02-07-2021, 11:47 PM
- ‘তুই বড্ড চিন্তা করিস আমাকে নিয়ে। আগে থেকে এতো নেগেটিভ চিন্তা করে নাকি রে বোকা। জীবনের সব কিছুই ভালো হয়। খারাপ বলে এই পৃথিবীতে কিছু নেই। ‘
- ‘আমি তোর কথা একটু বেশী চিন্তা করি বলেই তুই আমাকে খারাপ ভাবছিস তাই না?’
- ‘কেন? কোনোদিন দেখেছিস, আমি তোকে কখনও খারাপ বলেছি?’
- ‘আসলে এই কথাগুলো মনে এল, তোকে বললাম, কেন জানিস তো? তুই আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি জানি, দেবের কখনও খারাপ হতে পারে না। ও যখন কারুর খারাপ চায় না। ভগবান ওর ক্ষতি করতে পারে না। তবে যদি দেখি, তুই কখনো কষ্ট পাচ্ছিস, আঘাত পাচ্ছিস, তাহলে তোর জন্য আমিও খুব কষ্ট পাবো, এটা জেনে রাখিস।
শুক্লাকে বললাম, প্রথম প্রথম আমিও ভাবতাম, প্রেম টেম আবার কি? ওতো কিছু সময় নষ্ট। জীবনে প্রেম ভালোবাসার কোনো দাম নেই। কেরিয়ার গড়াটাই মূল লক্ষ্য। কিন্তু বিদিশা আমার ধারণাটাকে পুরো ভেঙে দিল। জানিস তো শুক্লা। কি মেয়ে ও। ওর সাথে যে প্রেম করে, সে বুঝতে পারে। এবার তুই ও একটা প্রেম কর আমার মতন।
শুক্লা বললো-ওসব প্রেম টেম আমার ধাতে সইবে না বাবা। কলেজে সবাই আমার বন্ধু। যেমন তুই বন্ধু, শুভেন্দু, রনি বন্ধু। সবাই আমার বন্ধু।
-আর সৌগত?
-ওর ব্যাপারটা তো আমি ভেবেই উঠতে পারছি না। যাকে আমি বন্ধু হিসেবেই ভাবছি, সে আমাকে তার প্রেমিকা হিসেবে ভাবছে। মনের মিল না হলে কি প্রেম করবো বল দেখি?
আমি বললাম,-আরে একদিনে কি মন মেলে নাকি? প্রেম শুরু কর। আসতে আসতে দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
শুক্লা বললো-আচ্ছা দেব, বিদিশা যে সবসময় আমাকে তোর সাথে কথা বলতে দেখে, ও কিছু বলে না তোকে? কিছু মাইন্ড করে না?
-কেন? মাইন্ড করবে কেন? বিদিশা তো জানে, তুই আমার শুধু বন্ধু। ওর মনে সেরকম কোনো সন্দেহ বা আশঙ্কা নেই।
-এই দেব। আমি একদিন বিদিশার সাথে একটু মজা করবো? তুই যদি কিছু মনে না করিস।
-কি?
-বিদিশাকে বলবো, তুমি যে দেবের সাথে প্রেম করো, জানো দেব আমার কথা ছাড়া, একপাও নড়চড় হয় না। ওকে যদি আমি বলি তোমার সাথে প্রেম চালিয়ে যেতে, তবেই ও তোমার সাথে দেখা করবে, কথা বলবে, নচেৎ নয়। দেব আমার কথায় ওঠে বসে।
শুক্লাকে বললাম-তুই বলে দেখতে পারিস। তবে মনে হয় বিদিশা তোর কথা বিশ্বাস করবে না। কারণ ও বুঝেই যাবে, তুই ওর সাথে ইয়ার্কী মারছিস।
-ঠিকই বলেছিস তুই। ও বুঝে যাবে। আমাকে মনে হয় অন্যকিছু বলতে হবে।
-কি বলবি?
-বলবো, তুমি যে দেবের সাথে প্রেম শুরু করেছো, জানো দেব আমার সাথেও প্রেম করে।
-ভাগ, কি যাতা বলছিস
-ভয় পেয়ে গেলি? আরে আমি তো ইয়ার্কী মারছি।
কলেজে মিনুর সাথে যেদিন আমার প্রথম চোখাচুখি। ক্যান্টিনে একবার ওর দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম, মিনুর দৃষ্টিটা কিরকম বাজে। মিনু আমার প্রতি আকর্ষিত। আমার ফর্সা চেহারা, টিকোলো নাক, গমগমে কন্ঠস্বর মিনুকে তখন এক অমোঘ আকর্ষনের ডাক দিয়েছে।শুভেন্দু এসে একদিন বললো, এই মিনুটা কি রে? জানে তুই বিদিশার সাথে প্রেম করিস, তাও তোর পেছনে পড়ে আছে। সৌগতকে ধরেছে, তোকে নাকি ওর বোনকে গান শেখাতে হবে। এই অন্যায় আবদারের কোনো মানে হয়? আর সৌগতটাই বা কিরকম? শুধু শুধু মিনুর কথা শুনে তোরও মাথা খারাপ করছে।
-আমি জানি, সৌগত সব আমাকে বলেছে।
-আমার তো মিনুকে একটা সস্তা মেয়েছেলে বলেই মনে হয়। কলেজে ঢ্যাড়া পিটিয়ে বেড়াচ্ছে। তোর নামে কিসব বলে বেড়াচ্ছে।
-কি বলেছে মিনু?
