01-07-2021, 11:45 PM
শুক্লাকে বললাম, হ্যাঁ। তুই ফোন করে আমাকে পরে বলেছিলিস। বিদিশা তোর কাছে পরে দূঃখ করেছে। ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তখন বিদিশারও আর করার কিছুই নেই। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিদিশা বিয়ে করে মুম্বাই চলে যাচ্ছে।
শুক্লা অবাক করে আমাকে বললো, বিদিশা, তোকে যদি এতদিন পরে তোকে আবার দেখতে চায়, যাবি না ওর কাছে?
আমি শুক্লার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কি বলছে ও কিছুই বুঝতে পারছি না।
শুক্লা বললো, বিদিশা এখন কলকাতায়। ও তোর সাথে একবার দেখা করতে চায়। আমাকে অনেক করে বলেছে।
আমি বললাম, বিদিশা কলকাতায় কেন? ও কি এখন এখানেই রয়েছে?
শুক্লা বললো, এখানেই থাকবে ও। আর ফিরে যাবে না, মুম্বাইতে। বিদিশার স্বামীর সাথে বিদিশার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তাই ও-
কথাটা তখনো শেষ করেনি শুক্লা। আমি যেন কেমন ভাবুক মত হয়ে গেছি। আপন মনে কি যেন ভাবছি। আর মনে হচ্ছে, পুরোনো দূঃখের স্মৃতিতে দগ্ধ মনটায় হঠাৎই এ যেন এক খুশীর খবর। মরে যাওয়া ভালোবাসাতে নতুন করে আবার প্রাণের স্পন্দন। শুনেছি, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা নাকি কখনো সখনো ঘুরে ফিরে আসে। এটা কি তাহলে তাই? ভগবান কি এইভাবেই প্রেমিক প্রেমিকার পরীক্ষা নেয়? যে দূঃখ দেয়, ভগবান নাকি তাকে কখনো সুখী করেনা। আর যে দূঃখ পায় ভগবান শুধু তার ধৈর্য্যেরই পরীক্ষা নেয়। যেমনটি আমার নিয়েছে ভগবান এই কটা দিন।
এর থেকেও বড় সারপ্রাইজটা আমার জন্য বোধহয় অপেক্ষা করছিল। শুক্লা যেখানটায় বসে ছিল, ওখান থেকে উঠে এসে আমার পাশে হঠাৎ বসলো। আমার হাত দুটো ধরে বললো, ‘দেব’ তুই কি বিদিশার কাছে আবার ফিরে যাবি?
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিছু তো ভাবিনি এখনো। তুই বল-
শুক্লা বললো, ‘যাস না দেব, যাস না। আমি বলছি, বিদিশার কাছে তোর ফিরে না যাওয়াটাই আর ভালো। আমি তোকে-
বিদিশার চিন্তাতে আমি কেমন মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। কি একটা বলতে গিয়ে শুক্লাও হঠাৎই থেমে গেছে। দেখলাম মা, চা নিয়ে ঢুকেছে ঘরে। শুক্লা মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে মা’কে ঢুপ করে একটা প্রনাম করে বসলো। মা, শুক্লার মাথায় দুহাত রেখে বললো, ‘থাক থাক মা, আমাকে আর প্রনাম করতে হবে না। আমি এমনি তোমাকে আশীর্ব্বাদ করছি।’
চায়ের সাথে চানাচুর আর মিষ্টি। শুক্লা বললো, এ কি মাসিমা? দেবকে দিলেন না। শুধুই আমাকে?
মা বললো, ‘ও তো খেয়েছে এই সবে। তুমি খাও। দেব সকালে একবারই চা খায়, তারপরে আর খায় না।’
শুক্লা আমাকে বললো, ‘কলেজে তো খুব চা খেতিস। ঘন্টায় ঘন্টায়। এখন সব কমে গেছে বুঝি?
