01-07-2021, 10:57 PM
পাঁচ
‘তোর মনে হচ্ছে আজ অফিস যাবার কোনো ইচ্ছে নেই। সকালে উঠেই ডায়েরী খুলে বসে গেছিস লিখতে। ঘড়িতে কটা বেজেছে, খেয়াল করেছিস?’
মাকে দেখলাম আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার পিঠে হাত দিয়ে দেখছে, আমি আপন মনে কিসব লিখে যাচ্ছি। মা বললো, ‘কি লিখছিস? গল্পো?’ হেসে বললাম হ্যাঁ মা গল্পো। তবে জীবনের কিছু পুরোনো কথাও এর মধ্যে আছে। ওগুলো সব মনে পড়ে যাচ্ছে, তাই একটার পর একটা লিখে যাচ্ছি।
‘অফিসে যাবি না?’
‘হ্যাঁ যাবো তো। এই আর একটা পাতা লিখে নিই।’
মা জানে লেখার নেশাটা আমার অনেকদিনের। সেই ছোটবেলা থেকে লিখে আসছি। কত কিছু লিখলাম। বিদিশাকেও আমার কতগুলো লেখা পড়িয়েছিলাম। আমার গল্প আর কবিতা গুলো পড়ে বিদিশা বলেছিল, ‘তুমি এত ভালো গান গাও, আবার এত ভালো লেখো, এতসব পারো কি করে? কি প্রতিভা তোমার।’
আমি বলেছিলাম, ‘দূর। এরজন্য আবার প্রতিভার দরকার হয় নাকি? লিখতে লিখতে ওটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। আর গানটা গাইতে গেলে সাধনা করতে হয়। সবই রেওয়াজের ওপর। প্র্যাকটিস না করলে কোনকিছুতেই দক্ষ হওয়া যায় না।
বিদিশা জানতো না ওকে দেওয়া আমার চিঠিটা শুভেন্দু লিখে দিয়েছিল। আমাকে বললো, ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে একটা সুন্দর প্রেমপত্র লিখবে। শব্দের মালা বসিয়ে যেমনটা তুমি লেখো। চিঠিটা পড়ে আমিও আবেগে আপ্লুত হয়ে যাবো। আমার ভেতরের অনুভূতিটা চিনচিন করে উঠবে। তা না। কি একটা লিখলে। ওটা কি প্রেমপত্র হল?’
হেসে বলেছিলাম, ওটা তো আমি লিখিনি। ওটা শুভেন্দু আমার হয়ে লিখে দিয়েছিল।
বিদিশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, কেন? শুভেন্দু লিখবে কেন? তোমার ঠিঠি ও লিখবে কেন?
এই রে বোকার মতন সত্যি কথাটা বলে এখন বিপদে পড়ে গেছি। যাতে ওর রাগ না হয়, বিদিশার গালে হাত রেখে বলেছিলাম, শুভেন্দু তাড়াহূড়ো করে না লিখলে, সেদিন তুমি কি ক্যাফেটরিয়াতে আসতে? না আমরা একে অপরকে ভালবাসতে পারতাম? মিছিমিছি ওর ওপর রাগ করছ। ও তো আমাকে জানিয়েই চিঠি লিখেছে তোমাকে।
একটু যেন মন খারাপ করে ফেলেছিল বিদিশা। ভুলটা আমারই জন্য। রাগ ভাঙাতে আমি কত কিছু করলাম। ওর জন্য মান্না দের গানটা গাইলাম, ‘সুন্দরী গো দোহাই তোমার মান কোরো না। আজ নিশীথে, কাছেই থেকো। না বোলো না। সুন্দরী গো।’
কলেজে গিয়ে বিদিশার ক্লাসে ঢুকে গেলাম সোজা। দেখলাম বিদিশা চুপ করে বসে আছে সিটে। মুখটা ভারভার। উস্কো খুস্কো। ওর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। বিদিশা লজ্জা পেয়ে গেলো। ওর ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলো আমাকে দেখে বলতে লাগল, ‘আরে গায়ক মশাই যে। তা হঠাৎ আমাদের ক্লাসে পদার্পন। কি মনে করে?’
