03-07-2021, 01:46 PM
নয়
অফিস থেকে বেরিয়ে শুক্লার বাড়ীর দিকে যখন আসছিলাম। ট্যাক্সিতে এফ এম এ খুব সুন্দর একটা কিশোর কুমারের গান হচ্ছিল। গানটা আমারও খুব ফেভারিট।
হে প্রিয়তমা, আমি তো তোমায়, বিদায় কখনো দেবো না।
শুনে মনে হল, সত্যি তাই। বিদিশাকে আমি নিজে থেকে কখনও বিদায় দিতে পারি না, এক সে যদি নিজে থেকে না চায়। আমার মনের মধ্যে আশাটা কিছুটা হলেও এখনো যেন বেঁচে আছে। বিদিশাকে আমি চাই। শেষ পর্যন্ত যে করেই হোক বিদিশাকে আমি ফিরে পেতে চাই।
ঠিক তার পরে পরেই কিশোর কুমারের আর একটা গান শুরু হল, গানটা হল, ‘আজ থেকে আর ভালোবাসার নাম নেবো না আমি। যারে দিয়েছিলাম, যা কিছু তা আমার চেয়েও দামী। নাম নেবো না আমি।’
এবার আমার মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘দাদা এই যে লোকটার গান শুনছেন না? ইনি তো অমর শিল্পী কিশোর কুমার। কিন্তু লোকে বলে ইনি নাকি মরে যাবার আগের দিন পর্যন্ত প্রেমিক ছিলেন। চার চারটে বিয়ে করেছেন, ভালোবাসা ওনার কাছে অফুরন্ত ছিল।
আমি বললাম, কিশোর কুমার সন্মন্ধে আমি যা জানি, তা আর কেউ জানে না। একসময় কিশোরের গান গেয়েও অনেকের প্রশংসা কুড়িযেছি। লোকটার জীবনে প্রেম অনেক ছিল তাও জানি। কিন্তু লোকটার জীবনে একটা ব্যাথাও ছিল। সেটা বাইরে থেকে ওর পাগলামী দেখে কেউ বুঝতে পারত না। কিশোর কুমার নিজেও এমন ছিলেন, কাউকে বুঝতে দিতেন না।
ঠিক সন্ধে সোয়া সাতটা নাগাদ ট্যাক্সিটা শুক্লার ফ্ল্যাটের নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। গাড়ীতে আসতে আসতে এরমধ্যেই শুক্লার ২বার ফোন এসে গেছে আমার মোবাইলে। আমি যে সত্যি আসছি কিনা সেটা ও ফোন করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। যাচাই করে দেখে নিতে চেয়েছে আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি কিনা? আমার কাছ থেকে কনফারমেশন পেয়ে খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছে শুক্লা। এতটা আনন্দ পেতে আমি বিদিশাকেও কোনদিন দেখিনি।
আমি ট্যাক্সি থেকে নামলাম। ভাড়া মিটিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। এসেছি তো ঠিক জায়গায়। কিন্তু বাড়ীর নম্বরটা খুঁজে পাচ্ছি না। সল্টলেকে এই এক অসুবিধে। প্রথমবার এলে বাড়ী খুঁজে নিতে বেশ ঘাম ঝরাতে হয়। অ্যাডড্রেশ জানার জন্য এলাকার কোনো লোক পেয়েগেলে সুবিধে। নচেৎ একবার এমাথা থেকে ওমাথা, নয়তো এ গলি ও গলি ঘোরাটাই শুধু সার।
শুক্লা বলেছে, সাদা রংয়ের চারতলা বাড়ী। প্রতিটা ফ্লোরে দুটো করে ফ্ল্যাট। দ্বোতলায় উঠে পেছন দিকের ফ্ল্যাটটাই শুক্লাদের অর্থাৎ শুক্লার। আমার অসুবিধে হয় বাড়ী খুঁজতে তাহলে ওকে মোবাইলে ফোন করতে।
