15-07-2021, 07:23 AM
(This post was last modified: 15-07-2021, 09:41 AM by Bichitro. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
Update 2
সুধাংশু বাবু স্বর্গীয় দেবাশীষ বাবুর সমবয়সী । পুরো নাম সুধাংশু মৈত্র । যৌবনে লোহা এদিক ওদিক করে বেশ টাকা করেছিলেন। পরবর্তী কালে সেই টাকা দিয়েই ঘর বাড়ি বানানোর রডের কোম্পানি খুলেছিলেন। সেই কোম্পানি এখন অবশ্য পুরোপুরি এক মারোয়াড়ী ভদ্রলোকের অধীনে। আর এরজন্য দায়ী সুধাংশু বাবুর ছোট ছেলে স্নেহাংশু বাবু।
সুধাংশু বাবু সেই রড রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেবাশীষ বাবুর Import & Export কোম্পানির সাহায্য নেন । সেখান থেকেই তাদের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব টাকে সম্পর্কে বাঁধতে বিশেষ দেরি করেন নি দেবাশীষ বাবু। ছেলের বয়স আঠাশ কি উনত্রিশ হতেই সুধাংশু বাবুর একমাত্র মেয়ের সাথে তিনি বিয়ের কথা বলেছিলেন । বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে সুধাংশু বাবু খুব খুশি হয়েছিলেন ।
অফিসে সেদিন যখন পিওন এসে বললো বড়ো বাবু ডাকছেন তখন শুভাশীষ বাবু ভেবেছিলেন অফিসের কোন কাজে হয়তো ডেকেছে । তাই তিনি রোজকার মতোই তার বাবা দেবাশীষ বাবুর অফিসের কেবিনের দরজা ঢেলে জিজ্ঞেস করেছিলেন “ আমায় ডেকেছো বাবা ? „
“ হ্যাঁ ডেকেছি। বসো । „ বলে টেবিলের অপর প্রান্তের আরামদায়ক esey চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন দেবাশীষ বাবু ।
শুভাশীষ বাবু চেয়ারটাতে বসলে দেবাশীষ বাবু বলেছিলেন “ তোমার বিয়ে ঠিক করেছি । পাত্রী আমার পছন্দ হয়েছে । পাত্রী একবার তোমাকে দেখতে চেয়েছে। পরশু দিন যেতে হবে । তুমি এখন আসতে পারো । „ আদেশের সুরেই শেষ কথাটা বলেছিলেন আকাশের দাদু।
বাবার কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন শুভাশীষ বাবু। এত বড়ো সিদ্ধান্ত তিনি ছেলেকে না জিজ্ঞেস করেই নিয়ে নিলেন ? তাও আবার বিয়ের মতো একটা বড়ো সিদ্ধান্ত। ছোটবেলা থেকেই শুভাশীষ বাবুর জীবনের সব সিদ্ধান্ত দেবাশীষ বাবুই নিতেন। তাই শুভাশীষ বাবুর শুধু একটা “ হ্যাঁ „ বলে বেরিয়ে আসা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
বাবার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলা কিংবা বাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস শুভাশীষ বাবুর কোন কালেই ছিল না। তাই তিনি পরের দুই দিন জিজ্ঞাসা করতে পারেন নি যে --- মেয়ের নাম কি ? মেয়ের বাবার নাম কি ? মেয়ে কতদূর পড়াশোনা করেছে ? মেয়ে দেখতে কেমন ? এমনকি লজ্জার জন্য মা সুনীতা দেবী কেও জিজ্ঞাসা করতে পারেননি কিছুই।
শুভাশীষ বাবু দুই দিন পর যখন সপরিবারে পাত্রী দেখতে বেরিয়েছিলেন তখনও জানতেন না পাত্রীর নাম কি ? যখন পাত্রীর বাড়ি পৌছে বাড়িতে ঢুকেছিলেন তখন তিনি দেখলেন সুধাংশু আঙ্কেল তাদের অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে বসালেন। সুধাংশু আঙ্কেল কে দেখেই তিনি চিনতে পেরেছিলেন। তাদেরই কোম্পানির এক ক্লায়েন্ট । এই সুধাংশু আঙ্কেল এর সাথে কাজের জন্য অনেকবার দেখা হয়েছে কিন্তু তার বাড়িতে কখনো আসা হয়নি। কিছুক্ষণ পর যখন মাঝারি উচ্চতার সুন্দরী স্নেহা দেবী চা বিস্কুট পকোড়ার ট্রে নিয়ে এসেছিলেন তখন স্নেহা দেবীকে পছন্দ করে ফেলেছিলেন শুভাশীষ বাবু। বলা বাহুল্য স্নেহা দেবীও শুভাশীষ বাবুকে প্রথম দেখায় পছন্দ করেছিলেন ।
সুধাংশু আঙ্কেল কে কাজের জন্য শুভাশীষ বাবু আগে দেখেছেন কথা বলেছিলেন। তখন থেকেই সুধাংশু আঙ্কেল কে সম্ভ্রম করতেন শুভাশীষ বাবু। কারন সুধাংশু আঙ্কেল আর তার নিজের বাবার চরিত্রের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য পাননি শুভাশীষ বাবু। তাই সুধাংশু আঙ্কেল কে বাবার মতোই সমঝে চলতেন শুভাশীষ বাবু।
তাই যখন আকাশের অন্নপ্রাশনের পরের দিনেই আকাশের দাদু বাড়ি চলে যেতে চাইলেন তখন আকাশের বাবার তেমন বাঁধা দেওয়ার কিংবা আরো কিছু দিন থেকে যাওয়ার কথা ছাড়া বেশি জোড়া জুড়ি করতে পারেন নি শুভাশীষ বাবু ।
জামাইয়ের অনুরোধে আকাশের দাদু বলেছিলেন “ না শুভ, ওদিকে অনেক কাজ আছে। বেশিদিন এখানে থাকা যাবে না। „
----------
প্রতি বছরেই সোসাইটির নিজস্ব দূর্গা পুজা হয়। খুব ধুমধাম করে আয়োজন করে কমিটি মেম্বাররা। সোসাইটির ভিতরে একটা কমিউনিটি হল আছে। সেখানেই অষ্টমীর দিন একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে নাচ , অঙ্কন আর আবৃত্তির প্রতিযোগিতা হয় ।
প্রতি বছরের ন্যায় এবছরেও পূজা হলো। মা এলো। পুরো সোসাইটি বিভিন্ন রঙের আলোয় রানির মতো সাজলো । ধুমধাম করে পঞ্চমী ষষ্ঠী সপ্তমীর পূজা হলো। অষ্টমীর দিন বিকালে প্রতিযোগিতা হওয়ার সময় সুচেতা দেবী তার ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে দ্বিতীয় সারির একদম পাশের দিকে একটা চেয়ারে বসলেন কিছু সময় পর স্নেহা দেবীও আকাশকে নিয়ে এসে সুচেতা দেবীর পাশে এসে বসলেন। স্নেহা দেবীর সাথে ছোট্ট লাল রঙের বাদশাও এলো জিভ বার করে লেজ নাড়াতে নাড়াতে ।
“অঙ্কিতার নাচ হয়ে গেছে ? „ চেয়ারে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন স্নেহা দেবী।
“না , এখনও হয়নি । ওটাই তো স্পেশাল , তাই লাস্টের জন্য রেখে দিয়েছে । „ বেশ আগ্রহ নিয়ে বললেন সুচির মা।
অঙ্কিতা হলো এই রাজ্যের সেরা ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্য শিল্পীদের একজন । বয়স মাত্র উনিশ। তাই নামটাও একটু বেশি বড়ো। রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। বেশিরভাগ প্রতিযোগিতায় প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান দখল করতে পারে । থাকে এই সোসাইটিতেই।
পাঁচ ছয় জন সদস্যের নৃত্য প্রদর্শিত হওয়ার পর মাইকে ঘোষনা হলো “ এবার আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়ে নৃত্য পরিবেশন করতে চলেছে আমাদের গর্ব এই রাজ্যের গর্ব অঙ্কিতা। „
তারপরেই মঞ্চে অঙ্কিতা প্রবেশ করলো। মাঝারি উচ্চতার হালকা শ্যাম বর্ণ। মাথার চুল খোপা করা আর টগর ফুলের মালা দেওয়া। কাজল টানা চোখ , আর ঠোঁটে হাল্কা লাল রঙের লিপস্টিক । দুই হাতে একটা করে মোটা বালা। মাথায় টিকলি , কানে দুল , গলায় হার , আর নাকে নথ তো আছেই। লাল পাড় নীল শাড়ি কোমড় থেকে এমন ভাবে নিচে নেমে গেছে যেন ওটা শাড়ি নয় ওটা ধুতি। আর নীল ব্লাউজ। পায়ের পাতায় আলতা মাখা আর মোটা ঘুঙুর পড়া । সবাইকে নমস্কার করে সে নাচ শুরু করলো। অন্যান্য মেয়েরা একটাই নাঁচলো কিন্তু অঙ্কিতা পরপর তিনটে গানে নাঁচলো। অসাধারণ সব মুদ্রা দিয়ে ভরিয়ে তুললো তার নাঁচকে।
প্রথম নাচ
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥
দ্বিতীয় নাচ
মায়বন বিহারিনী হরিণী
গহন স্বপন সঞ্চারিনী
কেন তারে ধরিবারে করি পন
অকারণ
মায়াবন বিহারিনী
তৃতীয় নাচ
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি,
ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি॥
সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারি পিছে গো,
রেখো না আর, বেঁধো না আর কূলের কাছাকাছি॥
নাচ শেষ হতেই সবাই দাঁড়িয়ে হাততালি দিলো মঞ্চ হাততালির আওয়াজে ফেটে পড়লো । সেই নাচ দেখে নয় দশ মাসের আকাশ হাঁসতে হাঁসতে হাততালি দিতে লাগলো । আকাশের হাত তালি দেওয়ার জন্য কি অঙ্কিতা দির নাচ দেখে নিজের ভালো লাগার জন্য সুচি বললো “ মা , আমি নাচ সিকবো । „
