07-07-2021, 02:12 PM
চোদ্দো
শেষপর্যন্ত শুভেন্দু যে হঠাৎই পাল্টি খেয়ে বসবে, না ওটা আমি আশা করেছিলাম, না শুক্লাও। এমন ভাবে বলল কথাটা, আমি শেষ পর্যন্ত চোখ খুলতে গিয়েও খুলতে পারলাম না। বিদিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শুভেন্দুর দিকে। একটু আগে শুক্লা যে কথাগুলো ওকে বলেছে, ডাক্তার বলেছে ঘুমোতে, রেস্ট নিতে। ওকে ডিসটার্ব করা বারণ, তাহলে ওগুলো সব শুক্লার মন গড়া কথা? পুরো বেইজ্জ্বতের মত অবস্থায় পড়ে শুক্লাও মুখটাকে কাচুমুচু করে নিয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুভেন্দুকে গাল পাড়ছি, শালা ঢ্যামনা। দিলি তো সব ফাঁশ করে। এখন বিদিশা কি ভাবছে?
আমাকে চোখ খুলতে না দেখে, শুভেন্দু ম্যানেজ করে নিল। শুক্লাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। শুভেন্দু বলল, ‘নারে শুক্লা, আমার মনে হল দেব যেন জেগে আছে। এখন দেখছি সত্যিই ও ঘুমোচ্ছে। আসলে মালটা এমনই ঘুমের ঘোরেও সব শুনতে পায়। দেখবি ঘুম থেকে উঠে বলবে, ‘তোরা এই বলছিলিস, ওই বলছিলিস। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সব শুনতে পেয়েছি।’
বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক কাজ কর বিদিশা, তুই দেবের মাথায় হাত বুলিয়ে দে। দেখ ও ঘুমের ঘোরে কেমন ফিক ফিক করে হাসবে। আসলে দিবারাত্রি তোরই তো স্বপ্ন দেখে সারাক্ষণ। তুই হাত বোলাবি, ও ধরেই নেবে, বিদিশাই হাত বোলাচ্ছে আমার মাথায়।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ শুভেন্দু ঠিকই বলেছে। আমিও তো একটু আগেই হাত বোলাচ্ছিলাম। দেখলাম ঘুমের ঘোরে দুবার বলে উঠল, বিদিশা, বিদিশা, তুমি এসেছ? আমি তখুনি হাতটা তুলে নিলাম। কি জানি চোখ খুলে বিদিশার বদলে আমাকে দেখে যদি মন খারাপ করে বসে?’ এখন আসল লোক এসেছে, সেই হাত বোলাবে।
শুভেন্দুও তাল দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ একদম ঠিক। শুক্লা ঠিক কথাই বলেছে। নে শুরু কর বিদিশা। দেখ ঘুমের ঘোরে ‘দেব’ তোর কেমন নাম নেয়। এখুনি প্রমান পেয়ে যাবি।’
শুভেন্দু আর শুক্লা এমন ভাবে আমাকে চালনা করছে, আমিও মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছি। বিদিশা যেই কপালে হাতটা ঠেকাবে, আমিও ওর নামটা নেব। যেন সবকিছু সত্যি সত্যি সফল হয়ে যায়।
অনুভব করলাম একটা নরম হাত স্পর্ষ করেছে আমার কপালে। আমার কপালটা যেন ধন্য হয়ে গেল বিদিশার হাতের স্পর্ষে। শুভেন্দু ফোড়ণ কেটে বলল, ভালো করে বোলা, তবে তো ও বুঝবে, কেউ এসেছে ঘরে। এ মেয়ে বিদিশা না হয়ে যায়ই না। দেখবি ও দুতিনবার ওর নাম নেবে। অবধারিত।’
যেন শুয়ে শুয়ে যাত্রাপালার অভিনয় হচ্ছে। আমি নায়ক, বিদিশা আমার নায়িকা। আর শুভেন্দু হলেন পরিচালক মশাই, তিনি দুজনকেই পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, শিখিয়ে দিচ্ছেন।
বিদিশা এবার আমার কপালে হাত বোলাতে লাগল। চুলেও হাত বুলিয়ে দিল। নরম আঙুলগুলো কতদিন পর এই মাথায় খেলা করছে। সখিকে পেয়ে সখা আনন্দিত, আপ্লুত অভিভূত।
আমি প্রথমে বিদিশার নামটা আর উচ্চারণ করলাম না। একটু চোখ পিট পিট করতে লাগলাম। আর মুখে একটু অল্প হাসি দিলাম। যেন ঘুমের ঘোরেই আমি হাসছি।
বিদিশা এবার বুঝতে পেরে, চোখ বড় বড় করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওমা তুমি তো জেগেই আছ। চোখ বন্ধ করে ঘুমোবার ভাণ করছিলে এতক্ষণ?’আমি ধরা পড়ে গেছি। বেগতিক দেখে শুক্লা, শুভেন্দু দুজনেই চুপ। বিদিশা মাথার ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে আমাকে বলল, ‘চোখটা পুরো খোলো। পিট পিট করছ কেন?’
