05-07-2021, 12:21 PM
কলিং বেলটা বাজছে। মা বলল, ‘ওই এল বোধহয় কেউ।’
তেরো
বলতে বলতে মা’ ঢুকলো ঘরে। শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি শুভেন্দু চা খাবে? চা করে দেবো?’
তলপেটের কাছটায় হাত দিয়ে অল্প একটু টিপে দেখলাম, ব্যাথাটা এখন বেশ কম। ডাক্তারের ওষুধ কাজ করতে আরম্ভ করে দিয়েছে।
তেরো
শুভেন্দু ঘরে ঢুকেছে। দেখলাম, বেশ খুশি খুশি ভাব। আমাকে বলল, ‘একেই বলে অন্তরের টান। যেই বললাম, অমনি ভেতর থেকে টানটা বেরিয়ে এল অটোমেটিক। কি ফার্স্ট রেসপনস। যেন এখুনি ছুটে চলে আসবে তোর কাছে।’
আমি বললাম, ‘কার কথা বলছিস তুই?’
শুভেন্দু বলল, ‘একজনই তো আছে গুরু। আমরা সব ওর কাছে নস্যি।’
আমি বললাম, মানে? কে সে?
শুভেন্দু বলল, তোমার জন্ম জন্মান্তরের সঙ্গিনী। শুধু এ জন্মে নয়, পরজন্মেও যে অলরেডি খাতায় নাম লিখিয়ে রেখেছে তোমার জন্য।’
আমি বললাম, ‘কে বিদিশা?’
শুভেন্দু একটু চেঁচিয়ে উঠে বলল, ইয়েশ। তোমার ডারলিং। তোমার প্রাণেশ্বরী।’
আমি বললাম, বিদিশাকে তুই ফোন করেছিলিস?
শুভেন্দু বলল, ‘ওকে ফোন না করলে কি হত জানিস?’
আমি বললাম, কি?
শুভেন্দু বলল, ‘তুই এই পাংশুমতন মুখখানা নিয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতিস, আর থেকে থেকে একবার করে বলে উঠতিস, বিদিশা ও বিদিশা। কোথায় তুমি?’
আমি হেসে বললাম, ‘যা মেলা বাজে বকিস না।’
শুভেন্দু হেসে বলল, ‘শালা। তুই কালকেও যা রকম দেখিয়েছিস, ডাক্তারও তাজ্জব হয়ে গেছে তোকে দেখে।’
মনে পড়ল ডাক্তারের কথা। উনিও আমাকে বলেছেন, কাল ওই অবস্থার মধ্যেও আমি নাকি বিড়বিড় করে বিদিশার নাম অনেকবার উচ্চারণ করেছি।
শুভেন্দু বলল, ‘তবে তোকে হ্যাটস অফ। অনেক তপস্যা করে তোর মত স্বামী আর প্রেমিক পাওয়া যায় রে। ব্যাচারা বিদিশা। এই সামান্য জিনিষটাই বুঝলো না। অসামান্য একটা লোককে অতিসামান্য করে ছেড়ে দিয়ে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনলো।’
আমি বললাম, ‘ছাড়, যা হয়েছে, হয়েছে। ও আর কি করা যাবে? তবে তুই যে ফোনটা করবি, আমি জানতাম। তারপরেই আবার ভাবছিলাম, মানসিক কষ্টে আছে মেয়েটা। ওকে দোষ দিয়েই বা কি করবো? আইনকে অবজ্ঞা করে তো আর কিছু করা যায় না। কিছু সময় তো লাগবেই।’
শুভেন্দু বলল, ‘শোনো বৎস। আইন যেমন আছে, আইনের ফাঁকও আছে। যতদিন ডিভোর্সটা না হচ্ছে, বিয়ে হয়তো করতে পারবি না। কিন্তু প্রেমটা করতে অসুবিধে কোথায়?’
আমি বললাম, ‘কথাটা তো ঠিক। তাহলে এত টেনশন কিসের? বিদিশাকে কি কোন ভয় পাচ্ছে? না কি ওর স্বামী সত্যি ওকে বলেছে ডিভোর্স দেবে না।’শুভেন্দু বলল, ‘কিছু একটা ব্যাপার আছে, বুঝছিস দেব। বিদিশা ওটা খোলসা করে বলছে না। ওর পেট থেকে কথাটা বার করতে হবে। হয়তো কোন দোটনায় পড়ে আছে ব্যাচারা।’
‘দোটনায়?’ আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
শুভেন্দু বলল, ‘এই দ্যাখ, তোর আবার টেনশন শুরু হয়ে গেল। না, তোকে কথাটা না বললেই ভাল হত। এক কাজ কর। বিদিশা আসছে, তুই ওকেই বরং পরিষ্কার করে সব জিজ্ঞেস করে নিস।’
আমি বললাম, ‘বিদিশা আসছে?
শুভেন্দু বলল, ‘না এসে পারে? আমার দেবের মুখে হাসি ফোটাতে আসছে।’
কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে শুভেন্দু আস্তে আস্তে বলল, ‘এই মাসীমাকে কিছু বলিস নি তো? বিদিশা কিন্তু আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল।’
আমি বললাম, ‘কোনটা?’
‘আরে ওর ডিভার্স যে এখনো হয় নি, সেই ব্যাপারটা।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুভেন্দুকে বললাম, ‘মা’র সাথে এ ব্যাপারে কোন কথাই হয় নি আমার। কেন বিদিশা কি এখনও আমার মনটাকে বুঝতে পারে না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারে না?’