কপাল ভালো দুটো বাড়ী পরেই ওই চারতলা সাদা বাড়ীটা দেখতে পেয়ে গেলাম। শুক্লাকেও আর ফোন করতে হল না। যখন ওর ফ্ল্যাটের দিকে এগোতে লাগলাম, মনের ভেতরে শুক্লাকে নিয়ে জমে থাকা সন্দেহগুলো আসতে আসতে দূর হতে লাগল। মনে হল, শুক্লা আমাকে কিছুই সেরকম বলেনি। বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে হঠাৎই প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কের সূচনা। শুক্লা সেরকম তো কিছুই আভাস দেয় নি। অথচ শুভেন্দু আর রনি ওকে সন্দেহ করছে, আসলে বিদিশার প্রতি শুক্লার এই বিদ্বেশ মনোভাব, শুভেন্দু আর রনিকে তাই এতটা চটিয়ে দিয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। দু তিন ঘন্টা শুক্লার সাথে জমিয়ে গল্প করব, এই উদ্দেশ্য নিয়েই ওর ফ্ল্যাটের কলিংবেল টিপছি। মনে হল, কে যেন আমার কানে কানে বলে দিল, ‘আবার তুমি ভুল করতে চলেছ দেব। সবাইকে এত অন্ধবিশ্বাস করো তুমি? ওকি তোমায় এমনি এমনি ডেকেছে এখানে? নিশ্চই কোনো উদ্দেশ্য আছে। মিনুকে বিশ্বাস করে তুমি যে ভুলটা করেছ, আবার শুক্লাকেও বিশ্বাস করে দ্বিতীয়বার ওই ভুলটা কোরো না। দেব তুমি ভীষন সরল। এই সরলতার জন্যই আজ জীবনে এত খেসারত দিচ্ছ বারবার। একই ভুল তুমি কোরো না।’
আমার মুখটা কেমন গম্ভীর মতন হয়ে গেল। যেন একটা ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে আমি শুক্লার বাড়ীতে এসেছি। শুক্লা দরজা খুলে আমার ঐ ফ্যাকাসে মুখটাই দেখল। আমাকে বলল, ‘এ কি রে? কি হয়েছে তোর? এত মুখ ভার কেন তোর? আয় আয় ভেতরে আয়। শুক্লাকে তো পাত্তাই দিচ্ছিলি না তুই। দেখ, আমিই তোকে এখানে আসতে বাধ্য করালাম।’
ফ্ল্যাটে ঢুকেই শুক্লা আমাকে ওর ড্রয়িং রুমটায় বসতে বলল। বেশ সুন্দর সাজিয়েছে ফ্ল্যাটটা। দেওয়াল জুড়ে শুধু কাঁচের আলমাড়ী। থাক থাক করে সাজানো গল্পের বই। শুক্লা গল্পের বই পড়তে খুব ভালোবাসতো আমি জানতাম। আমাকে বলল, ‘এগুলো সব আমার কালেকশন। গতবারে বইমেলা থেকেও অনেক বই কিনেছি আমি। একা একা থাকি। গল্পের বই পড়ে সময় কেটে যায়। কিছু তো করতে হবে। পুরোনো সেই সখটা আমার এখনো রয়ে গেছে বলতে পারিস।’
আমি জানি শুক্লা খুব ভালো ছবি আঁকতেও পারে। দেওয়ালে খুব বড় একটা আঁকা ছবি দেখলাম। ছবিটা খুব সুন্দর করে বাঁধানো। শুক্লাকে বললাম, ‘এটা নিশ্চই তোর আঁকা? বাঃ সুন্দর হয়েছে ছবিটা।’
এক যুবক স্বপ্নাতুর চোখে নীল আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে, আকাশের নীলিমার মাঝে একটা নারীমুখ ভেসে উঠেছে। যেন সুন্দরী ওই নারী যুবকের কোনো স্বপ্নের নারী। যুবক তাকেই চিন্তা করছে। আর সমস্ত পৃথিবীটা যেন রোদে স্নান করছে। রঙটাই আসতে আসতে পাল্টে যাচ্ছে।
‘কি করেছিস রে? এ তো অনন্য কীর্তি। শিল্পের ছোঁয়া। এমন ছবি তো দেখাই যায় না।’
শুক্লা বলল, ‘এ ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা তো আমি তোর কাছ থেকেই পেয়েছি। তুই জানিস না?’
