02-07-2021, 12:44 PM
শুভেন্দুদের বাড়ীতে আবার হারমোনিয়াম, তবলা কিছুই নেই। মাধুরী ছোটবেলায় গীটার শিখতো। আমি গীটারটাও বাজাতে পারতাম বলে, মাঝে মাঝে ওর গীটারের সাথে সুর ভাজতাম। মাধুরী বিয়ে করে এ বাড়ী ছেড়ে চলে গেলো, সেই সাথে গীটারও ওর সাথে চলে গেল। আমি অবাক হলাম, যখন দেখলাম, পাশের ঘর থেকে রনি একটা স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম নিয়ে এলো। আমাকে বললো, ‘সব ব্যবস্থা করেছি আজকে। তোর কোনো চিন্তা নেই।’
পাশের কোনো বাড়ী থেকে হয়তো হারমোনিয়ামটাকে নিয়ে এসেছে। মাধুরী বললো, ‘এ কি এ কি দাঁড়াও। এতদিন পরে বিদিশা এলো, দেবদার সাথে একটু কথা বলে নিক। তারপরে তো গান বাজনা সব হবে।’
শুভেন্দুদের চারতলা বাড়ীর ছাদটা খুব সুন্দর। চারিদিকে টব দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে একটা দোলনা দুলছে। শুভেন্দুর বাকী দাদারা সব বিবাহিত। সবাই বউ নিয়ে এসে সন্ধেবেলা থেকে একঘন্টা করে ওখানে দোল খেয়ে যায়। আমাকে শুভেন্দু বললো, ‘শোন ছাদটা, তোর আর বিদিশার জন্য আজ আধঘন্টা রিসার্ভ। ওখানে কেউ যাবে না। এই আমরা তিনজনও নয়। কিন্তু আধঘন্টার বেশী দেরী করবি না। তাহলে কিন্তু বামাল করবো গিয়ে। তোর গান শোনবার পর্বটা তারপরে হবে। আমরা ততক্ষণ আমাদের লিকারের ব্যবস্থাটাও সেরে ফেলছি। ‘
চা খাবার পর, মাধুরী আমাকে আর বিদিশাকে ছাদে নিয়ে গেলো। আমাদের দুজনকে বললো, ‘নাও আধঘন্টার জন্য তোমাদেরকে আমি এখানে ছেড়ে গেলাম। ঠিক আধঘন্টা পরেই আমি আসছি। এর মধ্যে দুজনের যা কথা বলবার, সেরে নাও।’
আমার থেকে চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে তখন বিদিশা। মনে হচ্ছিলো, ও হয়তা চাইছে, আমি ওকে কাছে ডাকি, নয়তা ওর কাছেই এগিয়ে যাই। বিদিশাকে বললাম, ‘দূরে কেন দাঁড়িয়ে রয়েছো? কাছে এসো।’
বিদিশা একটু এগিয়ে এলো। মনে হল, দূরত্বটা কিছুটা হলেও কমলো। কিন্তু এখন যেন অল্প একটু ফাঁক থেকে গেলো।
দূরের আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে, একটু ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। বিদিশা বললো, বেশীক্ষণ কিন্তু ছাদে দাঁড়ানো যাবে না। তাহলে আবার ঠান্ডা লেগে যাবে।’
বিদিশাকে বললাম, ‘তুমি গরম কিছু পড়ে আসোনি? নইলে ফেরার সময় তো ঠান্ডা লেগে যাবে।’
বিদিশা বললো, ‘তুমিও তো কিছু পরে আসোনি। একটা হাফহাতা শোয়েটার অন্তত পড়ে আসতে পারতে। তারপরেই বললো, মাধুরীকে বলবো, যাবার সময় একটা শাল জাতীয় কিছু দিয়ে দিতে। কাল বা পরশু ওকে ফেরত দিয়ে দেবো।’
বিদিশাকে বললাম, তোমার বাবা মা এখন কেমন আছেন?
