Thread Rating:
  • 21 Vote(s) - 3.38 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance সুনিতা মাতা
#45
পালঘাটে আকাশ –
শনিবার ১৭-ই আগস্ট আকাশ পালঘাটে পৌঁছায়। ট্রেন থেকে নেমে ও সোজা সুনিতার কাছে যায়। সুনিতা ঘরে শুয়ে ছিল। বাড়ীতে তখন সুনিতার মা আর আকাশের বাবা ছিলেন। আকাশের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ওনারা দুজনেই গিয়ে আকাশকে ধরে বসান। আকাশ বলে ও আগে সুনিতার সাথে কথা বলবে। সুভাষ বাবু বলেন সুনিতা একদম ঠিক আছে কোন চিন্তার কারণ নেই। আকাশ বলে যাই হোক ও আগে সুনিতার সাথে কথা বলবে।

আকাশ সুনিতার ঘরে ঢোকে। সুভাষ বাবু আর সুনিতার মা পেছন পেছন আসেন। সুনিতা আকাশকে দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে। আকাশের বুকে মুখ রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমাকে ক্ষমা করে দাও প্রভু, আমি তোমার প্রসাদ আমার মধ্যে রাখতে পারলাম না। আমি পাপী আমাকে ক্ষমা করে দাও”।

আকাশ সুনিতার দু হাত ধরে চুমু খায়। ওর চোখের জল মুছিয়ে দেয়, আর বলে, “তোমার কোন পাপ নেই। যা কিছু হয়েছে সেটা আমার পাপে হয়েছে। আমি সেদিন যে মুহূর্তে পাপ করেছি, সেই মুহূর্তে সূর্য দেবতা আমাকে শাস্তি দিয়েছেন। আমি পাপী সুনিতা, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার পাপে তোমাকে শাস্তি দিলেন ঠাকুর। আমি কথা দিচ্ছি আর কোনদিন এইরকম পাপ কাজ করবো না”।

সুনিতা আর আকাশ দুজনেই কাঁদতে থাকে। দুজনেই বলে, “তুমি কেঁদো না”।

তবু কেউ কান্না থামায় না। সুভাষ বাবু আর সুনিতার মা ওদেরকে একা রেখে বাইরে যান। ওরা কাঁদতে কাঁদতে ধীরে ধীরে কান্না থামায়। আকাশ জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছিল সেদিন। সুনিতা বাংলাতেই বলে, “আমি এতো আনন্দে ছিলাম যে আমি ভুলে গেছিলাম সাবধানে থাকতে হবে। অসাবধান হয়ে ছিলাম তাই সূর্য দেবতা আমাকে শাস্তি দিয়েছেন”

আকাশ – তুমি পড়ে গিয়েছিলে সন্ধ্যে সাত টার সময়। সেই সন্ধ্যায় ঠিক সেই সময়ে আমাদের অফিসের একটা মেয়ে আমাকে পাপ করতে প্ররোচিত করেছিল। আর আমি মুহূর্তের জন্য সব কিছু ভুলে গিয়ে ছিলাম আর পাপ করতে গিয়েছিলাম। সাথে সাথে আমার চেতনা ফিরে আসে আর আমি ওখান থেকে চলে যাই। কিন্তু আমার পদস্থলন হয়েছিল। সেই পাপের শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হল। সুনিতা আমাকে ক্ষমা করে দাও সোনা।

সুনিতা – তুমি তো পাপ করতে গিয়ে ফিরে এসেছ, তাতে তোমার পাপ কোথায় হল।

আকাশ – পাপ করতে যাওয়াও এক রকম পাপ।

সুনিতা – তোমার পাপ নয়, আমার ভুল।

আকাশ – মন খারাপ করোনা। এবার আমরা কোলকাতায় চলে যাব। আমার বাবা মা দুজনেই রাজী আছেন। আমি একবার ডাক্তারের সাথে কথা বলেই তোমাকে কোলকাতায় নিয়ে যাব। আমার সুনিতা আমার বুকে থাকবে। আমরা আর ভুল বা পাপ কোনটাই করবো না।

সুনিতার মুখে বেশ কিছুদিন পরে হাঁসি ফোটে। ও আকাশকে পরম আবেগে চুমু খায়। আকাশ বলে, “তুমি খুব ভালো বাংলা শিখে গেছআমি খুব খুশীআমি এবার গিয়ে বাবার সাথে কথা বলি।

