06-07-2021, 11:09 PM
তেরো
গানটা শুনতে শুনতে শুভেন্দু যেন দোলায় দুলছে। গান পাগল নয় আমার গলা পাগল। হঠাৎ একটা আবদার করে বসল, ‘এই দেব একটা রিকোয়েস্ট করব, রাখবি? তোকে এটা করতেই হবে।’
আমি বললাম, কি?
শুভেন্দু বলল, ‘এবারের পূজোতে বিরাট ফাংশন হচ্ছে আমাদের পাড়াতে। তোকে গাইতে হবে।’
আমি বললাম, ‘পাড়ার জলসা?’
শুভেন্দু বলল, ‘কেন, তুই তো গেয়েছিস বেশ কয়েকবার। তোদের পাড়ার ফাংশনেই গেয়েছিস। এবার না হয় আমাদের ওখানে গাইবি।’
আমি বললাম, ‘সে তো দেরী আছে এখনও। তখন যদি শরীর সুস্থ থাকে নিশ্চই গাইব। আর তুই রিকোয়েস্ট করছিস, তোর অনুরোধ কি আমি ফেলতে পারি?’
দাঁত বার করে একটু ফিক ফিক করে হাসল শুভেন্দু। শুক্লা বলল, ‘আচ্ছা দেব, আমিও যদি তোকে একটা রিকোয়েস্ট করি রাখবি?’
শুভেন্দু শুক্লার পুরো কথাটা শেষ না হতে দিয়েই শুক্লাকে বলল, ‘তুইও কি ওকে জলসায় গাওয়াবি নাকি? কি প্ল্যান মতলব?’
শুক্লা বলল, ‘এই চুপ কর। তুই যা করবি, আমাকেও তাই করতে হবে নাকি? আমি দেবকে দিয়ে গাওয়াব না। আমি গান শিখব।’
শুভেন্দু শুক্লার কথা শুনে হেসেই লুটোপুটি। হাসতে হাসতে বলল, ‘তুই? গান শিখবি? এই বয়সে?’
শুক্লা বলল, ‘কেন? আমি কি বুড়ী হয়ে গেছি নাকি? যে বয়সের খোটা দিচ্ছিস?’
আমি মাঝখানে বাঁধা দিয়ে শুক্লার তারিফ করে শুভেন্দুকে বললাম, ‘জানিস তো শুভেন্দু। শুক্লা কিন্তু দারুন ছবি আঁকে। এক একটা ছবি যেন মাষ্টার পিস। চোখ জুড়িয়ে যায়। আমি ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে ওর আঁকা ছবি দেখেছি।’
শুভেন্দু বলল, ‘সত্যি তোদের কত গুণ। এই ‘দেব’ কি সুন্দর গান গায়, আবার গল্পটল্পও লেখে শুনেছি। তুই খুব ভাল ছবি আঁকিস। আর আমি হলাম যে পুরোপুরি কোয়ালিটি লেস। আমার কোন গুন নেই।’ বলেই মুখটা এমন ব্যাজার মত করল, যেন নিজের ওপরেই খুব আফসোস হয়েছে ব্যাচারার।
মা সেই সময়ে আর একবার ঘরে ঢুকল। শুভেন্দুর কথাটা শুনতে পেয়েছে। ওকে বলল, ‘কার গুণ নেই বলছ শুভেন্দু? তোমার? তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করব? তোমার মত ছেলে হয় না। আমি নিজে তার প্রমাণ পেয়েছি। এমন ছেলে লাখে একটা।’
মা কাছে এসে শুভেন্দুর থুতনিটা ধরে একটু আদর করে দিল। শুভেন্দু তাড়াতাড়ি মা’র পা ধরে প্রনাম করে বলল, ‘মাসীমা আরও আশীর্ব্বাদ করুন। আমি যেন আপনাদের সেবায় আরও নিমজ্জিত হতে পারি। এবার আপনি বললেন, আমার দূঃখটা দূর হল। আর আমাকে কেউ বেগুন বললেও আমি মানব না।’
আমি আর শুক্লা দুজনেই হাসছি, শুভেন্দুর রকম দেখে। শুক্লা হাসতে হাসতে বলল, ‘যাক, মাসীমার কাছ থেকে সার্টিফিকেটটা পেয়ে গেলি। এর থেকে বড় সার্টিফিকেট পৃথিবীতে আর নেই।’মা বলল, ‘সত্যি গো, ছেলেটার মনটা এত ভাল। আমার তো খুব ভাল লাগে ওকে। দেব বারেবারে ওর কথা বলে। এখন মনে হয়, সত্যি এমন বন্ধু আর কে আছে? ক জনের ভাগ্যে জোটে। ‘দেব’ আমি দুজনেই খুব ভাগ্যবান।’