“ঠিক আছে । আমি অঙ্কিতার সাথে কথা বলছি । „ বলে সুচির মাথায় একটা চুমু খেলেন। আসলে সুচেতা দেবীর ইচ্ছা ছিল সুমি নাচ শিখুক। কিন্তু সে শিখতে চাই নি। তাই যখন সুচি নাচ শেখার কথা বললো তখন একবারেই রাজি হয়ে গেলেন সুচেতা দেবী।
অঙ্কিতার নাচ শেষ হওয়ার পর সুচেতা দেবী ম্যাকআপ রুমে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন “ তুমি সুচিকে নাচ শেখাবে ? „
সে বললো “ হ্যাঁ শেখাবো কাকিমা । কিন্তু সুচির বয়স পাঁচ বছর হলে । „
তারপর তারা হাঁসি মুখে চলে এলো কারন সুচির বয়স পাঁচ হতে আর এক বছর বাকি। দশমীর দিন মায়ের বিদায় নেওয়ার সাথে সাথে সুচি নাচ শেখার কথা ভুলে গেলেও সুচেতা দেবী ভুললেন না।
তার কয়েক সপ্তাহ পরের কথা । একদিন সকালে সুচি তার পুতুল গুলোর চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছিল। আর আকাশ তার সামনে বালিশের দূর্গের মধ্যে বসে হাঁসতে হাঁসতে হাত পা নাড়ছিল । আর মেঝেতে বাদশা ঘুমাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর সুচি তার পুতুল গুলো রেখে আকাশকে উদ্দেশ্য করে বললো “ একানে চুপতি কলে বসবি , আমি হিসু করে আসছি। „
সুচি গেল হিসু করতে। হিসু করে এসে যখন ঘরে ঢুকলো তখন খাটের উপরের দৃশ্য দেখে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো । কাঁদতে কাঁদতে গাল লাল হয়ে উঠলো সুঁচির । সেই কান্নার আওয়াজ শুনে স্নেহা দেবী দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে যা দেখলেন তা হলো--- আকাশ লাথি মেরে তার সামনের কোল বালিশ সরিয়ে দিয়ে সুচি যে পুতুল টার চুল ঠিক করছিল সেই পুতুল টার চুল ধরে পুতুল টাকে বিছানায় আছাড় মারছে। আর বাদশা ঘেউ ঘেউ করে লেজ নাড়ছে আর লাফাচ্ছে।
আকাশের মা দ্রুত গিয়ে আকাশের হাত থেকে পুতুল টা নিয়ে তার চুল ঠিক করে দিল। তারপর সুচির হাতে দিয়ে দিল। সুচি পুতুল টা নিয়ে বললো “ ও খুব দুষ্তু বদমাস। „ কথাটা বলে স্নেহা দেবীকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই তার সমস্ত পুতুল নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল । স্নেহা দেবী জানতেন সুচি খুব রাগী মেয়ে । অল্পতে রেগে যায় ।
সুচি যখন কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে পৌছালো তখন সুচেতা দেবী ঘর ঝাট দিচ্ছিলেন। সুচিকে কাঁদতে দেখে ঝাড়ু ফেলে এগিয়ে এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “ কাঁদছিস কেন ? কি হয়েছে ? „
“আকাস আমাল পুতুলকে মেলেছে । ও খুব দুষ্তু , বদমাস । „ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নাক টানতে টানতে বললো সুচি
সুচেতা দেবী মেয়েকে চুপ করার জন্য বললো “ ও বাচ্চা ছেলে না বুঝে করেছে । তুই তো বড়ো হয়ে গেছিস। বড়োরা কাঁদে এই ভাবে ? „
এই বড়ো হওয়ার কথা শুনে সুচি কান্না থামিয়ে চুপ করলো। সত্যি ও বড়ো হয়ে গেছে। চার বছর বয়স হয়ে গেছে ওর। আকাশতো এখনও বাচ্চা। এইসব ভাবতে লাগলো সুচি ।
পরের দিন সকালে সুচি সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার তার পুতুল গুলো নিয়ে খেলার জন্য হাজির হলো।
পরের বছর সরস্বতী পূজার সময় রাধানাথ ঠাকুর এসে আকাশের হাতেখড়ি করে দিয়ে গেলেন। তারপর আকাশের প্রথম হামাগুড়ি, প্রথম হাঁটা, প্রথমত মা ডাক , প্রথম জন্মদিন সব মিষ্টি মুহুর্তের মধ্যে দিয়ে কখন আকাশ দুই বছরের হয়ে গেল সেটা স্নেহা দেবী বুঝতেই পারলেন না। আর এইসব মিষ্টি মুহুর্ত ক্যামেরায় ফ্রেম বন্দী করে রেখে দিলেন স্নেহা দেবী। সব ফটো তুললেন সুমি আর স্নেহা দেবী মিলে। বলা বাহুল্য বেশির ভাগ ফটোতেই আকাশ আর ওর মায়ের সাথে আছে সুচির ফটোও।
দুই বছর পর একদিন সকালে স্নেহা দেবী বাপের বাড়ি থেকে ফোনে খবর পেলেন যে সুধাংশু বাবু মারা গেছেন।