09-07-2021, 03:30 PM
আমি শুভেন্দুর দিকে আবার মোবাইল ফোনটা বাড়িয়ে দিলাম। শুভেন্দু ফোনে শিখার সঙ্গে কিছুক্ষণ গুজগুজ করলো। তারপর ফোনটা ছেড়ে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে বিদিশা বলল, ‘কি বললো শিখা? আসছে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ আসছে। বলল গাড়ী নিয়ে এক্ষুনি বেরুচ্ছে। এক ঘন্টা মতন লাগবে এখানে আসতে।’
শুক্লা তখন ভীষন উসখুস করছে আরো কি কথা হয়েছে জানবার জন্য। আমাকে বলল, ‘আর কি বললো শিখা? এই ‘দেব,’ বল না। কি কথা হলো? বল না?’
আমি বললাম, ‘ওই তো, আমার শরীর এখন কেমন, তাই জিজ্ঞাসা করছিল। আর বলছিল, এলে আমাদের কোন অসুবিধে হবে না তো? কনফারমেশনটা নিয়ে নিল।’ আমি তখন ওকে আস্বস্ত করলাম। ও আসতে রাজী হয়ে গেল।’
চোখ দুটো গোল গোল মতন করে অত্যাশ্চর্যের মতন শুক্লা বলে উঠল, ‘ও মা। কি সুন্দর মেয়ে রে? এত দায়িত্ব সচেতন আর কর্তব্যপরায়ণ? শুভেন্দু তো বাজীমাত করে দিয়েছে। আমি ভাবতেই পারছি না।’
একটু গদগদ হয়ে শুভেন্দুও বলে উঠল, ‘ওই জন্য তো বলি। কখনও কাউকে আন্ডারেস্টিমেট করবি না। আর আমাকে তো নয়ই। ভেবেছিলিস, শুভেন্দুর তো বিয়ে থা করার ইচ্ছা নেই। চিরকাল এভাবেই কাটিয়ে দেবে। তাই তোদের এই ভ্রান্ত ধারণাকে আমি নির্মূল করে দিলাম।’ বলে গলা ফাটিয়ে শুভেন্দু যাত্রার নায়কদের মতন হাসতে লাগলো, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
শুক্লা বলল, ‘বা রে? আমরা আবার কি ভাবলাম? তুই ই তো সেই কলেজের সময় থেকে বলে আসছিস, প্রেম, বিয়ে থা তোর পোষায় না। আমরা কি কখনও তোকে না করেছিলাম? না বলেছিলাম, তোর দ্বারা কখনও প্রেম হবে না।’
শুভেন্দু বলল, ‘সেটা অবশ্য ঠিক। তবে কেন জানি না শিখাই আমার তপস্যা ভঙ্গ করলো। এমন একটা মেয়ে, দেবের মত আমার জীবনেও প্রেমকে ফিরিয়ে আনলো। এরজন্য থাউজেন্ড পার্সন্ট ক্রেডিট গোজ্ টু হার। বলতে পারিস এই অসম্ভব কাজটা শিখার জন্যই সম্ভব হয়েছে।’
আমি বললাম, এরজন্য শিখাকে আমিও একটা ধন্যবাদ দেবো। তোকে শেষ পর্যন্ত নাবালক থেকে সাবালক করেছে ও। আরে বাবা, প্রেম বিবাহ এসব না করে কি চিরকাল থাকা যায়? শেষ বয়সে তাহলে তোকে দেখতো কে? আমি তো শত চেষ্টা করেও তোর ধ্যান ভাঙাতে পারিনি। যাক, শেষ পর্যন্ত কেউ না কেউ তো কাজটা করে দেখালো। আমি এ ব্যাপারটাকে দারুন ভাবে অ্যাপ্রিসিয়েট করছি।’
বিদিশা আমার কথাটা মনোযোগ সহকারে শুনছে। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, জানো বিদিশা, মেয়েটার গলাটা কি মিষ্টি। আমি ফোনে প্রথমে ওর গলার আওয়াজ শুনে অবাক হয়ে গেছি। এত মাধুর্য্য গলার মধ্যে। অথচ শুভেন্দু যখন ফোনে আমার সাথে কথা বলে, ওর গলাটা ঠিক যাঁড়ের মতন লাগে।’
বিদিশা হো হো করে হাসতে লাগলো আমার কথা শুনে। সেই সাথে শুক্লাও। শুভেন্দু সেই সময় বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ এটাও শুনে নাও তোমরা বন্ধুরা। শিখা শুধু সুন্দরী আর ভালো মেয়ে নয়। ও ভালো গাইতেও পারে। অসম্ভব দরাজ আর মিষ্টি ওর গানের গলা। আমি যতবার ওর গান শুনেছি, শুধু মুগ্ধ হয়ে গেছি। শিখাকে আমি দেবের গানের ব্যাপারটাও বলেছি। বলেছি, জানো শিখা, আমি বরাবরই দেবের গানের খুব ফ্যান ছিলাম, এখনও তাই। ও যখন গাইতে শুরু করে, তখন আর কেউ কথা বলতে পারে না। সবাই মূগ্ধ হয়ে শুধু ওর গান শোনে। আর আজ তোমার গান শুনে আমার দেবকে বারে বারেই তোমার কথা বলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছে না। একদিন না একদিন হয়তো ঠিক আমি বলবো।’
আক্ষেপের সুরে শুভেন্দুকে বললাম, বললি আর কোথায়? রনি আজ ফাঁস না করে দিলে আমাদের তো এত কিছু আর জানাই হতো না। মেয়েটার স্বভাব ভালো, দেখতেও শুনছি ভালো। আবার ভালো গানও গায়। একেবারে সর্বগুনা সম্পন্ন রমণী। এর থেকে ভালো উপমা আর কি হতে পারে?’শুক্লা বলল, ‘তা যা বলেছিস। তবে এত প্রশংসা করছিস। বিদিশা আবার খারাপ ভাবছে না তো?’