আকাশ বাইরে বেড়িয়ে দেখে রাজন এসে গেছে। দুই বন্ধু আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে পরে। আকাশ কিছু বলতে গেলে রাজন ওকে বলে আগে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিতে। কিছু খেয়ে নিতে। তারপর সব কথা বলবে। রাজনের কথা মত আকাশ ফ্রেস হয়ে আসেএসে রাজনের হাত ধরে বলে ও না থাকলে ওর অনেক কিছুই দেখা বা করা সম্ভব হত না। ও বন্ধুদের ধন্যবাদ দেয় না। কিন্তু চায় ও আর রাজন সারাজীবন এইরকম বন্ধু থাকবে। আকাশ আরও বলল ও সুনিতাকে কোলকাতায় নিয়ে যেতে চায় আর তাই ডাক্তারের সাথে দেখা করা খুব দরকার।

আকাশ ওর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে মা কোথায়। উনি উত্তর দেন যে স্মৃতি দেবী হোটেলেই আছেন। আকাশ জিজ্ঞাসা করে মা সুনিতাদের বাড়ি কেন আসেনি। সুভাষ বাবু বলেন পরে জানাবেন। আকাশ বুঝতে পারে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।

দুপুর পর্যন্ত আকাশ সুনিতার সাথেই থাকে। তার পর বাবার সাথে হোটেলে যায়। মাকে জিজ্ঞাসা করে, “মা কেমন আছো?”

স্মৃতি দেবী – আমি ভালই আছি। তুমি কি দেখে আসলে তোমার প্রানের সুনিতার কাছে ?

আকাশ একটু থমকে গেল, কিন্তু উত্তর দিল, “সুনিতা এখন অনেক ভাল আছে।”

স্মৃতি দেবী – সেতো ভালো থাকবেই। আমার বংশের প্রদীপটা ভেঙ্গে দিয়ে মনের আনন্দে আছেনা ভাঙলে তো তোমাকে এতো তাড়াতাড়ি কাছে পেত না।

আকাশ – মা তুমি এইসব কি বলছ ?

স্মৃতি দেবী – আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়েরা বড়ো ঘোড়েল হয়, তুমি তো আমাকে কত কি শুনিয়ে দিলে। আমি মূর্খ মানুষ কিছু বুঝিনা। তোমরা সব আধুনিক লেখা পড়া শেখা ছেলে। আমি ভাবলাম তুমি হয়ত ঠিক কথা বলছ। ওমা ! আমি যা ভেবেছিলাম সেটাই ঠিক। তোমাকে সাদা সিধে পেয়ে পটিয়ে নিয়েছে।

আকাশ – কি যা তা বলে যাচ্ছ। কি করেছে সুনিতা ? ও নিজের ভুলের জন্য নিজে কাঁদছে আর তুমি যা খুশী বলে যাচ্ছ !

স্মৃতি দেবী – তুই সোজা ছেলে। তোর সাদা মনে কাদা নেই। তুই কি করে বুঝবি ?

আকাশ – মা ! তুমি থামো।

স্মৃতি দেবী – আমাকে থামালে কি আর সবাই থেমে যাবে? তারা যখন থু থু করবে তখন বুঝবি।

আকাশ – সুনিতা কি করেছে সেটা আগে বল আমাকে।

স্মৃতি দেবী – ওর শরীরে কুট কুটানি উঠেছে। ও চাইছিল কি ভাবে তোর সাথে অসভ্যতা করবে। তুমি কি ভেবেছ তোমরা হানিমুনের নাম করে কি কি নোংরামি করেছ আমি সেসব জানিনা। কোন সভ্য মানুষ করে ওইসব। ওর ইসের জ্বালা উঠেছে। তোমাকে চায়। যখন ডাক্তার বলেছে যে এখন যেতে পারবে না। তখন ইচ্ছা করে পরে গিয়ে বাচ্চা নষ্ট করে দিয়েছে। এবার তো সব ঠিক। তোমার কাছে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবে। আর ওইসব নোংরামি করবে। আবার ন্যাকামো করে তোমাকে প্রভু প্রভু বলে। সহ্য হয় না আমার এইসব।

আকাশ – মা তুমি এতো নোংরা কথা বলতে পারছ তোমার বৌমাকে নিয়ে ?

