01-07-2021, 11:05 PM
সৌগত. শুক্লার পেছনে লাইন দিয়ে বসে আছে। এদিকে শুক্লা তো কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। আমাকে শুভেন্দু বললো, ‘তুই তাহলে এক কাজ কর। সৌগতর যখন কোন চান্স নেই, আমাকে শুক্লার সাথে ভিড়িয়ে দে। ওকে আমার জীবন সঙ্গিনী বানিয়ে নিচ্ছি।’
-তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা এই চারজনে এত ভালো বন্ধু। শুধু একটা মেয়ের জন্য বন্ধুত্ব খারাপ করবি নাকি?
শুভেন্দু দেখলো না ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ও আশা ছেড়ে দিল। দুদিন বাদে হঠাৎই আমার পাশে বসে বললো, ‘তোদের এই প্রেম টেম কিছু টিকবে না। সব বকওয়াশ জিনিষ। ভেবে দেখলাম, আমি যা আছি ঠিকই আছি। এসব রমনী ভালোবাসার চক্করে পড়ে থেকে লাভ নেই। এই মেয়েগুলো সব দুষ্টু। এরা সব মুখোস পড়ে থাকে। আমার বাবা দুষ্ট গোয়ালের চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো।
কথাটা ইয়ার্কী মেরেই বলেছিল শুভেন্দু। কিন্তু ওর কথাটা সত্যি হয়ে গেল। আমার আর সৌগতর দুজনেরই প্রেম টিকলো না শেষ পর্যন্ত।
স্নান সেরে আমি সবে মাত্র বাথরুম থেকে বেরিয়েছি। মা বললো, দেখতো নিচে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। কে যেন নিচে থেকে 'দেব'' দেব' বলে ডাকছে। ও তো মেয়ের গলা। আমি খালি গায়ে পাজামাটা গলিয়ে নিয়ে বারান্দায় গেলাম। দেখলাম এক মহিলা পেছন ফিরে আমার পাড়ার একটা ছেলেকে কি জিজ্ঞাসা করছে। একটু পরেই মহিলা পেছন ফিরলো। আমি দেখে অবাক। দেখি শুক্লা হাত নাড়ছে আমার দিকে রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে। অবাক হলাম। শুক্লা এসেছে, এতদিন পরে। আমার বাড়ীতে কি মনে করে? সকাল থেকেই পুরোনো বন্ধুরা আমাকে সব স্মরণ করছে একে একে। শুভেন্দুর ফোনের পর শুক্লাও এতদিন পরে হঠাৎ?
নিচে থেকেই শুক্লা বললো, কোনদিক দিয়ে যাবো বলতো? তোদের সিঁড়িটা কোনদিকে?
আমি বারান্দা থেকে ওকে ওপরে ওঠার সিঁড়িটা দেখিয়ে দিলাম। নিচে দাঁড়িয়ে তখনো শুক্লা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। ওর হাসিটা দেখে মনে হল, শুক্লার সেই পুরোনো হাসি। কলেজে ওর হাসি দেখে সৌগত বলতো, ‘মেয়েরা বিয়ের আগে সব হাসে, আর বিয়ের পরে ভালো স্বামী না জুটলে সব কাঁদতে শুরু করে। ওর এই সুন্দর হাসিটা কতদিন থাকবে বলতো ‘দেব’? বলছি আমার অফারটাকে অ্যাকসেপ্ট করে নিতে, কিছুতেই করছে না। আমি ওকে রাজরানী করে রেখে দিতাম, এই হাসিটাও ও সারাজীবনের মত প্রানখুলে হাসতে পারতো। তা না, শুধু শুধু ও জেদ ধরে বসে আছে।’
শুক্লা যখন সৌগতর সাথে প্রেম করা শুরু করলো, তখন আবার সৌগতর মুখে হাসি ধরে না। এমন ভাব করতে লাগলো, তখন আবার আমাকে চেনে না। অথচ একসময় আমার কাছে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো। শুক্লার মন পাচ্ছে না বলে আমার কাছে এসে আফসোস করত। বলতো, ‘মেয়েদের মুখে হাসিটাই কি যথেষ্ট নাকি? ওসব ঢঙ্গী হাসি। আসল হল, মেয়েদের মন। শুক্লার মনটা খুব কঠোর। আমার প্রতি এতটা নির্দয় হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।’
ওকে বলতাম, ‘তুই এককাজ কর, কালীঘাটে গিয়ে একটা মানত করে আয়। শুক্লার সাথে তোর ফিটিং হয়ে গেলে মাকালীকে খুশি করে আসবি। মানত করলে মা কালী তোর মনবাসনা নিশ্চই পূরণ করবে।’
সৌগত বলতো, ‘তুই হচ্ছিস মহা ঢ্যামনা। বিদিশাকে পেয়ে গেছিস তো, এখন আর আমাকে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। আমি শালা দেবদাসের মত জ্বলে পুড়ে মরছি, কারুর আমাকে নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই?’এরপরে এমন কান্ড করে বসলো সৌগত আমার তো মাথায় হাত। দেখি অ্যানুয়াল ফাংশনের দিন সকালবেলাই এক পেট মাল খেয়ে বসে আছে। কলেজে এসে শুক্লাকেও হঠাৎ সামনাসামনি পেয়ে গেল। সৌগতর চোখদুটো তখন এমন টকটকে লাল হয়ে রয়েছে, শুক্লা ওই দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সৌগত বললো, তুমি আমার সাথে প্রেম করবে কিনা বলো? নইলে আমি কিন্ত-
শুক্লা প্রথমে ভয় পেয়েছিল, তারপরে একটু সাহসী হয়ে বললো, কি করবে? সোসাইড? শোলের ধর্মেন্দ্রর মত?
