07-07-2021, 02:16 PM
মা ঢুকেছে এবার বিদিশার জন্য চা বানিয়ে। শুভেন্দু উত্তেজিত হয়ে এতক্ষণ প্রেমের বানী শোনাচ্ছিল। মা বলল, ‘একি শুভেন্দু? তুমি কাঁদছ?’
শুভেন্দু বলল, ‘না মাসীমা। আমি আবার মেয়েদের কান্না দেখলে কান্না চেপে রাখতে পারি না।’
মা তাকাচ্ছে একবার বিদিশার দিকে, একবার শুক্লার মুখের দিকে। কি হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। শুক্লাকেই প্রথমে বলল, ‘কি হয়েছে গো, তোমাদের। হঠাৎই শুভেন্দু এই কথা বলছে?’
শুক্লা বলল, ‘মাসীমা শুভেন্দু যা হাসায়, আপনি তো জানেন। হাসতে হাসতে পেট ফেটে এখন চোখে জল চলে এসেছে।’
মা বিদিশার দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে বলল, ‘ওহ্ তাই বুঝি? আমি ভাবলাম কি না কি হয়েছে।’
বিদিশা মা’কে দেখেই আমার মাথার কাছ থেকে উঠে পড়ল। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিল। মা বলল, ‘দেখলে তো দেবকে। মাঝে মধ্যেই এই রোগটা বাঁধায়, আর আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাই।’
বিদিশা একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। মায়ের দিকে ফিরে বলল, ‘ভাল হয়ে গেছে ও এখন। আর কোন চিন্তা নেই।’
মা বলল, ‘তোমরা সবাই মিলে আমার এই ছেলেটাকে একটু বোঝাও তো। কিছুতেই কথা শুনবে না। হাবিজাবি সব খাবে। আর থেকে থেকেই পেটের রোগ বাঁধাবে।’
মা’কে আমি বললাম, ‘মা এটা তো পেটের রোগ নয়, এটা হল আলসার কোলাইটিস। প্রবলেমটা ইনটেনস্টাইনে হয়।’
মা বলল, ‘ওই হল। রোগ মানেই রোগ। নিজেকে সাবধানে রাখতে হবে তো?
আমি চুপ করে গেলাম। বিদিশা আমার দিকে ঘুরে বলল, ‘শুনেছ তো মা কি বলছে? এবার থেকে নিজের শরীর নিয়ে আর ছেলেখেলা কোরো না। সবসময় তো আর শুভেন্দুকেও পাবে না। মা তখন একা কি করবে বলোতো?’
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে বিদিশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শুভেন্দু শুক্লাকে বলল, এই বিদিশা দেবকে ধমকাচ্ছে রে। দেখ ‘দেব’ কেমন চুপ। যেন শান্ত শিষ্ট বালক। আর আমরা যদি বলতাম, এক্ষুনি দেব, তেড়েমেড়ে উঠত।’
শুক্লা এবার হাসতে শুরু করেছে। মা’ও একটু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি যেন বকা খেয়েছি, এইভাবেই বিছানায় করুন মুখটা করে শুয়ে রয়েছি।’
বিদিশা বলল, ‘না না। ধমক কোথায়? নিজের শরীরের দিকে আগে খেয়াল রাখতে হবে তো? তারপরে তো সব। ও নিশ্চই খাওয়াদাওয়াতেও অনিয়ম করে, তাই এরকম হয়। আমি জানি নিজের শরীরের দিকে ও একদমই তাকায় না।’
শুক্লা বলল, ‘এক কাজ করবি। তুই এবার এসেগেছিস। দেবকে নিজের হাতে তুই খাইয়ে দিবি। দেব তোর হাতের ছোঁয়া ছাড়া জলস্পর্ষও করবে না।’
বিদিশা বলল, ‘ইস। ও যেন বাচ্চা ছেলে।
শুভেন্দু বলল, ‘শোন বিদিশা, বাচ্চা হয়ে যতদিন থাকা যায় ততই ভাল। বুড়ো হলেই যত বিপত্তি। এই দ্যাখ, আমিও কেমন দেবের মতন। শান্ত শিশু। দেব শুধু বিছানায় শুয়ে আছে, আর আমি বসে আছি, এই যা তফাত।’বিদিশা বলল, ‘তুমি আর কথা বোলো না। বাচ্চা হয়েই থাক চিরকাল। বিয়ে থা আর কোরো না। তোমাকে খাওয়াবারো কেউ নেই।’