শুভেন্দু আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে শরীরটা ঝুঁকে আমাকে দেখে বিদিশাকে বলল, ‘সত্যি ও জেগে আছে?’
বিদিশা বলল, ‘হ্যাঁ একটু আগে হাসছিল। আমি তো তাই দেখলাম।’
শুভেন্দু বলল, ‘ওটাই তো দেবের স্টাইল। ও যখন ঘুমিয়ে থাকে। তোর স্বপ্ন দেখে, তখন হাসে। দেখ এখন হয়তো তোরই স্বপ্ন দেখছে, আর হাসছে। তা তুই ওর কপালের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিলি কেন? বোলা, যেমন বোলাচ্ছিলিস একটু আগে।’
বিদিশা আবার কপাল স্পর্ষ করছে না দেখে আমিও বললাম, ‘বোলাও না বিদিশা। সরিয়ে নিলে কেন?’
বিদিশা এবার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। -তুই বন্ধুতে মিলে ভালই শুরু করেছ। নাও এবার চোখ খোল দেখি। আর অ্যাকটিং করতে হবে না।’
আমি শেষপর্যন্ত চোখ খুললাম। বিদিশার মুখের এই হাসিটাই এতক্ষণ দেখতে চেয়েছিলাম। চোখ খুলে ওকে বললাম, কখন এসেছ?’
আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বিদিশা বলল, ‘তুমি পারো। শরীর খারাপের মধ্যেও কি অদম্য উৎসাহ, কি অফুরন্ত এনার্জ্জী।’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘শরীর তো আমার তোমরাই এসে ভাল করে দিয়েছ। আমার কিচ্ছু হয় নি। দিব্যি ভাল আছি।’
শুভেন্দু বলল, ‘তোমরা নয়, বল তুমি। বিদিশাই তোর শরীর ভাল করে দিয়েছে।’
আমি জোর করে একটু উঠে বসার চেষ্টা করছি। বিদিশা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘থাক থাক, উঠতে হবে না। আবার পেটে যদি চাপ পড়ে। তুমি বরং শুয়েই থাকো।’
শুভেন্দু শুক্লাকে বলল, ‘দেখলি তো শুক্লা। যেই বিদিশা এল আমরা কেমন ফেকলু হয়ে গেলাম। আর আমাদের দুজনের দিকে এরা দুজনের কেউ তাকাবে না। চল চল আমরা বরং পাশের ঘরে গিয়ে বসি।’
বিদিশা বলল, ‘এই ইয়ার্ক্কী হচ্ছে? বস বলছি। মাসীমা এক্ষুনি ঘরে ঢুকবে। কি ভাববে বল দেখি।’
শুভেন্দু বলল, ‘মাসীমা অত বোকা নয়। তোকে আর দেবকে এই ঘরে একা দেখলে থোড়াই ঢুকবে? উনি যেন কিছু বোঝেন না?’