মা কথাগুলো খুব আবেগ নিয়ে বলছে, আর শুভেন্দু চেয়ারে বসে বসে বুকের ছাতি চওড়া করছে। শুক্লা হাসতে হাসতে আমাকে বলল, ‘দেখ, দেখ। মাসীমার কথাগুলো শুনে ও কেমন করছে? শুভেন্দুর রকমটা দেখ।’
আমিও শুয়ে শুয়ে হাসতে লাগলাম। মা হঠাৎই সেইসময় বলে বসল, ‘আমার কিন্তু একটা কথা আছে বাবা? এটা কিন্তু তোমাকে রাখতে হবে।’
কথাটা শুভেন্দুকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। শুভেন্দু প্রথমে বুঝতে পারেনি। ভ্যাবাচাকা খেয়ে ওর মুখের আদলটাই পাল্টে গেল। মা কি আদেশ করবে ও জানে না। মুখটা একটু করুন মত করে বলল, ‘বলুন মাসীমা।’
মা বলল, ‘এবার কিন্তু তোমাকেও বিয়ে করতে হবে বাবা, আমি কোন কথা শুনছি না।’
শুভেন্দু আঁতকে ওঠার মতন করে বলল, ‘বিয়ে?’
মা বলল, ‘হ্যাঁ বিয়ে। তুমি শুনে অমন চমকে উঠলে?’
আমি আর শুক্লা দুজনেই মুখ টিপে হাসছি, শুভেন্দু বলল, ‘আপনি বলছেন যখন মাসীমা। করে ফেলব। এ আর কি এমন কঠিন কাজ? কবে করতে হবে বলুন? আপনি শুধু হুকুম করুন।’
বাধ্য ছেলের রকম দেখে আমার আর শুক্লার দুজনেরই খুব মজা লাগছে। মা বলল, ‘বিয়েটা করবে কাকে? একটা মেয়ে তো দরকার। মেয়ে দেখা শুরু করেছ?’
শুভেন্দু বলল, ‘ওটাই তো মাসীমা। সমস্যা তো ওখানেই হয়েছে। কিছুতেই মেয়ে খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক চেষ্টা করলাম। সব বৃথা গেল।’
মা বলল, ‘সত্যি তুমি মনের মতন মেয়ে খুঁজে পাচ্ছো না? এও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
আমি বিছানায় শুয়েই ওকে বললাম, কটা মেয়ে খুঁজেছিস তুই? মাকে খুব ম্যানেজ করছিস। ব্যাটা গুলবাজ।’
শুক্লা কান্ডকারখানা আর রকম দেখছে শুভেন্দুর। শুভেন্দু বলল, ‘ভাবছিস আমি সত্যি গুল মারছি। আরে তোদের কাছে আমি অনেক কিছুই লুকোতে পারি। তা বলে মাসীমার কাছে কি লুকোব? এই তো গত মাসেই আমি ছটা মেয়েকে দেখলাম। আরে আমার মেজবৌদিও খুব উঠে পড়ে লেগেছে আমার জন্য। তাছাড়া মাধুরীও চেষ্টা চরিত্র করছে। জানি একদিন না একদিন আমাকে বিয়ে করতেই হবে। তাই তো সত্যি কথাটাই বললাম।’
শুক্লা বলল, ‘ছটা মেয়ে কে দেখলি, তারমধ্যে একটাকেও তোর পছন্দ হল না? তোর ব্যাপারটা কি বলতো?’ সর্বগুণে গুণান্বিত আবার অপূর্ব সুন্দরী। দুটো কিন্তু একসাথে হবে না। ও আশা ছেড়ে দাও।