এক সময়ে চায়ের একটা নেশা ছিল। চায়ের সাথে বিস্কুট আর সিগারেট। বিদিশা বলতো, ‘তোমার এই চায়ের নেশাটা খুব বাজে। আর এত ঘনঘন সিগারেট খাও কেন তুমি? জানো বেশী সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়। গলা খারাপ হয়ে যায়। তোমাকে গলাটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে কিনা?’ আমি বিদিশার জন্য চায়ের নেশা কমিয়ে দিলাম। সিগারেট খাওয়াও ছেড়ে দিলাম। কিন্তু বড়ই অদ্ভূত। বিদিশাই তারপরে আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
শুক্লাকে দেখলাম, চা খাচ্ছে, আর বারে বারেই আমার দিকে তাকাচ্ছে। কি যেন বলতে গিয়ে একটু আগে থেমে গিয়েছিল ও। শুক্লার এমন দৃষ্টি, কলেজে যখন পড়তাম, আগে কখনো দেখিনি। আমার পাশেই বসে রয়েছে ও। অথচ কলেজে যখন পাশে বসতো, কোনদিন এভাবে কখনো তাকাতো না আমার দিকে।
-’কিছু বলবি শুক্লা? কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলি তুই?’
শুক্লা বললো, ‘তোকে যদি কিছু বলি, তাহলে তোর মান হবে। অভিমান হবে আমার ওপর। রাগ করবি না বল?’
শুক্লাকে বললাম, ‘তুই তো আমার ক্ষতি কোনোদিন চাস নি। রাগ করবো কেন? কি বলছিলিস বল?’
চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে, আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সব বলবো তোকে, যদি পারিস, আজ সন্ধেবেলা আসবি একবার আমার ফ্ল্যাটে?’
আমি বললাম, ‘সন্ধেবেলা? আমাকে তো শুভেন্দুও আবার ডেকেছে ওর বাড়ীতে। কি করে যাবো?’
শুক্লা বললো, ‘ওকে বারণ করে দে। বল, শুক্লাও আমাকে ডেকেছে। আমি শুক্লার ফ্ল্যাটে যাচ্ছি।’
শুভেন্দুকে আজ অবধি কোনদিন না করিনি। শুক্লার কথায় না বলবো, মনটা কেমন খচখচ করতে লাগলো। বিদিশার চিন্তাটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। শুভেন্দু আমাকে সারপ্রাইজের কথা বলেছে, সেটাও আমাকে জানতে হবে। ওকে যদি না বলে দিই।, শুভেন্দু অসন্তুষ্ট হবে, সারপ্রাইজটাও আমার জানা হবে না।
-’কি হল? কিছু বলছিস না যে? বল আজ আসবি কিনা? আমি তো এখন অফিসে যাবো। ওখান থেকে ফিরে সন্ধেবেলা ফ্ল্যাটেই থাকবো। তোর জন্য অপেক্ষা করবো। আসবি তো?’
সল্টলেকের কোয়ালিটি বাস স্টপেজের কাছে শুক্লারা ফ্ল্যাট কিনেছিল আমি জানি। এই শুভেন্দুই আমাকে বলেছিল, ‘জানিসতো দেব, শুক্লারা এখন সল্টলেকে থাকে। আগে থাকতো বেহালায়। এখন ওখানেই রয়েছে মা বাবাকে নিয়ে।’
শুভেন্দু পুরোনো বন্ধু বান্ধবদের সব খবর গুলো কেমন পেয়ে যায়, অথচ আমি পাই না। নিজেকে বেশ কিছুদিন গুটিয়ে রেখেছিলাম, হয়তো সেইজন্য।
শুক্লা বললো, ‘আমার ফ্ল্যাটটাতেও তো তুই কোনদিন আসিস নি। তা একবার এসে দেখে যা। সবাই তো এসেছে। শুধু তুই বাকী।’
আমি বললাম, ‘সবাই বলতে কে কে?’
শুক্লা বললো, ‘কেন শুভেন্দু, রনি। ওরা দুজনেই তো এসেছে।’
-’আর সৌগত?’
নামটা শুনে মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল শুক্লার। আমাকে বললো, ‘কষ্ট দিচ্ছিস?’
ভাবিনি ওর মুখটা এমন করুন হয়ে উঠবে। শুক্লাকে আমি কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। চোখের কোনে জলটা চিকচিক করছিল। রুমাল দিয়ে তাড়াতাড়ি চোখটা মুছে নিয়ে বললো, ‘না তোকে এমনি বললাম, আমি জানি তুই কোনদিন কাউকে কষ্ট দিতে শিখিস নি।’ সৌগত কি করে আসবে? ও তো বিয়ে করে কবেই চলে গেছে আমাদের থেকে অনেক দূরে। মনে নেই? ওর বিয়েতে তো আমিও তো গিয়েছিলাম।’বললাম, জানিস সৌগত এখন কোথায়?