আমি অবাক হলাম, শুক্লা বলল, ছবিটা আঁকতে শুরু করার সময়, আমি একটা সূত্র থুঁজে বার করার চেষ্টা করছিলাম। ভাবছিলাম, ঐ যুবকটা যদি দেব হয়, তাহলে ওর স্বপ্নের নারীটা কে? যাকে চিন্তা করে করেই দেব এতটা লাইফ কাটিয়ে দিল। বিদিশা ছাড়া নিশ্চই আর কেউ নয়।’
মনে হল, এই রে আবার বিদিশাকে নিয়ে শুরু করল শুক্লা। এবারে দেখছি আমাকে পালাতে হবে এখান থেকে। ওকে বললাম, ‘তুই কিন্তু আমাকে সকালে যা বলেছিলিস, তার একবর্ণও মিলছে না এখন। কেন বিদিশার কথা তুলছিস? থাক না ওই প্রসঙ্গ। তুই অন্য কথা বল।’
শুক্লা বলল, ‘ভয় হয়। তুই যদি আবার রাগ করে উঠিস। ছবিটার কথা উঠলো বলে তাই তোকে বললাম। তা চা খাবি তো? নাকি ওটার কথাও বলতে পারবো না তোকে?’
হেসে বললাম, ‘নিশ্চই খাবো। তবে শুধু চা। চায়ের সাথে অন্য কিছু নয়।’
শুক্লা বলল, ‘অফিস থেকে ফিরলি। শুধু চা কেন? আমি সিঙ্গারা, নিমকি এসব আনিয়েছি। এক্ষুনি তোকে দিচ্ছি।’
এতবড় ফ্ল্যাটটায় শুক্লা এখন একা থাকে। ওকে বললাম, ‘তোর আত্মীয়সজন, রিলেটিভ, বন্ধু বান্ধবরা কেউ আসে না? একা একা থাকিস, বই পড়ে আর ছবি এঁকেই কি সময় কেটে যায়?’
শুক্লা বলল, ‘আমার মাসীরা আসে মাঝে মাঝে। দুই মাসী আছে আমার। দুজনেই মায়ের থেকে কয়েকবছরের ছোট। বিয়ের সময় এক মাসী সন্মন্ধটা করে বিয়েটা ঠিক করে দিয়েছিল আমার। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর, মাসীর মনে একটা আফসোসটা থেকে গেছে। মাঝে মাঝে আমাকে সান্তনা দিতে আসে। মা, বাবা কেউ তো এখন বেঁচে নেই। তাদের অভাবটা আমি অনুভব করি। কেউ এলে ভালোই লাগে। মাঝে মধ্যে আমার জ্যাঠাও আসে। বেহালায় যেখানে আমরা থাকতাম, ওখান থেকে কিছুটা দূরেই জ্যাঠাদের বাড়ী। আমার খবর নিতে মাঝে মাঝে জ্যাঠা এখানে আসে। আর আসে চুমকী বলে একটা মেয়ে। ও বিবাহিতা। আমার অফিসে চাকরী করে। আমার কলিগ। মাঝে মধ্যে আড্ডা দিতে আমার এখানে চলে আসে।’
‘বাড়ীতে কাজের লোক?’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। অমলা বলে একটা কাজের বউ আছে। দুবেলা কাজ করে চলে যায়। ওর সাথে কথা বলেও আমার সময়টা কেটে যায়।’
জীবনটা বড়ই কঠিন দেব। আমরা যতটা সহজ মনে করি। জীবন ততটা সহজ নয়। অনেক ঝড় ঝাপাটা আছে, অনেক বাঁধা আছে। আমাদের সবাইকেই সেগুলো অতিক্রম করতে হয়। কেউ পারে, কেউ পারে না। আমি নতুন ভাবেই জীবনটাকে আবার সাজানোর চেষ্টা করছি। জানি সুখ ফিরিয়ে দেবার মতন, সেরকম আমার জীবনে কেউ নেই। তবুও একটা চেষ্টা। একটা আশা। যদি কিছু-
আমি বললাম, ‘তুই তো আবার একটা বিয়ে করতে পারিস। ভালো চাকরি করিস। তোর তো পাত্রের অভাব হবে না। তাছাড়া ডিভোর্স হয়ে গেলেই যে জীবন শেষ হয়ে যায় তা তো নয়। ভগবান তোর জন্য হয়তো কোনো অন্য পরিকল্পনা করে রেখেছে।’
শুক্লা হেসে বলল, ‘পরিকল্পনা? ভালোই বলেছিস। হ্যাঁ। সেরকমই তো কিছু মনে হচ্ছে। তবে কি জানিস তো? মনের মিল হওয়াটা আজকালকার দিনে বড়ই কঠিন ব্যাপার। স্বামীরা স্ত্রীকে প্রাধান্য দিতে দিতে শেষকালে এতটাই প্রাধান্য দিয়ে বসে তখন শুরু হয় মতের অমিল। ইগো ক্ল্যাশ। তাসের ঘরের মত হূড়মূড় করে বিয়েটা তথন ভেঙে পড়ে। আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে, কিছুই তখন তার দাম থাকে না।’
আমি বললাম, আর স্বামীদের ক্ষেত্রে?
