03-07-2021, 11:03 PM
যতক্ষণ আমার কাছে বসেছিল সৌগত, কথায় কথায় এটাও আমাকে বলেছিল, ‘আমার কেন জানি না দেব, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যেন একটা খুব ভুল করে ফেলেছি।’
ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কি ভুল করেছিস তুই?’
সৌগত সেই সময় মিনুর প্রসঙ্গটা তুললো। আমাকে বলল, ‘মিনুর জন্য তোকে বোধহয় সেই হ্যাপাটা এখনো পোয়াতে হচ্ছে? সেই ওর বোনকে গান শেখানোর ব্যাপারটা? ভীষন বেয়ারা মেয়ে। একবার কারুর পিছু নিলে, সহজে তাকে ছাড়তে চায় না।’
ওকে হেসে বললাম, ‘না না, সেতো কবেই আমি সেই পাট তুলে দিয়েছি। এখন আর ওর বোনকে গান শেখাতে যাই না। সেই প্রথম প্রথম কদিন গিয়েছিলাম, তারপরে যাওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’
সৌগত বলল, ‘কলেজ ছাড়ার পরে আর মিনুদের বাড়ী আর যাসনি?’
ওকে বললাম, ‘শ্যামল মিত্রর এক ছাত্রের কাছে আমি কিছুদিন তালিম নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল মিনুর বোন রীনাকে ওখানে পাঠিয়ে দেবার। কিন্তু মিনু রাজী হল না। গোঁ ধরে বসে থাকলো। আমার কি ওখানে যেতে আর ইচ্ছে করে? তুই তো বিদিশার ব্যাপারটা জানিস। ও পছন্দ করে না রীনাকে গান শেখাতে আমি যাই বলে। সেই শেষ দিন থেকে মিনুর প্রতি বিদিশার একটা বিতৃষ্মা। বিদিশা মিনুকে সহ্য করতে পারে না। নাম শুনলেই ক্ষেপে ওঠে। আমি যে মিনুর বাড়ীতে এখন যাই না। সেটা ওকে বললেও অবিশ্বাস করে ওঠে। বলে সত্যি বলছ তো? কি জানি তোমার কথা বিশ্বাস করলেও। মিনুকে আমার একদম বিশ্বাস হয় না।’
সৌগত বলল, ‘লাস্ট কবে গিয়েছিলিস মিনুর বাড়ীতে?’
আমি বললাম, ‘তাও নয় নয় করে মাস ছয়েক তো হয়ে গেল। এখন যাওয়া একদমই বন্ধ করে দিয়েছি।’
সৌগত বলল ভালো, এইজন্যই তো মিনুকে আমি বিয়েতে নেমতন্ন করতে চাই না। ওখানে বিদিশাও আসবে। মিনুকে দেখলে বিদিশা একেবারেই চটে যাবে। কি করতে কি করে বসবে মিনু। ওকে বোঝা খুব মুশকিল।’
সৌগত এরপরে চলে গেল। ভাবিনি মাস ছয়েক পরে হঠাৎই মিনুর আবার দর্শন পাবো। সেদিনই সন্ধেবেলা মিনুর হঠাৎই আবির্ভাব ঘটল আমার বাড়ীতে। সাথে ওর বোন রিনাকেও নিয়ে এসেছে। বেশ সেজেগুজে এসেছে মিনু। আমাকে বলল, দেব, তোর জন্য একবাক্স মিষ্টি নিয়ে এসেছি। রীনা খুব ভালোভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। তুই ওর গানের গুরু। ওকে ভাল করে আশীর্ব্বাদ কর।’
রীনা মাথা হেট করে, ঝুঁকে প্রনাম করল আমাকে। ওকে বললাম, ‘থাক থাক আর প্রনাম করতে হবে না। তা গান টান কি গাইছ? নাকি ছেড়ে দিয়েছে সব?’
রীনা ঘাড় নেড়ে বলল, এখনো গাইছি, ছেড়ে দিই নি এখনো। তবে আপনাকে খুব মিস করি। আপনি তো আর আমাদের বাড়ী আর আসেন না। আসুন না একদিন।’
ঠিক সেভাবে ওকে জোর দিয়ে বলার মতন আমার আর কিছু ছিল না। মিনু আমাকে পটানোর জন্য ওর বোনকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, সেটাও বুঝতে পারলাম। পাছে আমি না বলে ফেলি, মিনু আগে থেকেই রীনাকে বলল, ঠিকই যাবে। তুই ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? এখন দেবদার সময়ের খুবই অভাব। দেবদার এখন অনেক দায়িত্ব। চাকরী করতে হবে। বিয়ে করে বউকে খাওয়াতে হবে। তোর জন্য ভাড়ী দেবদার দরদ? তবে তুই বলছিস যখন, ঠিকই যাবে। কি ‘দেব’ যাবি না?’
