23-07-2021, 09:36 PM
(This post was last modified: 26-07-2021, 11:36 AM by ddey333. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
প্রথম ভাগ
পরিচ্ছদ ২
ফিলাডেলফিয়া
শুক্রবার, ২১শে ফেব্রুয়ারি, সকাল ৮টা
মার্কেট স্ট্রিটের বৃষ্টিস্নাত পথে রোজকার মত ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে সেই ভোর থেকেই। অদ্ভুত এই মার্কেট স্ট্রিট, ধোপদুরস্ত উর্দি পরিহিত শোফার বিলাসবহুল লিমুজিন গাড়ি চালিয়ে চলেছে বস্তি পরিবৃত পথ দিয়ে। একদিকে সুউচ্চ অট্টালিকা আর তার পাশেই বস্তির ছোট ছোট নোংরা ঘরগুলো পাশাপাশি গুঁতোগুঁতি করে জায়গা ভাগ করে নিয়েছে, ঘরের পাশেই জড় করে রাখা আবর্জনার স্তুপ। অবস্য ট্রেসি হুইটনির কোনদিকেই এইমুহুর্তে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। দ্রুত পদক্ষেপে সে হেঁটে চলেছে তার কর্মক্ষেত্র... চেস্টনাট স্ট্রিটের পূর্ব প্রান্তে, ফিলাডেলফিয়া ট্রাস্ট এন্ড ফিডেলিটি ব্যাঙ্কের দিকে। আজ তার পরনে একটা উজ্বল বর্ষাতি, পায়ে উঁচু বুটজোড়ে। মাথায়ও হলুদ রঙের একটা টুপি পড়ে নিয়েছে যাতে তার ঘন প্রাণবন্ত বাদামী চুলগুল না বৃষ্টির জলে ভিজে যায়, সেই ভয়ে। ট্রেসি হুইটনি... যেন প্রাণের প্রতীক... মধ্য কুড়ির অসম্ভব সুন্দরী বুদ্ধিদীপ্ত যুবতী। একঝলক তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যখন সেই উচ্ছল সৌন্দর্যের সাথে বুদ্ধিমত্তা মিশে থাকে, সেই মুখকে অঘ্রাহ্য করা একটা দূরহ ব্যাপার হয়ে ওঠে যে দেখে তার পক্ষে। সুন্দরী, ট্রেসির সৌন্দর্য শুধু একটা বৈশিষ্টেই আবদ্ধ নেই... পানপাতার মত মুখবায়ব, সরু পাতলা ওষ্ঠদ্বয়, গভীর বুদ্ধিদীপ্ত পান্নার মত সবুজ চোখের মনি আর সেই সাথে ছিপছিপে মেদহীন দেহবল্লরী। গায়ের শুভ্র চামড়ার রঙ গমের মত, আবার সেই রঙই কখনও কখনও রূপান্তরিত হয়ে যায় ষদচ্ছ সাদায় আর তা নয়তো গভীর গোলাপিতে। অদ্ভুত ভাবে তার চামড়ার রঙ বদলায় ট্রেসির মেজাজের ওপর, তার রাগ, অভিমান, ক্রোধ, উত্তেজনা, হতাশা সাথে সাথে। তার মা একবার বলেছিল, ‘সত্যি ট্রেসি, কখনও সখনও আমিই তোকে ঠিক বুঝতে পারিনা। ভগবান কি পৃথিবীর সমস্ত রঙ দিয়ে গড়েছেন তোকে?’
ট্রেসি হেঁটে চলেছে তার কর্মক্ষেত্রের দিকে দ্রুত পায়ে। পথচলতি মানুষ তার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার না হেসে পারে না। এই রকম খুশিতে উজ্বল সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে কে না একবার হাসিমুখে সুপ্রভাত না বলে থাকতে পারে? অতি বড় হৃদয়হীনেরও তার দিকে তাকিয়ে না হাসার সাহস আসে না বোধহয়। ট্রেসিও সহাস্যে সুপ্রভাত জানাতে ভোলে না প্রত্যুত্তরে।
‘প্রত্যেক মানুষেরই জীবনে কিছু না কিছু ঘটনা ঘটে তাকে খুশির শীর্ষে পৌছে দেবার জন্য...’ চলতে চলতে ভাবে ট্রেসি। ‘আর কয়একদিনের মধ্যেই আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করতে চলেছি... তারপর কিছুদিন পর সেই মানুষটার সন্তানের মা হব আমি... পৃথিবীতে এর থেকে খুশির আর কি থাকতে পারে কারুর জীবনে?’
