02-07-2021, 12:03 AM
শুভেন্দুদের বাড়ীর সামনের রাস্তাটা বেশ সরু। ওখানে ট্যাক্সি ঢোকে না। এর আগে যেকবারই ট্যাক্সি চড়ে আমি এসেছি, গলির মুখটায় ট্যাক্সিটা আমাকে ছেড়ে দিতে হত। কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গেলে তারপরেই শুভেন্দুদের বিশাল বাড়ী। পিকনিক গার্ডেনে শুভেন্দুরা খুব বড়লোক। নতুন লোক এলে বাড়ী খুঁজে নিতে তার অসুবিধে হবে না। শুভেন্দুদের নাম বললেই সবাই ওই বাড়ী দেখিয়ে দেবে।
দুর থেকে ওদের বাড়ীর একতলার বারান্দাটা দেখা যায়। বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে দূর থেকেই সেটা চোখে পড়ে। রাস্তাটায় ঢুকেই আমার মনে হল, শুভেন্দুর বোন মাধুরী দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। দূর থেকে ও আমাকে দেখছে।
মাধুরীর স্বভাবটা খুব মিষ্টি। একে তো বড়লোকের একমাত্র মেয়ে। শুভেন্দুরা চারভাই। আর ওদের এই একটিই মাত্র আদরের বোন মাধুরী। খুব প্রানখোলা স্বভাবের মেয়ে মাধুরীর সাথে আমারও গল্প করতে খুব ভালো লাগতো। কলেজে পড়ার সময় শুভেন্দুদের বাড়ীতে যতবারই এসেছি, মাধুরীর সঙ্গেও একটা দাদা বোনের মত সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। মাধুরী, রনির সঙ্গে তখন থেকেই প্রেম করতো, কিন্তু শুভেন্দুর সাথে যেহেতু আমার একটা আলাদা খাতির ছিল, আমি এলে মাধুরী জমিয়ে আড্ডা দিত আমার সঙ্গে। ওর ডাক নাম ছিল ছুড়ী। ওকেও আমি ছুড়ী বলে ডাকতাম।
বয়সে শুভেন্দুর থেকে দু’বছরের ছোটো মাধুরী উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর আর পড়াশুনা করেনি। রনির সঙ্গে কয়েকবছর পরেই ওর বিয়ে হয়ে গেল। মাধুরী আর রনির সুন্দর একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। নাম রেখেছে ‘দেবমাল্য’।
ওর বাচ্চা হবার পর শুভেন্দু আমাকে বললো, এই ‘দেব’ নামটা আমার খুব পছন্দ। তোকেও যার জন্য আমার খুব পছন্দ। মাধুরীর যেহেতু তোকে খুব ভালো লাগে, আমাকে বললো, ‘ছোড়দা, আমার ছেলের নাম, আমি দেব দিয়ে রাখবো। দেবদার মতন। পরে রনিও রাজী হয়ে গেল। তাই ওর নাম রাখা হলো, ‘দেবমাল্য।’
দূর থেকে মাধুরী আমাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললো, ‘এই যে দেবদা, ছোট্টবোনটাকে ভুলে গেছো বুঝি? ওফ কতদিন তোমায় দেখি না। সেই দুবছর আগে একবার তুমি এসেছিলে। আবার এতদিন পর।’
শুভেন্দুর বাড়ীর গেটের সামনে যেতেই মাধুরী হাসতে হাসতে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো। ওর গালটা টিপে দিয়ে বললাম, ‘ও আমার ছুড়ী রে। দাদাটার কথা বুঝি এতদিন বাদে মনে পড়লো?’
মাধুরী বললো, ‘তুমি না কেমন জানি হয়ে গেছো দেবদা। আগে কত আসতে আমাদের বাড়ীতে। এখানে আড্ডা হতো। গান বাজনা হতো। মজা হতো। তা না, সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে, তোমরা সব নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। আর আমাকেও তুমি ভুলে গেলে।
মাধুরীকে বললাম, ‘তোকে আমি ভুলিনিরে ছুড়ী। শুভেন্দু যতবারই ফোন করেছে, তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছি। রনিকে জিজ্ঞাসা করে দেখিস, ওকেও জিজ্ঞাসা করেছি তোর কথা। তোদের যখন ছেলে হল, শুভেন্দু আমাকে বললো, মাধুরী ওর ছেলের নাম রেখেছে দেবমাল্য। দেব নামটা ওর খুব পছন্দ। তোকে তো আমাদের বাড়ীর সবাই খুব পছন্দ করতো, তাই না? মাধুরীও বললো, আমি দেব নামটাই রাখবো। রনিও রাজী হয়ে গেল। তাই-মাধুরী বললো, তুমি খুশি হয়েছো, ‘আমার ছেলের নাম দেবমাল্য রেখেছি বলে?’
