29-06-2021, 02:10 PM
এখন আর সুনিতার আকাশের সাথে কথা বলতে বা ওর কথা ভাবতে লজ্জা করে না। আকাশও সুনিতাকে এক বন্ধু হিসাবে নিয়েছে। অনেক সময় মীনা এসে আকাশের সাথে গল্প করে আর ওর মাকে গিয়ে আকাশের সম্বন্ধে বলে। ওর মার আকাশকে নিয়ে বেশ ভালো ধারনাই হয়েছে। কিন্তু উনি মালায়ালাম ছাড়া কোন ভাষা জানেন না। তাই শনিবার আকাশ ফিরলে মীনাকে দোভাষী করে ওর সাথে কিছু কথা বলেছে। জেনেছে ও কি করে, বাড়ীতে কে কে আছে এইসব। ফলে শনিবার রাত্রে সুনিতা যখন ওর মাকে বলল ও আকাশের কাছে গল্প শুনতে যাবে তখন কোন আপত্তি করেনি। ওর মার মাথায় ছিল ছেলেটাতো দুদিন পরে চলেই যাবে, কিই বা করবে সুনিতার সাথে। তার থেকে সুনিতা এমনি তো একাই থাকে। দুদিন একটা বন্ধু পেয়ে যদি ওর ভালো লাগে তাতে ক্ষতি কি।
সুনিতা লতা আর দিব্যাকে হাত ধরে আকাশের সামনে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দিল। লতা আর দিব্যাকে দেখিয়ে বলল ওরা ওর সবসময়ের সাথী। পড়াশুনো, খেলা, হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ সব ওদের সাথেই। আর আকাশকে দেখিয়ে বলল ওর একমাত্র বন্ধু। ওকে ওর খুব ভালো লাগে। ওরা চারজনে কিছুক্ষন গল্প করার পড়ে আকাশ উঠে ঘরে গেল আর মেয়ে তিনটে নাচতে নাচতে ক্যানালের ধারে চলে গেল। ওর মা খেতে ডাকলে বলে গেল ওর খিদে পায়নি। ওর মা বললেন এইরকম সময়ে ওনারও ক্ষিদে পেত না।
সুনিতা এই দুদিনে দেখেছিল আকাশ সূর্যোদয় দেখার পরেই চা খায়। সেইজন্য রবিবার সকালে চায়ের জোগাড় করে রেখেই বেরিয়ে ছিল। একসাথে সূর্যোদয় দেখার পর ও আকাশকে একটু বসতে বলে ঘরে গিয়ে ওর জন্য চা আর বিস্কুট নিয়ে এলো। ওর মা শুয়ে শুয়ে সেটা দেখে নিজের মনে হাসল। আসলে ওর মা নিজে যখন যখন ছোটো ছিল তখন যাকে ভালো লাগতো সেটা কোনদিন কাউকে বলতে পারেনি। ওনার বাবা যখন বিয়ে দিয়ে দেয় মুখ বুজে বিয়ে করে নিয়েছিলেন। উনি বুঝতে পারছিলেন সুনিতা ওই ছেলেটাকে কোনভাবে পছন্দও করেছে কিন্তু যেহেতু আকাশ বেশী দিন থাকবে না তাই কোন বাধা দেননি।
সুনিতা চা নিয়ে আসতেই আকাশ অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞ্যাসা করল সুনিতা কি করে জানল যে ও সাকালে চা খায়। সুনিতা বলল ও দেখেছে ওকে সকালে চা খেতে আর সিগারেট খেতে। আকাশ কৃত্রিম রাগ করে বলল যে সুনিতা ওর ওপর spying করছে। ( এই spying কি জিনিস আকাশের সেটা সুনিতাকে বোঝাতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল)। সুনিতা বলল ও মোটেই ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে নি। এমনিই দেখতে পেয়েছে। ওর যাকে ভাললাগে তার কি কি ভালো লাগে সেটা ওর জানার অধিকার আছে। এইটা বলেই সুনিতা কি বলেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে চুপ করে গেল। ওর গাল আবার লাল হয়ে গেল। আকাশ বুঝে গিয়েছিল এই সুনিতা মেয়েটা ওকে মনেমনে ভালবাসতে শুরু করেছে। তাই সুনিতা ভালো লাগার কথা বোলাতে ও একটুও আশ্চর্য হল না। বরঞ্চ দুষ্টুমি করে জিজ্ঞ্যাসা করল সুনিতার কেন ওকে ভালো লাগে। সুনিতা চুপ করে থাকল। আকাশও কিছু না বলে চা খেয়ে নিল। তার পরে উঠে যেতে গেলে সুনিতা ওর হাত ধরে ফেলল, আর জিজ্ঞ্যাসা করল ও রাগ করেছে কিনা। আকাশ এবার অবাক হয়ে বলল ওকে যদি একটা মেয়ে পছন্দ করে তাতে ওর কেন খারাপ লাগবে। সুনিতা জিজ্ঞ্যাসা করল আকাশ কোথায় যাচ্ছে। এবার আকাশ খুব জোরে হেঁসে বলল সারাদিন ধরে খেয়ে গেলে সকাল বেলায় কিছু বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ করতে হয়। সেটা তো শেষ করতে হবে। সুনিতা ভীষণ লজ্জা পেয়ে যেটা বলতে গেল সেটা ইংরাজিতে বলতে না পেরে নিজের ভাষায় বলল, যার মানে “তুমি না ভীষণ অসভ্য”। আকাশ কথাটার আক্ষরিক মানে না বুঝলেও, আন্দাজ করল কি বলতে পারে। তারপর জিজ্ঞ্যাসা করল সুনিতার ওকে কেন ভালো লাগে।
সুনিতা আস্তে করে বলল, “সেটাই তো ভেবে ভেবে বুঝতে পারছি না তোমাকে কেন ভালো লাগে, সেই প্রথম দিন দেখার থেকেই ভালো লাগে”।
আকাশ বলল ও এসে গল্পটা পড়ে শোনাবে। চার পাঁচদিন লাগবে। হয়ত ওই গল্পটা শুনলে নিজের মনকে অনেক ভালো ভাবে বুঝতে পারবে।
রবিবার সকালে দুজনে পাশাপাশি বসল মেহগনি গাছের নীচে। সূর্য নিজের মনে উদিত হল। সূর্যের কিছু আসে যায় না এই দুটো ছেলে মেয়ের মনের মধ্যে কি হচ্ছে তা নিয়ে। আসলে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে যখন কোন সম্পর্ক তৈরি হয় তখন অন্য কেউই তা জানতে পারে না। তাই সম্পর্ক তৈরি করার যে টানা পোড়েন সেটা ওই দুজনকেই সামলাতে হয়। সূর্য নিজের মনে উঠতে থাকলেও ওরা চুপ করেই দেখছিল আর ওদের মনের মধ্যে সমুদ্রের তোলপাড় চলছিল। সুনিতা সেই একই কথা ভাবছিল যে ওর কেন আকাশকে ভালো লাগে। আর কতদিন থাকবে এই সম্পর্ক। আকাশ ভাবছিল ও কি সত্যিই পছন্দ করে এই মেয়েটাকে। তারপর ভাবল পছন্দ নিশ্চয়ই করে এই মেয়েটার নিস্পাপ প্রকৃতি। ওর ভয় হতে লাগলো ও যদি এই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলে তবে কি হবে! এত দুরের একটা মেয়ে কখনই ওর সাথে যেতে পারবে না। তবে ওর কি উচিত ওদের সম্পর্ককে আগে বাড়তে দেওয়া! এই সব ভাবতে ভাবতে কখন দুজনে হাত ধরে ফেলেছে বুঝতে পারেনি। কিন্তু যখন বুঝতে পারল তখন সুনিতা হাত ছাড়িয়ে নিল না। ওর কিরকম যেন ভালো লাগতে লাগলো। দুজনেই অন্যের হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরল। আকাশ দুই হাতের সন্ধির ওপর ওর আরেকটা হাত রেখে দিল। সূর্য অনেক ওপরে উঠে গেছে। রোদের তেজ বেড়ে গেছে। কিন্তু কেউই আর হাত ছেড়ে যেতে পারছে না।
