01-07-2021, 11:00 PM
আমি জানি, মা সেদিন সরল মনে মিনুকে সব বলে দিয়েছিল, ‘ও তো ফাংশন দেখেতে গেছে। ফিরবে সেই দেরীতে। আমাকে বলে গেছে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা হবে।’
মিনুর চোখে মুখে তখন কৌতূহল। মাকে জিজ্ঞাসা করে বসলো, কার সাথে গেছে বলতে পারবেন?
মা’ও সরল মনে ওকে বলেদিল, ‘ও যে বললো, বিদিশাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কলেজে ওরা দুজনে কেউ তো যায়নি আজকে। সোজা বাড়ী থেকে চলে গেছে ফাংশনে।’
বাড়ীতে ফেরার পর, মা, মিনুকে সব বলে দিয়েছে দেখে আমি আঁতকে উঠেছিলাম। মিনু কদিন ধরেই আমার পেছনে শুধু পড়ে রয়েছে। খালি জ্বালাতন করছে। ওর ছোটো বোনকে আমায় গান শেখাতে হবে।
আমি রাজী নই। যেটুকু সময় পাই, কলেজ, পড়াশুনা তার বাইরে শুধু বিদিশার সাথে প্রেম। এর মধ্যে মাষ্টারী করার আর আমার সখ নেই। তবু মিনু আমার পেছন ছাড়বে না। একেবারে জোঁকের মতন পেছনে লেগে রয়েছে।
সেদিন মিনুকে কথা দিয়েছিলাম, ওর বাড়ীতে যাব। ঝেমেলাটা সৌগতই আগে পাকিয়ে রেখেছে। ওর হয়ে এমন ভাবে আমাকে সাধাসাধি করতে শুরু করলো, যেন মাথাব্যাথাটা ওর। মিনু সৌগতকে রিকোয়েস্ট করেছে, ‘তুই আমার হয়ে দেবকে রাজী করা। দেব কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। তুই বললে হয়তো রাজী হবে।’
সৌগত মিনুর হয়ে আমার কাছে এসে যখন পীড়াপীড়ি করতে শুরু করলো, ওকে বললাম, তোর এখানে কি স্বার্থ আছে বলতো? কেন এই নিয়ে আমাকে বারে বারে ডিস্টার্ব করছিস?
এটা আসলে সৌগতর দোষ নয়। এটা নাকি আমার গলার দোষ। সৌগত বললো, ‘কি করব? যা গানের গলা তোর। মিনু তোর পুরো ফিদা হয়ে গেছে। ওর ছোটবোন বেশ কিছুদিন ধরেই গান শিখছে। মিনুর ধারণা, তোর হাতে পড়লে ও নাকি ভালো গায়িকা হতে পারবে। এখন ধরেছে আমাকে। দেব তুই আমার মানটা রাখ।’
কলেজ থেকে মিনুদের বাড়ীটা খুব কাছে। গলি ধরে শর্টকাটে গেলে পাঁচ মিনিট। আমি জানি, মিনুর স্বভাবটা ভালো নয়। রোজ কলেজ থেকে একটা করে ছেলে ধরে ওর বাড়ী নিয়ে যায়। যেহেতু বাড়ীটা কলেজের খুব কাছে, কেউ নাও করে না। ইদানিং মিনুকে নিয়ে আদিখ্যেতাটা খুব বেড়ে গেছে সকলের। যেন সবার নয়নের মনি। চার পাঁচটা ছেলের সাথে সবসময় বসে আছে। তারা ওর গায়ের যেখানে সেখানে হাত দিচ্ছে, খুনসুটি করছে। দেখতে ভীষন বাজে লাগে এসব। আমি একটু অন্য স্বভাবের। চোখের সামনে বাড়াবাড়িটা বেশী পছন্দ নয়। তাও কাউকে কিছু বলিনা। ওটা যার যার ব্যক্তিগত, মজ্জাগত স্বভাব। অন্যতে যেটা করে আনন্দ পায়, সেখানে আমার হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।
মিনু কদিন ধরেই ক্যান্টিনে খুব যাতায়াত শুরু করেছে। আগে খুব একটা বেশী আসতো না। কার মুখে শুনেছে, ক্যান্টিনে রোজ একঘন্টা করে আমি গান গেয়ে পুরো ক্যান্টিন মাতিয়ে রাখি। কলেজে আমার এই গুনে সুনাম অনেক। সারা কলেজ আমার গান শোনার জন্য পাগল।
জানি না আমার মধ্যে ও কি পেয়েছিল। মিনুকে প্রথম যেদিন কলেজে দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম ও একটু অন্য টাইপের। বিদিশার মতই মিনুর স্লীম ফিগার। তবে গায়ের রঙটা বিদিশার মত অত ফর্সা নয়। নাকটা একটু চ্যাপটা মতন, চোখ মুখ সুন্দর। তবে বিদিশার মত অতীব সুন্দরী নয়।