বিদিশা বলল, ‘না তাও। তোরা যাবি না। বস এখানে।’
শুক্লা অবাক হয়ে বিদিশাকে দেখছিল। ওর চোখের কোনায় একটু জল। রুমাল দিয়ে চোখটা মুছে বিদিশা আর আমাদের সবাইকে বলল, ‘এতদিন বাদে বিদিশাকে দেখছি, আমার মনটা যেন সেই অতীতে ফিরে যাচ্ছে। দেবের ভালবাসার প্রতিদান এখন কানায় কানায় পূর্ণ। এই পৃথিবীতে বালি, সাহারার মরুভূমি বলে কিছু নেই।
আস্ত পৃথিবীটাই শস্য শ্যামলে ভরা ক্ষেত। এই পৃথিবীটা হল কোমল,সজীব, সবুজ পৃথিবী।’শুভেন্দু বলল, ‘সহজ করে বল, সহজ করে বল, বাংলায় আমি আবার অগা মূর্খ কিনা? তুই কি শুধু দেবের পৃথিবীর কথাটাই বলছিস, না গোটা পৃথিবীর কথা বলছিস?’
শুক্লা একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, তার মানে?
শুভেন্দু বলল, ‘শোন তাহলে। দেবের পৃথিবীটার সাথে কিন্তু গোটা পৃথিবীটাকে তুই মেলাতে পারবি না। ওরটা হল এক্সেপসনাল। এই যেমন তুই আর আমি, তোর আর আমার জন্ম হয়েছে মরুভূমিতে। ওখানেই মরব, ওখানেই সারাজীবন কাটাব। আর দেব বিদিশাকে এতদিন বাদে পেয়েছে। ও ধানক্ষেতে বিদিশাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। আর গুন গুন করে গান গাইবে। চিরদিনই তুমি যে আমার। যুগে যুগে আমি তোমারই। আমি কি গো? তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব কোনদিন? সঙ্গী। সঙ্গী। আমরা অমর সঙ্গী।’
শুক্লা হেসে বলল, সত্যিরে তুই? কি করে পারিস এত? অমন ভাবে বলছিস, ওরা কি করে প্রেমটা করবে বল দেখি? দেখ বিদিশা কেমন লজ্জ্বায় পড়ে যাচ্ছে।’
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি তাই। বিদিশা মাথাটা একটু নিচু করে নিয়েছে। শুভেন্দু চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘একশবার বলব। হাজার বার বলব। দরকার হলে লাখোবার কোটিবার বলব। কে আছে পৃথিবীতে এমন জোড়িদার? একটা সঙ্গী তুই খুঁজে দেখাতে পারবি? ভালবাসা কি ফেলনা নাকি? যে করলাম আর ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সত্যিকারের ভালবাসার কোন দাম নেই? বিশ্বাসের কোন দাম নেই? আমার ভালবাসা কি আমাকে প্রেমিকের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারে না? যে বন্ধন অটুট। তা কখনও ভেঙে যায় না। যদি একবার ভাঙে, শুনেছি তা নাকি চেষ্টা করেও জোড়া দেওয়া যায় না। কোথায় তারা? যারা বলেছিল, ভাঙা প্রেম নাকি সহজে জোড়া লাগে না। আমার তাদেরকে বলতে ইচ্ছ করে। এই বিদিশা আর দেবের উদাহরণটাই তুলে ধরতে ইচ্ছে করে। দেখ তোরা রোমিও জুলিয়েটের দল। প্রেম কাকে বলে, দেব আর বিদিশাকে দেখে তোরা শেখ।’
শুভেন্দু এমন ভাবে উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলেছে, শুক্লা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। দেখলাম বিদিশার চোখেও জল। হঠাৎ দেখলাম শুভেন্দুর চোখেও জল। চট করে চোখটা মুছে নিয়ে শুভেন্দু বলল, ‘একটু বেশি বলে ফেললাম না? না আমিও আজকাল বড্ড ইমোশোনাল হয়ে পড়ছি।’