বিদিশা বললো, ‘ভালো। তবে বাবার ব্যবসা করে অনেক লোকসান হয়ে গেছে। আগের মতন বড়লোকীয়ানা ব্যাপারটা নেই। আমাদের আর্থিক অবস্থা সেই আগের মতন নয়।’
শুনে একটু খারাপ লাগলো। তবু বললাম, ‘তোমার বাবা মা লোক হিসেবেও খুব ভালো ছিলেন। একেবারে মাটীর মানুষ। আমি একবারই গিয়েছিলাম, আর ওনাদের দেখে এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।’
বিদিশা বললো, মাসীমা কেমন আছেন? আমার কথা কখনো জিঞ্জেস করেন?বললাম, ‘হ্যাঁ। মা ভালো আছে। মাঝে মাঝে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করে তো আমাকে।’
মনে হল, এই আলোচনার বাইরে বিদিশা যেন আরো একটু সপ্রতিভ হতে পারছে না আমার সাথে। ওকে সহজ করে দেবার জন্য বললাম, আমার সাথে তুমি দেখা করতে চেয়েছিলে, আমার বাড়ীতে তুমি আসতেও চেয়েছিলে। শুভেন্দুর মুখে আমি সবই শুনলাম। তবুও আগের মতন পুরো হাসিটা কিন্তু এখনো আমি বিদিশার মুখে দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মনে কি কোনো লজ্জ্বা বা দ্বিধা আছে এখনও? সেরকম কিছু থাকলে মন থেকে সেটা দূরে সরিয়ে দাও। পুরোনো কথা আমিও কিছু মনে রাখি না। আর আশা করি তুমিও-
বিদিশা বললো, তুমি বিয়ে করো নি কেন?
মনে হল, মান্না দের গানটা গেয়ে ওকে উত্তরটা দিই আর ওকে বলি, হয়তো তোমারি জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য, জানি তুমি অনন্য আশার হাত বাড়াই। যদি কখনো এ প্রান্তে, চেয়েছি তোমায় জানতে, শুরু থেকে শেষ প্রান্তে শুধু ছুটে গেছি তাই। আমি যে নিজেই মত্ত, জানিনা তোমার শর্ত, যদি বা ঘটে অনর্থ, তবু তোমাকে চাই। আমি যে দুরন্ত, দু’চোখে অনন্ত, ঝড়ের দিগন্ত জুড়েই, স্বপ্ন চড়াই। তুমি তো বলনি মন্দ, তবু কেন প্রতিবন্ধ, রেখোনা মনের দ্বন্দ্ব, সব ছেড়ে চল যাই।
বিদিশা চেয়ে আছে আমার মুখের দিকে। যেন অনেক না বলা কথা আমাকে সে বলতে চায়। নিষ্পাপ সরলা যুবতীর মতই সে দেবকে নতুন করে ভালোবাসতে চায়। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রেমের সুখানুভূতিতে একসময় শরীরে যেমন শিহরণ জাগতো। অসংখ্য স্বপ্ন আর আনন্দে জেগে উঠতো মনটা। বিদিশা সেইভাবেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমটা সমর্পন করে দিতে চাইছে আমার কাছে।
আমার এবারে খুব কাছে এসে বিদিশা বললো, ‘আমাকে তুমি বিয়ে করবে দেব? আমি কিন্তু সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে তোমার কাছেই আবার ফিরে এসেছি।’ বিদিশার দিকে আমি দু’হাত বাড়ালাম। ও আমার দুহাতের আলিঙ্গনে শরীরের সাথে আবিষ্ট হয়ে গেল। বিদিশার ঠোঁটদুটো আমার খুব কাছে, ইচ্ছে হচ্ছিলো একটা চুমু খাই।
মনে পড়ছিলো, ছোটোবেলার কথা। একটা হলদে প্রজাপতি ঘাসের ওপর দিয়ে নেচে নেচে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি প্রজাপতিটাকে ধরার অনেক চেষ্টা করছি, কিছুতেই ধরতে পারছি না। প্রজাপতিটা সেদিন উড়ে চলে গেলো বলে খুব মন খারাপ হয়েছিল, মা পরে বলেছিলো, ‘প্রজাপতি যেদিন নিজে থেকে তোর গায়ে এসে বসবে, বুঝবি তোর এবার বিয়ে হতে চলেছে।’ শুভেন্দুদের বাড়ীর ছাদে একটা নরম প্রজাপতি অনেকদিন পর আমাকে আবার জড়িয়ে ধরেছে। আমার বুকে মুখ ঘসছে, গলায় মুখ রাখার চেষ্টা করছে, আমিও তাকে আদর করার চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে, এই শীতকালের সন্ধে রাত্রে এ হল সেই উষ্ণতার পরশ। যেটা পেলে শরীর এমনি গরম হয়ে যায়, শোয়েটার বা শাল। হয়তো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না।