স্মৃতি দেবী – ওই নোংরা মেয়েটা আমার বৌমা নয়। ওকে ছেড়ে দিয়ে তুই এক্ষুনি আমাদের সাথে চল। তোর জন্য আমি লক্ষ্মী মেয়ে খুঁজে আনব।

আকাশ – কি করে তুমি এতো ছোটো মনের কথা বলতে পারো ?

স্মৃতি দেবী – আমি ছোটো মনের ? তবে আরেকটা কথা বলি শোন। তুই তো বুঝবি না আমি না বলে দিলে।

আকাশ – আর কি বলবে ? তোমার আরও কি বলার আছে ?

স্মৃতি দেবী – আকাশের বাবা তুমিও শোন। তুমিও তো বৌমা বৌমা করে পাগল। বাপ আর বেটা এক হয়েছে। আমার যত জ্বালা।

সুভাষ বাবু – আর কি বলবে তুমি ?

স্মৃতি দেবী – সুনিতার বাবা কালো, মা কালো, ভাই কালো। আসে পাশের সবাই কালো। শুধু সুনিতা কি করে ওইরকম গায়ের রঙ পায় ? বল তোমরা এর উত্তর দাও।

সুভাষ বাবু – তুমি কি বলতে চাইছ পরিষ্কার করে বল।

স্মৃতি দেবী – সুনিতা ওঁদের মেয়েই না। আর না হলে সুনিতার মায়ের সাথে কোন ফর্সা লোকের সম্পর্ক ছিল। সুনিতার তার মেয়ে। আমি ওইরকম মেয়েকে আমার বাড়ীর বৌ করবো ! মগের মুল্লুক পেয়েছ ?

সুভাষ বাবু – তুমি কি ভাবে এইরকম নিচ মনোবৃত্তি নিয়ে আমার সাথে থাকলে বলতো ?

স্মৃতি দেবী – সেতো বলবেই। আমি এখন বুড়ি হয়ে গেছি বলে আমি নিচ। আর কচি মেয়েটাকে দেখে তোমারও জিব লক লক করছে !

আকাশ – কি যা তা বলে যাচ্ছ তোমরা ? তুমি কি মানুষ ?

স্মৃতি দেবী – তাতো বলবেই। এখন আমি মানুষ নই। আমি নিচ। তোমাদের আমি ভালো করে বুঝেছি।

আকাশ – তোমার সাথে কথা বলাই বৃথা। তুমি যা খুশী ভাব আমার কিছু যায় আসে না। আমি তোমাদের সাথে থাকছি না। তোমরা কোলকাতা ফিরে যাও। আমাকে আর সুনিতাকে নিয়ে তোমাদের কিচ্ছু ভাবতে হবে না।

আকাশ বেড়িয়ে যায়। সুনিতার কাছে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু ক্যানালের ধারে পৌঁছে ওর মন আরও খারাপ হয়ে যায়। ও কোন মুখ নিয়ে ওর দেবী তুল্য প্রেয়সীর কাছে যাবে। ও ক্যানালের ধারেই বসে পরে। হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। একসময় চোখের জল শুকিয়ে যায় কিন্তু চোখের জলের দাগ থেকে যায়। যতই চেষ্টা করি না কেন কোনদিন চোখের জলের দাগ মুছে ফেলা যায় না। অনেক নামী দামী বিদেশী ক্রীম আছে মুখের যে কোন দাগ তোলার জন্য। কিন্তু চোখের জলের দাগ মোছার ক্রীম আজও আবিস্কার হয়নি।

আকাশ কতক্ষন ওইভাবে বসে ছিল জানে না। সন্ধ্যের একটু আগে রাজন আর দিব্যা বাড়ি ফিরছিল, ওকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। রাজন আকাশের পাশে বসে মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কি হয়েছে তোমার ? সুনিতা ঠিক হয়ে গেছে, এর জন্য এতো মন খারাপ করার কোন মানে নেই।”

আকাশ চুপ করেই বসে থাকে। রাজন আর দিব্যা অনেকবার বলে সব ঠিক হয়ে গেছে। অনেক পরে আকাশ বলে, “আমি জানি সুনিতা ঠিক আছে। আমি এটাও জানি যে সুনিতার হয়ত এর পর বাচ্চা হতে অসুবিধা হবে। এটা ডাক্তারের কাছে এখনও শুনিনি, কিন্তু আমি জানি। তাও আমার সুনিতা আমারই আছে আমারই থাকবে।”

রাজন – সেটা আমরা সবাই জানি। এখানকার ডাক্তারও তাই বলেছে। কিন্তু সেসব আমরা পরে চিন্তা করবো। তোমার এখন কি হল।

আকাশ – মা

রাজন – মা ? মা কি ? কি হয়েছে ?

