01-07-2021, 11:55 PM
শুভেন্দু হাসলো। বললো, ‘রনি থাকবে বাড়ীতে। আমি সাড়ে ছটার মধ্যে কাজ সেরে ঢুকবো। আর যে সারপ্রাইজটার কথা তোকে বলেছি, তার জন্য আরো আধঘন্টা তোকে অপেক্ষা করতে হবে।’
মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ওকে বললাম, ‘হেঁয়ালিটা রাখ না। কি সারপ্রাইজ দিবি, সেটা আগে থেকে বল না?’
শুভেন্দু বললো, ‘সারপ্রাইজ ইজ অলওয়েজ সারপ্রাইজ। আগে থেকে বললে, ওটা আর সারপ্রাইজ থাকে না। তুমি এসো। ধীরে ধীরে সব রহস্য উন্মোচন হবে। একটু অপেক্ষা কর বৎস।’
শুক্লার সকালে আমার বাড়ীতে আসার ব্যাপারটা চেপে গিয়েই ওকে বললাম, ‘তুই কিন্তু যে সারপ্রাইজের কথা আমাকে বলছিস। ওটা আমি আগে থেকেই জানি। আমার জানা হয়ে গেছে, আজ সকালে।’
শুভেন্দু বললো, কি জেনেছিস? আমাকে বল দেখি।
আমি বললাম, না থাক। বলবো না।
শুভেন্দু বললো, ‘বলবি না যখন তুইও চেপে থাক। দেখা যাক তোর জানার সাথে আমার সারপ্রাইজ মেলে কিনা’। ফোনটা রাখতে রাখতেই আবার বললো, ‘তোর মুখে আমি অনেকদিন হাসি দেখিনি। আজ তোর মুখে আমি হাসি ফোটাবো।’
আমি বুঝে গেলাম, তারমানে বিদিশার কথাই শুভেন্দু আমাকে বলতে চাইছে।
ট্যাক্সির কাঁচ দিয়ে কতগুলো ছেলে মেয়েকে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে ফিরতে দেখছি। আর ভাবছি বয়সটা আমার দশবছর কমে গেছে। কি জানি হয়তো বিদিশারই জন্য।
রনির কথা ভেবে, রনিকেও একটা ফোন লাগালাম। রনি বললো, ‘কিরে দেব? তুই আসছিস তো?’
একটু আগেই শুভেন্দুর সাথে ফোনে কথা হয়েছে রনিকে সেটা বললাম। রনি বললো, ‘তোর জন্য আমি আর শুভেন্দু একটা পাত্রী ঠিক করেছি। তুই এলে, সেই মেয়েটিকে তোকে দেখাবো। শুভেন্দু যে সারপ্রাইজটার কথা বলেছে, ওটা সেই সারপ্রাইজ।’
আমি বললাম, ‘পাত্রীটি কে?’
রনি বললো, ‘ধরে নাও খুব সুন্দরী। তবে এখন একটু বয়স হয়েছে। তবে সৌন্দর্য তার কমে নি। তোমার সাথে ভালো মানিয়েও যাবে, কোনো চিন্তা নেই। এবার একটু ধৈর্য নিয়ে তুমিও এসো। আর হ্যাঁ আজকে কিন্তু খুব সহজে তোমায় ছাড়ছি না। অনেক গান শোনাতে হবে, সেই রাত অবধি। যিনি আসবেন, তিনিও তোমার গান শুনবেন।’
তারপর আবার হেসে রনি বললো, ওফ দেব, কতদিন তোর গান শুনি না। সেই কবে শুনেছিলাম লাস্ট। মনেই নেই। তারপর মনে হয় একজুগ হয়ে গেছে।
মোবাইলটা কানে ধরে নিজের ভেতরের আনন্দটা ওকে প্রকাশ করতে পারছি না। শুধু রনি বললো, আজ তুই মুকেশের ওই গানটা আবার গাইবি। যেটা খুব গাইতিস আগে। বলে নিজেই গাইতে লাগলো -সুহানি চাঁদনী রাতে। হামে শো নেহী দেতে। তুমহারী প্যায়ার কী বাতে, হামে শো নেহী দেতে।
রনি ফোনটা ছাড়ার পরেই ধরে নিলাম, এ মেয়ে বিদিশা না হয়ে কিছুতেই যায় না। ও যা বলছে, তাতে আর রহস্যের কিছু নেই। শুক্লার মত শুভেন্দুও হয়তো দেখে ফেলেছে বিদিশাকে। রাস্তায় দেখতে পেয়ে ওকে ইনভাইট করেছে বাড়ীতে। আজ সেখানে আমিও যাচ্ছি। সামনা সামনি আজ আমরা আবার দুজনে মুখোমুখি।বিদিশাকে আমি ভালোবাসতাম। সেই ভালোবাসার মধ্যে কোনো খুঁত ছিল না। জানি, ভালোবাসার মধ্যে যদি সততা থাকে, সে ভালোবাসা কখনো হারিয়ে যায় না। সেদিন বিদিশা আমাকে ভুল বুঝেছিল, তাই আমার জীবন থেকে ও হারিয়ে গিয়েছিলো। বিদিশার যখন ভুলটা ভাঙলো, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। কিন্তু আমার এই স্বচ্ছ ভালোবাসাই ওকে আবার ফিরিয়ে আনলো আমার কাছে। এই পৃথিবীতে দেবকে ছেড়ে বিদিশা আর যাবে কোথায়?