শুভেন্দু বিদিশাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘কে বলছে তোকে? আমার বউদিরা সব আছে না? ওরাই তো আমাকে খাইয়ে দেয়।’
শুক্লা এবার হাসতে শুরু করেছে। ফোড়ন কেটে বলল, ’এই শুরু হল শুভেন্দুর আবার ফাজলামী। সত্যি পারে ও।’
বিদিশা চায়ের কাপটা নিয়ে আবার আমার মাথার কাছটায় বসেছে। একনাগাড়ে শুয়ে থাকতে আমারও ভাল লাগছে না। দেহটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই বিদিশা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘হু হু। একদম নয়। ওঠার চেষ্টা একদম করবে না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।’
আমি যাও বা শরীরটাকে নিয়ে একটু কসরত করে নিজেকে ঠেলা মেরে ওঠবার চেষ্টা করছিলাম, বিদিশার বকানির ঠেলায় আমার প্রত্যাশা আর পূর্ণ হল না। শুভেন্দু ঠিক বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা। শুক্লাকে বলল, ‘আজ দেবের কপাল সত্যি খারাপ। দিদিমনি এসে গেছেন। ছাত্রকে থেকে থেকেই বকা দিচ্ছেন।’
আমি হাসব না কাঁদব, তাই বুঝতে পারছি না। বিদিশা বলল, দেখ কোনো মানে হয়। ডাক্তার মানা করে দিয়ে গেছে। তাও ও জোর করে ওঠবার চেষ্টা করছে। আবার যদি পেটে ব্যাথা শুরু হয়?’
শুক্লাও সায় দিয়ে বলল, ‘হ্যা রে দেব। তুই জোর করিস না। অন্তত আজকের দিনটা একটু রেস্ট নে।’
শুভেন্দু বলল, ‘শুধু আজকের দিনটা কি? ডাক্তার তো বলেছে ওকে সাতদিন রেস্ট নিতে।’
আমি বললাম, ‘তাহলে আমি মরে যাব। এভাবে বিছানায় মরার মতন পড়ে থাকতে আমি পারব না। তোরা এসেছিস, আমি উঠে বসতে পারছি না। ভীষন বিরক্তি কর।’
আমার কাছে এগিয়ে এসে শুভেন্দু বলল, ‘এই সিরিয়াস বলছি, পাশের ঘরে যাব? তোদের একটু নিরিবিলিতে ছেড়ে দিই কি বল?’
বিদিশা চা খেতে খেতেই বলল, ‘এই যে পাশের ঘরে যাবার কিছু হয় নি। অত উদারতা দেখাতে হবে না। আমি যেন এখুনি চলে যাচ্ছি।’
আমি শুয়ে শুয়ে অতি উৎফুল্ল হয়ে বিদিশাকে বললাম, ‘তুমি থাকবে বিদিশা?’
বিদিশা বলল, ‘কেন? থাকলে তুমি খুশি হবে না?’
আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলছে বিদিশা। সেই চেনাপরিচিত মুখদৃষ্টি। বিদিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি, মনের মধ্যে যে ঝড়টা উঠেছিল, সেটা যেন ও অনেক কাটিয়ে উঠেছে। এখন আর দ্বিধা নেই। বাঁধা, প্রতিবন্ধকতা, এগুলোকে কাটিয়ে ওঠবার মানসিকতা নিয়ে ফেলেছে ও। ওর চোখের পরিভাষা সেই কথাটাই বলছে।
আমাকে থ মেরে শুয়ে থাকতে দেখে, শুভেন্দু বলল, একিরে দেব? স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন? বিদিশার কথার জবাব দে।’শুক্লা বলল, ‘দেব মনে হয় এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে বিদিশা ওর কাছে থাকবার জন্যই এসেছে।’
আমার যেন খানিকের ঘোরটা একটু কাটল। শুভেন্দু আর শুক্লা দুজনকেই বললাম, ‘আমি জীবনে অনেক কঠিন জিনিষটা খুব সহজ ভাবে বিশ্বাস করে এসেছি। অথচ কত সহজ, কত সরল, মনের কথাটা কেউ মন থেকে বললে, কেন মনে হয় আমার বিশ্বাস করতে কেন এত কষ্ট হচ্ছে। বিদিশা এতদিন পরে আমার বাড়ী এসেছে, ওকে সেই আগের মতন দেখছি বলেই আনন্দে বিশ্বাস করতে পারছি না।’
বিদিশাকে বললাম, ‘বাড়ীতে বলে এসেছো? তোমার মা’ বাবাকে?’
