04-07-2021, 10:01 PM
এগারো
মাথাটা একটু ঝিম ঝিম করছে। কেন জানি না শুক্লার বাড়ী থেকে ফিরে আসার পরই শরীরটা কিরকম খারাপ লাগছিল আমার। পেটের কাছটা কেমন ব্যাথা ব্যাথা করছিল। ঠিক যেমন আলসার কোলাইটিসের সময় ব্যাথাটা ওঠে, ঠিক তেমনই। ভীষন একটা যন্ত্রণা অনুভব করে বারান্দা থেকে আমি ঘরে ফিরে এলাম। কোমরের কাছটায় হাত দিয়ে একটু কাতরাতে শুরু করেছি। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলাম, ‘ও মা গো। আবার সেই যন্ত্রণা।’
ঘরের মধ্যে জলের বোতলটাও নেই। উঠে যে খাওয়ার ঘরে ফিল্টারের কাছে যাব, একটু জল খাবো। সে সামর্থও নেই। আমার চোখ দুটো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে, বুঝতে পারছি এ যন্ত্রণা সারা রাত ভোগাবে আমায়। সকাল অবধি আর ঘুম হবে না।
কোমরের দুপাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। টানটান পুরো শরীরটা নিমেষের মধ্যে ব্যাখায় আবার কুঁকড়ে গেল। যন্ত্রণাটা তখন ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে উঠছে। মনে হল, এই সময় কাউকে যদি পাশে পেতাম খুব ভাল হত। কেন যে ব্যাথাটা থেকে থেকে এরকম কষ্ট দেয় বুঝি না। এই বেশ আছি, আবার শরীরটা খুব খারাপ। সুস্থ সবল শরীরটা হঠাৎই বিষন্ন, ভীষন দূঃখী। কি জানি মনের সঙ্গে বোধহয় শরীরেরও একটা যোগসাজশ আছে বোধহয়। একটা অলৌকিক কোন শক্তি। যে শক্তিটাই আমাদের ঠিক থাকতে দেয় না।
মা ঘুমোচ্ছে অন্যঘরে। এই মূহূর্তে মাকে ডাকাটা ঠিক হবে না। মা আমার অনেক কষ্ট করে, সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে। মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত আমি ঘটাতে চাই না। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে তাই যন্ত্রণাটা সহ্য করার চেষ্টা করে যেতে লাগলাম। মনে হল পেটের ভেতরে কে যেন হাতুড়ী মারছে, এক্ষুনি নাড়িভূড়ি সব বেরিয়ে পড়বে। একটা অসহায় মানুষের মতন সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, ‘হায় ভগবান। এতটা কষ্ট দিও না আমায়।’
বিচিত্র মানুষের শরীর। হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেল, অমনি শরীরটা বিগড়ে গেল, ব্যস, হয়ে গেল তার দফারফা। ডাক্তার বলেছিল, খাওয়াদাওয়ার কিছু গড়বড় হলেই কিন্তু এই রোগটা মাঝে মধ্যে আবার দেখা দেবে। সুতরাং সাবধানে থাকতে হবে আপনাকে। গোলমাল হলেই ব্যাথাটা আবার আপনাকে কষ্ট দেবে। আর ব্যাথা যদি না কমে, তাহলেই বুঝবেন, বাথরুমে গিয়ে আবার সেই থোকা থোকা রক্ত। ডাক্তার ডেকে, ওষুধ খেয়ে হয়রানি। নার্সিংহোমে ভর্তী। এক গাদা শুধু পয়সা নষ্ট।
আমি কি এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারি না?হ্যাঁ পারেন। তারজন্য খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করতে হবে। আমি জানি, আপনি কাজের মানুষ, কিন্তু বাইরের হাবিজাবি খাওয়া একদম চলবে না। তাহলেই কিন্তু-
‘কিন্তু ডাক্তার আমি তো এই শেষ কয়েকমাসে বাইরে উল্টোপালটা কিছু খাই নি। তাহলে কেন এমন হচ্ছে?’