আমি সৌগতকে বললাম, এই সৌগত কি হচ্ছে টা কি? সাতসকালে মাল খেয়ে এসব কি করছিস তুই?
হঠাৎ কোত্থেকে তখন শুভেন্দুও ওখানে এসে হাজির। আমাকে বললো, ‘লে হালুয়া এর আবার কি হল?’
আমি শুভেন্দুকে কিছুটা দূরে নিয়ে গেলাম। কানে কানে বললাম, ‘ওকে কিছু বলিস না। তাহলে আরো বামাল করবে। আমি শুক্লাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি।’
শুক্লা তো রেগে অস্থির। আমাকে বললো, ‘মাল খেয়ে আবার চোখ রাঙাচ্ছে আমাকে। কত বড় সাহস ওর। তুই কি ভাবিস? যার তার সাথে শুক্লার মত মেয়ে ভেড়ে না। আগে ওর চরিত্রটাকে ঠিক করতে বল।’ তারপরে ওর সাথে প্রেম করবো কিনা আমি ভেবে দেখবো।’
পাছে সৌগত বেশী হজ্জূতি না করতে পারে। শুক্লা সবসময় আমার পাশেই বসে রইলো। সৌগত তখনো চোখ বড় বড় করে দেখে যাচ্ছে শুক্লাকে দূর থেকে। একটু পরে দেখি সৌগত মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যাচ্ছে কলেজ ছেড়ে। শুভেন্দু মাথা নেড়ে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছে মালটা?সুইসাইড করতে নাকি? এই শালাগুলোর ন্যাকামো দেখলে আর বাঁচি না।’
কলেজ ছেড়ে সৌগত চলে গেল। এবার শুভেন্দু শুক্লার কাছে গেল। শুক্লাকে বললো, ‘সৌগতর জন্য আমি এতবড় স্যাক্রিফাইস করলাম, আর তুই কিনা ব্যাচারেকে কষ্ট দিচ্ছিস?’
শুক্লা বললো, ‘মানে?’
শুভেন্দু বললো, ‘দেব’ আমাকে বলেছিলো, ‘বিদিশা আর ওর মত আমাকেও একটা প্রেম করতে। আমি রাজী হয়েছিলাম, শ্র্রেফ তোর জন্য। তোকে আমার মনে ধরেছিল। তারপরে দেখলাম, না কাজটা করা ঠিক হবে না। এটা সৌগতকে দূঃখ দেওয়া হবে। ও এমনি তোকে ভালোবাসে। ব্যাচারাকে কষ্ট দিয়ে আর লাভ নেই। আর তুই কিনা ওকে শেষ পর্যন্ত দেবদাস বানিয়েই ছাড়লি? ‘পার্বতী’ এই ছিল তোর মনে?’