প্রায় পৌছে গেছে সে ব্যাঙ্কের কাছাকাছি। কবজি উল্টে হাত ঘড়িতে সময় দেখে... আটটা বেজে কুড়ি। ব্যাঙ্কের দরজা কর্মচারীদের জন্য খুলতে এখনও মিনিট দশেক বাকি। কিন্তু ক্ল্যারেন্স ডেসমন্ড, ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন চার্জ এতক্ষনে বাইরের অ্যালার্ম বন্ধ করে দিয়ে দরজা খোলার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ট্রেসির বেশ লাগে এই প্রতিদিনকার পদ্ধতি দেখতে। রাস্তার একপাশে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল ডেসমন্ড ব্যাঙ্কে ঢুকে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলেন। পৃথিবীর সমস্ত ব্যাঙ্কেরই নিজস্য একটা রহস্যময়তা থাকে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা পদ্ধতিতে। এই ব্যাঙ্কও তার থেকে কিছু মাত্রায় বেতিক্রমী নয়। এই প্রতিদিনকার কার্যপ্রনালীতে কোন ছেদ নেই শুধু সিকিউরিটি সিগন্যাল ছাড়া, যেটা প্রতি সপ্তাহে একবার করে পরবর্তন করা হয়ে থাকে। ব্যাঙ্কের প্রবেশপথের প্রথম জানলার ভারী পর্দাটা সামান্য নামানো। এটাও একধরনের সিগন্যাল, কর্মচারীদের কাছে। এই ভাবে অর্ধেক নামানো পর্দা মানে এই মুহুর্তে ব্যাঙ্কের মধ্যে কোন অনুপ্রবেশকারী ঢুকে আছে কিনা, তার খোজ চলছে। ক্ল্যারেন্স ডেসমন্ড ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা ব্যাঙ্কে ঢোকার আগে নিজে সমস্ত বাথরুম, স্টোররুম, ভল্ট আর সেফ-ডিপোজিট রুম ভালো করে খুঁজে দেখছেন, যদি কেউ কোথাও লুকিয়ে থাকে। বলা তো যায় না। সাবধানের কোন মার নেই। তবে এটা আজ নয়, প্রতিদিনকার ঘটনা। এই একভাবে প্রতিদিন সকালে কর্মচারীরা ব্যাঙ্কে ঢোকার আগে ঠিক এই ভাবেই একবার চিরুনি তল্লাসি চলে। তারপর ডেসমন্ড যখন নিজে সম্পর্ণরূপে সন্তুষ্ট হন, তখনই তিনি জানলার পর্দাটাকে পুরোপুরি সরিয়ে খুলে দেন। মানে ভেতরে সব কিছু ঠিকঠাক রয়েছে। কোথাও কোন অসঙ্গতি পাওয়া যায় নি।
এরপর ব্যাঙ্কের অন্যান্য সমস্ত কর্মচারীদের মধ্যে প্রথম ঢোকেন ব্যাঙ্কের সিনিয়র হিসাবরক্ষক। তাঁর বসার জায়গা ইমার্জেন্সি অ্যালার্মের পাশেই। প্রত্যেক কর্মচারী ব্যাঙ্কে প্রবেশ করার পর আবার সদর দরজাটা বন্ধ হয়ে লক হয়ে যায়।
ট্রেসি যখন ব্যাঙ্কে ঢুকল অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে, তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় আটটা তিরিশ। সুসজ্জিত হলঘরে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারের কাছে গিয়ে গা থেকে বর্ষাতি, টুপি খুলতে খুলতে আশ্চর্য হয়ে সে শুনতে লাগল এই বৃষ্টির প্রতি অন্যান্যদের বিরক্তিভরা উক্তিগুলো...