শুভেন্দু বলল, আমার কাছে সুন্দরীটা ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু একটা জিনিষ বুঝিস তো? জয়েন্ট ফ্যামিলি আমাদের। আমাদের চার ভাইয়ের নিজেদের মধ্যে খুব ভাব। বিয়ের পরও সেই বন্ধনটা অটুট রয়ে গেছে। আমার বৌদিরাও সব মানিয়ে নিয়েছে। আজকালকার মেয়েরা, তারা সব আলাদা থাকতে চায়। আলাদা সংসার হবে। ছোট্ট সংসার। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে তারা থাকতে চায় না। এই ব্যাপারগুলো বুঝে শুনে,তবেই তো বিয়েটা করতে হবে। বিয়ের পরে কোন ঝেমেলা বহন করতে আমি রাজী নই।মা শুভেন্দুর কথাটা শুনে ঘাড় নাড়ল। বলল, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিকই বলেছ। সেরকম মেয়ে খুঁজেই তবে তাকে বিয়ে কর। তবে পাবে নিশ্চই। আমার মন বলছে।’
শুভেন্দু বলল, ‘চেষ্টায় তো লেগে আছি। দেখি-
মা এরপর পাশের ঘরে চলে গেল। শুভেন্দু আমার আর শুক্লার দিকে তাকিয়ে মিচকি মিচকি হেসে বলল, ‘কোনরকমে ম্যানেজ করেছি বল? নইলে মাসীমা এখুনি চেপে ধরত আমায়।
শুক্লা ওর কথা শুনে প্রথমে চোখটা বড় করেছে। তারপর হাসতে হাসতে আমাকে বলল, ‘দেখেছিস ব্যাটা কেমন পাজী। মাসীমাকে দিব্যি কেমন বানিয়ে বানিয়ে কথাগুলো বলে গেল।’
শুভেন্দু একটু সিরিয়াস হয়ে বলল, ‘দেখ শুক্লা, এখন আমার বিয়ের থেকেও সবথেকে বড় ইমপরট্যান্ট জিনিষটা হচ্ছে দেব আর বিদিশার আবার মিল হয়ে যাওয়া। আরে আপন কা ক্যায়া? কিসিকো ভী শাদী করলেগা ইয়ার। লেকিন এ যো পড়া হ্যায় না বিস্তার মে। তেরে সামনে? পহেলে ইসকা জিন্দেগী বস জানে দে ইয়ার। বহূত ইন্তেজার কিয়া। অব আয়া ও শুভঘড়ি। এ মেরে সবসে প্যায়ারা দোস্ত। জিসকা শাদী মে ম্যায় জবরদস্ত নাচুঙ্গা। আরে ইয়ে মেরে ইয়ার কি শাদী হ্যায়। এ মেরে ইয়ার কি শাদী হ্যায়।’
শুভেন্দু একটু এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে গান গাইতে শুরু করল, ‘এ দোস্তী। হাম নেহী তোরেঙ্গে। তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে। ‘
আমিও ওর সাথে গলা মেলাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে নিজেই খেই হারিয়ে, হাত ছেড়ে দিল। তারপর আক্ষেপের সুরে বলল, না, এই হেঁড়ে গলায় আমার দ্বারা আর গান হবে না। নারে শুক্লা, তোর মত আমাকেও গানটা শিখতে হবে দেখছি দেবের কাছে।’
মা হঠাৎই ঘরে ঢুকেছে আবার। যেন মা’রও বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইছে না। বহুদিন পরে খুব চেনা, কাছের জনকে দেখলে যেমন মনটা আকুলতায় ভরে যায়, নিজের চোখকেও অনেকে বিশ্বাস করতে পারে না। আমি যা দেখছি, সত্যি দেখছি তো? নাকি ভুল দেখলাম? মা সেভাবেই ঘরে ঢুকে বলল, ‘বারান্দা থেকে দেখলাম বিদিশা ট্যাক্সি থেকে নামছে। কতদিন পরে ওকে আবার দেখছি। হ্যারে দেব? সত্যি আমি ওকে দেখলাম তো? না, বিদিশার মত দেখতে অন্য কোন মেয়ে? কিন্তু আমার চোখ কি এতটাইই ভুল হবে?
শুভেন্দু বলল, ‘না মাসীমা। আপনি ঠিকই দেখেছেন। বিদিশাই এসেছে। ও সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসুক। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি।’
পরবর্তী আপডেট একটু পরেই