হঠাৎ ভ্যাবাচাকা খেয়ে নিজেই থমকে গেল শুভেন্দু। আমাকে বলল, ‘আর কত পরীক্ষা দিবি? পরীক্ষারও তো একটা শেষ আছে। তোর মত কেউ নয়। সেটা যদি বিদিশা বুঝত, তাহলে হয়তো- বলে নিজেই মাথাটা নিচু করে নিল শুভেন্দু।
আমি বললাম, ‘বিদিশা মাথা উঁচু করে এ বাড়ীতে আসবে। ওকে কেউ আমরা খারাপ চোখে দেখব না। আমিও না। মাও নয়।’
শুভেন্দু বলল, মাসীমা কিছু বলছিল?
- ‘কি ব্যাপারে?’
- ‘বিদিশার কথা। বলেনি মাসীমা? তোকে কিছু জিজ্ঞাসা করে নি?’
আমি বললাম, ‘মা তো আমার্, আমারই মতন। আমি যেমন ছটফট করে উঠি। মায়ের মনটাও খুব নরম। মাঝে মাঝে একই সুরে গেয়ে ওঠে। কাল থেকে অনেকবারই বিদিশার কথা বলেছে। বিদিশা আসবে কিনা? অন্তত আমার শরীর খারাপের খবর জেনেও আসবে কিনা? পারলে মা হয়তো নিজেই ফোন করে বসতো বিদিশাকে। ‘কি গো বিদিশা? দেবের শরীর খারাপ। তুমি আসবে না?’
শুভেন্দু বলল, ‘কি অদ্ভূত না? তোর সাথে বিয়েটা তখন বিদিশার হয়ে গেলে বিদিশাও আর একটা মা পেয়ে যেত তোর মতন। আমি সেইদিনটার জন্য শুধু অপেক্ষা করছি।’
বলেই আমার দিকে তাকালো মা। আমাকে বলল, ‘এই তুই রাগ দেখাবি না। সবাই আর শুভেন্দু এক নয়। কাল তোর জন্য ও কত খেটেছে বলতো?’
শুভেন্দু যেন কিছুই বুঝতে পারেনি। আমার আর মায়ের মুখের দিকে দুএকবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলল, ‘কি হয়েছে মাসীমা? ও রাগ দেখাবে কেন?’
আমিও হাসি তখন চেপে রাখতে পারছি না। মা বলল, ‘ছেলের আমার মায়ের জন্য খুব দরদ। আজকে সবাই এক এক করে আসবে। আগে ভাগে তাই আমাকে শাঁসিয়ে রেখেছে। তুমি কিন্তু সবাইকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়বে না। তোমার আবার তাহলে দারুন খাটাখাটনি হবে।’
শুভেন্দু বলল, ‘ঠিকই তো বলেছে। আপনি অত ব্যস্ত হবেন না তো। আজ এখানে কারুর খাতির নেই। যে যে আসবে সব বাড়ী থেকে খেয়ে দেয়েই আসবে। চা, জলখাবার মিষ্টি ওসবের কোন দরকার নেই।’
মা বলল, ‘তুমিও আমার ছেলের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছো? আরে ওটুকু করলে কি এমন কষ্ট হয়? ওতে আমার কোন খাটনি নেই।’
আমি বললাম, ‘যাও যাও চা করে নিয়ে এসো। শুভেন্দুর জন্য স্পেশাল চা। বাকীদের জন্য কোন খাতির নেই। শুধু আমার এই বন্ধুটির জন্য তোমাকে ছাড় দিলাম।’
মা মুখ ভেঙিয়ে চলে গেল। আমাকে বলল, ‘তুই বললেই বা শুনছে কে?’
শুভেন্দু তখন হাসছে। আমিও হাসছি। আমার মুখের কাছে মুখটা নিয়ে এসে শুভেন্দু বলল, ‘আজ কিন্তু দারুন জমবে।’
আমি বললাম, ‘বিদিশা আসছে, তাই?’
শুভেন্দু বলল, ‘জীবনের বাকী কটা দিন যদি সুখে কাটাতে চাস, তাহলে বিদিশার আসাটা সত্যিই দরকার। আমি তো তাই মনে করি, তোর ভালবাসা যেখানে এখনো স্বচ্ছ, সেটা যদি শেষবারের মতন বিদিশা উপলব্ধি করতে পারে, তারজন্যই বিদিশার আসাটা নিতান্তই দরকার। অসুখের ঘোরে তুই শুধু বিড় বিড় করে যাবি, আর বিদিশা বিদিশা বলে পাগল হবি। আমাদেরও মাথাটা খারাপ হওয়ার আগে বিদিশার আসাটা একান্তই দরকার। প্রেমের রাজ্যে আমার তো মনে হয়, এমন কোন জায়গা নেই যেখানে বিদিশা নিশ্চিত আশ্রয় লাভ করতে পারে। এমন একটা নীড়। যেখানে মনের মতন একটা স্বামী আর মনের মতন একটা শ্বাশুড়ি। উফঃ এটা বোঝার জন্যও ওর একবার আসাটা খুবই দরকার। আর আমরা কি কেউ ওর এই বিপদে ওর পাশে নেই? এটা যেন ও কোনদিন না ভাবে, তারজন্যও ওর আসাটা দরকার। আর সব শেষে, তুই এখন শয্যাশায়ী। বিদিশা যদি না আসে তাহলে বাকীরা এসে শুধু কি করবে? সেটাও তুই বল। সেইজন্যই-
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। বুঝেছি ওর আসাটা দরকার। ওফ তুই পারিস।’
শুভেন্দু হাসছে। মা চা নিয়ে ঢুকেছে ঘরে। বলল, ‘নিচে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। মনে হল শুক্লা এসেছে মনে হয়।’