‘উফফফ, জঘন্য ওয়েদার। আমার তো ছাতাটাই হাওয়ার তোড়ে উড়ে গিয়ে একেবারে ভিজিয়ে দিল আমাকে...’, বলে উঠল এক সহকর্মী।
পাশ থেকে হেড ক্যাশিয়র মজা করে বলে উঠল, ‘আরে আমি আবার মার্কেট স্ট্রিটে দুটো হাঁসকে সাঁতরাতে দেখেছি আজ অফিস আসার সময়।’
ওপাশ থেকে আর একজন তাড়াতাড়ি খবর দিল, ‘রেডিওতে বলছিল, এই রকম ওয়েদার নাকি আগামী পুরো সপ্তাহটাই যাবে। এহঃ, এখন যদি ফ্লোরিডায় থাকতাম, কি দারুন হত বলোতো!’
ট্রেসি ওদের কথা শুনে মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিল। সে এই ব্যাঙ্কের কেবল-ট্রান্সফার বিভাগের ইন চার্জ। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত টাকা ট্রান্সফার করা একটা বিশাল কষ্টসাধ্য কাজ ছিল। সেটা একটা ব্যাঙ্ক থেকে আর একটা ব্যাঙ্কে হোক বা একটা দেশ থেকে আর একটা দেশে। পুরো ব্যাপারটা করতে, হাজার একটা ফর্ম ভরো, সেটা তারপর পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে পাঠাও আর ওদের খেয়াল মর্জির ওপর অপেক্ষা করে বসে থাকো। কিন্তু সম্প্রতি কম্পুউটার আসার পর থেকে সব কাজটাই অনেক ত্বরান্নিত হয়ে উঠেছে। মূহুর্তের মধ্যে বিশাল বিশাল অঙ্কের টাকা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। আর ট্রেসির কাজই সেটা। প্রতিদিন কত লক্ষ্য লক্ষ্য ডলার যে এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য আকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয় ট্রেসির হাত দিয়ে বলার নয়। এই প্রতিটা ট্রান্সফারেই কিছু সংকেতলিপি রয়েছে। আর সেটা প্রতিদিন বদলে দেওয়া হয় অননুমোদিত অবৈধ প্রবেশ রুখতে। বেশ লাগে কিন্তু ট্রেসির এই কাজ করতে। তার মনে হয় যেন সারা বিশ্বের ধমনীতে বয়ে চলা ডলারের স্রোত তারই হাতের ছোয়ায় একদিক থেকে আর একদিকে দৌড়ে যাচ্ছে। বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করত সে এই কিছুদিন আগে অবধিও, চার্লস স্ট্যানহোপ দ্য থার্ড তার জীবনে আসার আগে পর্যন্ত। এখন তো তার জীবনের রোমাঞ্চ শুধুই চার্লস... তাকে ঘিরেই। কানে এল সহকর্মীদের কথপোকথন...
‘এই জানিস, গতকাল প্রায় কয়এক মিলিয়ন ডলার তুরস্ককে লোন দেওয়া হয়েছে আমাদের ব্যাঙ্ক থেকে...’ ডেবোরা, ব্যাঙ্কের সিনিয়র বুককিপার বলে উঠল।
সেটা শুনে মায়ে ট্রেনটন, ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারী, বেশ বিজ্ঞের সাথে মন্তব্য করল, ‘আজ সকালেই বোর্ড মিটিংএ ঠিক হয়েছে পেরুকে কিছু অর্ধ সুবিধা দেওয়া হবে। তা এই ধরো প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলার হবে...’
ওপাশ থেকে জন ক্রাইটনের মন্তব্য, ‘শুধু পেরু কেন? মেক্সিকোকেও তো প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন দেওয়া হবে বলে শুনেছি। এদের তো এক কানাকড়িও পাওয়া উচিত নয়...’
সত্যি, কি অদ্ভুত না? - ভাবল ট্রেসি - যে সমস্ত দেশ এই অ্যামেরিকাকে গালি দেয় যে অ্যামেরিকা নাকি সব থেকে বেশি অর্থ-ভিত্তিক দেশ, এই বলে, আর তারাই সবার থেকে আগে অ্যামেরিকার কাছে হাত পাতে লোনের আশায়...’