আকাশ – মা বলছেন এই মেয়ে ভালো না। অনেক বাজে বাজে কথা বলেছেন আমি তোমাদের বলতে পারবো না। আমাকে একটু একটা থাকতে দাও। আমি একটু পরে সুনিতার কাছে আসছি।

রাজন আর দিব্যা আরও কিছুক্ষন আকাশের পাশে বসে থাকে। তারপর কিছু না বলে চলে যায়। সন্ধ্যে সাত টার পর আকাশ সুনিতার কাছে যায়। আকাশ পৌঁছানোর একটু পরেই সুভাষ বাবু সুনিতাদের বাড়ি আসেন। জিজ্ঞাসা করেন আকাশ আছে কিনা। রাজন বেড়িয়ে এসে সুভাষ বাবুকে বলেন আকাশ একদম ভেঙ্গে পড়েছে। ও কোন কারণ বুঝতে পারছে না। আকাশ বেড়িয়ে এসে বাবাকে দেখে বলে, “বাবা, আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। তুমি মাকে দেখো। মা যদি নিজের ভুল বোঝে তবেই আমি ফিরে যাব। মা যদি মায়ের ওইসব নোংরা চিন্তা থেকে সরে না আসে আমি আর কোলকাতাতেও ফিরব না। এখানেই থেকে যাব।”

সুভাষ বাবু – আমি কি করবো বল। আমি হয়ত বকে তোর মাকে চুপ করিয়ে দেব। কিন্তু তাতে ওর সুনিতার সাথে ব্যবহারের তো কোন বদল হবে না।

আকাশ – সেটা আমি বুঝি। সেই জন্য আমি তো তোমার ওপর রাগ করে নাই।

সুভাষ বাবু – তাই বলে তুই কোলকাতা ছেড়ে দিবি ? এটা কিরকম কথা ?

আকাশ – তুমি এখন হোটেলে ফিরে যাও। এখানে তোমার সাথে এইসব কথা বলা ঠিক নয়। তুমি রাত্রে মায়ের সাথে কথা বল। আমি কালকে হোটেলে আসব। আমাদের যা কথা বলার ওখানেই বলবো।

সুনিতা ভেতর থেকে সব শোনে আর বোঝে। কিন্তু সমস্যা কোথায় বুঝতে পারে না। রাজন আর সুনিতার মাও বোঝে যে কিছু একটা সাংঘাতিক সমস্যা হয়েছে। কিন্তু ওনারা কেউ আকাশকে কিছু জিজ্ঞাসা করেন না। আকাশ ভেতরে সুনিতার কাছে গিয়ে শুয়ে পরে। সুনিতা আস্তে আস্তে উঠে বাইরে আসে। মা আর রাজনকে বলে ও পরে আকাশের সাথে কথা বলবে। আকাশ এখন একদম ভেঙ্গে পড়েছে। রাজন আকাশের কাছ থেকে যা জেনেছিল সেটা বলেসুনিতার মা বলেন আকাশ সুনিতাকে ভুল না বুঝলেই হল। আগের দিন আকাশের মা কত খুশী ছিলেন। মেয়ের এই সমস্যার সময় ওনার কি হল কেউ বুঝতে পারে না। সুনিতা ওর মাকে বলে আকাশের জন্য কিছু খাবার দিতে। ও আকাশকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। একে তো তিন দিন ধরে জার্নি করে এসে ক্লান্ত তারপর এই মানসিক ধকল। বেচারা আর পারছে না।