আমার মনে আছে, কলেজে বিদিশার সাথে যখন প্রেম শুরু করলাম, তখন রনি কত পেছনে লেগেছে আমাদের। বিদিশার সাথে ফাজলামী আর খুনসুটি তো করতোই এছাড়া আমাকেও কখনো কখনো ছাড়তো না। একদিন খুব গুরু গম্ভীর ভাবে আমাকে বললো, ‘দেব, একটা কথা খুব সিরিয়াসলি ভাবে তোকে জিজ্ঞাসা করছি। ‘এখনো অবধি বিদিশাকে তুই কটা চুমু খেয়েছিস? গালে, কপাল আর ঠোঁট মিলিয়ে কটা?’
তারপর আবার নিজেই হেসে বললো, ‘গুনে দেখিস নি, তাই না বল?’
রনিকে কোনদিন কাব্যিক হতে দেখিনি, আমাকে বলেছিল,‘প্রেম যখন হৃদয়ে আসে, তখন পুরুষ বা রমনী কি চায় জানিস? সে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। বাঁচিয়ে রাখতে চায়, লালন করতে চায় তার প্রেমকে। সবার উপরে থাকে সমর্পনের ইচ্ছে।’ একেবারে পি সি সরকারের ম্যাজিকের মতন। এক ঝলক চাহনি, একটু ঠোঁটের কাঁপন, মাথাটা হেলিয়ে রাখা, হাতের আঙুলের নড়াচড়া। এর প্রত্যেকটিই প্রেমকে জাগিয়ে তুলতে পারে। ঠিক ম্যাজিকের মতন। কিন্তু খুব সাধারণ ম্যাজিক।’
রনির কথা ভাবছিলাম আর বিদিশার মুখটাকে চিন্তা করছিলাম, ট্যাক্সিতে যেতে যেতে হঠাৎই আমার মনে হল, বিদিশার মুখটা যেন আমার মুখের খুব কাছে। সেই আগে যেরমকম গরম নিঃশ্বাস ফেলতো আমার ঠোঁটের ওপরে। প্রথমবার চুমু খেতে গিয়ে ওর ঠোঁটটা একটু কেঁপে গিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন ওর ঠোঁটে প্রেমের চিহ্ন এঁকে দিলাম, ও জড়িয়ে ধরলো আমাকে। প্রজাপতির মত বিদিশার আঙুলগুলো আমার পিঠে তখন খেলা করছে। বিদিশার ঠোঁটের ওপর আমার ঠোঁট। বিদিশার পায়ের ওপর আমার পায়ের উষ্ণ চাপ। দ্রুত নিঃশ্বাস একসাথে মিশে যাচ্ছে। আঙুল গুলো দিয়ে বিদিশা আমার পুরো শরীরটাকে এমন ভাবে খেলাচ্ছে, যেন শরীরের প্রতিটি কোনকে জানার জন্য ও কত অধীর। জড়িয়ে ধরে বিদিশাকে আমি বলছি, ‘বিদিশা, ভালোবাসাটাকে আমি অমর করে রাখতে চাই। তুমি আমাকে কোনদিন ভুলে যাবে না তো? বিদিশার মুখ দিয়ে শুধু গোঙানির মত শব্দ। দুটো ঠোঁট তখন ভালোবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আমাকে জড়িয়ে ধরে বিদিশা বলছে, ‘না গো না। আমি কি তোমাকে ভুলে যেতে কখনো পারি?’