মনে পড়ে এই ব্যাপারটা নিয়েই তার আর চার্লসের মধ্যে প্রথম বাক্য-বিতন্ডাটা বেঁধেছিল।
******
পরিচ্ছদ ২
ফিলাডেলফিয়া
শুক্রবার, ২১শে ফেব্রুয়ারি, সকাল ৮টা
মার্কেট স্ট্রিটের বৃষ্টিস্নাত পথে রোজকার মত ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে সেই ভোর থেকেই। অদ্ভুত এই মার্কেট স্ট্রিট, ধোপদুরস্ত উর্দি পরিহিত শোফার বিলাসবহুল লিমুজিন গাড়ি চালিয়ে চলেছে বস্তি পরিবৃত পথ দিয়ে। একদিকে সুউচ্চ অট্টালিকা আর তার পাশেই বস্তির ছোট ছোট নোংরা ঘরগুলো পাশাপাশি গুঁতোগুঁতি করে জায়গা ভাগ করে নিয়েছে, ঘরের পাশেই জড় করে রাখা আবর্জনার স্তুপ। অবস্য ট্রেসি হুইটনির কোনদিকেই এইমুহুর্তে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। দ্রুত পদক্ষেপে সে হেঁটে চলেছে তার কর্মক্ষেত্র... চেস্টনাট স্ট্রিটের পূর্ব প্রান্তে, ফিলাডেলফিয়া ট্রাস্ট এন্ড ফিডেলিটি ব্যাঙ্কের দিকে। আজ তার পরনে একটা উজ্বল বর্ষাতি, পায়ে উঁচু বুটজোড়ে। মাথায়ও হলুদ রঙের একটা টুপি পড়ে নিয়েছে যাতে তার ঘন প্রাণবন্ত বাদামী চুলগুল না বৃষ্টির জলে ভিজে যায়, সেই ভয়ে। ট্রেসি হুইটনি... যেন প্রাণের প্রতীক... মধ্য কুড়ির অসম্ভব সুন্দরী বুদ্ধিদীপ্ত যুবতী। একঝলক তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যখন সেই উচ্ছল সৌন্দর্যের সাথে বুদ্ধিমত্তা মিশে থাকে, সেই মুখকে অঘ্রাহ্য করা একটা দূরহ ব্যাপার হয়ে ওঠে যে দেখে তার পক্ষে। সুন্দরী, ট্রেসির সৌন্দর্য শুধু একটা বৈশিষ্টেই আবদ্ধ নেই... পানপাতার মত মুখবায়ব, সরু পাতলা ওষ্ঠদ্বয়, গভীর বুদ্ধিদীপ্ত পান্নার মত সবুজ চোখের মনি আর সেই সাথে ছিপছিপে মেদহীন দেহবল্লরী। গায়ের শুভ্র চামড়ার রঙ গমের মত, আবার সেই রঙই কখনও কখনও রূপান্তরিত হয়ে যায় ষদচ্ছ সাদায় আর তা নয়তো গভীর গোলাপিতে। অদ্ভুত ভাবে তার চামড়ার রঙ বদলায় ট্রেসির মেজাজের ওপর, তার রাগ, অভিমান, ক্রোধ, উত্তেজনা, হতাশা সাথে সাথে। তার মা একবার বলেছিল, ‘সত্যি ট্রেসি, কখনও সখনও আমিই তোকে ঠিক বুঝতে পারিনা। ভগবান কি পৃথিবীর সমস্ত রঙ দিয়ে গড়েছেন তোকে?’
ট্রেসি হেঁটে চলেছে তার কর্মক্ষেত্রের দিকে দ্রুত পায়ে। পথচলতি মানুষ তার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার না হেসে পারে না। এই রকম খুশিতে উজ্বল সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে কে না একবার হাসিমুখে সুপ্রভাত না বলে থাকতে পারে? অতি বড় হৃদয়হীনেরও তার দিকে তাকিয়ে না হাসার সাহস আসে না বোধহয়। ট্রেসিও সহাস্যে সুপ্রভাত জানাতে ভোলে না প্রত্যুত্তরে।
‘প্রত্যেক মানুষেরই জীবনে কিছু না কিছু ঘটনা ঘটে তাকে খুশির শীর্ষে পৌছে দেবার জন্য...’ চলতে চলতে ভাবে ট্রেসি। ‘আর কয়একদিনের মধ্যেই আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করতে চলেছি... তারপর কিছুদিন পর সেই মানুষটার সন্তানের মা হব আমি... পৃথিবীতে এর থেকে খুশির আর কি থাকতে পারে কারুর জীবনে?’