সুনিতার মা খাবার দিলে সুনিতা আকাশকে খেতে বলে। আকাশ খেতে চায় না বলে ওর ক্ষিদে নেই। সুনিতা অনেক বুঝিয়ে প্রায় জোর করেই ওকে খাওয়ায়। তারপর আকাশকে ঘুমাতে বলে। আকাশ শুয়ে পড়ে সুনিতার কোমর জড়িয়ে ধরেসুনিতা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আকাশ ঘুমিয়ে পরে। সুনিতা কোনরকমে আকাশের হাত থেকে বেড়িয়ে খেয়ে আসে। আকাশের পাশে শুয়ে পরে। কত দিন অপেক্ষা করছিল আকাশের সাথে রাত কাটাবার জন্য। সেই রাত এলো কিন্তু যে ভাবে এলো সেটা কেউ চাইছিল না। আকাশকে কাছে পেতে চাইছিল কিন্তু সেই পাওয়ার জন্য যে মুল্য দিতে হল সেটা কোন বাবা মাই চায় না। যাই হোক সুনিতা আকাশকে তো পেয়েছে, সেটাই বড়ো শান্তি।

সকালে উঠে দুজনেই ওঁদের অভ্যেস মত মেহগনি গাছের নীচে গিয়ে বসে। কিন্তু সূর্যোদয় দেখার সে মন আর নেই। সুনিতাও গত তিন চার দিন সূর্যোদয় দেখেনি। সেদিন সূর্য মেঘের আড়ালেই লুকিয়ে থাকল। সুনিতাদের বোঝাতে চাইল সূর্যদেবও ওঁদের দুঃখে দুখী। ওরা আকাশের দিকে চেয়েই থাকে কিন্তু সূর্য আর সামনে আসে না। আকাশ বলে সূর্য দেবতার লজ্জা লাগছে ওঁদের মুখ দেখাতে। উনি লঘু পাপে গুরু শাস্তি দিয়ে দিয়েছেন। দুজনে হাঁটু গেড়ে বসে সূর্য দেবের প্রার্থনা শুরু করে। দুজনেই একসাথে বলে,

ওঁ জবাকুসুম সংকাসং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম।
ধান্তারিম সর্বপাপঘ্ন্য, প্রনতহস্মি দিবাকরম।

হে সূর্য দেবতা আমরা নিশ্চয়ই অনেক পাপ করেছি। কিছু জেনে করেছি। কিছু না জেনে করেছি। আমরা তোমার সামনে সঙ্গম করার মত গর্হিত কাজ করেছি। আমরা মানছি যে ওটা ভীষণ বড়ো পাপ। আমরা তোমাকে সন্মান দেইনি। আমরা আর কোনদিন সজ্ঞানে কোন পাপ করবো না। আমাদের ক্ষমা করো ঠাকুর।

ওরা চোখ বন্ধ করে যে যার মত প্রার্থনা করে। চোখ খুলে দেখে সূর্য মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে ওঁদের দিকে তাকিয়ে আছেআকাশ উত্তেজিত হয়ে বলে সূর্যদেব ওঁদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। ওঁদের এই দুঃখের দিন আর থাকবে না। একদিন ওঁদের জীবন ফিরে আসবে।

সকাল ন’টার সময় আকাশ হোটেলে যায়। সুভাষ বাবু জিজ্ঞাসা করেন সুনিতা কেমন আছে। আকাশ বলে যে সুনিতা অনেকটাই নর্মাল। আজ ও আর রাজন ডাক্তারের কাছে যাবে। স্মৃতি দেবী চুপ করেই বসে থাকেন। আকাশ জিজ্ঞাসা করে, “তোমরা কবে ফিরবে?”

সুভাষ বাবু – আমরা আজ রাত্রে মাদ্রাস যাব। কাল মাদ্রাস থেকে করমন্ডলে কোলকাতা যাব।

স্মৃতি দেবী – ব্যাস আমরা চলে যাচ্ছি। এবার তুমি তোমার মত নেচে বেড়াও। কেউ কিছু বলার নেই। যাও আবার সুনিতাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়। রাস্তায় রাস্তায় অসভ্যতা করে বেড়াও। বাবা মায়ের কথা মনে না রাখলেও চলবে।

আকাশ – মা তুমি এই নিয়ে আর কোন কথা বল না। আমার তোমার ওপর রাগ নেই। কিন্তু আমি সুনিতকে নিয়ে তোমার কাছে গিয়ে থাকতে পারবো না।

স্মৃতি দেবী – তোমাকে আমি সুনিতাকে আমার কাছে নিয়ে আসতেই দেব না। তুমি আশা করো কি ভাবে!