মনে হল আপন মনে আমি কথা বলছি বিড় বিড় করে। ডাক্তার আমার পাশে নেই। অথচ আমার মনে হচ্ছে আমি যেন ডাক্তারের সাথেই কথা বলছি।
অনেক কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস জল নেবার জন্য ফিল্টারের দিকে এগোতে লাগলাম। মনে হল গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, সমস্ত শরীরটা জবজব করছে ঘামে, এইবার মনে হয় ধুপ করে আমি মাটিতে পড়েও যাব। যেন শরীরে শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই আমার। রোগটা হঠাৎই শরীরে নতুনভাবে দানা বেঁধেছে, আমার সমস্ত শক্তিকে সে কেড়ে নিতে চাইছে।
ফিল্টার থেকে আমি গ্লাসে জল গড়াতে লাগলাম। তলপেটের কাছটা চিনচিন করছে। পেটের কাছটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বললাম, ‘বিদিশা, তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না যেতে, তাহলে হয়তো এই কষ্ট কোনদিন আমার হত না। আজ তুমি ফিরে এসেছো। তাও পুরোন ব্যাথা সেই আমাকে আবার কষ্ট দিচ্ছে।’
এবার জল গড়াতে গিয়ে দুম করে মাটিতে পড়েও গেলাম। মাথার কাছটা ভীষন জোরে আঘাত লাগল। মনে হল মাটিতে লেগে মাথার পিছনটা যেন নিমেষে ফুলে আলুর মতন ঢোল হয়ে গেল। মেঝেতে গ্লাসটা পড়ল, ঝনঝন করে একটা শব্দ বয়ে গেল।
বেশ জোরে শব্দটা হয়েছে। মা’রও ঘুম ভেঙে গেছে আওয়াজ শুনে। মা, ছুটে এসেছে। দেখছে, মেঝেতে শুয়ে আমি ব্যাথায় কাতরাচ্ছি। আমার পেটের কাছটা আর মাথার পিছনে, দুটো জায়গাতেই ভীষন ব্যাথা অনুভব করছি। আমি আর পারছি না।
মা বেশ ভয় পেয়ে গেল। আমাকে বলল, কি হয়েছে তোর?
আমি বললাম, মা, মনে হচ্ছে সেই আলসার কোলাইটিসের ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিয়েছে। ভীষন কষ্ট হচ্ছে।
মা বলল, আমাকে ডাকবি তো তুই? দেখেছ কান্ড। ওঠ, ওঠ, দেখি একটু কষ্ট করে।
আমার কাঁধটা ধরে, মা আমাকে ওঠানোর চেষ্টা করতে লাগল। নিজেই কেমন শক্তিশূণ্য হয়ে গেছি। মাকে বললাম, ‘মা দেখো তো ওষুধের বাক্সেতে কোলাইটিসের ওষুধটা আছে কিনা? ভীষন ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচবো না।’
- ‘দূর পাগল। অমন কথা মুখে আনতে আছে?’ মা, তাড়াতাড়ি ওষুধের বাক্স থেকে একটা ট্যাবলেট বার করে, আমার মুখে দিল। ফিল্টার থেকে জল গড়িয়ে আমার মুখে ঢালতে লাগল। আমাকে বলল, ‘আসতে আসতে ওঠার এবার চেষ্টা কর, আমি তোকে বিছানায় নিয়ে যেতে সাহায্য করছি। কেন ব্যাথাটা কি খুব বেশী হচ্ছে?’
মাকে বললাম, উঠতে পারছি না মা, ভীষন ব্যাথা হচ্ছে। আমি আর পারছি না।’
আমার কষ্ট দেখে মা ভীষন নার্ভাস হয়ে পড়েছে, বুঝতে পারছি মা না এবার কাঁদতে শুরু করে দেয়। হঠাৎই দেখছি, আমার মাথার কাছে বিদিশা। আমাকে বলছে, ‘ওঠো একটু চেষ্টা করে। তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়, তাহলে আমারই বা চলবে কি করে?’
