05-07-2021, 07:22 AM
(This post was last modified: 05-07-2021, 07:25 AM by Bichitro. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
Update 3
সুমিত্রার বয়স আট। দেখতে বেশ সুন্দর । কিন্তু ফর্সা না আবার শ্যাম বর্ণো বলা যায় না । ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল আর চার ফুট উচ্চতার শান্ত শিষ্ট মেয়ে। সে পাশেরই একটা মর্নিং কলেজে ক্লাস থ্রি তে পড়ে। পড়াশোনায় খুব ভালো। এতোটাই ভালো যে বাবা মায়ের সন্দেহ একদিন সুমিত্রার চোখে চশমা পড়বে।
সমরেশ বাবু ঘুম থেকে উঠে সাতটার দিকে মেয়েকে কলেজে দিয়ে আসেন। তারপর বাড়ি ফিরে গোঁফ দাড়ি কেটে , স্নান করে , খবরের কাগজ পড়ে , খেয়ে দেয়ে সাড়ে নটা বাজলেই অফিসে চলে যান । পাশেই অফিস , কুড়ি মিনিট সময় লাগে যেতে। একটা বাস ধরলেই পৌছিয়ে দেয় । সুচেতা দেবী সাড়ে দশটার দিকে ঘরে তালা দিয়ে সুচিকে নিয়ে সুমিকে আনতে যান। এটাই হলো এই পরিবারের দৈনন্দিন সূচি।
আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। সুচেতা দেবী ঘরে তালা দিয়ে সুচিকে নিয়ে চলে গেলেন সুমিকে আনতে। সুমিকে নিয়ে সোসাইটিতে এসেই দেখলেন নিচে আকাশদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সুচেতা দেবী মনে মনে ভাবলেন --- তাহলে ওরা হয়তো চলে এসেছে।
দুই দিন অফিসে যেতে পারেন নি বলে শুভাশীষ বাবু স্নেহা দেবীকে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে স্নান করে , কোট প্যান্ট পড়ে অফিস চলে যাচ্ছিলেন । সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় সুচেতা দেবীর সাথে দেখা। শুভাশীষ বাবু সুচেতা দেবীকে দেখে বললেন “ বৌদি ! দুই দিন কাজে যেতে পারি নি। ওদিকে কি হচ্ছে কিছুই জানি না। তাই বাধ্য হয়েই যেতে হচ্ছে। তুমি স্নেহা আর আকাশকে দেখো একটু। „
সুচেতা দেবীকে প্রতুত্বরে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই সুভাশীষ বাবু ভারী বুটের আওয়াজ করে গটমটিয়ে অফিস চলে গেলেন। সুচেতা দেবী মনে মনে বললেন “ কাজ পাগল ঠিক আছে তবে সংসারের দিকে একটুও খেয়াল নেই ? এ কিরে বাবা ! „ সুচেতা দেবী উপরে উঠে প্রথমে নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়ে সুমিকে বললেন “ তুই কলেজের জামা কাপড় ছেড়ে অন্য জামা পড় । আমি ততক্ষণে তোর কাকি কে দেখে আসি একটু। „ বলে তিনি পাশের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লেন। দরজা ভেজানো ছিল তাই ঢুকতে কোন অসুবিধাই হলো না।
ঘরে ঢুকতেই সুচি তিরের বেগে দৌড় দিল কাকির ঘরের দিকে। ছোট মেয়ের এই দৌড় দেখে সুচেতা দেবী শাসন করলেন “ এই আস্তে ! মেয়েটা এক জায়গায় স্থির থাকলে হয় ! „ কিন্তু সুচির মায়ের কথায় কান নেই।