আকাশ – আমি আশা করিও না। তুমি থাকো তোমার পুরনো ধ্যান ধারনা নিয়ে। তোমাকে বোঝানও বা শেখানো আমার দায়িত্ব নয়। আমি আজকেই এখানকার অফিসে যাচ্ছি। দেখি যদি আমার চাকুরি এখানে ট্রান্সফার করে নিতে পারি।

সুভাষ বাবু – সত্যিই তুই আমাদের ছেড়ে চলে আসবি ?

আকাশ – আমার সে ছাড়া আর কোন উপায় আছে ? তুমি বল।

সুভাষ বাবু – তোর মা এখন এইরকম বলছে। দুদিন পরে ঠিক বুঝে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

স্মৃতি দেবী – তুমি কি করে ভাবছ আমি এই অনাচার মেনে নেব!

সুভাষ বাবু – তুমি বোঝোই না অনাচার কাকে বলে।

আকাশ – বাবা তুমি গত ২৫ বছর ধরে মাকে বুঝিয়েছ। পরের ২৫ বছরে আরও বোঝাও। কিন্তু আমি সুনিতাকে ছেড়ে আর এক মুহূর্ত থাকব না।

সুভাষ বাবু – তোমার কি বাবা মায়ের প্রতি কোন দায়িত্ব নেই ?

আকাশ – হ্যাঁ আমার বাবা মায়ের ওপর দায়িত্ব আছে। কিন্তু আমার কাছে সুনিতার দায়িত্ব তার থেকে বেশী। তোমার জন্য মা আছে, মায়ের জন্য তুমি আছো। সুনিতা আমার হাত ধরে বেড়িয়ে এসেছে। সুনিতার জন্য আমি ছাড়া আর কে আছে ? কেউ নেই। সুনিতার বাবা, মা ওকে দেখে রাখবে। বন্ধুরা জীবন দিয়ে সাহায্য করবে। কিন্তু সবকিছুর দায়িত্ব আমার। সেখানে আমি সুনিতাকে ছেড়ে যেতে পারি না।

স্মৃতি দেবী – কেন ওর সাথে কথা বলছ ? ওর মাথায় সুনিতা চেপে আছে, আর কিছুই ঢুকবে না।

আকাশ চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, কোনরকমে নিজেকে সামলিয়ে নেয়, বাবাকে বলে, “বাবা, একটা কথা বল। আমরা সবাই প্রকৃতির নিয়মে চলি তো?”

সুভাষ বাবু – হ্যাঁ

আকাশ – সব প্রানীর জন্যই প্রকৃতির নিয়ম এক, সেটা মানো ?

সুভাষ বাবু – হ্যাঁ, প্রকৃতি সবাইকে সমান ভাবে দেখে। যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায় প্রকৃতি তাকে ক্ষমা করে না।

আকাশ – না আমি প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবার কথা বলছি না। সব প্রাণীর মধ্যেই প্রাকৃতিক নিয়মে মায়ের কর্তব্য সন্তান জন্ম দেওয়া। বাবার দায়িত্ব সেই সন্তানকে বড়ো করে তোলা। বাবা আর মা দুজনে মিলে সন্তানকে স্বাবলম্বী করে তোলে। একটা বাঘ তার বাচ্চাকে শিকার করা শেখায়। একটা পাখি টার বাচ্চাকে আকাশে ওরা শেখায়। ঠিক তো ?

সুভাষ বাবু – হ্যাঁ, একদম ঠিক।

আকাশ – এবার তুমি বল মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী বড়ো হয়ে বাবা মায়ের দেখাশোনা করে ? শুধু মানুষই বুড়ো বাবা আর মায়ের দায়িত্ব নেয়। তাই এটা মানবিক নিয়ম, প্রাকৃতিক নিয়ম নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে আমার প্রধান দায়িত্ব আমার সন্তানের জন্ম দেওয়া। আর তার জন্য আমার সুনিতাকেই চাই। তোমরা যদি সেটা মেনে নাও তবে তোমাদের সব দায়িত্ব আমার। আর যদি মেনে না নাও তবে আমার কোন দায়িত্ব নেই।

সুভাষ বাবু – তুই এই কথা বলতে পারলি। তুই ভুলে গেলি আমরা তোর জন্য কি কি করেছি।

আকাশ – বাবা, আমার কথা গুলো খুব রুঢ় শোনাল। আমি হয়ত ঠিক ভাবে বলতে পারিনি। কিন্তু যুক্তি দিয়ে বল আমি কোন ভুল কথা বলেছি কি ?