ভালোবাসার বেশী সুখ নাকি কপালে কখনো সয় না। মূহূর্তগুলো সব ঝাপসা হয়ে যায়। এই বুঝি শুরু হল। আর কদিন পরেই সব শেষ। মনে হল, বিদিশার মুখটাকে আমি দেখছিলাম এতক্ষণ। তারপরেই ওর মুখটা কেমন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল আসতে আসতে। আমার মুখের কাছে বিদিশার মুখটা আর নেই, হঠাৎ দেখছি ওখানে মিনুর মুখটা চলে এসেছে। বিদিশার ঠোঁটদুটোও নেই। ওখানে মিনুর ঠোঁট দুটো চলে এসেছে।মূহূর্তে মুখটা কেমন পাথরের মত হয়ে গেল আমার। মনে পড়ল, মিনুর বাড়ীতে সেদিন কি ঘটেছিল।
সেদিন ছিল শনিবার। বাবা বলতেন, শনিবার দিনটা আমার কাছে নাকি শুভ নয়। শনি যদি ঘাড়ে চেপে বসে, তাহলে তো আরো মুশকিল। সেদিন মিনু হয়েছিল আমার শনি। তখন ঠিক সন্ধে সাতটা। মিনু আমাকে বাড়ীতে ডাকলো। আগের দিন সৌগতর দাদার বিয়েতে গিয়েছিলাম। সারারাত সৌগতর দাদার বিয়ের বাসরে জেগেছি। অনেক রাত অবধি হৈহুল্লোর আর গানবাজনা হয়েছে। শরীরটা এমনি খারাপ। মিনুকে বললাম, ‘আজ ছেড়ে দে মিনু, আজ আমার বাড়ী থেকে বেরোনোর একদম ইচ্ছে নেই।’
মিনু শুনলো না। বললো, ‘তোকে কি এমনি এমনি আমি বাড়ীতে ডাকছি? কারন তো একটা আছে। তুই আয়। আমি দশমিনিটের মধ্যে তোকে ছেড়ে দেবো।’
জানতাম না সেদিন বিদিশাও আমার বাড়ীতে এসে হাজির হবে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি, মিনুর বাড়ী যাবো বলে। তার ঠিক একঘন্টা পরেই বিদিশাও আমার বাড়ীতে এসে হাজির। আমাকে দেখতে পাইনি। মা’ বলে দিয়েছে আমি মিনুর বাড়ী গেছি। বিদিশাও আর অপেক্ষা করেনি।
বিদিশার ভীষন রাগ ছিল মিনুর ওপর। কলেজে কোনদিন দাঁড়িয়ে কথা পর্যন্ত বলেনি মিনুর সঙ্গে। মিনুর বাড়ীতে আমি যাই, সেটা ওর বোনকে গান শেখানোর জন্য হলেও বিদিশার একেবারেই পছন্দ হতো না। সৌগতর দাদার বিয়ের দিন এই নিয়ে একটু মুখ ভার করেছিল বিদিশা। আমি ওর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছি। বিদিশা বললো, ‘আমি তো বলেছি মেয়েটা ভালো নয়। তুমি তাও শুধু শুধু। কি পাও তুমি ওখানে গিয়ে?’
বিদিশাকে কথা দিয়েছিলাম, আর মিনুর বাড়ীতে যাবো না। কিন্তু সেদিন নিয়তি আমাকে ডেকে নিয়ে গেল মিনুর কাছে।
যখন ওর বাসায় ঢুকলাম, তখন দেখলাম ওর ছোট বোনটা নেই। মিনু একা রয়েছে ঘরে। ওর চোখ দুটো কেমন ঘোলা ঘোলা। ঘরের মধ্যে শাড়ী ছেড়ে নাইটি পড়ে রয়েছে। মুখ চোখ দেখেই মনে হল, যেন শয়তান ভর করেছে ওকে।
শুরুটা করলো ভালোভাবে। আমাকে বললো, ‘সৌগতর দাদার বিয়েতে খুব আনন্দ হল। তাই না রে?’
-তুই তো যাসনি। গেলে আনন্দটা বুঝতে পারতিস।
-আমাকে তো সৌগত বলেনি। তোদের বলেছে আমি বাদ।
-তোকে কেন বলেনি, সেটা তো বলতে পারবো না। তবে আনন্দ তো খুব হয়েছে।
-এই দেব, তুই গান গেয়েছিস?
-গেয়েছি অনেক। ওরা ছাড়ছিল না তাই।