10-07-2021, 03:36 PM
(This post was last modified: 18-12-2021, 02:06 PM by Bumba_1. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
থাকিসনে বসে তোরা সুদিন আসবে বলে
লেখা এবং প্রচ্ছদ :- বুম্বা
এ কথা অনস্বীকার্য আমাদের দেশ এখন বেকারত্বের একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যখন নাকি আমরা demographic golden age এর মধ্যে আছি।
এমনিতেই পুরোপুরি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য সাইটে নিজের লেখা দু'টি এরোটিক থ্রেড (যদিও লেখাগুলি যে খুব একটা উচ্চমানের তা নয়) সবদিক থেকে ভীষণরকম সাফল্য পাওয়ার পরেও এইরকম একটি নন-এরোটিক থ্রেড খোলার জন্য অনেকেই আমাকে অর্ধোন্মাদ ভাবেন। তার উপর আমার এইসব কথা শুনে আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন এখন দেখছি মাথাটা পুরোই গেছে বুম্বার। demographic golden age এই ব্যাপারটা আবার কি? .. এটা খায় না মাথায় মাখে?
একটু ধৈর্য ধরুন, বুঝিয়ে বলছি..
সহজ ভাষায় বললে .. ২০১৮ সালের পর থেকে আমাদের দেশে working population অর্থাৎ যে বয়সের মানুষেরা রোজগার করতে সক্ষম (এই যেমন ধরুন ১৮ থেকে ৬০ বছর) তাদের সংখ্যা dependent population অর্থাৎ যারা কর্মক্ষেত্রে অক্ষম (এই যেমন ধরুন ১৮ বছরের কম এবং ৬০ বছরের বেশি) এর থেকে অনেকটাই বেশি হয়ে গিয়েছে।
আপনারা শুনলে অবাক হবেন সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতবর্ষে working population এর সংখ্যা এখন সবথেকে বেশি এবং এই সমীকরণটি আগামী ২৫ থেকে ৩০ বছর বহাল থাকবে।
আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোর কথা ছেড়ে দিচ্ছি। এই রকম পরিস্থিতি যখন জাপান, চীন এবং সাউথ কোরিয়ার মতো দেশগুলিতে হয়েছিল তখন তারা এই demographic dividend এর পুরো ফায়দা তুলে ইন্ডাস্ট্রির পর ইন্ডাস্ট্রি বানিয়ে তাদের দেশে প্রায় ৯৫% কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হয়েছিল। এর ফলেই তাদের দেশ আজ এতো উন্নতি সাধন করেছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সমস্যাটা একদম অন্য জায়গায়। graduate, post graduate MBA, engineer হওয়ার পরেও পিয়ন বা সুইপারের কাজের জন্য cut-throat competition হয় এই দেশে।
চাকরি না পেয়ে যদি যুবসমাজ প্রতিবাদ করে তাহলে তাদের বলা হয় চপ ভাজো .. এতেও যদি তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকে তাহলে তখন অর্ণব দাদা বা সুধীর বাবুর মতো সজ্জন ব্যক্তিরা এসে অবলীলায় বলে দেন এরা হলো urban naxal অথবা tukde tukde gang এর সদস্য .. এইসব কিছুর উপরে international conspiracy এর ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এর সঙ্গে গত দেড় বছর ধরে যুক্ত হয়েছে Covid এর মতো মহামারী .. যার ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়ছে জনসাধারণ। একটি দমবন্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সর্বত্র।
তবে এতো কিছু প্রতিকূলতা ছাড়াও আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ থাকেন যারা কোনোদিন জীবিকা নির্বাহ করার জন্য কোনো কাজ করে উঠতে পারেন না। এমনকি একসময় চাকুরী খোঁজার চেষ্টা বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করার ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলেন।
কাজ না করার অজুহাত হিসেবে "nepotism" এবং "favouritism" এই দুটি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। যতদিন বাবা থাকেন বা বাবার পয়সা থাকে ততদিন সমাজে "ভালো ছেলে" বলে গণ্য হয় আর পয়সা না থাকলে "চিটিংবাজ" বলে চিহ্নিত করা হয় তাকে।