আমি বিদিশার হাত ধরে টানছি। ‘এই চলো না চলো না।’ ও লজ্জা পেয়ে বললো, ‘ধ্যাত। কি হচ্ছেটা কি? সবাই দেখছে। ছাড়ো বলছি।’
আমিও অগত্যা চুপ করে বসে রইলাম। একটু পরে প্রফেশর এলেন। আমাকে দেখে ভিমরী খেলেন। বললেন, ‘দেব’ তুমি এখানে? কি ব্যাপার? নিজের ক্লাসে না গিয়ে এখানে বসে কি করছ?আমি নাছোড়বান্দা প্রেমিকের মত জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে আছি। বিদিশা ওই দেখে মুখ টিপে ফিক ফিক করে হাসতে লাগলো। ক্লাসের বাকীরাও সবাই হাসতে লাগল। বুঝলাম জোর ফাঁসা ফেসেছি আজকে। একেবারে বেইজ্জ্বত হয়ে গেছি। আজ আমার রেহাই নেই। সেদিন কলেজে ঢ্যাড়া পিটে গেল, সবাই জেনে গেল, তারমানে আমি বিদিশার সাথে প্রেম করি।
বিদিশা খুব লজ্জ্বা পেয়েছিল সেদিন। ওর রাগ ভাঙাতে আমি যে এতটা করতে পারি, ওর ধারনা ছিল না। বিদিশা কখনও আমাকে ভুল না বোঝে, আমাকে খারাপ না ভাবে আমি সবসময়ই চেষ্টা করতাম। ওর জন্য আমি একটা গান লিখতে চেয়েছিলাম, সেটা লেখা হয় নি। কিন্তু বিদিশা আমাকে বলেছিল, তুমি যেদিন আমাকে নিয়ে কিছু লিখবে, সেদিন বুঝবো, তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। কোন গল্প কাহিনী, কবিতা, উপন্যাস। পারবে আমাদের প্রেম কাহিনী নিয়ে লিখতে?
বিদিশাকে বলেছিলাম, কেন পারবো না? ও তো আমার কাছে জলভাত।
‘তাহলে লিখে দেখাও।’
কলম নিয়ে সেদিন আর কিছু লেখা হয় নি। কিন্তু আজ লিখছি। ‘বিদিশা তুমি জানো না, আমার জীবন কাহিনীর কতটা অধ্যায় জুড়ে তুমি বসে আছো। সব কথা আজ লিখতে চাই, তোমার আর আমার প্রেমকাহিনী নিয়ে সবাইকে সব কথা বলতে চাই। কিন্তু তুমি তো এখন অনেক দূরে। এ লেখা কি শেষ পর্যন্ত তোমাকে পড়াতে পারবো বিদিশা? তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছো। আর তো ফিরে আসবে না কোনোদিন। তাহলে?
একটু হেসে মা পেছন থেকে বললো, কার কথা লিখছিস?
মাকে কি আর বলতে পারি, বিদিশার কথা। বললাম,ঐ কলেজের সব ঘটনাগুলো লিখছি। যেগুলো যেগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে, সেগুলো।
মা আমার কথাটা শুনে কেমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। বললো, ‘কেন লিখছিস ওসব পুরোনো কথা? কে মনে রাখে? নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট দিস। এখনো ভুলতে পারিস নি তুই বিদিশার কথা। তাই না?
‘তুমি কি করে জানলে আমি বিদিশার কথা লিখছি? আমি তো-’
মা বললো, আমার চোখকে তুই ফাঁকি দিতে পারবি? যে মেয়েটা তোকে ছেড়ে চলে গেলো। একবার ফিরেও তাকালো না। ঘর করলো না, তার কথা তোর এখনো মনে পড়ে? কি পেয়েছিস তুই বিদিশার কাছ থেকে? সত্যিকারের ভালবাসা? ও যদি তোকে সত্যি ভালোবাসতো, তাহলে কি এভাবে ছেড়ে যেত?
