01-07-2021, 11:44 PM
মা তখন ঘরে চলে এসেছে। শুক্লা মাকে দেখে বললো, ‘মাসীমা, ছেলের এখনো বিয়ে দেন নি কেন? কি করেছেন কি? আমি তো ভাবলাম, এতোদিন বাদে দেবের বাড়ী যাচ্ছি, নিশ্চই ওর বউটাকেও দেখতে পাবো।’
মা বললো, ‘কি আর করবো বলো? এটা তো আমার ছেলেরই মর্জী সব। আমি তো কবে থেকে ওকে বলছি। উনি শুনবেন, তবে তো কথা।’
মার সাথে শুক্লার আলাপ করালাম। মাকে বললাম, ‘মা, একে তুমি চেনো? এ হল শুক্লা। আমার কলেজের বান্ধবী।’
মা যেন পুরোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। মানে মিনুর চেহারার সাথে শুক্লার চেহারাটা মেলানোর চেষ্টা করছে। ভাবছে আগে ওকে দেখেছে কিনা? আমি ঠিক বুঝে গেলাম, মা’কে বললাম, ‘না মা, একে তুমি আগে কখনো দেখো নি। এর নাম শুক্লা। ও আজই প্রথম আমার বাড়ীতে এলো।’
মা এবার বুঝতে পারলো, শুক্লাকে বললো, ‘চা খাবে তুমি? তাহলে চা করে নিয়ে আসি।’
শুক্লা বললো, ‘তা খেতে পারি মাসীমা। তবে আপনি ব্যস্ত হবেন না। আজ আমি দেবের কাছে এসেছি, ওরজন্য একটা বীরাট সারপ্রাইজ আছে বলে। আপনার ছেলে শুনলে একেবারে চমকে যাবে।’
কথাটা এমন ভাবে বললো, আমি সত্যি চমকে গেলাম। এও এতদিন পরে এসে বলে সারপ্রাইজ? কি হচ্ছেটা কি আজকে? সকাল থেকে উঠে খালি সারপ্রাইজের কথা শুনছি। কিসের সারপ্রাইজ?
শুক্লা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আছে আছে বৎস। সাধে কি তোর কাছে আমি এসেছি? এমনি এমনি? খবর তো একটা আছে। ক্রমশ প্রকাশ্য।’
আমার মনে হল, এরা বোধহয় সবকটা এতদিন পরে একজোট হয়েছে আবার। আমার মুখে কি হাসি ফোটাবে কে জানে? কিছুতো একটা ব্যাপার নিশ্চই আছে, যেটা শুভেন্দু, শুক্লা দুজনেই জানে। অথচ আমাকে বলতে চাইছে না।
আমি বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম। মনে পড়লো, শুভেন্দুর কথা। শুভেন্দু বলেছে, আজ ওর বাসায় যেতে। সেখানে রনি থাকবে। আর সাথে রনির বউ থাকবে। কিন্তু শুক্লার কথা তো বলেনি। আবার শুক্লা সাতসকালে আমার বাড়ীতে ছুটে চলে এসেছে। আমাকে সারপ্রাইজের কথা বলছে। তাহলে শুক্লাও নিশ্চই জানে বিষয়টা। আসল ব্যাপারটা কি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
ওকে বললাম, ‘কে বলেছে তোকে? শুভেন্দু?’
শুক্লা যেন আকাশ থেকে পড়লো। আমাকে বললো, ‘শুভেন্দু কেন বলবে? আমার কাছে তো ওর ফোন নম্বরই নেই। একটু আগেই তোকে তো বললাম। সব ফোন নম্বরগুলো হারিয়ে গেছে।’
ঠিক ক্লিয়ার হচ্ছে না। শুক্লাকে বললাম, দাঁড়া, দাঁড়া। তুই বলছিস শুভেন্দুর ফোন নম্বর তোর কাছে নেই। অথচ শুভেন্দুও আমাকে ফোন করে একই কথা বলেছে।
শুক্লা বললো, কি বলেছে?
-ওই সারপ্রাইজ। তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে। কি সারপ্রাইজ কে জানে। আমাকে বললো, এখানে এলে সব জানতে পারবি। সন্ধেবেলা ওর বাড়ীতে যেতে বলেছে। ওখানে গেলে নাকি সারপ্রাইজটা আমাকে দেখাবে।
শুক্লা বললো, ‘তুইও শুভেন্দুর কথা বিশ্বাস করিস? ও আর্ধেক কথা মুখ দিয়ে বলে। আর আর্ধেক কথা পেট দিয়ে। পট্টী মেরে ওখানে নিয়ে যাচ্ছে তোকে। ও আবার দেবে তোকে সারপ্রাইজ?’আমার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সব অদ্ভূতুড়ে লাগছে। এরা সব পুরোনো বন্ধুগুলো আমাকে নিয়ে মজা করছে নাকি? শুক্লাকে বললাম, ‘কি সারপ্রাইজ বলবি তো? তবে তো বুঝবো। তুইও বলবি না। শুভেন্দুও বললো না। তাহলে আমি কোথায় যাই বলতো?’