বিদিশা বলল, ‘বলেছি, আজ আর বাড়ী ফিরব না। তোমার এখানে থাকব। কাল সকালে আমি চলে যাব।’
শুভেন্দু এবার চোখটা বড় করে ফেলেছে। গোল গোল করে বিদিশার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এবার আমার মতই শুভেন্দুর অবস্থা। এ যেন আশাতীত। বেশ বড়সড় একটা ঢোঁক গিলে শুভেন্দু বলল, ‘ওরে তুই তো ষোল আনা দেবের আকাঙ্খা পূর্ণ করলি। দেবের এখানে থাকবি বলে তুই বাড়ীতে বলে এসেছিস? গ্রেট। এইজন্যই প্রাইভেসির ব্যাপারটা তখন পাত্তা দিচ্ছিলি না। আমি আর শুক্লা যখন বাড়ী ফিরে যাব, তখন তোরা মনের আনন্দে প্রেম সারবি?’
আমার কেমন মনে হল, শরীরের মধ্যে আনন্দশ্রোতগুলো সব বইতে শুরু করেছে। কে বলবে আমি একজন অসুস্থ রুগী। আমার শিরা উপশিরাগুলো সব আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক। পেটের ব্যাথা অদ্ভূত ভাবে পুরোপুরি গায়েব। আমি একজন পুরোনো হারিয়ে যাওয়া প্রেম ফিরে পাওয়া ভাগ্যবান প্রেমিক। আমার মনের মধ্যে আর কোন কষ্ট নেই। আমার জীবনে কোন একাকীত্ব নেই। আমি এখন নাচতে পারি, গাইতে পারি। বিদিশাকে নিয়ে কত কি করতে পারি।
শুভেন্দু দেখলাম হেঁড়ে গলায় আবার গাইতে শুরু করেছে, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। শাখে শাখে পাখী ডাকে। কত শোভা চারিপাশে। আহা কি আনন্দ-
শুক্লা বলল, ‘তুই থামবি। তখন থেকে কিশোরকুমার, মহম্মদ রফি হবার চেষ্টা করছিস। দেখ বিদিশা আরো কিছু বলবে। আমরা ওর কথাটা বরং শুনি মন দিয়ে।’
শুভেন্দু গান গাওয়াটা বন্ধ করে দিল। বিদিশা তখন চা খাওয়াটা সবেমাত্র শেষ করেছে। শুক্লা আর শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে বিদিশা বলল, ‘এই মাঝখানে একটা দিন, অনেক ভেবেছি, নিজের মনের সাথে শুধু লড়াই করেছি। একবার শুধু ভাবছি, আমি দেবকে সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও কেন পারলাম না? আমার নিজের সততাটা কেন এখানে জাহির করতে পারলাম না? আমি কি দেবের কাছে ছোট হয়ে যাব বলেই সত্যি কথাটা বলতে ইতস্তত করে ফেললাম? বললাম যখন পুরোটা কেন বললাম না? দেবকে একদিন বিশ্বাস না করে আমি চলে গিয়েছিলাম। আবার যখন ফিরে এলাম, বিশ্বাসটা কেন পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে পারলাম না? আমার মনে হয়েছিল আমি হয়তো ছোট হয়ে যাব দেবের কাছে। ভুল আমি করেছি, দেবের তো কোন ভুল নেই। কিন্তু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত যখন করতে চাইছি, তখন আমার অনেক জ্বালা, আমার অনেক বাঁধা আর প্রতিবন্ধকতা। বারে বারেই আমার মনকে শুধু পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। দেবের জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট করেছি আমি। আমার জন্যই শুধু শুধু ও কেন এত কষ্ট সহ্য করবে? আজ যে আমার ওখান থেকে ফিরে এসেও এত সমস্যা। কে আছে এমন? এত কিছু ঝেমেলা সত্ত্বেও আমাকে-