আমি রীনার সামনে মিনুকে সেভাবে কিছু বললাম না। শুধু বললাম, ‘যাব একদিন। এই সামনে সৌগতর বিয়ে। ওর বিয়েটা হয়ে যাক। তারপরে সময় করে একদিন যাব। তোমাদের বাড়ী যাবার পথে কলেজেও একবার ঘুরে আসব।’
মিনু জানতো, আমি শুধুই ওর বোনকে সান্তনা দিচ্ছি। যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই আমার। আমাকে বলল, সৌগতর বিয়েতে যাবি নিশ্চই? তোকে কার্ড দিয়েছে। কই আমাকে তো দিল না?’
আমি বললাম, ‘হয়তো পরে দেবে। এখনও অবধি আমাকে ছাড়া কাউকেই কার্ড দেয় নি ও।’মিনু যেন পরিকল্পনা করেই এসেছিল। আমাকে বলল, ‘কাল বাড়ীতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তোকে কিন্তু আসতে হবে।’
হঠাৎ কিসের অনুষ্ঠান, কিছুই আমি জানি না। বেশ ভ্যাবাচাকা খেযে গেলাম। মিনু বলল, ‘আসলে রীনা ভালভাবে পাশ করেছে তো। তাই কজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ীতে ডাকছি। তুই ও আসবি, একটু আনন্দ আর হৈহুল্লোর হবে।’
আমি প্রায় মুখের ওপরেই না বলতে যাচ্ছিলাম। মিনু বলল, ‘কেন বিদিশা রাগ করবে তোর ওপর? আমি যদি ওকেও বাড়ীতে ডাকি।’
বেশ অবাক হলাম মিনুর কথা শুনে। বিদিশাকে ও বাড়ীতে আসতে বলবে। আর বিদিশাও ওর কথাশুনে একডাকে ছুটে যাবে। কখনোই সেটা সম্ভব নয়। মিনুকে বললাম, ‘শুধু শুধু বিদিশাকে কেন বলতে যাবি? ও তোর ওখানে যাবে না।’
মিনু একটা গম্ভীর মতন হয়ে গেল। আমাকে বলল, ‘তাহলে তুই আসবি তো?’
আমি বললাম, ‘কথা দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করব।’
রীনাকে নিয়ে মিনু একটু পরে চলে গেল। আমাকে বলে গেল, ‘রীনার কথা ভেবে অন্তত আয়। তোকে কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন তোকে আমার বাড়ীতে আসতে বলব না।’
আজ মনে পড়ে সেদিন কিন্তু মিনুর বাড়ীতে আমি গিয়েছিলাম। বিদিশা যাইনি। বিদিশাকে বলেই আমি মিনুর বাড়ীতে গিয়েছিলাম। মনে মনে একটু অসুন্তষ্ট হয়েছিল বিদিশা। ওকে বলেছিলাম। বোনটার পাশের জন্য বাড়ীতে একটা পাটি দিচ্ছে মিনু। রীনা যদি আমাকে না বলতো, আমি হয়তো ওর বাড়ীতে যেতাম না।
পরের দিন মিনুর বাড়ীতে বেশ কিছু ঘন্টা আমি ছিলাম। ও কিন্তু একবারও বুঝতে দেয় নি ওর অভিসন্ধিটা। আমার কাছ থেকে বিদিশার ফোন নম্বরটা নিয়েছিল, বিদিশাকে ফোনও করেছিল, অথচ আমাকে বিদিশা সেকথা বললেও মিনু একবারও তা বলেনি।
বিদিশা ভাবতেই পারেনি, মিনু ওকে ফোন করবে। ফোনটা যখন করেছে, বিদিশার মা ধরেছিল। মিনু নিজের পরিচয় দেয় নি। বিদিশা এসে ফোনটা ধরতেই ওকে ঠেস মেরে বলেছিল, ‘কালতো দেব আসছে আমার বাড়ীতে। তুমি আসবে নাকি?’
আমাকে একনাগাড়ে কতকিছু বলে গেল বিদিশা। মিনুর বাড়ী থেকে ফেরার পর ফোন করে আমাকে বলল, ‘সখ মিটেছে তোমার? আঁশ মিটেছে? ধন্যি মেয়ে বাপু। এখনো তোমার পিছন ছাড়ে না।’
সেদিন বিদিশার মুখে ওই কথা শুনে মিনুর ওপরে আমিও খুব চটে গিয়েছিলাম। ভাবিনি আরো কত পরিকল্পনার জাল বিস্তার করে রেখেছে মিনু। তার কিছুদিন পরেই ঘটল আর একটি মারাত্মক ঘটনা।
সেদিন ছিল রবিবার। মা বলল, সোদপুরে আমার বড়মামার বাড়ীতে যাবে। বাড়ীতে রান্না সব করাই আছে। শুধু ভাতটা ফুটিয়ে নিলেই হবে। বিদিশাকে ফোন করলাম। বিদিশা বলল, ‘বাড়ীতে একা রয়েছ বলে আমাকে ডাকছ? কি করবে তুমি?’