কিন্তু আমার মতে nepotism বা favoritism যাই বলুন না কেনো, এগুলো তো সব জায়গাতেই। আমার মতে সব থেকে বেশি স্বজনপোষণ এবং পক্ষপাতিত্ব কোথায় হয় জানেন? পরিবারের ভেতরে। কলেজে so called "ভালো ছাত্রদের" প্রতি শিক্ষকদের পক্ষপাতিত্ব এবং সাধারণ ছাত্রদের প্রতি অবহেলা এ কথাতো অনস্বীকার্য। এছাড়াও ক্রীড়া, রাজনীতি, শিল্পকলা ... এই সব ক্ষেত্রেই স্বজনপোষণ এবং পক্ষপাতিত্ব আছে আর চিরকাল থাকবেও। যাক সে কথা, আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি, মূল কথায় ফেরা যাক।
একটু আগে যে শ্রেণীর কথা বলছিলাম, আমাদের নিরু'দা হলো একদম সেইরকম, যে জীবনে চাকরীর চেষ্টা করেনি, এমনকি দু'টি ভালো চাকরী পেয়েও সেটাকে ছেড়ে দিয়ে হাতের লক্ষী পা'য়ে ঠেলেছিল।
নিরু'দা মানে নিরুপম চট্টোপাধ্যায়। আমার থেকে অনেকটাই.. প্রায় বছর দশেকের বড় হবে। আমাদের পাড়াতেই থাকতো। ভাবছেন আমি past tense এ কেনো কথা বলছি? বুঝিয়ে বলছি পরে।
নিরু'দা তার বাবা-মা এর অনেক বেশী বয়সের সন্তান .. তাই ছোটবেলা থেকেই আদরটা একটু বেশীই পেয়েছিলো হয়তো। নিরু'দার বাবা পেশায় কলেজশিক্ষক ছিলেন। আমার মেজোমামা আর ছোটমামা দুজনেই উনার ছাত্র ছিলেন। একসময় আমিও উনার কাছে (উনি রিটায়ার করার পর) কিছুদিন প্রাইভেট পড়েছিলাম। সেই সুবাদে ওদের পরিবারকে খুব কাছ থেকে চিনতাম।
নিরু'দা ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনাতে ভালো। অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকোত্তর করেছিল। সব বিষয়েই অসম্ভব জ্ঞান ছিল ওর। নিরু'দার বাবা যখন অবসর নেব নেব করছেন সেই সময় 'টেট পরীক্ষার' এতো রমরমা ছিল না। তখন primary teachers training নিলেই প্রাইমারি কলেজের টিচার হওয়া যেতো আর সঙ্গে থাকতে হতো লাল পার্টির তকমা, যেটা ছিলও নিলু'দার বাবার।
প্রথমদিকে তো এই চাকরী করতে রাজিই হয়েনি নিরু'দা.. বলেছিলো "এতো পড়াশোনা করে শেষে প্রাইমারি টিচার হবো?" পরে ওর বাবার চাপে রাজি হলেও join করার পর একমাস যাওয়ার পরেই ছেড়ে দেয় সেই চাকরি। কারণ হিসেবে দেখায় common room corruption এবং কলেজের প্রধান শিক্ষকের নীরু'দা কে বাদ দিয়ে অন্যান্য শিক্ষক/শিক্ষিকাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব।
এরপর মাস্টারমশাই মানে নিরু'দার বাবা আমার বাবাকে খুব করে ধরেন যদি আমার বাবাদের আপিসে একটা ক্লারিকাল পোষ্টেও ওকে ঢোকানো যায়।
অনেক চেষ্টার পরে বাবা একটা চাকরি করে দিয়েছিলেন ওকে বাবাদেরই অফিসে। কিন্তু সেখানেও কয়েক মাস গিয়ে আর যায়নি নিরু'দা। অজুহাত হিসেবে সেই একই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছিলো .. nepotism & favoritism.
এরপর মাস্টারমশাইও কিরকম যেন হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ছেলে বড় হয়ে গিয়েছে, বেশি তো কিছু বলাও যায় না। ২০০৮ এ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন মাস্টারমশাই। তখন শুধু নিরু'দা আর তার মা। বাবার পেনশনটুকু দিয়েই দিন কাটতো ওদের।
মাঝে ওদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না আমার। ২০১১ সালে বাড়ি (বলা ভালো ফ্ল্যাট) কিনে যে পাড়াতে এলাম, তার কয়েকটা বাড়ির পরেই নিরু'দা দের বাড়ি। আমার জীবনের উপর দিয়েও ততদিনে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে .. ২০১০ সালে বাবাকে হারিয়েছি আমি।
যাইহোক এখানে এসে নিরু'দার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো আমার। আসলে ঠিক বন্ধু নয়, ওকে মনে মনে দাদা হিসেবে শ্রদ্ধা করতাম আমি। ওর সঙ্গে কথা বলার সময় লক্ষ করতাম সব কিছুতেই হতাশা গ্রাস করেছে ওকে। সব কিছুর প্রতি অসম্ভব রকমের অনিহা। নিরু'দার মতে এই দুনিয়াতে যা কিছু ঘটছে সব কিছুই নাকি ফালতু।
ফিল্ম, খেলা, রাজনীতি, চাকুরী .. সবক্ষেত্রেই নাকি গোলমাল আছে, বদল দরকার। সরকারি কর্মীরা, বিশেষ করে যারা প্রথমে অন্য জায়গা থেকে এসে প্রথমে কন্ট্রাকচুয়াল স্টাফ হিসেবে কোনো সরকারি অফিসে ঢুকে, পরে পার্মানেন্ট হয়েছে .. তারা নাকি সাপের পাঁচ পা দেখে আর সবথেকে বেশি সুবিধাবাদী হয়। কথাগুলো যে আমাকে কটাক্ষ করে বলতো সেটা বেশ বুঝতে পারতাম। তার সঙ্গে এটাও বুঝতাম জীবনের ব্যর্থতা থেকেই এগুলো বলছে ও, তাই ক্ষমা করে দিতাম।
২০১৭ সাল নিরু'দার মাতৃবিয়োগ হলো। তার আগের বছর আমিও আমার মা'কে হারিয়েছি (আমার সেই অসহ্য কষ্ট এবং বেদনার দিনগুলির কথা না হয় আরেকদিন বলবো .. কারণ আজকের লেখাটা আমার নিজের কথা বলার জন্য নয়)। মা এক অমূল্য নাম এই পৃথিবীতে, যার কোনো substitute হয় না। কিন্তু একথাও তো সত্যি পৃথিবীতে কেউই চিরকাল থাকার জন্য আসেনি, দুঃখ তো থাকবেই মনে .. কিন্তু সেটা নিয়েই চলতে হবে .. সেটাকে অজুহাত করে থেমে গেলে চলবে না।
নিরু'দা সেটা পারেনি, মা চলে যাওয়ার পর একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। তার একটা করণ অবশই অর্থনৈতিক সমস্যা। পেনশনের টাকাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো, জমানো টাকা তো আগেই শেষ। একটা কথা বলা হয়েনি.. মাস্টারমশাইয়ের বাড়িটা উনার একার বাড়ি ছিলোনা। ওটা শরিকি সম্পত্তি ছিলো।
মাস্টারমশাইয়ের দুই ভাই চাকরীর সুবাদে বাইরে থাকতো, তাদের পরিবারও বাইরে প্রতিষ্ঠিত। যতদিন নিরু'দার মা বেঁচে ছিলেন তারা এখানে আসেনওনি। কিন্তু উনি মারা যাওয়ার পর প্রোমোটারের হাতে দিয়ে দিয়েছিল বাড়িটা। প্রথমদিকে অনেক আপত্তি করেছিল নিরু'দা। কিন্তু যখন ওরা আইনের পথ ধরে তখন নিরু'দা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়, টাকা কোথায় মামলা লড়ার? বাড়ি ভাঙার পরে প্রোমোটার একটা মাথা গোঁজার বন্দবস্ত করে দিয়েছিল নিরু'দা কে, যেটা সব প্রোমোটারই করে থাকে।
কিন্তু এতো আঘাত বোধহয় আর নিতে পারেনি নিরু'দা। পিতৃবিয়োগ, মাতৃবিয়োগ হওয়ার পর শেষে গৃহছাড়া হতে হলো তাকে। শেষের ক'দিন খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল নিরু'দা। কোনো বিষয় নিয়েই আর তর্ক করতো না কারো সঙ্গে। খোকার চা'য়ের দোকানে চুপচাপ বসে থাকতো সারাদিন। যদি কেউ দয়া করে কিছু খেতে দিতো তাহলে খেতে পেতো, না দিলে সারাদিন হয়েতো খাওয়াই জুটত না।
পরশু ফেরার পথে আমাদের ক্লাবের পাশের রাস্তাটা তে নিরু'দার সঙ্গে দেখা, আমার হাতদুটো হঠাৎ চেপে ধরে বললো "ভালো থাকিস ভাই .. হয়তো অনেক ছোট বড় কথা বলেছি সময়-অসময় .. ক্ষমা করে দিস.."
আমি বললাম "আরে ধুর, আমি কিছুই মনে করিনি.. কিন্তু আজ হঠাৎ এইসব বলছো!"
ও বললো "কিছু না .. যাহ্ .."
গতকাল ভোররাতে নিরু'দা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন অন্য এক দুনিয়াতে।
আমাদের সমাজে ঘরে ঘরে এইরকম অনেক নিরুপম আছে। যারা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবে হয়েতো অকালেই ঝরে পরে যাবে .. তাদের সকলের উদ্দেশ্যে "থাকিসনে বসে তোরা সুদিন আসবে বলে।"
ভালো থাকবেন সবাই
বিঃ দ্রঃ অর্ণব দাদা কে? সুধীর বাবু কে? এইরকম প্রশ্ন করে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা আশাকরি আমাকে বিব্রত করবেন না।