সুভাষ বাবু – আমার তো মনে হচ্ছে না লজিকালি তুমি কিছু ভুল বলছ। তবু...

আকাশ – তোমরা আমাদের মানুষ করেছ সেটাকে ছোটো না করে বলছি, বাবা মায়ের কর্তব্য ছেলে মেয়েকে মানুষ করা। তোমরাও করেছ, তার মধ্যে কোন মহানতা নেই। আর বাবা মা মানুষ করেছে বলে সন্তানের বাবা মায়ের কাছে কোন ঋণ নেই।

সুভাষ বাবু – কেন ঋণ নেই ?

আকাশ – বাবা তাকেই ঋণ বলে, যেটা নেওয়ার আগে কোন ফেরত দেবার চুক্তি থাকে। চুক্তি না থাকলে, সেটা লিখিত হোক বা মৌখিক হোক, সেটা ঋণ হিসাবে গ্রাহ্যই হবে না। তোমরা কি আমাকে জন্ম দেবার পর আমার সাথে কোন চুক্তি করেছিলে যে আমি ফেরত দিতে যাব !

সুভাষ বাবু – তুমি আজ অনেক খারাপ ভাবে কথা বলছ। কিন্তু আমি রাগ করছি না। আমরাই দায়ী তোমার এই অবস্থার জন্য। আমি বুঝতে পারছি তোমার মত ছেলে মানসিক ভাবে কি অবস্থায় পৌঁছলে এই ভাবে কথা বলে। তাই আমি তোমাকে দোষী করছি নাতুমি যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও।

আকাশ সুভাষ বাবুর পায়ে হাত দিয়ে বলে, “আমাকে এই কথা বল না। আমি তোমাদের কক্ষনো অশ্রদ্ধা করিনি আর করবও না। যাতে অশ্রদ্ধা না করতে হয় তাই দুরে থাকতে চাইছি। আমি জানি একমাত্র মা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে। কিন্তু আজ মা আমাকে ভালবাসার নামে যা বলল সেটা মায়ের ধারনায় হয়ত ঠিক। কিন্তু আমি মানতে পারছি না। আমি এটাও বুঝি যে মা বোঝে না যে মা বোঝে না। কোনদিন যদি সেটা বুঝতে পারে সেদিন আমরা ফিরে আসব।”

সুভাষ বাবু চুপ করে থাকেন। স্মৃতি দেবীও চুও করেই থাকেন। অনেকদিন আগে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন মেয়েদের বুদ্ধি নারকেলের মালার মত, দু ভাগেই থাকে কখনো সম্পূর্ণ হয়না। এখন অনেক মহিলা সেই অবস্থা থেকে বেড়িয়ে এসছে। কিন্তু কিছু মহিলার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রের ধারনাই সত্যি আছে।

আকাশ হোটেল থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে বাবা আর মাকে প্রনাম করে। সুভাষ বাবু মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন স্মৃতি দেবী সেটুকুও করেন না। কখনো কখনো আত্মাভিমান সন্তান স্নেহের থেকেও যে বড়ো হয়ে যায় সেটা আজ বোঝা গেল। হোটেলের বাইরে সুভাষ বাবু আকাশের সাথে এসেছিলেন। উনি আকাশকে কুড়ি হাজার টাকা দিলেন আর বললেন, “আমি জানি এখানে ঘর নিয়ে জীবন শুরু করতে যত টাকা দরকার সেটা তোমার কাছে নেই। তাই এটা তোমাকে দিচ্ছি। এটা ঋণ নয়, এটা আমার কর্তব্য। তোমার জীবন ভালো ভাবে শুরু করানোটাও প্রাকৃতিক নিয়মে আমার দায়িত্ব।”

আকাশ টাকাটা নেয়, আর বাবাকে বলে, “তখন উত্তেজনার বসে কি সব বলে গেছে সেগুলো মনে না রাখতে। ও কি সব ভুল ভাল কথা বলেছে ও নিজেও জানে না।”

আকাশ যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো ঠিক না ভুল ? কে জানে !!
 