আমাকে বলে নিজেই একটু বিষন্ন হয়ে পড়লো মা। সেদিন মায়ের চোখে আমিও জল দেখেছিলাম, আজ আবারো দেখলাম। ডায়েরীর পাতাটা বন্ধ করে মাকে বললাম, এই দেখো, তুমি আবার মন খারাপ করছো। তাহলে লেখাটা বন্ধ করে দিই। মা আমার মাথায় হাতটা রাখলো। বললো, না রে বাবা, তুই লেখ। আমি তো এমনি বলছিলাম।
মাকে বললাম, এই দেখো না শুভেন্দু এতদিন বাদে ফোন করলো, আমাকে ওর বাড়ী যেতে বললো, আর আমারো পুরোনো কথা সব মনে পড়ে গেল। তাই ভাবি একটু লিখি। তুমি যখন বলছো, তাহলে লিখবো না।মা আবারো আস্বস্ত করলো আমাকে। বললো, ‘না তুই লেখ। আমি তোকে বাঁধা দেবো না। আজ অবধি তোর কোনো কাজে বাঁধা দিয়েছি কি? তবে তুই যদি এখন না বেরোস, তাহলে আমাকে বলে দে। আমি একটু স্নানটা সেরে আসি। এসে তাহলে তোর খাবারটা বেড়ে দেবোখনে।
মা’কে বললাম, ঠিক আছে তুমি যাও। আমি একটু পরেই লেখালেখি শেষ করছি।
যাবার আগে মা বললো, বিদিশারা এখন কোথায় থাকে রে? বিয়ের পরে তো মুম্বাই চলে গিয়েছিল শুনেছিলাম। এখন কি ওখানেই?
মাকে বললাম, তোমার এখনো মনে আছে তাহলে। মা বললো, কেন তুই তো আমাকে বলেছিলিস। ওর মুম্বাইতে বিয়ে হয়েছে। পয়সাওয়ালা শশুড় বাড়ী পেয়েছে। সুখে ঘর করছে। আর হবে নাই বা কেন? ওরা নিজেরাও তো খুব বড়লোক ছিলো।
মাকে বললাম, এখন আর বিদিশার খবর জানি না মা। আর জানবোই বা কি করে? ও তো পরে আর যোগাযোগ করেনি আমার সঙ্গে। চলে যাবার পরে কোনো ফোনও করেনি আমাকে।
যাবার আগে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মা বললো, ‘ছেলে আমার বিদিশা বিদিশা করেই গেলো। এবার একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে কর। তাহলে আমিও একটু হাল্কা হই।’
মা চলে গেল। আমি আবার ডায়েরীটা খুলে ভাবছি কি লিখবো। কলেজের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আরো লিখতে ইচ্ছে করছে। বিদিশার সাথে আমার প্রেম। নেতাজী ইন্ডোরে অনেক রাত অবধি জলসা দেখতে গিয়ে কি অবস্থা হয়েছিল সেদিন। বিদিশা বাড়ীতে বলে আসেনি। আর প্রোগ্রাম শেষ হবার পর ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে বেরোনোর সময়ই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টিতে কেউ বেরোতে পারছে না অডিটোরিয়াম থেকে। বিদিশা আমার হাতটা ধরে বললো, কি হবে বলোতো? বাড়ীতে বলে আসিনি। এখন বৃষ্টি। মা আমাকে পুরো খেয়ে ফেলবে। কিছু একটা ব্যবস্থা করো। একটা ট্যাক্সি। যেমন করে পারো।
বিদিশা যাতে সময় মত বাড়ী পৌঁছোতে পারে বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে ভিজে চপচপে হয়ে ওর জন্য ছুটে গিয়ে ট্যাক্সি ধরেছিলাম। বাড়ীতে ওকে ড্রপ করে দিয়ে যখন নিজের বাড়ী ফিরছি, তখন বাজে রাত্রি একটা। মা বসে আছে ঘরে। আমার জন্য প্রবল চিন্তা করছে। আমি ঘরে ঢুকতেই মা বললো, তুই বিদিশা ছাড়া আর কটা মেয়ের সাথে ভাব পাতিয়েছিস?
আমি অবাক। মাকে বললাম, কেন? একথা বলছো কেন?
মা বললো, মিনু বলে একটা মেয়ে এসেছিল সন্ধেবেলা। তোর খোঁজ করছিল। বললো, মাসীমা দেব কোথায় গেছে বলতে পারবেন? আজ তো কলেজে দেখলাম না ওকে।
চমকে উঠেছিলাম আমি। মিনু? কেন? ও কেন আমার বাড়ীতে আসবে? আর ওকে বাড়ীর ঠিকানাই বা কে বললো, তাহলে কি সৌগত?
মা বললো, ‘মেয়েটা একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে এসেছিল। আমাকে বললো, আমি দেবের বন্ধু। আর এ হলো সৌগত। আমরা দুজনেই দেবের বন্ধু। দেবকে খুব দরকার। বলুন না ও কোথায় গেছে?