আমি বললাম, বারে? খুশি হবো না? আমি তো তখনই খুশি হয়েছি। খুব খুশি হয়েছি।
মাধুরী বললো, ‘তোমার প্রতি আমার কিন্তু একটা ক্ষোভ আছে দেবদা। আমি খুব রেগে আছি তোমার ওপরে।’
ওর গালটা টিপে দিয়ে বললাম, ‘কেন রে ছুড়ী? রাগ কেন?’
মাধুরী বললো, ‘তুমি তখন আমার ছেলেকে দেখতে আসো নি কেন? জানো তোমায় কত এসপেক্ট করেছিলাম। তুমি এলে না। আর আমিও ছোড়দাকে বললাম, কি রে ছোড়দা? দেবদা তো এলো না? তুই কি কিছু জানাসনি নাকি দেবদাকে? ছোড়দা বললো, সব বলেছি। দেব এখন কাজবাজ নিয়ে ব্যস্ত। ওর এখন তোর ছেলেকে দেখতে আসার টাইম নেই।’
মাধুরীকে বললাম, শুভেন্দু এই কথা বলেছে তোকে? দাঁড়া ওকে আসতে দে। তারপর ওর মজা দেখাচ্ছি। মিথ্যে কথা বলা বের করছি।
মাধুরী মুখটা একটু করুন মত করে, ছেলেমানুষির মত করছিল। বার বার ঘাড় নেড়ে বলতে লাগল, ‘না, না, বলো, তুমি আসোনি কেন?’
মাধুরীকে বললাম, ‘দূর বোকা। আমি তখন ছিলাম না কি কলকাতায়? কোম্পানীর কাজে আমি তখন হায়দ্রাবাদে। একমাস মত ওখানে ছিলাম। কলকাতায় ফিরেই চলে গেলাম, সিঙ্গাপুরে। কোম্পানীর তরফ থেকে ট্রিপ। ফিরে এসেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। একমাস মত বিছানায় শয্যাশায়ী। কাজকর্ম সব ডকে। এমন একটা রোগ বাঁধিয়ে ফেলেছি, ডাক্তার বললো, সাবধানে থাকুন। বাইরের খাবার একদম খাবেন না। আর মিষ্টি খাওয়া তো একদম বন্ধ।’
মাধুরী বললো, ‘কি যেন রোগটা হয়েছিল তোমার?’
আমি বললাম, ‘আলসার কোলাইটিস।’
মাধুরী শুনে বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি। ও তো খুব কঠিন রোগ। ভীষন কষ্ট দেয়। পেটে ব্যাথা করে। রক্ত পড়ে। আমাশার মতন।’
মাধুরীকে বললাম, ‘হ্যাঁ, তারপর থেকেই মিষ্টি খাওয়া একেবারে বন্ধ। মিল্ক প্রোডাক্ট থেকেই না কি রোগটা হয়।’
মাধুরী বললো,তুমি তো আগে খুব মিষ্টি খেতে ভালবাসতে দেবদা। সব বন্ধ হয়ে গেল। তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
মাধুরী বললো, ‘এ তোমার ভারী অন্যায় দেবদা। মাসীমাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছো। বিয়ে থা তো এবার করো। আর কতদিন একা একা থাকবে? তোমাকে দেখার জন্যও তো কাউকে দরকার?
তরপর নিজেই বললো, অবশ্য এখনকার মেয়েদের মধ্যে ভালো মেয়ে খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। মেয়েরা এখন স্বামীদের কেউ দেখে না।
ওকে বললাম, ‘কেন? তুই মেয়ে দেখেছিস আমার জন্য?’