হঠাৎই ছাদের দরজাটা সেইসময় খুলে গেলো। দেখি মাধুরী ওখানে দাঁড়িয়ে। আমাদের দুজনকে বললো, ‘এই যে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক, প্রেমিকা। টাইম হয়ে গেছে। ছোড়দা তোমাদের দুজনকে ডাকছে। এবারে নিচে যেতে হবে।’
আচমকা মাধুরীকে আবার ছাদে আসতে দেখে বিদিশা কিছুটা লজ্জ্বায় পড়ে গেছে। আমার বুক থেকে মুখটা তুলে ও তখন নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, মাধুরী অন্ধকারে অত ভালো করে ঠাওর করতে পারে নি আমাদের। তারপরে যখন বুঝলো, বিদিশা আর আমি পরষ্পর দুজনকে জড়িয়ে ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে, ও খিল খিল করে হেসে উঠলো। আমাদেরকে বললো, ধরা পড়ে গেছো তো? ভয় নেই ভয় নেই, আমি নিচে গিয়ে কাউকে কিছু বলছি না। নাও আরো কিছুক্ষণ সময় এখানে থাকো, তারপরে নিচে চলে এসো।বিদিশা আমাকে বললো, ‘ধ্যাত, তুমি আমাকে বলবে তো? মাধুরী চলে এসেছে, আমি খেয়াল করিনি।
আমি হেসে বললাম, ‘তো কি হল? শুভেন্দু এলে না হয় একটা কথা ছিল। মাধুরী নিচে গিয়ে কিছু বলবে না। আমার ওর ওপরে ভরসা আছে।’
বিদিশা বললো, ‘চলো, চলো, নিচে যাই। নইলে ওরা আবার-’
‘এই তো এতদিন বাদে তোমাকে এত কাছে পেলাম, এখনি চলে যাবো? দাঁড়াও না একটু।’
বিদিশার হাত ধরে টানতে লাগলাম, ওকে আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। বিদিশা বললো, ‘এবারে কিন্তু শুভেন্দু ওপরে উঠে আসবে। তোমার আর আমার দফা রফা করবে এসে।’
বিদিশাকে বললাম, ‘কিছু করবে না। তাহলে প্যাঁদানি খাবে আমার কাছে। তুমি শান্ত হও তো।’
আবার কয়েক মূহূর্তের জন্য প্রজাপতিটা কাছে পেয়েছি। বিদিশা বললো, ‘তুমি এরকম ভালোবাসা আগে কখনো বাসো নি। বেসেছো কি?’
বিদিশাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘না বাসিনি তো। সত্যি কথাই বলছি। আসলে তখন আমার বয়সটা কম ছিলো।’
বিদিশা বললো, ‘বয়স কম থাকলে বুঝি ভালোবাসতে নেই?’
বিদিশাকে বললাম, ‘এই বয়সেই তো মানুষ মরীয়া হয়ে কাউকে ভালোবাসতে পারে। দেখছো না কেমন মরীয়া হয়ে উঠেছি এখন তোমার জন্য।’
বিদিশার ঠোঁটে একটা চুমু খেতে যাচ্ছিলাম। ঠোঁটের ওপরে হাত রেখে মুখ চাপা দিয়ে বললো, এই কেউ দেখে ফেলবে।
-কে দেখবে এখন? মাধুরী তো চলে গেছে।
-না, তাও পরের বাড়ীতে লজ্জ্বা করে না বুঝি?
বিদিশাকে বললাম, ‘তোমাকে আর আমাকে নিরিবিলিতে ছাদে কেন শুভেন্দু পাঠিয়েছে, জানো না? যাতে চুমুটা ভালো করে খেতে পারি। পরের বাড়ীতে যখন এ সুযোগ কেউ করে দেয়ে, তখন তাকে সদব্যবহার করে নিতে হয়।’
বিদিশা বুঝতেই পারছিল, আমি এবার সজোরে ওকে চুমুটা খাবো। আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগালো, ছাদের অন্যদিকে। আমিও ওর পেছন পেছন দৌড়োতে লাগলাম। বেশ লম্বা বড় ছাদ। কিছুটা দৌড়োনোর পর, বিদিশা হাঁপিয়ে গেল। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। আমি সামনে যেতেই বললো, এই আমাকে কিন্ত জোর করে চুমু খেলে, আমি নিচে ছুট্টে চলে যাবো। শুভেন্দু আর রনি এখন নিচে রয়েছে, ওরা তখন দুজনে মিলে জব্দ করবে তোমাকে।’ বলেই হাসতে লাগলো।