শুক্লা কিন্তু কিন্তু করেও শুভেন্দুর কথাটার শেষ উত্তর দিতে পারেনি। তারপর থেকে সৌগত বেশ কয়েকদিন ধরে কলেজে আর আসছে না। আর শুক্লাও কলেজে এসে খালি আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘সৌগত এসেছে? আজও এলো না? পরপর তিনদিন হয়ে গেল ওর দেখা নেই। কোথায় গেল ছেলেটা মনটা খারাপ লাগছে।’
আমি বিদিশাকে যা করতে পারেনি, শুক্লা তাই করে বসলো। যেদিন সৌগত কলেজে আবার এলো, দেখলাম ওর চোখ মুখ শুকনো। যেন শুক্লার জন্য কেঁদে কেঁদে চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। ভালো করে কারুর সাথে কথা বলছে না। মাথা নিচু করে বসে আছে একদম লাস্টের সীটে। শুক্লা সৌগতকে দেখে আমার পাশের সীটটা থেকে উঠে গেল ওর কাছে। সৌগতর পাশে গিয়ে বসলো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মুখটা নিচু করে সৌগতকে বললো, ‘কি হয়েছে তোমার? কলেজে আসোনি কেন এতদিন?’ সৌগত জবাব দিচ্ছেনা। মুখ নিচু করে তখনো বসে আছে। আমাদের ফিজিক্স এর প্রফেশর নয়নবাবু এলেন, ক্লাস শুরু হলো। আমি নোট নিচ্ছি, স্যারের লেকচার শুনছি। হঠাৎই চোখটা গিয়ে পড়ল পেছনে ওদের সীটে। দেখি শুক্লা তখন মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে সৌগতর ঘাড়ে। যেন পার্বতী মাথা গুঁজেছে দেবদাসের শরীরে। অমর প্রেমকথার রেপ্লিকা দেখছি চোখের সামনে। জানতাম যা শুরু করেছে দুজনে, নয়নবাবুর ঠিক চোখে পড়বে। হলও তাই। স্যার, ওদের দুজনের ওই রকম দেখে হঠাৎই ধমক দিয়ে বললেন, ‘সৌগত আর শুক্লা, কি করছো তোমরা পেছনে? বিহেভ ইয়োরসেল্ফ।
শুভেন্দু ফিক ফিক করে হাসছে। আমাকে পরে বললো, ‘দেখলি? শালা কত নাটকই পারে এরা দুজনে।’
সিঁড়ি দিয়ে শুক্লা উপরে উঠে এসেছে দ্বোতলায়। কলেজে যখন পড়তো, কোনদিন আমার এই ফ্ল্যাটে ও আসেনি। দুদুবার মিনু এসেছিল আর বিদিশাতো বেশ কয়েকবার। কিন্তু শুক্লাকে এতদিন পরে আজ প্রথম আসতে দেখে আমি সত্যি অবাক হয়ে গেলাম। ওকে বললাম, আরে ‘শুক্লা? তুই? আমি তো ভাবতেই পারিনি তুই আসবি। এ কাকে দেখছি আমি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
দরজা খুলে ঘরে ঢোকালাম ওকে। শুক্লা বললো, ‘আমি জানতাম তুই অবাক হবি। কেমন যেন পরপর হয়ে গেছিস তুই। খোঁজখবরও রাখিস না। ফোন নম্বরটাও সেই যে একবার দিয়েছিলিস, হারিয়ে ফেলেছি। পুরোনো মোবাইলটা জলে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল, আর আমার পুরোনো বন্ধুদের নম্বরগুলোও সব হারিয়ে গেল। কাউকে পাই না। না তোকে, না শুভেন্দুকে, না রনিকে। কাউকেই নয়। শেষমেষে আজ আর থাকতে পারিনি। ট্যাক্সি ধরে তোর কাছে ছুটে এসেছি।’
ওকে বললাম, ‘বেশ করেছিস। এতদিন বাদে আমাকেও যে তোর মনে পড়েছে। আয় ভেতরে আয়।’
আমার বসার ঘরে শুক্লাকে বসালাম, বললাম, কি খাবি বল? ওফ তোকে দেখে আমার যা আনন্দ হচ্ছে না, কি আর বলবো।
শুক্লা বললো, তা গায়ক মশাইয়ের খবর কি? বিয়ে থা কি করা হয়েছে? না এখনো সেই-
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। ভাবছি, শুক্লার কথার কি উত্তর দেবো। ওকে বললাম, ‘না আমি ভাবছি চিরকুমারই আমি থাকতে চাই।’
শুক্লা হেসে একটু টিপ্পনি করলো আমাকে। বললো, চিরকুমার না ছাই? বলো, এখনো তোমার বিদিশার জন্য মন পড়ে আছে। তাই না? বিয়ে করে যে তোকে ছেড়ে চলে গেল। আর তুইও পারিস।