শুক্লা দেখলাম, ওর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে কি একটা বার করলো। আমার হাতে দিয়ে বললো, এটা দেখতো।
হাতে নিয়ে দেখলাম, ওটা একটা ছোট্টো ভাঁজ করা কাগজ, তাতে হিজিবিজি কিসব লেখা রয়েছে। শুক্লাকে বললাম, ‘এগুলো কি? আমি তো কিছুই ভালো করে বুঝতে পারছি না।
শুক্লা বললো, ‘ভালো করে দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবি।’
একটা ছোট্ট চিরকূটের মত কাগজ। তাতে মাঝখানে দুতিন লাইন লেখা রয়েছে। কিন্তু লেখাটাকে পেন দিয়ে হিজিবিজি করে কে যেন কেটে দিয়েছে। ভালো করে লেখাটা পড়া যাচ্ছে না। শুধু ওপরে ছোট্ট একটা নাম। নামটা কষ্ট করে হলেও পড়া যাচ্ছে। ব এ রস্সিকার, দ এ রস্সিকার, তালবশ্য এ আকার। এ কি? এতো বিদিশা। বিদিশাকে লেখা শুভেন্দুর সেই চিঠি। তোর কাছে এলো কি করে? আমার নাম করে বিদিশাকে যে চিঠিটা শুভেন্দু দিয়েছিল। এতো সেই চিঠিটা। তুই এই চিঠিটা কোথায় পেলি?
শুক্লাকে দেখি, একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই পুরোনো দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আবার মনে করাচ্ছে আমাকে। কিছু দূঃখ, কিছু আনন্দ এই নিয়েই তো জীবন। সবাই তো সুখী হতে চায়। তারমধ্যেও কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না। আমাকে বললো, আমিও পারলাম না জীবনে সুখী হতে। আর তুই ও নয়।
কাগজটা হাতে নিয়ে ভালো করে আবার দেখতে লাগলাম। তলার লেখাগুলো সব পেন দিয়ে কাটা। নিজের নামটাই যা কাটেনি বোঝা যাচ্ছে।
শুক্লাকে দেখলাম, কিরকম অদ্ভূত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আমার মনের ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করছে। আমাকে বললো, কলেজ ছাড়ার পর তোকে তো কোনদিন বলিনি। ভেবেছিলাম বলবও না কোনোদিন। তুই কি ভেবেছিলিস, বিদিশা এই কান্ড করতে পারে?
আমার মুখে যেন ভাষা নেই, সেভাবেই বললাম, কিন্তু বিদিশার তোকে এই চিঠি?
শুক্লা বললো, ‘হ্যাঁ তোকে না বলেই আমি সেদিন বিদিশাদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। সেদিন বিদিশাকে আমি অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। ওকে বলেছিলাম, দেব কে তুই ভুল বুঝছিস বিদিশা। ওর মত ছেলে হয় না। দেব যা করেছে, না বুঝেই করে ফেলেছে। ওকে তুই ক্ষমা করে দে। ছেলেটার কাছে গিয়ে একবার দেখ। তোর জন্য শুধু শুধু ও কত কষ্ট পাচ্ছে।’
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি শুক্লার দিকে। শুক্লা বললো, ‘সেদিন কিছুতেই আমার কথা মানতে চাইল না বিদিশা। অতকরে ওকে বোঝলাম, তাও মানলো না। যখন ফিরে আসছি, আমার হাতে এই কাগজটা দিলো। আমাকে বললো, ‘দেবকে দিও। এটা ওরই চিঠি। মন থেকে যখন মুছে ফেলেছি, তখন চিঠিটা রেখেই বা কি হবে? চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলাম হিজিবিজি করে কেটে দিয়েছে পুরো চিঠিটা। রাগে, ক্রোধে বিদিশা তখন ফেটে পড়ছে। আমি তাও বললাম, এ চিঠি আমি দেবকে দিয়ে কি করবো বিদিশা? তোর যদি রাখতে ইচ্ছে না হয়, তুই চিঠিটা ফেলে দে। এ চিঠি আমাকে কেন দিচ্ছিস?’