 
আকাশ হোটেল থেকে বেড়িয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার বলে সুনিতা মোটামুটি ঠিকই আছে। তবে ওর ওপর সেক্সুয়াল চাপ একদম কম রাখতে। আকাশরা যেন কম করে দু তিন মাস কোন সেক্স না করে। সুনিতার মিস ক্যারেজ হওয়ার কারণ ফিটাসের গায়ে ইটের ধাক্কা খুব জোরে লেগেছিল। আর সুনিতার ফ্যালপিয়ান টিউব অনেকটা ড্যামেজ হয়েছে। তবে সুনিতা বাচ্চা মেয়ে তাই আসা করা যায় খুব তাড়াতাড়ি রিকোভার করবে। আর পরে বুঝতে পারবে সুনিতা আবার মা হতে পারবে কি না। ডাক্তার বললেন কোন অসুবিধা না হলে সুনিতাকে তিন মাস পরে দেখিয়ে নিয়ে যেতে।

আকাশ ডাক্তারের কাছ থেকে বেড়িয়ে ওর পালঘাটের অফিসে যায়। ওদের কোম্পানির সারা ভারতে ব্রাঞ্চ ছিল (এখনও আছে)। ব্যাঙ্গালরে হেড অফিস হলেও, মালিক মিঃ নাম্বিয়ার পালঘাটেই বসতেন। কারণ উনি কেরালার লোক। আকাশ ট্রেনিং এর সময়েও মিঃ নাম্বিয়ারের সাথে দেখা করেছিল। তাই সেদিন আকাশ সোজা ওনার কাছেই গেলসব কিছু বলল ওনাকে। মিঃ নাম্বিয়ার সব শুনে ওঁদের কারখানার ম্যানেজারকে ডাকলেন আর বলে দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আকাশকে ওখানে ট্রান্সফার করে নিতে। ম্যানেজার বললেন, “আকাশ যখন এখানে ট্রেনিং এ এসেছিল তখনই ভেবেছিলাম আকাশ আমাদের এখানে থাকলে অনেক ভালো হবে। ও মেসিন সারানোর থেকে R&D তে বেশী ভালো কাজ করবে। আজ যখন আকাশ এখানে আসতে চাইছে, আমার কোন অসুবিধা নেই। ও কাল থেকেই এখানে বসতে পারে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।”

আকাশ যারপরনাই আনন্দিত। ও বলল মাঝখানে দশ দিন মত ছুটি চাই ওর সব জিনিসপত্র কোলকাতা থেকে নিয়ে আসার জন্য। মিঃ নাম্বিয়ার বললেন সেটা কোন সমস্যা নয়। ম্যানেজারকে বলে দিলেন সব কিছু ঠিক মত দেখে নিতে। 
 
[+] 2 users Like TumiJeAmar's post
Like Reply


Messages In This Thread
সুনিতা মাতা - by TumiJeAmar - 28-06-2021, 12:11 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 28-06-2021, 12:29 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 29-06-2021, 01:53 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 29-06-2021, 02:30 PM
RE: সুনিতা মাতা - by Kallol - 29-06-2021, 05:09 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 01-07-2021, 01:35 PM
RE: সুনিতা মাতা - by Kallol - 02-07-2021, 05:55 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 05-07-2021, 10:05 AM
RE: সুনিতা মাতা - by TumiJeAmar - 06-07-2021, 02:09 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 07-07-2021, 04:03 PM
RE: সুনিতা মাতা - by Kallol - 07-07-2021, 07:13 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 10:14 AM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 03:53 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 03:54 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 05:44 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 05:45 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 05:47 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 05:48 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 05:49 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 05:51 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 06-01-2022, 10:09 PM
RE: সুনিতা মাতা - by Siraz - 06-01-2022, 10:15 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 30-03-2022, 01:15 PM
RE: সুনিতা মাতা - by ddey333 - 09-01-2023, 07:05 AM
RE: সুনিতা মাতা - by S_Mistri - 09-01-2023, 10:10 AM
RE: সুনিতা মাতা - by kourav - 12-01-2023, 07:38 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)