- ‘তোর গান নাকি ওর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তুই হলি গানের জাদুকর। গান গেয়ে মেয়েদের মন চুরি করার বিদ্যা যে তুই জানিস, আর কেউ জানে না। মিনু তোর জন্য পাগল। সে এখন খাওয়াদাওয়া ভুলে গেছে, সব ভুলে গেছে। সে এখন উন্মাদিনী। শোন দেব, আমার তো মনে হয়, মিনু হল, শয়তানি লোভী মাকড়শা। সহজে নিস্তার দেবে না তোকে। ওর সাথে কথা বলে, তুই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দে। তোর জীবনে বিদিশা ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই। কাউকেই তুই সে জায়গায় বসাতে পারবি না।’
পরের দিন মিনুকে ডাকলাম, ক্যান্টিনে। বললাম, কি ব্যাপার মিনু? কিসব শুনছি?
মিনু যেন কিছুই জানে না, আকাশ থেকে পড়ার মতন ভাব করলো, আমাকে বললো, কি শুনেছিস? কলেজে মিনু রোজই খবরে। আমাকে নিয়ে রোজই কিছু না কিছু কথা হয়। নতুন কি শুনেছিস সেটা শুনি।
-মিনু আমি চাই না। আমার নাম জড়িয়ে তুই কলেজে কাউকে কিছু বলিস। এটা ঠিক নয়, আমার সন্মন্ধে আর একজন খারাপ ভাবতে পারে।
-কে ভাববে তোকে খারাপ? দেব, আমি তোর ফ্যান। কলেজে বাকীরা যেমন তোর গান মুগ্ধের মত শোনে, আমিও তেমন শুনি। তোকে তো বলেছি, বোনটাকে তুই যদি গান শেখাতে রাজী হয়ে যাস, আমি তাহলে ধন্য হয়ে যাবো। তোর কাছে কৃতার্থ থাকবো দেব। এগুলো যারা বলেছে, তারা সব বাড়িয়ে বলেছে। সেরকম কিছু নয়।
চকিতে মিনু সেদিন মনের মধ্যে পাপটা রেখে পাল্টি খেয়ে গেলো। আমি ধরতেও পারলাম না, মিনু হল সুযোগ সন্ধানি। যেদিন সুযোগ পাবে, মোক্ষম চাল দিয়ে ও আমাকে ঘায়েল করবে।
আমি শুয়ে শুয়ে পুরোনো কথা সব চিন্তা করছি, অথচ মনে হলো, কে যেন আমার ভেতরে হাতুরী দিয়ে ঘা পিটছে। দুমদুম করে আওয়াজ করছে। আমার দু’গালে ঠাসঠাস করে দুটো চড় মেরে দিয়ে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে সে, আমার জামার বোতাম ছিড়ে রাগে দূঃখে, চেঁচিয়ে বলছে, ভালোমানুষের অভিনয়? ভালোই পারো তুমি তাই না? এসব গল্প লিখে লোককে বোকা বানাচ্ছো। নিজে ভালো সেজে কখনো মিনুকে খারাপ করছো, কখনো শুক্লাকে খারাপ করছো তুমি কি? আদর্শ প্রেমিক? একটা মেয়েকে ভালোবেসে, শুধু তার কথা ভেবেই জীবনকে অতিবাহিত করে ফেললে। এসব কি বিশ্বাস যোগ্য? আবার সেই মেয়েটাই যখন তোমার জীবনে ফিরে এলো। তার জন্য তোমার দরদ একেবারে উথলে পড়ছে। তাকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না। একেবারে সাধুপুরুষ যুধিষ্ঠীর তুমি? সবাই তোমার গল্প পড়ে, তুমি যা বলো, সত্যি কথাটাই তারা ধরে নেয়। সত্যের আড়ালেও যে কিছু থাকে। তাকে গোপণ কেন করো? মিথ্যেবাদী তুমি লেখক। যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। বিদিশা এই জন্যই তোমার জীবনে কোনদিন ফিরবে না।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাবছি, যা লিখেছি, এর মধ্যে তো কোন মিথ্যে নেই। আমি তো কিছুই গোপণ করিনি। আমি তো মিনুর সাথে সেভাবে কোনদিন কিছু করিনি। শুক্লার সাথেও আমার সেভাবে ঘনিষ্ঠতা হয় নি। তাহলে কেন? এভাবে-হঠাৎই অনুভব করলাম, মা আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে। জোরে জোরে আমার গায়ে ঠেলা মারছে। চেঁচিয়ে বলছে, একি রে দেব? সকাল হয়েছে, ঘুম থেকে ওঠ। আপন মনে কি সব বিড়বিড় করছিস?