শুক্লা বললো, সেদিন তোদের দূরন্ত প্রেমটার ইতি সমাপ্তি ঘটলো। চোখের সামনে দেখলাম, ভালোবাসার মৃত্যু ঘটেছে। ভালোবাসাকে নাকি অত সহজে ধরে রাখা যায় না। তুই ও পারলি না। আর আমি তো নই ই।আমি বললাম, আমাকে তো তুই বলিসনি। কেন গেলি তুই বিদিশার বাড়ীতে?
শুক্লা বললো, ‘তোকে তো আমি চিনি। তোর জন্য শুক্লা যা করতে পারবে। আর কেউ নয়। সেদিন বাড়ী বয়ে ওর কাছে আমি গেছিলাম। অনেক আশা নিয়েই গেছিলাম। কিন্তু বিদিশার মনকে আমি সেদিন ঘোরাতে পারিনি। কেন জানি না, আমার মনে হয়েছিল, মেয়েটার মন বলে কিছু নেই। চট করে যার বিশ্বাস এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারে। সে কি করে তোর মনটা জিততে চেয়েছিল? চিঠিটা আমার হাতে দিতে এতটুকু ওর বাঁধলো না?
শুক্লা বললো, ‘ভাবছিস এতদিন পরে এই চিঠি তোকে কেন আমি এনে দেখাচ্ছি। তাই তো? রাগে ঘেন্নায়, আমারো সেদিন মনে হয়েছিল, ওর কাছে আমি গেলাম, আর ও বলছে এই চিঠিটা তোকে এনে দিতে? বিদিশার মনটা এত নিষ্ঠুর? তোর মনের অবস্থা তখন কি,আমি তো জানি। তোকে এনে বিদিশার চিঠিটা দেখাবো আর বলবো, এই দেখ, কি করেছে বিদিশা, এই দেখ সেই চিঠি। হিজিবিজি করে কেটেছে লেখাগুলোকে। এর জন্য তুই আর কত কষ্ট পাবি? ভুলে যা ওকে। বিদিশার মত মেয়ে তোর যোগ্য নয়।
আমি বললাম, তারপরে?
শুক্লা বললো, ‘তারপরে মন চাইলেও আর আসতে পারিনি তোর কাছে। জানি তুই কষ্ট পাবি। এই চিঠি তোকে কিছুতেই দেখানো যায় না। চিঠিটা তাই নিজের কাছেই রেখে দিলাম। ডায়েরীর পাতার মধ্যে কোথায় যে রেখেছিলাম, মনেও নেই। ঘরের মধ্যে থেকেই চিঠিটা তারপর হারিয়ে গেলো। আর খুঁজেও দেখিনি কোনদিন। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে পুরোনো ডায়েরীগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছি। হঠাৎই দেখি, পুরোনো একটা ডায়েরীর মধ্যে এই সেই চিঠি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এতদিন বাদে, তুই চিঠিটা আবার আমার কাছে নিয়ে এলি? কেন হঠাৎ? এ আর দেখে আমি কি করবো?
শুক্লা বললো, যে তোকে কষ্ট দিয়ে চলে গেল, সে অন্তত জীবনে সুখী হোক, তুই তো এটাই চেয়েছিলিস?
আমি বললাম, আমি চাই সবাই ভালো থাকুক। পৃথিবীতে আমিই যদি একমাত্র কষ্ট পাই, তাহলেও কোন দূঃখ নেই। ভগবান সবাইকে সুখ দিক, আমাকে দূঃখ দিলে কোন কষ্ট নেই। ভাগ্যে যা আছে লেখা, সেটা কি আর খন্ডানো যায়? হয়তো এটাই আমার লেখা ছিল জীবনে।
শুক্লা বললো, জীবনটা বড় অদ্ভূত। তাই না দেব?
আমি বললাম, যার যার জীবন যেরকম, সেরকমই তাকে মানিয়ে নিতে হবে। এটাই তো ধ্রুব সত্য।
শুক্লা বললো, ‘বিদিশার জন্য তুই কি এখনো কষ্ট পাস?’
ওকে হেসে বললাম, নিজের কষ্টটা নিজের কাছেই রাখতে হয়। সবাইকে অত বলতে নেই। আমি অন্যের দূঃখটা শুনতে বেশী ভালোবাসি। এই পৃথিবীতে তো আর আমি একা নই। সবার কথাই ভাবতে হবে। ভগবানেরও অনেক দায়িত্ব।
শুক্লা বললো, আমিই না তোকে পরে বলেছিলাম,বিদিশা নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে।