22-07-2021, 05:14 PM
জংলি নদী
১.
২২.০৭.২০২১
১.
হঠাৎ করেই সংসারের পিছুটান থেকে মুক্ত হয়ে গেলাম।
আমার কাছের মানুষগুলো একদিন এক মেঘলা সকালে, গড়িয়ে পড়ে গেল তিরিশ ফুট গভীর খাদে, খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে; বাস অ্যাক্সিডেন্টে।
শুধু আমিই বেঁচে গেলাম ভাগ্যের জোরে।
তারপর আমার আর আপন বলতে কেউ কোথাও রইল না।
আমি বিবাগি হয়ে গেলাম।
ঘর ছেড়ে দিলাম, শহর ছেড়ে দিলাম, রোজগারের থেকেও মুখ ফিরিয়ে, অকালে সন্ন্যাসী হয়ে, পথে-পথে বেড়িয়ে পড়লাম।
তারপর একদিন উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে-ঘুরতে, চলে এলাম এই জঙ্গলের কিনারায়, এই সরু, নাম না জানা নদীটার কোলে।
২.
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া তিরতরে, পাতলা একটা নদী। গ্রীষ্মে থাকে ক্ষীণতনু, বর্ষায় হয়ে ওঠে বেগবতী।
এ নদীতে আশপাশের কেউ মাছ ধরতে আসে না, সালতি বাইতেও আসে না কখনও। আশপাশের গ্রাম থেকে সবাই যায় সড়ক পেড়িয়ে ওপারে, বড়ো নদীর কাছে।
দুঃখী নদীটা, আমার মতোই, চুপচাপ, একা-একা বয়ে যায় সারাদিন।
এখানে পাখির ডাক ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই। আমি তাই সারাদিন এই নাম না জানা ছোট্ট জংলি নদীটার কূলে এসে, চুপচাপ বসে থাকি।
মানুষের সংস্পর্শ আমার আর ভালো লাগে না।
নদীর সংস্পর্শে আমি যেন মনে-মনে কোন সুদূরে ভেসে যাই…
৩.
প্রতিদিনের মতো আজও বসেছিলাম। নদীর পাশে, গাছের নীচে, একটা চ্যাটালো পাথরের উপর, চুপ করে।
জংলি দুপুর তার নিঝ্ঝুম নীরবতার নেশা, ক্রমশ চাড়িয়ে দিচ্ছিল আমার অনুভূতিতে।
হঠাৎ একটা পরিত্রাহি চিৎকারে আমার ঘোর কেটে গেল।
একটা মেয়ের গলা; ডোকার ছেড়ে কাঁদছে।
সঙ্গে-সঙ্গে দৌড় লাগালাম। কয়েকটা ঝোপঝাড় টপকে গিয়ে দেখি, গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা আপাত ভাবে পরিষ্কার যায়গায়, লুটিয়ে পড়ে রয়েছে মেয়েটি।
কোমড়ের নীচ থেকে ভেসে যাচ্ছে রক্তে। আমার আমার পায়ের শব্দ পেয়ে, বুড়ো ভাল্লুকটা পালিয়ে গিয়েছে আরও গভীরতর জঙ্গলে।
৪.
ওকে কোলে তুলে, আমার ঝোপড়াতে নিয়ে এলাম। ওর হাঁটবার মতো ক্ষমতা ছিল না।
ভাল্লুকটা বুড়ো। তাই নোখের আঁচড়ে একেবারে পায়ের মাংস খাবলে, ছাড়িয়ে নিতে পারেনি।
তবে আঁচড়ের দাগ বেশ গভীর। আমি তাই ওর পরণের কাপড়টাকে আস্তে করে থাই অবধি তুলে দিলাম।
৫.
ওকে আমি চিনি। ওর নাম লোরি। বেশি বয়স নয়; কুড়ির ঘরেই।
স্বামীর ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। ওর স্বামী ওকে দু'বেলা পিটত।
এখন বন থেকে কাঠ কুড়িয়ে, ওর কোনও মতে চলে যায়।
আমি ওর পরণের কাপড়টা তুলতেই, ও কেমন যেন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল।
আমি আলতো করে, তুলোয় ডেটল ঢেলে, ওর ক্ষতর উপর বোলাতে লাগলাম।
ওষুধের ঝাঁঝে, ও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে, যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগল।
৬.
লোরি কালো। যেন এই জঙ্গলের রুক্ষতায় পুড়ে যাওয়া, চকচকে একটা কষ্ঠীপাথরের প্রাচীনা দেবী মুর্তি!
ও যখন প্রতিদিন নদীর পাশ দিয়ে চলে যেত গভীর জঙ্গলের দিকে, তখন ওর গা থেকে একটা বনজ খুশবু, আমার নাকে এসে ঝাপটা মারত।
আজ ও কখন আমাকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল, খেয়াল করিনি।
এখন ওর কালো, চকচকে, নির্লোম পা-টা আমার কোলের উপর শায়িত।
ওর বড়ো-বড়ো ডাগর চোখ দুটো কৃতজ্ঞতা ও কৌতুহলে টুপটুপে হয়ে, নীরবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার মুখের উপর।
আমি বললাম: "জখম এমন কিছু নয়, আস্তে-আস্তে ঘা শুকিয়ে যাবে। তবে পারলে একটা টেডভ্যাক ইঞ্জেকশন নিয়ে নিস। অথবা একটা রেবিসের টিকা।"
ও বড়ো-বড়ো চোখ মেলে শুধু তাকিয়েই রইল আমার দিকে। মুখে কিছু বলল না।
৭.
আমি তখন আবার বললাম: "কী রে, টাকা আছে তোর কাছে? নাকি আমি কিছু দিয়ে দেব?"
ও হঠাৎ ওর পায়ের পাতাটাকে একেবারে আমার বুকের লোমের সঙ্গে মিশিয়ে, আলতো করে ঘষে দিয়ে বলে উঠল: "তুই ইখানে ইকা-ইকা, লদীর পাড়ে বসে, কী এতো ভাবনা-চিন্তা করিস রে, বাবু?"
আমি হঠাতে এ প্রশ্নের কী উত্তর দেব, ভেবে পেলাম না। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম: "আমার কী মনে হয় জানিস, একদিন তোদের ওই ছোট্ট নদীটা দিয়ে নৌকো বেয়ে, আমি বোধ হয় কোনও অজানার দেশে পাড়ি জমাব…"
আমার কথা শুনে, লোরি ওর বড়ো-বড়ো, আর টানা-টানা চোখ দুটো মেলে, আরও বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর হঠাৎ নিজের পরণের অন্তর্বাসহীন কাপড়টাকে, এক টানে কোমড়ের আরও উপর পর্যন্ত টেনে তুলে ধরে বলল: "ভেসে পড় না কেনে, বাবু! আজই তোর লৌকোটাকে ভাসিয়ে দে না রে! ভরা লদীরও যে, একখান শক্তপোক্ত লৌকো ছাড়া, দিন কিচ্ছুতে কাটতেই চায় না, বটেক!"
এরপর আমি আর স্থির হয়ে থাকতে পারলাম না।
সেই আদিম জঙ্গলের ছোট্ট, তিরতিরে, কালো জলের নদীটাতে ভেসে পড়লাম, নিজের বাউন্ডুলে নৌকোটাকে, অনেকদিন পর বিনা বাঁধায় ভাসিয়ে দিয়ে।…