কদিন ধরেই মেয়েটাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারটা সেভাবে আসেই নি মিনু। সেসময় নাকি ওর মা মারা গিয়েছিল। কোনরকমে পরীক্ষা দিয়ে সেকেন্ড ইয়ার থেকে আসা শুরু করলো কলেজে। এসেই দেখছে কলেজে আমি তখন খুব ফেমাস। সবাই দেব কে একনামে চেনে। এ কলেজে দেব বলতে একজনই আছে। প্রথমে মিনু আমার গানের ভক্ত হলো। তারপর থেকে যেচে গায়ে পড়ে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করত। আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না। এদিকে কলেজে বিদিশার সাথেও ভালো করে আমি কথা বলতে পারি না। মিনু কাছে থাকলে ছুক ছুক করে। কি যে চায় মেয়েটা আমার ঠিক বোধগম্য হয় না। যখন আমাকে ওর বোনের কথাটা তুললো, তখন ভাবলাম এটা মনে হয় একটা বাহানা। এই সুযোগে আমাকেও বোধহয় ওর বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাইছে। আমি কিছুতেই মিনুর সাথে ভীড়বো না। ওর বাড়ীতেও যাবো না। এরপরে সৌগত যখন এসে আমায় বললো, বিশ্বাসটা কিছুটা হলেও হল। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজী হতে পারছিলাম না। গানের মাষ্টারি করে পয়সা রোজগার করার ইচ্ছা আমার একেবারেই নেই। এটা স্রেফ বন্ধুত্বের খাতিরে আমাকে করতে হবে, আর এর জন্য কিছুটা সময়ও আমার নষ্ট হবে।
আমি সৌগতকে না করে দিয়েছি, কারণ বিদিশাও শুনে আমাকে মানা করে দিয়েছে। ঠিক ফাংশনে যাবার আগের দিন মিনু এসে প্রায় পায়ে ধরে আমাকে সাধাসাধি করতে শুরু করলো। ‘দেব’ তোর পায়ে পড়ছি, তোকে রিকোয়েস্ট করছি, তুই প্লীজ একবার চল। সেরকম হলে সপ্তাহে একদিনের জন্য আসবি। ক্ষতি কি আছে? আমার বোন তাতেই খুশি হবে।
বোনকে খুশি করার জন্য আমাকে যেতে হবে? এতো ভারী আবদার। বললাম, ঠিক আছে কাল একবার যাবো। কিন্তু শেখাবো কিনা বলতে পারছি না। তোর বোনের গলাটা একবার দেখে নেবো। তারপর আমার ভালো ওস্তাদের সাথে জানাশোনা আছে। তোর বোনকে ওখানে পাঠিয়ে দেবো, ভালো তালিম পাবে।
মিনু তাতেই খুশী হল। সেদিন আমার কলেজে গিয়ে, ওখান থেকে মিনুদের বাড়ীতে যাবার কথা। সকালে বিদিশা, ফোন করে বললো, ‘এই আজ একটা ফাংশন দেখতে যাবে? নেতাজী ইন্ডোরে। বোম্বে থেকে ভালো ভালো আটিস্ট আসছে।
আমি বললাম, টিকিট কত করে? বিদিশা বললো, তিনশ টাকা করে। ওই নিয়ে তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। টিকিটের দাম আমি দেবো। তবে আমি বাড়ীতে কিছু বলতে চাই না। বাবা শুনলে যেতে দিতে চাইবে না। কলেজে না গিয়ে আমরা না হয় একটু ঘুরবো, ফিরবো, তারপর বিকেলে পৌঁছে যাবো, নেতাজী ইন্ডোরে।
মিনুকে শেষমেষ কথা দিয়েও কলেজে যাইনি বিদিশার জন্য। বিকেলবেলা আমার বাড়ীতে এসে হাজির। সাথে সৌগতকেও নিয়ে এসেছে। কেন কলেজে যাইনি, সেটা আবার যাচাই করছে এসে। সাংঘাতিক মেয়ে।
বিদিশার মত আমাকে প্রেম নিবেদন করেনি মিনু। কিন্তু ওর ওই একটা আবদার মেটাতে গিয়ে আমাকে কত খেসারত দিতে হয়েছিল, সে কথা বলবো আপনাদের, পরে।