শুক্লা বলল, ‘স্বামীরা যদি বউকে একেবারেই সময় না দেয়, তখন এই সমস্যাটা হয়। বিয়ে করা বউ মানেই তো সে আমার দাসী নয়। তারও সখ আহ্লাদ আছে। মনের ইচ্ছা পূরণ করার তাগিদ আছে। কিন্তু সেরকম স্বামী না জুটলে সে বউয়ের কষ্ট বোঝে না। তখন সংসারটা ছাড়খাড় হয়ে ভেঙে যায়। সাত পাকে বাঁধার কোনো দাম থাকে না।’
আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, ‘হঠাৎ তোর লাইফে কেন এমন ঘটল, কারণটা আমাকে বলতে পারবি?’
শুক্লা হেসে বলল, ‘কেন বললে, তুই আমাকে বিয়ে করবি?’
আমি বললাম, ‘তোর তো ইয়ার্কী মারাটা স্বভাব। ভাবিস, দেব কে একটু টেনশনে ফেলে দিই আর কি? আমি ওতে অত ঘাবড়াচ্ছি না। যাকে এতদিন ধরে দেখে আসছি, আমার থেকে ভাল কেউ তোকে চেনে না।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। এটা তুই ঠিক বলেছিস, আমি অন্যের চোখে খারাপ হলেও, তোর চোখে কোনদিন খারাপ হবো না। তবে জানি না কেন তুই আমার উপরে চটে গেলি? কাল অতবার তোকে ফোন করলাম, সকালেও ফোন করলাম। অথচ ফোন ধরছিস না। আমি ভাবছি, তুই আমার ওপরে রেগে আছিস বোধহয়।’
আমার মুখটা কেমন গম্ভীর মতন হয়ে গেল। যেন একটা ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে আমি শুক্লার বাড়ীতে এসেছি। শুক্লা দরজা খুলে আমার ঐ ফ্যাকাসে মুখটাই দেখল। আমাকে বলল, ‘এ কি রে? কি হয়েছে তোর? এত মুখ ভার কেন তোর? আয় আয় ভেতরে আয়। শুক্লাকে তো পাত্তাই দিচ্ছিলি না তুই। দেখ, আমিই তোকে এখানে আসতে বাধ্য করালাম।’
ফ্ল্যাটে ঢুকেই শুক্লা আমাকে ওর ড্রয়িং রুমটায় বসতে বলল। বেশ সুন্দর সাজিয়েছে ফ্ল্যাটটা। দেওয়াল জুড়ে শুধু কাঁচের আলমাড়ী। থাক থাক করে সাজানো গল্পের বই। শুক্লা গল্পের বই পড়তে খুব ভালোবাসতো আমি জানতাম। আমাকে বলল, ‘এগুলো সব আমার কালেকশন। গতবারে বইমেলা থেকেও অনেক বই কিনেছি আমি। একা একা থাকি। গল্পের বই পড়ে সময় কেটে যায়। কিছু তো করতে হবে। পুরোনো সেই সখটা আমার এখনো রয়ে গেছে বলতে পারিস।’