মাধুরী হেসে ফেললো, আমাকে বললো, ‘আমি যদি মেয়ে দেখি। সে মেয়ে তোমার পছন্দ হবে? সবাই তো আর বিদিশার মত সুন্দরী নয়।’
এই বিদিশা নামটা আমার জীবনের সাথে এমন ভাবে জড়িত। শুধু আমি কেন? অনেকেই ওকে ভুলতে পারেনি। মাধুরীর মুখ দিয়ে বিদিশা নামটা শুনেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। ওকে বললাম, ‘হ্যাঁ রে ছুড়ী, তুই কি কিছু জানিস? আমাকে সত্যি করে বলতো?মাধুরী বললো, ‘কি জানবো? কি বলবো?
ওকে বললাম, ‘আজ এখানে নাকি কারুর আসার কথা আছে। কোনো একটা মেয়ে। শুভেন্দু আর রনি তো সেই কথাটাই বলেছে আমাকে।’
মাধুরী শুনে এমন ভাব করলো, যেন ও কিছুই জানে না। আমাকে বললো, ‘কই সেরকম তো আমি কিছু শুনিনি।’
আমি অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম, তাহলে কি শুভেন্দু আর রনি, মাধুরীকেও ব্যাপারটা বলেনি? না ও সব জানে, রনি আর শুভেন্দুর মত মাধুরীও আমাকে গোপণ করছে।
মাধুরীকে বললাম, ‘কই তোর কত্তা কোথায়? ওকে ডাক দেখি একবার। দেখি জিজ্ঞাসা করে।’
মাধুরী বললো, ‘সে তো একটু আগেই বেরুলো তোমার জন্য।’
রনি আমার জন্য কোথায় গেছে? একটু অবাকই হলাম, ওকে বললাম, ‘কেন রে? আমার জন্য তোর কত্তা বেরিয়েছে? কোথায় গেছে?’
মাধুরী বললো, ‘গেছে হয়তো কিছু কিনতে টিনতে। দুপুর বেলা তো এক পেট ভাত খেয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছিল। তুমি ফোনটা করলে। অমনি বাবু তড়াক করে জেগে উঠলেন। আমাকে বললো, তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকো। ‘দেব’ আসছে। আমি ততক্ষণ দোকানটা থেকে চট করে ঘুরে আসছি।
বুঝে নিলাম, রনি কোথায় গেছে। মাল খাওয়ার নেশাটা রনির প্রচুর। তারপরেই আবার ভাবলাম, বিদিশা যদি সত্যি আসে, ওর সামনে এসব খাওয়াটা কি ঠিক হবে?
মাধুরী ভেতরে গিয়ে ওর বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে এলো। আমার সামনে আসতেই খেয়াল হল। ইস তাড়াহুড়োতে ওর জন্য কিছু কিনে আনা হয় নি। পকেট থেকে টাকা বার করতে যাচ্ছিলাম। মাধুরী বললো, ‘তুমি ওর মাথায় হাতটা রেখে আশীর্ব্বাদ করোতো। তাহলেই হবে। টাকা হাতে পেলে এক্ষুনি ওটাকে ছিঁড়ে দেবে। যা দুষ্টু।’
বাচ্চাটাকে দুহাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছিলাম। ও ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে দেখছিল, কিন্তু কিছুতেই আসছিল না। মাধুরী ওকে বললো, ‘এটা কে বলোতো? এটা হলো তোমার কাকু।’ যাও কাকু ডাকছে যাও।’
আমি দুহাত বাড়িয়ে মাধুরীকে বললাম, ‘কাকু কি রে? বল, আমি ওর মামা হই। মাধুরী বললো, হ্যাঁ এটা হলো তোমার দেব মামা। যাও মামার কাছে যাও।’
বাচ্চাটা এবার আমার কাছে চলে এলো। মাধুরী ওকে বললো, ‘মামা কিন্তু খুব ভালো গান জানে। তুমি মামার কাছে গান শিখবে?
বাচ্চাটা ঘাড় নাড়লো। দাঁত বার করে হেসে বললো, হাঁ।
মাধুরী বললো, দেবদা, তুমি বসো, আমি তোমার জন্য চা করে নিয়ে আসছি। ততক্ষনে রনিও এসে পড়বে।
আমি মাধুরীকে বললাম, শুভেন্দু কখন আসবে? আমাকে তো বললো, আধ ঘন্টার মধ্যে ঢুকছে।