স্নেহা দেবী তখন নিজে বিছানার ধারে শুয়ে আকাশকে দেওয়ালের পাশে রেখে শুয়ে ছিলেন। সুচি ঘরে ঢুকেই খাটে উঠে আকাশের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। স্নেহা দেবী ভালো করেই জানতেন সুচির দূরন্তপনার কথা। কিন্তু আকাশের প্রতি এতটা আগ্রহ হবে সেটা ভাবতে পারেন নি ।
স্নেহা দেবী সুচিকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বলার আগেই সুচেতা দেবী ঘরে ঢুকে বললেন দেখো না ! মেয়েটা কাল থেকে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে আকাশ কখন আসবে ? আকাশ কখন আসবে ? „ তারপর সুচির দিকে ফিরে বললেন “ নে , তোর আকাশ চলে এসছে । „
কিন্তু সুচির সেদিকে হুশ নেই। সে একমনে আকাশকে দেখে যাচ্ছে। স্নেহা দেবী ঠোঁটের কোনায় একটু হাঁসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “ কি দেখছিস রে অমন করে ? „
“ আমাল পুতুলেল থেকেও ছোত্ত । „ কথাটা আকাশের দিকে তাকিয়েই ছোট ছোট দুই হাতের তালু এক জায়গায় করে জোড়া লাগিয়ে বললো সুচি। আকাশ তখন গভীর ঘুমে।
সুচির কথা শুনে স্নেহা দেবী এবং সুচির মা দুজনেই হেঁসে উঠলেন। “এখন কেমন আছো ? „ জিজ্ঞাসা করতে করতে খাটের কিনারে স্নেহা দেবীর পাশে এসে বসলেন সুচেতা দেবী ।
“ আগের থেকে এখন অনেক ভালো । „ ঠোঁটে একটা হাঁসি নিয়ে বললেন স্নেহা দেবী।
শুভাশীষ বাবুর সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়েও চেপে গিয়ে সুচেতা দেবী বললেন “ আমি রান্নাটা করে নিই। „
“ না , না ! তুমি করবে কেন ? „
“ দেখো ! দেখো ! আদিখ্যেতা দেখো ! যেনো আমি আগে করিনি । আর শোনো , আমার রান্না সকালেই হয়ে গেছে । „ বেশ একটা অভিমানি আর রাগি সুরে কথা গুলো বললেন সুচির মা।
ঠিক সেই সময় সুমি কলেজের জামা পাল্টে একটা ফ্রগ পড়ে ঘরে ঢুকলো। সুচেতা দেবী আর স্নেহা দেবী একসাথে সুমিকে দেখলো। ঠিক সময় সুচি এমন একটা কান্ড ঘটালো যা সুচেতা দেবী আর স্নেহা দেবী কেউই দেখতে পেলেন না। কারন তারা সুমির দিকে তাকিয়ে ছিল।
কিছুক্ষণ থেকেই আকাশ ঘুমের মধ্যেই নিজের ঠোঁট নাড়ছিল । এমন ভাবে নাড়ছিল যেন সে কথা বলছে। আকাশের ঠোঁটের এই কাঁপুনি দেখে সুচির খুব আনন্দ হচ্ছিল , যেনো একটা ঠোঁট নাড়া পুতুল। যে মুহুর্তে সুমি ঘরে ঢুকলো ঠিক সেই মুহুর্তেই সুচি তার ডান হাতের ছোট্ট তর্জনী দিয়ে আকাশের ঠোঁট আরো বেশি নাড়িয়ে দিল। এর ফলে আকাশের ঘুম ভেঙে গেল আর সে ডুকরে চিল্লিয়ে ভ্যাঁ আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো।
আকাশের কান্না দেখে সুচিও ঠোঁট উল্টে গাল ফুলিয়ে চোখে জল এনে ফেললো। আকাশের ঠোঁটে আঙুল দেওয়ার জন্য যেন আকাশ সুচিকে বকেছে । তাই এই চোখে জল।
ঘরের বাকি সবাই আকাশের কান্নার আওয়াজ শুনে আকাশের দিকে তাকালেন । তারপর সুচির দিকে। ঘরের সবাই দেখলো আকাশ আর সুচি দুজনেই কাঁদছে। কিন্তু কেউই বুঝতে পারলেন না কি হয়েছে ? সুচির মা সুচিকে জিজ্ঞেস করলেন “ কাঁদছিস কেন রে বোকা মেয়ে ? „
কিন্তু সুচির কোন উত্তর নেই। আকাশের মা আর সুচির মা দুজনেই ভেবে কুল কিনারা পেল না। দুজনেরই মুখে বিষ্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। স্নেহা দেবি আকাশকে শান্ত করার জন্য “ আআআআআ , সোনা আমার , কাঁদে না , কাঁদে না , এইতো আমি „ আকাশ কান্না বন্ধ করলো। আকাশ কান্না বন্ধ করেছে দেখে সুচিও নিজের ঠোঁট আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনলো । সুচেতা দেবী মেয়ের কান্না থেমেছে দেখে একটু ধাতস্থ হলেন।
সুচেতা দেবী ঘরে আসার আগেই আকাশকে বুকের দুধ খাইয়েছিলেন স্নেহা দেবী , তিনি ভাবলেন আকাশের ক্ষিধে লাগেনি। তাই তিনি ছড়া কেটে আকাশকে ঘুম পাড়াতে লাগলেন। আকাশের কান্না বন্ধ হওয়া থেকে ফের ঘুমিয়ে পড়ার মধ্যে সুচিও আবার আগের মতো ঠোঁটে হাঁসি মুখে কৌতুহল নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
ততক্ষনে সুমি খাটের উপর উঠে সুচির পাশে বসে পড়েছে। আর দুই বোনই ঘুমন্ত আকাশকে দেখতে শুরু করেছে। আর সুচেতা দেবী সুচির আবার সেই হাঁসি খুশি মুখ দেখে , খাট থেকে উঠে রান্না ঘরে চলে গেলেন । সুচেতা দেবী রান্না করতে লাগলেন আর এদিকে খাটে শুয়ে স্নেহা দেবী ছড়া গেয়ে আকাশ কে ঘুম পাড়াতে লাগলেন।
ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি
মোদের বাড়ি এসো,
খাট নাই পালং নাই
খোকার চোখে বসো।
বাটা ভরে পান দিবো
গাল ভরে খেয়ো,
খোকার চোখে ঘুম নাই
ঘুম দিয়ে যেয়ো।
ছড়া শেষ হতেই স্নেহা দেবী দেখলেন শুধু আকাশ না সুচিও তার সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্নেহা দেবী আর সুমি দুজনেই সুচির ঘুম দেখে হেঁসে উঠলো।
রান্না করে দিয়ে, ঘরে ঝাট দিয়ে সুচেতা দেবী ঘুমন্ত সুচিকে নিয়ে চলে গেলেন। মাঝে মাঝে এসে দেখে গেলেন যে স্নেহা দেবীর কিছু লাগবে কি না। আর ভাত তরকারি একটা থালায় বেড়ে দিয়ে গেলেন তিন বেলা। আবার এসে এঁটো থালা বাসন নিয়ে রান্নাঘরে মেজে ধুয়ে রেখে গেলেন।
রাত নটা সাড়ে নটা নাগাদ যখন শুভাশীষ বাবু ফিরলেন তখন তার হাতে কয়েকটা দুই তিন তলা বাড়ির বিভিন্ন স্টাইল কিংবা প্যাটার্নের ব্লুপ্রিন্ট।
শুভাশীষ বাবু জামা কাপড় ছেড়ে স্নান করে বেডরুমে এলেন। এসে ব্যাগ থেকে ব্লুপ্রিন্ট গুলো বার করে খাটে বসে স্নেহা দেবীকে দিয়ে বললেন “ দেখো আর বলো কোনটা তোমার পছন্দ হচ্ছে। সেই মডেলের বাড়ি বানাবো । „
“ তুমি তো Import & Export এর ব্যাবসা করো। আর গাড়ি ভাড়া দাও। বাড়ি বানানোর কাজ কবে থেকে শুরু করলে ? „ কৌতূহল ঝরে পড়ে স্নেহা দেবীর কথায়।
“ আমি নিজেদের বাড়ি বানিয়ে থাকার কথা বলছি । „
“এটাও তো আমাদের বাড়ি ! „
“এর থেকেও বড়ো বাড়ি হবে। নিজেদের বাগান হবে। সেখানে শুধু আমি তুমি আর আকাশ থাকবো। „ বেশ উৎসাহের সাথে কথা গুলো বললেন শুভাশীষ বাবু।
“ আর তোমার মা ? „
শুভাশীষ বাবু কি বলবেন ভেবে পেলেন না। ছয় সাত মাস হলো তার মা সুনীতা দেবী মারা গেছেন। এর মধ্যেই তিনি এই পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন। শুভাশীষ বাবুর নিরবতা দেখে স্নেহা দেবী বললেন “ আমি জানি মা এখানেই আছে । মা আকাশ কে দেখে যেতে পারে নি । এখন যদি আমি আকাশকে নিয়ে চলে যাই তাহলে তোমার মার আত্মা খুব কষ্ট পাবে । „
“ এতো শিক্ষিত হয়েও এইসব বিশ্বাস করো তুমি ? „ বেশ বিরক্ত হলেন শুভাশীষ বাবু।
“ বিশ্বাস করলেই বিশ্বাস , না করলে অবিশ্বাস। এই বাড়িতেই তোমার মা বিয়ে করে এসছিলো । আমিও এখানেই বিয়ে করে এসছি । তোমার মা আমাকে নিজের মেয়ে মনে করতো। মার খুব ইচ্ছা ছিল নাতি কে দেখার। আকাশ নামটা তোমার মায়েরই রাখা। মা চেয়েছিল আকাশ বড়ো হয়ে আকাশের মতো বড়ো মন হবে। এখানেই তোমার মায়ের সব স্মৃতি আছে। আর তুমি এই বাড়ি ছেড়েই চলে যেতে চাইছো ? তুমি গেলে যাও । আমি আর আকাশ এখানেই থাকবো। „ বেশ রাগী গলায় এক টানা কথাগুলো বললেন স্নেহা দেবী।
“ তোমাদের রকমসকম বুঝি না আমি। একটা ভালো ঘর বানিয়ে সেখানে সুখে শান্তিতে থাকতে চাইছি ! তাতেই এতো কথা শোনাচ্ছো ! „ স্নেহা দেবীর রাগের কারন বুঝতে পারলেন না শুভাশীষ বাবু ।
“ ঘরে সুখ শান্তি থাকে পরিবারের জন্য। ইট , বালি , সিমেন্ট দিয়ে ঘর হয় না। এখানেই তুমি কতক্ষণ থাকো বলোতো যে নতুন বাড়ি করে সেখানে সুখে শান্তিতে থাকবে ? আর আমাদের রকমসকম বুঝে তোমার কাজ নেই। বৌদি খাবার গরম করে গেছে কিছুক্ষণ আগে। খেয়ে নাও। „ ছেলে জন্মানোর পর থেকেই স্বামীর উপরে রেগে ছিলেন স্নেহা দেবী। স্ত্রী আর সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানকে ছেড়ে কাজের জন্য চলে গেছিল আকাশের বাবা। তাই স্নেহা দেবী এক নিশ্বাসে বেশ রেগেই কথা গুলো বললেন।
স্ত্রীর রাগী গলা শুনে শুভাশীষ বাবু আর কিছু বললেন না। বলবেন কি করে ? তিনি তো ভালোভাবেই জানেন স্নেহা দেবীর মুখের কথা গুলো কতখানি সত্যি। সকাল আটটা নটায় চলে যান আর আসেন রাত নটার পর । আজ সারাদিনে শুধু দুইবার স্নেহা দেবীকে ফোন করেছিলেন আকাশের বাবা। একটা গভীর নিশ্বাস ছেড়ে স্নেহা দেবীর পাশে তার ঘুমন্ত সন্তানকে দেখে রাতের ডিনার খেতে চলে গেলেন শুভাশীষ বাবু ।
স্বামীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে স্নেহা দেবী আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলেন --- তার স্বামী এরকম কেন ? কিন্তু অনেক ভেবেও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না আকাশের মা স্নেহা দেবী।