06-07-2021, 03:30 PM
(This post was last modified: 01-01-2022, 11:41 AM by Bumba_1. Edited 4 times in total. Edited 4 times in total.)
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম
লেখা :- বুম্বা
আজ যে কোনো কারণেই হোক মনটা ভারাক্রান্ত আমার .. আর মনের সঙ্গে শরীর যেহেতু ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই হয়তো শরীরটাও খুব একটা জুতসই লাগছিলো না।
ঠিক করলাম অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবো। আজ আর অফিসের গাড়িতে কাঁচ তুলে দিয়ে এসি চালিয়ে একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করলো না। একটু মুক্ত বাতাস সেবন করার জন্য ট্রেনে করে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার কাছে 'পাস' থাকার দরুন এই লকডাউনের মধ্যেও ট্রেনে যাতায়াত করতে অসুবিধা হয় না।
যাই হোক, ফেরার পথে ট্রেনে কাল্লু ভাইয়ের সঙ্গে হঠাৎ অনেকদিন পরে দেখা।
"আরে ভাইয়া ক্যায়সে হো আপ? ইতনা দিন কোই খবর নেহি .. লেকিন পাপ্পু, জো সান্যাল স্যার কে ওয়াহাঁ কাম কারতে হ্যায় .. উনহি সে আপকে খবর মিলতে রেহেতে হ্যায় .. বহুৎ বুরা লাগা আপ কে বারে মে শুনকার .. ইতনা আচ্ছা আদমি কে সাঙ্গ এয়েসা ক্যায়সে হো সাকতা হ্যায়!" এই বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ এবং দুজনের বর্তমান জীবনের কথা বলতে বলতে যাত্রাপথের সময়টুকু কোথা দিয়ে যে অতিবাহিত হয়ে গেলো টেরই পেলাম না।
সাল টা ২০১২ হবে .. তখন আমি Bhushan Power & Steel এ চাকরী করি। কলকাতার হেড অফিসে J.K. Millennium Centre বিল্ডিং এর ছয় তলায় বসতাম।
সকালে অফিস যাওয়ার সময় আমার সঙ্গেই ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করতো কাল্লুভাই। তবে লক্ষ করতাম ওকে কেন জানিনা সবাই একটু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতো। কারণটা অবশ্য পরে জেনেছিলাম।
আমার আবার তাস খেলার বিশেষত 'কন্ট্রাক্ট ব্রিজের' খুব নেশা ছিল তখন (এখনো যে নেই তা নয়)। কাল্লুকে পার্টনার নিয়ে খেললেই বেশিরভাগ সময় আমরা জিতে যেতাম। এইভাবেই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব টা গাঢ় হতে লগলো। কখন যে আমরা একে অপরের অতি প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলাম বুঝতেই পারিনি।
এইভাবেই বেশ চলছিলো .. হঠাৎ একদিন দেখলাম কাল্লু আর আসছে না। একদিন.. দু'দিন.. তিনদিন.. করে এইভাবে সাতদিন কেটে গেলো।
ট্রেনের কাউকে জিজ্ঞেস করলে কেউই কিছু বলতে পারে না। একদিন মরিয়া হয়ে কাল্লুর বাড়ির ঠিকানা খুঁজে অফিস থেকে ফেরার পথে ওর বাড়ি গেলাম।
কাল্লুভাই ওরফে হায়দার আলীর বাড়ি উত্তরপাড়া তে। প্রথম জীবনে সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করতো। পরবর্তী কালে কি করে যেন লোহা মাফিয়াদের দলে ভিড়ে গিয়েছিলো।
ওর বাড়ি গিয়ে যা দেখলাম তা আমার কল্পনার অতীত। জরাজীর্ণ একটি বাড়িতে অন্ধকূপের মতো একটি ঘরে ভাড়া থাকে কাল্লু। যদিও বাড়িতে সে তখন ছিলো না .. ছিলো তার পক্ষাঘাতে পঙ্গু শয্যাশায়িনী মা আর তার তালাক হয়ে যাওয়া এক দিদি।
আধা বাংলা আধা হিন্দিতে যা বুঝলাম তার মানে হলো কাল্লুকে পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছে লোহা পাচারের জন্য। কাল্লু আমার কথা এবং আমার চেহারার বর্ণনা বাড়িতে এমনভাবেই দিয়েছে যে তারা আমাকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছে সে কথাও জানালো।
আমার মাথায় হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আমাদের ডানকুনি প্লান্টে কয়েকদিন আগে night shift এ galvanized steel পাচারের দায় তিনজন কে ধরেছিল পুলিশ। ঘটনাটা শুনেছিলাম .. কিন্তু যেহেতু আমি কলকাতার হেড আপিসে বসতাম, তাই ওই ব্যাপারে বিশদে জানবার প্রয়োজন বোধ করিনি।