আমাকে সমর্থন করে বিদিশা বলল, ‘খারাপ কেন ভাববো? ও, যার সন্মন্ধে যা বলে, সেটা কখনও ভুল হয় না। শিখা সত্যি ভালো মেয়ে। আমারো তো তাই মনে হচ্ছে।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বিদিশার মুখের দিকে তাকালাম। এবার বিদিশা আক্ষেপের সুরে আমাকে বলল, ‘ইস। তখন যদি আমিও ভালো করে গানটা শিখে নিতাম তোমার কাছ থেকে। তাহলে আমিও সম্পূর্ণা হতে পারতাম।’
স্বান্তনা দিয়ে ওকে বললাম, ‘মন খারাপ করো না। এবার আমি তোমাকে গান শেখাবো। সাতদিনে তোমাকে গান শিখিয়ে দেবো। তুমি দেখে নিও।’
শুভেন্দুও আবদার শুরু করেছে বিদিশার কথা শুনে। আমাকে বলল, এই তুই তোর বউকে গান শেখাবি। তোরা জোড়ায় জোড়ায় গান গাইবি। আর আমাকে শেখাবি না? আমিও তাহলে শিখার সঙ্গে একসাথে গলা মেলাতে পারতাম।’
শুক্লা ফোড়ণ কেটে বলল, ‘হু, সখ কতো একবার দেখেছো ছেলের।’
শুভেন্দু ধমক দিয়ে বলে উঠল, ‘এই তুই চুপ কর। আমার এখন দেবের সাথে ডিল হচ্ছে। তোরা কেউ মাথা গলাতে আসবি না।’
আমি বললাম, ‘কেন শিখাই তো তোকে গান শেখাতে পারে। তুই তোর বউয়ের কাছ থেকে তালিম নে। আর আমি আমার বউকে গান শেখাই।’
শুভেন্দু মাথা চুলকে বলল, ‘কিন্তু শিখা শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতই জানে। আমি একটু অন্যরকম ভাবে শিখতে চাইছিস। তুই যেটা পারবি।’
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা আগে শিখা আসুক। ওর গান আমিও শুনি। তারপর দেখছি তোর সঙ্গে ওকে ম্যাচিং করাতে পারি কিনা? তবে ডুয়েট গাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীতই তোমাকে শিখতে হবে বাপু। আর জেনে রেখো, ক্ল্যাসিকালের মত রবীন্দ্রসঙ্গীতও একটা বেস। বাংলা গানে রবীন্দ্র সঙ্গীতের এখনো কোন বিকল্প নেই।’
আমি দেখছি, পুরীর সেই গল্পটা থেকে আমরা অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি দেখে, শুক্লা আবার সেটা শুভেন্দুকে স্মরণ করাচ্ছে। বারবার ওকে মনে করাচ্ছিল। ‘এই শুভেন্দু, তারপর পুরীতে তোদের কি হলো বল না? এক্ষুনি তো শিখাও এসে পড়বে। তখন কি আর শোনা হবে? বল না?’
শুভেন্দু বলতেই যাচ্ছিল, রনি সেই সময় বলে উঠল, ‘এই শুভেন্দু, শিখা তোকে যে প্রথম গানটা শুনিয়েছিল, আমাদের দু লাইন গেয়ে একবার শোনা। তুই তো আগের দিন এই হেঁড়ে গলা নিয়েও খুব ভালো গাইলি। শোনা না একবার?’
শুভেন্দু গলাটা খকখক করে একবার কেশে নিয়ে পরিষ্কার করে নিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, গাইবো?’
আমি বললাম, ‘হ্যা গা। অসুবিধে কি? আমরা সবাই শুনি।’