ভীষন কাঁদছে বিদিশা। আমি ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার হাত বিদিশার চোখের কাছে কিছুতেই পৌঁছোচ্ছে না।
কেন এমন হচ্ছে আমার? ভীষন বাজে একটা অসুখ। চোখে শুধু ঝাপসা দেখছি। মাথাটাও ঘুরছে বনবন করে। আবঝা আবঝা দেখছি, সারা ঘর জুড়ে শুভেন্দু, রনি, মাধুরী এমনকি শুক্লাও অস্থিরভাবে ঘোরাঘুরি করছে। আমার দিকে ওরা ঘনঘন তাকাচ্ছে, আমার দিকে হাত বাড়াতে চাইছে অথচ আমার এই অস্থির অবস্থা দেখেও, ওরা যেন আমার জন্য কিছুই করতে পারছে না।মা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘ওঠ, খোকা। একটু চেষ্টা কর। আমি তোকে ধরছি। ওষুধ তো খেয়েছিস। এবারে ব্যাথা কমে যাবে। একটু চেষ্টা কর। একটু ধৈর্য ধর।’
কোনরকমে মা’কে ধরে আমি ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। শরীরের সমস্ত রয়ে যাওয়া শক্তিগুলো দিয়ে মায়ের হাতটা ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। আবার শরীরটা মাটিতে আছড়ে পড়ল। কে যেন মেঝের সঙ্গে আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চাইছে। শরীরটা মেঝের সঙ্গে একেবারে গেঁথে গেছে। পৃথিবীর যেন কোন শক্তিই নেই, আমাকে টেনে তোলে।
ভগবান আমাকে দয়া কর। আমি বাঁচতে চাই। ওহ্ কি কষ্ট, কি যন্ত্রণা। কি ভয়ানক ব্যাথা। আমার পেট থেকে এখন সারা শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে ওই ব্যাথাটা। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমার চোখের পাতা বুজে গেল। কাল সকালে চোখ খুলে সূর্যের মুখটা আমি বোধহয় আর দেখতে পারব না।
জ্ঞান হারাবার আগে, শেষবার মায়ের মুখ থেকে একটা চীৎকার শুনলাম। মা চেঁচিয়ে উঠল খোকা বলে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।
সকালে চোখ খুলে দেখি, বিছানায় শুয়ে আছি। কি করে ওই অবস্থায় বিছানায় এলাম তাও জানি না। আমার মাথার কাছে দেখি মা বসে আছে। ডাক্তার এসেছেন। আমাকে পরীক্ষা করছেন, আমার তলপেট চেপে চেপে দেখছেন, ব্যাথাটা আছে না চলে আছে।
ওনার নাম ডাক্তার এস বাসু। আমাদের হাউজ ফিজিশিয়ান। সব কিছু পরীক্ষা টরীক্ষা করে বললেন, শেষ কবে হয়েছিল, কোলাইটিস?
আমি বললাম, তাও সাত আট বছর আগে।
আমাকে বললেন, এখনো মিল্ক প্রোডাক্ট খাও তুমি?
আমি বললাম, না ও তো অনেক দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
ডাক্তার বললেন, ‘রোগটা এমনই। সামান্য কিছু থেকেই আবার ফর্ম করে নেয়। তাও ভয়ের কিছু নেই। তোমার কপাল ভাল, অত রাত্রে তোমার বন্ধু চলে এসেছিল গাড়ী নিয়ে। তোমার মা ভাগ্যিস তাকে ফোন করেছিলেন। আমাকেও ফোন করেছিলেন। আমি অত রাত্রে এসে দেখি, তোমার বন্ধু তার আগেই তোমাকে ওঘর থেকে তুলে এঘরে নিয়ে এসেছে। চোখে মুখে জল দিয়ে তোমার জ্ঞান ফেরানোর অনেক চেষ্টা করছে। আমি এসে তোমাকে আবার ওষুধ দিই। ব্যাথাটা ভাগ্যিস আর বাড়ে নি। তাহলে আবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হত। এখন কদিন ভারী খাবার একদম খাবে না। দু তিনদিন হালকা কিছু খাও। আর ঠান্ডা খাবার খাবে। গরম করা কোন জিনিষই নয়। তিন চারদিন বাড়ীতে পুরো রেস্ট নিতে হবে। অফিস, কাজ বন্ধ। তারপর তুমি আবার পুরোপুরি সুস্থ।’
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম, মা’কে বললাম, কে এসেছিল মা?
মা বলল, ‘শুভেন্দু।’
তুমি ফোন করেছিলে ওকে? অত রাত্রে?
মা বলল, ‘কি করব বল? আমার টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে তখন। তোর যদি কিছু হয়ে যেত?’ বলেই মা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।