সেই মুহূর্তে ওদের সামনে থেকে একটু তফাতে এসে আমি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের factory shop manager সাক্সেনা কে ফোন করে ওই তিনজন ছেলের নাম জানতে চাইলাম। প্রথমে তিনি নামগুলি জানাতে অস্বীকার করলেও পরে আমার পীড়াপীড়িতে যে নামগুলি বললেন তার ভেতর একজন হায়দার আলী ওরফে কাল্লুভাই।
কথাটা শুনে প্রথমে প্রচন্ড রকম চমকে উঠে তারপর কিছুটা আশঙ্কিত হয়ে পড়লাম আমি। এই ব্যাপারটা ওর মা-বোন কে জানালে ওরা কাল্লুকে ছাড়ানোর জন্য আমার উপর চাপ দিতে পারে এটা ভেবে ওদের কিচ্ছু না বলে তখনি বেড়িয়ে এলাম ওখান থেকে।
বাড়িতে ফিরে মা'কে সব খুলে বললাম। মা সব শুনে বললেন "নিজের মন যেটা চাইবে সেটাই করো.. তবে তোমাকে আমি যেটুকু শিক্ষা দিয়েছি তাতে মনে হয় না তুমি অমানবিক কাজ করতে পারো।"
সেদিন রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লাম .. অনেক রাতে ঘুম এলো। স্বপ্নে দেখলাম অস্পষ্ট একটা মুখ আমাকে বলছে "ভাইয়া ও ভাইয়া, কুছ কারোগে নেহি মেরে লিয়ে?" ঘুম ভেঙ্গে গেলো .. অনুভব করলাম ঘরে এসি চললেও দর দর করে ঘামছি।
পরেরদিন ডানকুনি প্লান্টে গিয়ে factory shop থেকে সাক্সেনা কে একপ্রকার জোর করে নিয়েই থানায় গেলাম। Quality Control এ কাজ করার সুবাদে ওই এলাকার পুলিশ স্টেশন আমাদের এবং অবশ্যই সাক্সেনা সাহেবের ঘরবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। তার উপর বড়বাবু আমার বিশেষ পরিচিত ছিলেন .. তাই personal bond এ কাল্লুকে ছাড়াতে বিশেষ অসুবিধে হলো না।
সেই থেকে কাল্লু আমার ভক্ত হয়ে গেলো। আমাকে কথা দিলো এই লাইন ও ছেড়ে দেবে। আমার এক দাদা শান্তনুকে ধরে ওকে কোনো একটি ব্যাঙ্কের ATM এর security guard এর চাকরী তে ঢোকানো হলো।
★★★★
সেবছর দুর্গাপূজার আগে আমার হঠাৎ মাথায় ভূত চাপলো বাড়ির দরজা-জানালা রঙ করাবো। ট্রেনেও সেইসব নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। ওই কম্পার্টমেন্টের বেশিরভাগ প্যাসেঞ্জার আমার মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল এবং আমাকে বিশেষ স্নেহ করতো। এক একজন এক এক রকমের suggestion দিচ্ছে।
সবশেষে কাল্লুভাই বললো "আপ ইতনা tension মাত লিজিয়ে ভাইয়া .. colour আপ choose কিজিয়ে .. হাম আকে পেইন্ট কর দেঙ্গে।"
যেমন কথা তেমন কাজ .. মহালয়ার পরের দিন থেকে কাজে লেগে পড়লো কাল্লুভাই।
আমি বললাম, তোমার ডিউটির কি হবে? ও বললো "ছুটি লে লিয়া, পাহলে আপকা কাম, বাদমে ডিউটি।"
মা বললেন "বুম্বা তুই ওকে পারিশ্রমিক দিবি তো?" আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে কাল্লুর উক্তি "এ্যায়েসা মাত বোলিয়ে ম্যাডাম জি .. হাম ইনকো 'ভাইয়া' আউর 'আপ' বোলতে হ্যায় ইজ্জত দেনে কে লিয়ে .. লেকিন ইনহে মন সে আপনা ছোটা ভাই মানতে হ্যায় .. প্যায়সা দোগে তো হাম আভি কাম ছোড়কে চালে জায়েঙ্গে .. আপ কুছ খিলা দিজিয়েগা হামে।"
মা বললেন "কাল্লু তোমাকে একটা কথা বলবো? ভাইফোঁটার দিন আসবে তুমি? যদি কোনো অসুবিধে না থাকে।"
কাল্লুভাই রাজি হলো। দুর্গাপূজার দু'দিন আগে রঙ করা শেষ হলো।
ভাইফোঁটার দিন প্রত্যেকবারের মতো আমার দুই মাসি এবং মিষ্টি হাতে রাঙামামা (মেজমামা) হাজির। ফোঁটা দেওয়া শেষ .. কাল্লুর কথা আমরা ভুলতেই বসেছিলাম, আসাও করিনি ও আসবে।
কিছুক্ষণ পরে কাল্লুর আগমন মিষ্টির বাক্স হাতে। আমরা তো খুব খুশি। গল্পগুজব চলছে। এর মধ্যেই আমার মা সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটালেন।
কাল্লুকে হঠৎ বলে বসলেন "আমি কি তোমাকে ফোঁটা দিতে পারি?"
আমরা তো সবাই চুপ, জানি উত্তর আসবে "বিলকুল নেহি। "
আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাল্লুভাই বললো "জরুর .. কিঁউ নেহি!"
মা ফোঁটা দিলো হায়দার আলী ওরফে কাল্লু ভাইকে।
আজ অনেকদিন পর কাল্লুকে দেখে সেই মধুর স্মৃতি রোমন্থন করলাম।
মা ও মা.. মা গো .. কোথায় তুমি!!!!