আমি বললাম, ‘কেন এর আগে যখন একা ছিলাম, তুমি বুঝি কোনদিন আসোনি আমার বাড়ীতে? মা, এই একটু পরেই বাড়ী থেকে বেরোবে। তারপরে সারাদিন আমি শুধু একা। এই মূহূর্তে একজনকে আমার খুব দরকার। বিদিশা ছাড়া আর কারুর নাম এই মূহূর্তে মনে করতে পারছি না।’
বিদিশা বলল, ‘বাহ্ আমাকেও তো বলে বেরোতে হবে। রবিবারে বাড়ী থেকে বেরুচ্ছি। বাড়ীতে বললেই তো বুঝে যাবে। মা বাবা তো জেনেই গেছে, তোমার বাড়ীতে যাবার জন্য আমি সবসময় পা বাড়িয়ে রয়েছি।’বিদিশাকে বললাম, ‘শোন বিদিশা। আমি তোমার সাথে ছাড়া আর কারুর সাথে তো প্রেম করিনা। ফুলশয্যার রাতে স্বামী যেটা তার স্ত্রীর সাথে করে, সেটা যদি এই ফাঁকা বাড়ীতে হয়ে যায় মন্দ কি? সুযোগকে কখনো পায়ে ফেলতে নেই। একা একা বাড়ীতে বসে তোমার স্বপ্ন দেখবো, অথচ তুমি আসবে না এটা কি কখনো হয়? কখন আসবে বলো। মা কিন্তু ঠিক এক ঘন্টা পরেই বেরুবে।’
বিদিশা ফোনেই বলল, ‘তুমি কি করবে আমাকে? বিয়ের আগেই ফুলশয্যা সেরে নেবে? দাঁড়াও মাসীমাকে আমি বলছি।’
ওকে বললাম, ‘দেখো সৌগত বিয়েটা সেরে নিচ্ছে। তোমার আমার বিয়েটাও হয়তো হয়ে যাবে আর কিছুদিনের মধ্যে। বিয়ের আগে ফুলশয্যার প্র্যাকটিশটা করে নিতে অসুবিধে কি? মা তো সেই সুযোগই আমাদের করে দিয়ে যাচ্ছেন।’
একটু যেন ঘাবড়ে গেল বিদিশা। আমাকে বলল, এই না। তারপরে কি থেকে কি হয়ে যাবে। মরি আর কি?ওসব সখটক তোমার পূরণ হবে না বাপু। বলোতো এমনি আমি যেতে পারি।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা বিদিশা? তুমি আসবে, আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। তোমার শরীর আমাকে ছুঁয়ে যাবে, আমার হৃদয়কে চঞ্চল করে তুলবে। সেই আশা নিয়েই তো আমি তোমাকে ডাকছি। তোমার কি মনে হয় না প্রেম মানেই একটা নিবিড় মূহূর্ত? যেখানে প্রেমের সাথে থাকবে একটু চুমোচুমি। নারীর সাহচর্য এক মধুর অনুভূতি। এর থেকে আমাকে কেন বঞ্চিত করছ বিদিশা? তুমি কি চাওনা মাঝে মধ্যে এই সখগুলো আমি পূরণ করি। মাঝে মধ্যে গোপণ খেলাটা খেললে অসুবিধা কি বিদিশা? তুমি এখুনি চলে এস। দেরী কোরো না।’
বিদিশা একপ্রকার নাই বলে দিল আমাকে। আমাকে বলল, ‘তোমার গোপণ খেলা আমি বার করছি। আজ তুমি জব্দ। বেশ হয়েছে। আজ বাড়ীতে একা থাকো। আমি আর যাচ্ছি না।’
একটু হতাশই হলাম। ভাবলাম, ঠিক আছে বিদিশা যদি না আসে, ঘুরতে ঘুরতে বিকেলবেলা ওর বাড়ীতেই চলে যাব। সময়টা কিছুটা হলেও অন্তত কাটবে। বিদিশা না থাকলে, কিছুই আমার ভাল লাগে না।
মা একটু আগেই বড়মামার বাড়ীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন বাজে সকাল এগারোটা। সারাটা দিন বাড়ীতে বসে কি করব তাই ভাবছি। হঠাৎই দরজায় কলিংবেল। ছুটে গেলাম। ভাবলাম, বিদিশাই এসেছে বোধহয়। আমাকে চমকে দেবার জন্যই না বলেছে তখন ফোনে। আমার সাথে মজা করতে বিদিশাও খুব ভাল পারে।
দরজা খুললাম। সামনে দেখি বিদিশা নয়। মিনু দাঁড়িয়ে। এক গাল হেসে আমাকে বলছে। ‘চমকে গেছিস না? আসলে তোদের বাড়ীর খুব কাছেই একটা দরকারে আমি এসেছিলাম। ভাবলাম, একটু ঢুঁ মেরে যাই। আজ তো রবিবার। তুই নিশ্চই বাড়ী থাকবি। তা আমাকে ভেতরে আসতে বলবি না? নাকি দরজা থেকেই বিদায় করে দিবি।’
মিনু হাসছে। আর আমি ভাবছি, এ আবার অসময়ে কেন এল? কি মুশকিল, বিদিশাও যদি আবার এখন এসে পড়ে?