও যে এরকম ভাবে একটা মেইল করে 'আর আসতে হবে না' বলা যায়, ও ভাবতেই পারেনি। আর তাই হয়ত অভিঘাত টাও বেশি হয়েছিল। এখনও মনে আছে, জুলাই মাস ই ছিল... প্রচন্ড রোদ ছিল। মেইলটা দেখে রাস্তায় বেরিয়ে গেছিল ও। খালি একটাই কথা ভাবছিল... এবার, এবার কি হবে? মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, রেজাল্ট ও সাদামাটা। বিয়ে থা করে সংসারী হবে ভেবে রেখেছিল, কিন্তু কলেজ পাশের পরে চাকরী করতে করতেই বাবার রাজরোগ ধরা পড়ল! ক্যানসার! স্টেজ থ্রি থেকে ফোর হতে সময় লাগেনি বিশেষ। কেমো, রে, ওরাল কেমো ইত্যাদির পরেও বাবা রইলেন মাত্র বছর খানেক। বাবা চলে গেলেন, সঞ্চয়টুকুও চলে গেল। তাও ভাগ্যিস, মাথার ওপরে ছাদ টা ছিল! তখনও মনে হত, একটা ভাল চাকরি হলে, দাঁড়িয়ে যাবে ঠিক... চাকরিটা পেয়ে মনে হয়েছিল এই তো, এবার আস্তে আস্তে জমাতে হবে টাকা...আর দুটো বছর...।
কিন্তু হায় হতোস্মি! দুবছর কাটার আগেই এসে গেল হাহাকারের দিন। আর... চাকরিটাও চলে গেল।
আজ ভাবতে দ্বিধা নেই, সেদিন মাকে "একটু আসছি দোকান থেকে" বলে বেরিয়ে এসেছিল ও। মাথা কাজ করছিল না তখন। বারবার মনে হচ্ছিল মাত্র কুড়ি হাজার আটশো টাকা জমা আছে অ্যাকাউন্টে... এটা শেষ হতে কতদিন আর? আর তারপর? তারপর? তারচেয়ে... কোনো চলন্ত বাসের সামনে যদি পড়ে যায়? বাস...ট্যাক্সি...যা হোক... এই টেনশান... 'কি হবে, কি হবে' র হাত থেকে তো মুক্তি পাওয়া যাবে! ভাবতে ভাবতেই চোখ কড়কড় করে উঠেছিল ওর...মা! মায়ের কি হবে! বাবা চলে গেছেন... ও এইভাবে চলে গেলে মা কি সামলাতে পারবেন? মা যে এমনিতেই একা হয়ে গেছেন বড্ড। অফিস থেকে ফিরতে ওর সামান্য দেরি হলেই চিন্তা করতেন, ফোন করে করে পাগল করে দিতেন... মায়ের কি হবে... উফ, কেন যে একটা ভাই, দাদা, দিদি, বোন... কিচ্ছু নেই ওর? কেন যে এত সাধারণ ও? নাচ গান ছবি আঁকা... কিচ্ছু পারে না! কোনোদিন আগ্রহও ছিল না এসবে। শুধু মায়ের দেখাদেখি রান্নাটা করতে ভালবাসত ও। বড় হয়ে 'বেলা দে' র রান্নার বই কিনে এনেছিল... তখন কতরকম রকমারি রান্না করেছে! চাকরি পাবার তিনমাস পরে একটা মাইক্রোওয়েভ ও কিনেছিল এইজন্য। ওদের সাদা কালো সংসারে একমাত্র রঙিন জিনিস!
ফাঁকা রাস্তা, লক ডাউন উঠে গেলেও বাস খুব কম চলছিল। তারমধ্যেও বারবার মনে হচ্ছিল ফুটপাথ থেকে নেমে যাই রাস্তায়... বাস টাস কিছু এসে ধাক্কা মারুক... মা কে মামারা দেখবেন না?
এইসব এতাল বেতাল ভাবনার মাঝেই জোরে ধাক্কা লেগেছিল একটা। একটি ছেলের সাথে। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে দেখে ছেলেটি কাউকে বলছে "হ্যাঁ দাদা, এই তো আমি গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে গেলাম, আপনি কোথায় আছেন...আচ্ছা...কোনো দোকান দেখতে পাচ্ছেন?" আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লাল জামা পরা ফুড ডেলিভারি অ্যাপের একটি ছেলে এসে ফোনে কথা বলা ছেলেটির হাতে কয়েকটি খাবারের প্যাকেট তুলে দিল। ছেলেটিও "থ্যাংকইউ দাদা" বলে চলে গেল।
...আজ একটি বছর পরে, ঈশিতা ভাবে, সেদিন ভাগ্যিস উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেছিল! তাই তো মাথায় আইডিয়াটা এসেছিল!
সেদিন বাড়ি ফিরে মা কে সব বলেছিল ও। চাকরি চলে যাবার ব্যাপার... আর নতুন পরিকল্পনার বিষয়ও। আর তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই শুরু করে দিয়েছিল "ঈশিতার রান্নাঘর"। প্রথমে সাধারণ মাছ, ডিম আর মুরগীর মাংসের থালি দিয়ে কাজ শুরু করেছিল। ভাত, ডাল, আলুভাজা, একটি তরকারি আর মাছ, ডিম বা মাংস...সাথে সামান্য স্যালাড...এই ছিল থালির উপকরণ। প্রথম প্রথম মা রান্না করতেন ও নিজেই কলেজজীবনে কেনা 'লেডিবার্ড' সাইকেল নিয়ে ডেলিভারি দিতে যেত। পাড়ার প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে সস্তার হলুদ কাগজে কালো হরফে লেখা "ঈশিতার রান্নাঘর" এর পোস্টার ছাপিয়ে রাতের অন্ধকারে লাগিয়েছিল নিজেই। তারপর আস্তে আস্তে নাম হল। শনিবার - রবিবার খবরের কাগজের সাথে মেনুকার্ড পাঠাত। ফেসবুক, ইউটিউবে নিজের নামে চ্যানেল খুলে লাইভে রান্না দেখাত, মায়ের হাতে মোবাইল টা দিয়ে। মাস তিনেক এইভাবে চালানোর পরে ফুড ডেলিভারি অ্যাপের সাথেও পার্টনারশিপ হয়ে গেল । এখন একজন দিদি ও আছেন, যিনি কুটনো কুটে, বাটিতে বাটিতে খাবার ভরে প্যাকিং এর কাজে সাহায্য করেন। সকাল থেকেই এখন বড্ড ব্যস্ত থাকে ওরা সবাই। মা ও সব অবসাদ ঝেড়ে ফেলেছেন। সাধ্যমত সাহায্য করেন ওকে। রাতে মা মেয়ে যখন ঘুমোতে যান, শত ক্লান্তির মাঝেও তখন দুজনের মুখেই হাসি লেগে থাকে... সৎ মানুষের, হেরে না যাওয়া মানুষের জয়ের গর্ব লেপা থাকে সেই হাসিতে।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নিজের ফোনটা টেনে নেয় ঈশিতা। তারপর গুগল থেকে খুঁজতে থাকে রন্ধনশিল্পীর ছবি। আর মনে মনে বলতে থাকে -
"গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু
গুরু দেব মহেশ্বর I
গুরু সাক্ষাত পর্ ব্রহ্মা
তাস্মাই শ্রী গুরুরেব নমঃ II"
যাঁর বই পড়ে, শিখে আজ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছে... গুরুপূর্ণিমার দিনে তাঁকে সম্মান না জানালে হয়?