আমি জানি শুক্লা খুব ভালো ছবি আঁকতেও পারে। দেওয়ালে খুব বড় একটা আঁকা ছবি দেখলাম। ছবিটা খুব সুন্দর করে বাঁধানো। শুক্লাকে বললাম, ‘এটা নিশ্চই তোর আঁকা? বাঃ সুন্দর হয়েছে ছবিটা।’
এক যুবক স্বপ্নাতুর চোখে নীল আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে, আকাশের নীলিমার মাঝে একটা নারীমুখ ভেসে উঠেছে। যেন সুন্দরী ওই নারী যুবকের কোনো স্বপ্নের নারী। যুবক তাকেই চিন্তা করছে। আর সমস্ত পৃথিবীটা যেন রোদে স্নান করছে। রঙটাই আসতে আসতে পাল্টে যাচ্ছে।
‘কি করেছিস রে? এ তো অনন্য কীর্তি। শিল্পের ছোঁয়া। এমন ছবি তো দেখাই যায় না।’
শুক্লা বলল, ‘এ ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা তো আমি তোর কাছ থেকেই পেয়েছি। তুই জানিস না?’
আমি অবাক হলাম, শুক্লা বলল, ছবিটা আঁকতে শুরু করার সময়, আমি একটা সূত্র থুঁজে বার করার চেষ্টা করছিলাম। ভাবছিলাম, ঐ যুবকটা যদি দেব হয়, তাহলে ওর স্বপ্নের নারীটা কে? যাকে চিন্তা করে করেই দেব এতটা লাইফ কাটিয়ে দিল। বিদিশা ছাড়া নিশ্চই আর কেউ নয়।’
মনে হল, এই রে আবার বিদিশাকে নিয়ে শুরু করল শুক্লা। এবারে দেখছি আমাকে পালাতে হবে এখান থেকে। ওকে বললাম, ‘তুই কিন্তু আমাকে সকালে যা বলেছিলিস, তার একবর্ণও মিলছে না এখন। কেন বিদিশার কথা তুলছিস? থাক না ওই প্রসঙ্গ। তুই অন্য কথা বল।’
শুক্লা বলল, ‘ভয় হয়। তুই যদি আবার রাগ করে উঠিস। ছবিটার কথা উঠলো বলে তাই তোকে বললাম। তা চা খাবি তো? নাকি ওটার কথাও বলতে পারবো না তোকে?’
হেসে বললাম, ‘নিশ্চই খাবো। তবে শুধু চা। চায়ের সাথে অন্য কিছু নয়।’
শুক্লা বলল, ‘অফিস থেকে ফিরলি। শুধু চা কেন? আমি সিঙ্গারা, নিমকি এসব আনিয়েছি। এক্ষুনি তোকে দিচ্ছি।’
এতবড় ফ্ল্যাটটায় শুক্লা এখন একা থাকে। ওকে বললাম, ‘তোর আত্মীয়সজন, রিলেটিভ, বন্ধু বান্ধবরা কেউ আসে না? একা একা থাকিস, বই পড়ে আর ছবি এঁকেই কি সময় কেটে যায়?’
শুক্লা বলল, ‘আমার মাসীরা আসে মাঝে মাঝে। দুই মাসী আছে আমার। দুজনেই মায়ের থেকে কয়েকবছরের ছোট। বিয়ের সময় এক মাসী সন্মন্ধটা করে বিয়েটা ঠিক করে দিয়েছিল আমার। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর, মাসীর মনে একটা আফসোসটা থেকে গেছে। মাঝে মাঝে আমাকে সান্তনা দিতে আসে। মা, বাবা কেউ তো এখন বেঁচে নেই। তাদের অভাবটা আমি অনুভব করি। কেউ এলে ভালোই লাগে। মাঝে মধ্যে আমার জ্যাঠাও আসে। বেহালায় যেখানে আমরা থাকতাম, ওখান থেকে কিছুটা দূরেই জ্যাঠাদের বাড়ী। আমার খবর নিতে মাঝে মাঝে জ্যাঠা এখানে আসে। আর আসে চুমকী বলে একটা মেয়ে। ও বিবাহিতা। আমার অফিসে চাকরী করে। আমার কলিগ। মাঝে মধ্যে আড্ডা দিতে আমার এখানে চলে আসে।’
‘বাড়ীতে কাজের লোক?’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। অমলা বলে একটা কাজের বউ আছে। দুবেলা কাজ করে চলে যায়। ওর সাথে কথা বলেও আমার সময়টা কেটে যায়।’
জীবনটা বড়ই কঠিন দেব। আমরা যতটা সহজ মনে করি। জীবন ততটা সহজ নয়। অনেক ঝড় ঝাপাটা আছে, অনেক বাঁধা আছে। আমাদের সবাইকেই সেগুলো অতিক্রম করতে হয়। কেউ পারে, কেউ পারে না। আমি নতুন ভাবেই জীবনটাকে আবার সাজানোর চেষ্টা করছি। জানি সুখ ফিরিয়ে দেবার মতন, সেরকম আমার জীবনে কেউ নেই। তবুও একটা চেষ্টা। একটা আশা। যদি কিছু-
আমি বললাম, ‘তুই তো আবার একটা বিয়ে করতে পারিস। ভালো চাকরি করিস। তোর তো পাত্রের অভাব হবে না। তাছাড়া ডিভোর্স হয়ে গেলেই যে জীবন শেষ হয়ে যায় তা তো নয়। ভগবান তোর জন্য হয়তো কোনো অন্য পরিকল্পনা করে রেখেছে।’
শুক্লা হেসে বলল, ‘পরিকল্পনা? ভালোই বলেছিস। হ্যাঁ। সেরকমই তো কিছু মনে হচ্ছে। তবে কি জানিস তো? মনের মিল হওয়াটা আজকালকার দিনে বড়ই কঠিন ব্যাপার। স্বামীরা স্ত্রীকে প্রাধান্য দিতে দিতে শেষকালে এতটাই প্রাধান্য দিয়ে বসে তখন শুরু হয় মতের অমিল। ইগো ক্ল্যাশ। তাসের ঘরের মত হূড়মূড় করে বিয়েটা তথন ভেঙে পড়ে। আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে, কিছুই তখন তার দাম থাকে না।’
আমি বললাম, আর স্বামীদের ক্ষেত্রে?
শুক্লা বলল, ‘স্বামীরা যদি বউকে একেবারেই সময় না দেয়, তখন এই সমস্যাটা হয়। বিয়ে করা বউ মানেই তো সে আমার দাসী নয়। তারও সখ আহ্লাদ আছে। মনের ইচ্ছা পূরণ করার তাগিদ আছে। কিন্তু সেরকম স্বামী না জুটলে সে বউয়ের কষ্ট বোঝে না। তখন সংসারটা ছাড়খাড় হয়ে ভেঙে যায়। সাত পাকে বাঁধার কোনো দাম থাকে না।’
আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, ‘হঠাৎ তোর লাইফে কেন এমন ঘটল, কারণটা আমাকে বলতে পারবি?’
শুক্লা হেসে বলল, ‘কেন বললে, তুই আমাকে বিয়ে করবি?’
আমি বললাম, ‘তোর তো ইয়ার্কী মারাটা স্বভাব। ভাবিস, দেব কে একটু টেনশনে ফেলে দিই আর কি? আমি ওতে অত ঘাবড়াচ্ছি না। যাকে এতদিন ধরে দেখে আসছি, আমার থেকে ভাল কেউ তোকে চেনে না।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। এটা তুই ঠিক বলেছিস, আমি অন্যের চোখে খারাপ হলেও, তোর চোখে কোনদিন খারাপ হবো না। তবে জানি না কেন তুই আমার উপরে চটে গেলি? কাল অতবার তোকে ফোন করলাম, সকালেও ফোন করলাম। অথচ ফোন ধরছিস না। আমি ভাবছি, তুই আমার ওপরে রেগে আছিস বোধহয়।’