শুক্লা বললো, ‘শুনেছিলাম তো অ্যামেরিকায়। নিউ জার্সি তে রয়েছে। যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল, কি সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে। বিয়ে করার একবছর পরেই অ্যামেরিকাতে চলে গেল। আমাকে একটা বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছিল সৌগত। তখন আমি বেহালাতেই রয়েছি। কার্ডটা পেয়ে যাবো কিনা ভাবছি। তারপরই সৌগত আমাকে ফোন করলো। বললো, কি গো আসবে না? নাকি রাগ এখনো রয়েছে আমার প্রতি? আমি কিন্তু সব কিছু ভুলেই ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম।’
শুক্লাকে বললাম, ‘তোকে কিন্তু সেদিন দেখে আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম শুক্লা। পরে ভেবেছিলাম, শুক্লার মনটাও কি তাহলে বিদিশার মত বিষিয়ে গেল। এত সুন্দর গড়ে উঠেছিল তোদের প্রেমটা। অথচ হঠাৎই কোথাথেকে কি যেন হয়ে গেল। তুই আবার সৌগতর বিয়েতেও এসেছিলিস, আমার খুব অবাক লেগেছিল।’
শুক্লা বললো, ‘অবাক তো লাগবেই। তুই যে আমার কথা ভাববি, আমি খুব ভালো করেই জানতাম। এই সৌগতই না কতদিন তোর পেছনে পড়েছিল, আমাকে রাজী করানোর জন্য।’
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ। মনে পড়ে সেসব কথা। তারপরেই ওকে বললাম, ‘সৌগতর জন্য তোর কোনদিন আফশোস হয় না শুক্লা? দুজনে পৃথিবীর এখন দুই মেরুতে। কখনো মনে হয় না, এই জীবনটা আমরা হয়তো চেষ্টা করলে একসাথেই কাটাতে পারতাম।’
শুক্লা বললো, ‘আফশোস তো হয়। এই যেমন তোরও হয় বিদিশার জন্য। কিন্তু কথায় বলে, আফসোস করে নাকি কিছু হয় না। পৃথিবীতে আমরা কি কেউ পেছনের দিকে তাকিয়ে চলি? বল? সবাই চায়, সামনের দিকে তাকাতে। আমিও তাই-
মনে হল শুক্লা যেন দূঃখ কষ্টটাকে চেপে রেখেছে, আমারই মতন। ভালোবাসা ওরও টেকেনি। পৃথিবীতে আমরা দুজন যেন একই পথের যাত্রী।
শুক্লাকে বললাম, ‘তাহলেও আমার আর তোর ব্যাপারটা তো আলাদা। সৌগতর সঙ্গে তোর বিয়ে দিতে নাকি তোর বাবা মা আপত্তি করেছিল। সৌগতও জেদের বশে বিয়ে করে ফেললো ওই মেয়েটাকে। এটা কি সত্যি?’
শুক্লা বললো, ‘হ্যাঁ বাবা মা আপত্তি করেছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল ঠিকই তো করেছে। এটা তো সত্যি। আমিই বা জোর করবো কেন?’
শুক্লাকে বললাম, ‘তুই তো সৌগতকে ভালোবাসতিস। জোর করলি না কেন?’
শুক্লা বললো, ‘আমার ভালোবাসাটা আসলে ঠুনকো ছিল। সেটাই বলতে চাইছিস তো? আমি তো বিদিশার মত অত ওকে ভালোবাসতাম না। যতটা বিদিশা তোকে ভালোবাসতো।’
শুক্লাকে বললাম, ‘আমি বিশ্বাসই করবো না সেকথা। শুধু এটুকু জানতাম, বিদিশা আমাকে যতটা ভালোবাসে, শুক্লা ঠিক ততটাই ভালোবাসে সৌগতকে। বিদিশা আমাকে ছেড়ে গেলেও শুক্লা কিছুতেই ছাড়তে পারে না সৌগতকে।’