ডায়েরীর কয়েকটা পাতা লেখা শেষ করে এবার আমি উঠে পড়লাম। সত্যি অনেক দেরী হয়ে গেছে। এবার রেডী হয়ে আমাকে বেরোতে হবে। মা’ও দেখি তখন আমার খাবার বেড়ে দেবার তোড়জোড় করছে। সেলফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছি, শুভেন্দুকে একটা ফোন করবো কিনা? আমার যেন আর তর সইছে না। ভাবছি, সাতটা নয়, দুঘন্টা আগেই নয় ওর বাড়ী চলে যাবো। গিয়ে বলবো, ‘দ্যাখ, তুই ডেকেছিস, আমি আগে ভাগেই তাই চলে এসেছি। এবার বল, কি সারপ্রাইজ দিবি আমাকে।’ব্যাপারটা জানতে খুব ইচ্ছে করছিলো। তখন কত করে জানতে চাইলাম। শুভেন্দু কিছুতেই বললো না আমাকে। ওখানে না যাওয়া অবধি ও কিছুই বলবে না আমাকে। শুভেন্দু বলেছে, সন্ধেবেলা রনিও আসবে ওর বউকে নিয়ে। তিনজনে আমরা গল্প করবো, খুব মজা হবে।
সারপ্রাইজের কথাটা এখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি, শুভেন্দুর স্বভাবটা বরাবরই এরকমের। ও কিছুতেই আগে থেকে কিছু বলে না। আমাকে যেমন বিদিশাকে চিঠি দেবার ব্যাপারটা লুকিয়েছিল। একবার কাউকে কিছু না বলে কুলুমানালি সিমলা ঘুরে এলো। ফিরে যখন এলো তখন ও খুব অসুস্থ। বাড়ীতে গিয়ে জানলাম ও বেড়াতে গিয়েছিল তারপর ফিরে এসেই এই কান্ডটা বাঁধিয়েছে। অথচ কলেজে আমাদের কাউকেই কিছু বলে যায়েনি ও। বাবু ফিরে এসেছেন ওখান থেকে। সুন্দর সুন্দর কিছু গিফ্ট কিনে এনেছেন বন্ধুদের জন্য। আমাকে বললো, কলেজে যেতে পারছি না, তাই তোদের বাড়ীতে ডেকে গিফ্টগুলো সব দিচ্ছি, এটাও একধরনের সারপ্রাইজ।
শুভেন্দু কখন কি বলে, আর কখন কি করে বসে বোঝা মুশকিল। আমাকে বললো, ভাবছি ‘দেব’ এবার তোদের মত আমিও একটা প্রেম করবো। তোকে আর সৌগত দেখে আমারও লাইন মারতে ইচ্ছে করছে শালা! ভালো জমিয়েছিস তোরা, দুজনে যা শুরু করেছিস, এবার না ইতিহাস রচনা হয়ে যায়।
প্রেমের অনেক ডেফিনেশন আছে। শুভেন্দুকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। শুভেন্দু বলতো, প্রেম হচ্ছে সব বেকার জিনিষ। ওসব মূর্খরা করে। চালু লোকেরা কখনও প্রেম করবে না। দুদিন মেয়েটেয়ে নিয়ে ঘুরবে, তারপর ফুটিয়ে দেবে। ব্যাস।
আমি বলতাম ও তো অসামাজিক প্রেম হয়ে গেল। সামাজিক প্রেমের, সত্যিকারের ভালোবাসার ডেফিনেশনটাই অন্যরকম।
শুভেন্দু বলতো, তুই বোঝা দেখি-
আমি বলতাম, দেখ, তুই প্রেরক হিসেবে বা প্রেরনাদায়ক হিসেবে কাউকে চাস না জীবনে?
শুভেন্দু বলতো, প্রেরণা না হাতি। এখন মেয়েরা শুধু পয়সা চায় পয়সা। বুঝলি? ও তোকে মোটিভেশন দেবে কি? পয়সাটাই ওদের কাছে মোটিভেশন।
-তাহলেও জীবন সঙ্গিনীতো একটা দরকার। যে তোকে অনাবিল এক আনন্দের স্তরে নিয়ে যাবে। তোকে ভালোবাসবে, আদর করবে, সোহাগ করবে, চুম্বন করবে। একাকীত্ব ঘুচিয়ে দেবে। রমনী ছাড়া জীবন কি করে কাটাবি, এ কখনো হয় নাকি? এখন যে যুবতী, সেই তো হবে তোর রমনী।’
আমার কথা শুনে কেমন ভাবুক মত হয়ে গেল শুভেন্দু। শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে বললো, কিন্তু কার সাথে প্রেমটা করা যায় বল দেখি। তুই তো শালা ভালোটাকে নিয়ে বসে আছিস। কলেজে মেয়েগুলো সব ঢোকে, দুদিনের মধ্যেই অন্য ছেলের সাথে ফিট হয়ে যায়। সেরকম কে আছে, যে আমার সাথে প্রেম করবে?