মা’র ঠেলা খেয়ে আমি ধরমড় করে বিছানা ছেড়ে উঠেছি।
ঠিক যেভাবে খারাপ স্বপ্ন দেখলে মানুষের মনটা খারাপ হয়ে যায়, মনে হয়, এটা দেখার কি সত্যি কোনো প্রয়োজন ছিল? আমারও ঘুমটা ভাঙার পর, খুব বাজে লাগছিলো। মনে হল, বিদিশাকে নিয়ে কাল বাড়ী ফেরার পর থেকে এতো চিন্তা করেছি, তারই প্রভাব পড়েছে স্বপ্নে। মা’র সাথে কাল বাড়ী ফিরে সেভাবে কথা বলিনি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে মা জিজ্ঞাসা করছে, ‘এতদিন বাদে, তুই শুভেন্দুদের বাড়ীতে গেলি, হঠাৎ ও তোকে নেমতন্ন করলো, কি কারণ সেটা তো বললি না?’
মা’র কাছে বিদিশার নামটা মুখ থেকে আবার উচ্চারণ করতে গিয়েও করতে পারলাম না। মনে হল, বিদিশা যখন কাল আবার আমাকে একটা ধাঁধায় ফেলে গেছে, তখন এই নিয়ে কথা তুলে কোনো লাভ নেই, শুধু শুধু মা’রও আবার টেনশন বাড়বে। আগে তো সমস্যার সমাধান হোক। তারপর বিদিশার কথা মা’কে খুলে বলতে অসুবিধে নেই। বিদিশাও আমার কাছ থেকে দুদিন টাইম চেয়েছে। সুতরাং এই দুদিন আমাকেও একটু ধৈর্য রাখতে হবে।
মা দেখি আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবার পর একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মা’কে বললাম, ‘না মা, এমনি কোনো কারন নয়। তুমি তো জানো, শুভেন্দুটা কি রকম করে আমি গেলে। এতদিন পরে গেছি, না খাইয়ে কি আমাকে ছাড়বে? এত পীড়াপিড়ী করলো, যে আমাকেও শেষপর্যন্ত ওর কথাটা রাখতে হলো।’
মা বললো, ‘আর কি কেউ এসেছিলো?’
আমি বললাম, ‘রনি আর মাধুরী এসেছিলো। আর তো কেউ আসেনি।’
আমার দিকে তাকিয়ে মা এমন ভাবে হাসলো, মনে হল, মা যেন সবই জানে। আমাকে বললো, ‘সারাদিনে বিদিশার নামটা আপন মনে কতবার উচ্চারণ করিস তুই? আর আমি যখন কিছু জিজ্ঞাসা করি, তখন আমার কাছে সব চেপে যাস। কাল যে বিদিশাও ওখানে ছিলো, আমি ভালমতনই জানি তা। তুই ঘুমের ঘোরে বকবক করছিলিস, বিদিশার নামটা বারে বারে উচ্চারণ করছিলিস, আমি সব শুনে নিয়েছি।’
আমাকে যেন বিদিশা রোগে পেয়েছে। মা বললো, ‘জানি না বাপু। কি তুই চাস? তবে শুধু শুধু এভাবে জীবনটা নষ্ট করিস না। ও যদি তোকে এতদিনেও বুঝতে না পারে, তাহলে আর কবে বুঝবে? আমি তো বলবো, আমার ছেলেকে বোঝার জন্য ওকে জন্মজন্মান্তর তপস্যা করতে হবে, তবেই ও তোকে বুঝতে পারবে। তার আগে নয়।’
আমি বললাম, ‘না মা, বিদিশার কোনো দোষ নেই। ওর হয়তো কিছু সমস্যা আছে, যেটা ও খুলে বলছে না। ইচ্ছে থাকলেও ওর বিবেক ওকে বাঁধা দিচ্ছে। আমি অনেক কষ্ট করেছি বলেই, ও নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখছে না। এমনও হতে পারে, সেই সমাধানের পথটাও খুলে গেলো, আর বিদিশাও পুরোপুরি আমার হয়ে গেলো।’