প্রায় পৌছে গেছে সে ব্যাঙ্কের কাছাকাছি। কবজি উল্টে হাত ঘড়িতে সময় দেখে... আটটা বেজে কুড়ি। ব্যাঙ্কের দরজা কর্মচারীদের জন্য খুলতে এখনও মিনিট দশেক বাকি। কিন্তু ক্ল্যারেন্স ডেসমন্ড, ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন চার্জ এতক্ষনে বাইরের অ্যালার্ম বন্ধ করে দিয়ে দরজা খোলার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ট্রেসির বেশ লাগে এই প্রতিদিনকার পদ্ধতি দেখতে। রাস্তার একপাশে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল ডেসমন্ড ব্যাঙ্কে ঢুকে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলেন। পৃথিবীর সমস্ত ব্যাঙ্কেরই নিজস্য একটা রহস্যময়তা থাকে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা পদ্ধতিতে। এই ব্যাঙ্কও তার থেকে কিছু মাত্রায় বেতিক্রমী নয়। এই প্রতিদিনকার কার্যপ্রনালীতে কোন ছেদ নেই শুধু সিকিউরিটি সিগন্যাল ছাড়া, যেটা প্রতি সপ্তাহে একবার করে পরবর্তন করা হয়ে থাকে। ব্যাঙ্কের প্রবেশপথের প্রথম জানলার ভারী পর্দাটা সামান্য নামানো। এটাও একধরনের সিগন্যাল, কর্মচারীদের কাছে। এই ভাবে অর্ধেক নামানো পর্দা মানে এই মুহুর্তে ব্যাঙ্কের মধ্যে কোন অনুপ্রবেশকারী ঢুকে আছে কিনা, তার খোজ চলছে। ক্ল্যারেন্স ডেসমন্ড ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা ব্যাঙ্কে ঢোকার আগে নিজে সমস্ত বাথরুম, স্টোররুম, ভল্ট আর সেফ-ডিপোজিট রুম ভালো করে খুঁজে দেখছেন, যদি কেউ কোথাও লুকিয়ে থাকে। বলা তো যায় না। সাবধানের কোন মার নেই। তবে এটা আজ নয়, প্রতিদিনকার ঘটনা। এই একভাবে প্রতিদিন সকালে কর্মচারীরা ব্যাঙ্কে ঢোকার আগে ঠিক এই ভাবেই একবার চিরুনি তল্লাসি চলে। তারপর ডেসমন্ড যখন নিজে সম্পর্ণরূপে সন্তুষ্ট হন, তখনই তিনি জানলার পর্দাটাকে পুরোপুরি সরিয়ে খুলে দেন। মানে ভেতরে সব কিছু ঠিকঠাক রয়েছে। কোথাও কোন অসঙ্গতি পাওয়া যায় নি।
এরপর ব্যাঙ্কের অন্যান্য সমস্ত কর্মচারীদের মধ্যে প্রথম ঢোকেন ব্যাঙ্কের সিনিয়র হিসাবরক্ষক। তাঁর বসার জায়গা ইমার্জেন্সি অ্যালার্মের পাশেই। প্রত্যেক কর্মচারী ব্যাঙ্কে প্রবেশ করার পর আবার সদর দরজাটা বন্ধ হয়ে লক হয়ে যায়।
ট্রেসি যখন ব্যাঙ্কে ঢুকল অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে, তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় আটটা তিরিশ। সুসজ্জিত হলঘরে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারের কাছে গিয়ে গা থেকে বর্ষাতি, টুপি খুলতে খুলতে আশ্চর্য হয়ে সে শুনতে লাগল এই বৃষ্টির প্রতি অন্যান্যদের বিরক্তিভরা উক্তিগুলো...
‘উফফফ, জঘন্য ওয়েদার। আমার তো ছাতাটাই হাওয়ার তোড়ে উড়ে গিয়ে একেবারে ভিজিয়ে দিল আমাকে...’, বলে উঠল এক সহকর্মী।
পাশ থেকে হেড ক্যাশিয়র মজা করে বলে উঠল, ‘আরে আমি আবার মার্কেট স্ট্রিটে দুটো হাঁসকে সাঁতরাতে দেখেছি আজ অফিস আসার সময়।’
ওপাশ থেকে আর একজন তাড়াতাড়ি খবর দিল, ‘রেডিওতে বলছিল, এই রকম ওয়েদার নাকি আগামী পুরো সপ্তাহটাই যাবে। এহঃ, এখন যদি ফ্লোরিডায় থাকতাম, কি দারুন হত বলোতো!’
ট্রেসি ওদের কথা শুনে মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিল। সে এই ব্যাঙ্কের কেবল-ট্রান্সফার বিভাগের ইন চার্জ। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত টাকা ট্রান্সফার করা একটা বিশাল কষ্টসাধ্য কাজ ছিল। সেটা একটা ব্যাঙ্ক থেকে আর একটা ব্যাঙ্কে হোক বা একটা দেশ থেকে আর একটা দেশে। পুরো ব্যাপারটা করতে, হাজার একটা ফর্ম ভরো, সেটা তারপর পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে পাঠাও আর ওদের খেয়াল মর্জির ওপর অপেক্ষা করে বসে থাকো। কিন্তু সম্প্রতি কম্পুউটার আসার পর থেকে সব কাজটাই অনেক ত্বরান্নিত হয়ে উঠেছে। মূহুর্তের মধ্যে বিশাল বিশাল অঙ্কের টাকা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। আর ট্রেসির কাজই সেটা। প্রতিদিন কত লক্ষ্য লক্ষ্য ডলার যে এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য আকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয় ট্রেসির হাত দিয়ে বলার নয়। এই প্রতিটা ট্রান্সফারেই কিছু সংকেতলিপি রয়েছে। আর সেটা প্রতিদিন বদলে দেওয়া হয় অননুমোদিত অবৈধ প্রবেশ রুখতে। বেশ লাগে কিন্তু ট্রেসির এই কাজ করতে। তার মনে হয় যেন সারা বিশ্বের ধমনীতে বয়ে চলা ডলারের স্রোত তারই হাতের ছোয়ায় একদিক থেকে আর একদিকে দৌড়ে যাচ্ছে। বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করত সে এই কিছুদিন আগে অবধিও, চার্লস স্ট্যানহোপ দ্য থার্ড তার জীবনে আসার আগে পর্যন্ত। এখন তো তার জীবনের রোমাঞ্চ শুধুই চার্লস... তাকে ঘিরেই। কানে এল সহকর্মীদের কথপোকথন...
‘এই জানিস, গতকাল প্রায় কয়এক মিলিয়ন ডলার তুরস্ককে লোন দেওয়া হয়েছে আমাদের ব্যাঙ্ক থেকে...’ ডেবোরা, ব্যাঙ্কের সিনিয়র বুককিপার বলে উঠল।
সেটা শুনে মায়ে ট্রেনটন, ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারী, বেশ বিজ্ঞের সাথে মন্তব্য করল, ‘আজ সকালেই বোর্ড মিটিংএ ঠিক হয়েছে পেরুকে কিছু অর্ধ সুবিধা দেওয়া হবে। তা এই ধরো প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলার হবে...’
ওপাশ থেকে জন ক্রাইটনের মন্তব্য, ‘শুধু পেরু কেন? মেক্সিকোকেও তো প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন দেওয়া হবে বলে শুনেছি। এদের তো এক কানাকড়িও পাওয়া উচিত নয়...’
সত্যি, কি অদ্ভুত না? - ভাবল ট্রেসি - যে সমস্ত দেশ এই অ্যামেরিকাকে গালি দেয় যে অ্যামেরিকা নাকি সব থেকে বেশি অর্থ-ভিত্তিক দেশ, এই বলে, আর তারাই সবার থেকে আগে অ্যামেরিকার কাছে হাত পাতে লোনের আশায়...’
মনে পড়ে এই ব্যাপারটা নিয়েই তার আর চার্লসের মধ্যে প্রথম বাক্য-বিতন্ডাটা বেঁধেছিল।
******