অন্য দিন সুনিতার বাবা একদম ভোর বেলা অফিসে যায়। রবিবার দুপুরের পড়ে যায় আর সোমবার ছুটি। সেদিন সকালে বাড়ি ছিল। ওর বাবা উঠে দেখে মেয়ে একটা ছেলের পাশে বসে আছে। দেখেই ওর বাবা জোরে ডেকে উঠলেন। ডাক শুনেই সুনিতা হাত ছেড়ে দিল। আর ওর মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যেতেই উনি বুঝতে পারলেন কি হয়েছে। উনি তাড়াতাড়ি এসে সুনিতার বাবাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে সব বোঝাতে লাগলো। ওদিকে সুনিতাদের যা হবার হয়ে গেছে। দুজনেই উঠে পড়েছে। আকাশ ঘরে চলে গেল। সুনিতাও ঘরে চলে গেল আর বাবার দিকে ভয়ে ভয়ে দেখতে থাকল। ওর বাবা জিজ্ঞাসা করতে ও সহজ ভাবেই বলল ওর খুব বন্ধু। ওর বাবা আর কিছু বললেন না। আকাশ একঘণ্টা পড়ে ঘর থেকে বইটা নিয়ে বেরোতেই সুনিতা বাবা ওকে ডাকলেন। কিন্তু উনিও ইংরাজি জানতেন না। কিন্তু ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি জানতেন। উনি আকাশের সাথে কথা বলে মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে এই ছেলে ওর মেয়েকে খারাপ কিছু করতে পারে না। শুধু বললেন আকাশ যেন সুনিতাকে কখনো দুঃখ না দেয়। আকাশ কিছু না বলে নিঃসব্দে মাথা হেলিয়ে চলে এলো।
একটু পড়ে সুনিতা কলার চিপস আর চা নিয়ে এলো। আকাশ চেয়ারে বসে ছিল। সুনিতা একটা ছোটো স্টুল এনে ওর পাশে বসল। আর বলল চা খেয়ে আমাকে গল্প শোনাও। আকাশ জিজ্ঞাসা করল বাবা বকেছে কিনা। সুনিতা বলল ওর বাবা ওকে বিশ্বাস করে আর আজ আকাশকেও বিশ্বাস করেছেন। আকাশ জিজ্ঞাসা করল কিসের বিশ্বাস। সুনিতা বলল, “দেখো একটা ছেলে একটা মেয়ের কি কি ক্ষতি করতে পারে সেটা বোঝার বয়স আমার হয়েছে। ভালবাসা কাকে বলে সেটা ঠিক এখনও বুঝতে পারিনা। তুমি হয়ত পার। কিন্তু আমি প্রথম দিনই তোমার চোখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম এই ছেলেটাকে বিশ্বাস করতে পারি। এ আমাকে কোনদিন কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। এতদিন বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আজ বুঝতে পেরেছি সেই জন্যই প্রথম দিন থেকেই তোমাকে ভালো লাগে”।
আকাশ বলল, “আমার চোখের মধ্যে কি এমন আছে যে একটু দেখেই এত সব বুঝে গেলে ? আমি তো রোজ দেখি আমার চোখ দুটো আয়নাতে, কিছু তো বুঝতে পারি না! কিন্তু আমি তোমার চোখে একটা সরল নিস্পাপ মেয়ের ছবি দেখি। আর আমারও মনে হয়েছে তোমাকে বিশ্বাস করা যায়”।
সুনিতা বলল, “দেখো যখনই আমরা নতুন কাউকে দেখি, প্রথমেই তার চোখ দেখি আর চোখের মধ্যে বিশ্বাস খুজি। যদি খুঁজে পাই তখনই মনে মনে বন্ধুত্ব করে নেই। যাই হোক এখন গল্পটা পড়”।
ওরা গল্পটা পড়ুক আমরা ততক্ষন কিছু অন্য কথা বলে নেই। এই ঘটনাটা হচ্ছে ১৯৮৫ সালের। আকাশ ১৯৮৫ সালের ৮-ই জানুয়ারি পালঘাটে গিয়েছিল। তখন কারো কাছে মোবাইল ফোন কেন সাধারণ ফোনও ছিল না। রেডিও ছিল, টেলিভিশন খুব কম ছিল। ল্যাপটপ ছিল না। কম্পিউটার ছিল কিন্তু অনেক বড় অফিসে একটা বা দুটো। আর চেতন ভগতের লেখা “Two States” বইটাও ছিল না যেটাকে এখন দুই ভিন্ন দেশের ছেলে মেয়ের মধ্যে কি ভাবে বিয়ে দেওয়া যায় তার Made easy Solution হিসাবে দেখা যায়। এইরকম অনেক কিছুই ছিল না। কিন্তু আবার অনেক কিছুই ছিল যা এখনকার প্রজন্মের ছেলেরা দেখেনি। সেসব লিখতে গেলে আরেকটা অন্য গল্প হয়ে যাবে।
আকাশ যতটুকু পড়ে শোনাল তার সারাংশ হল –
তিন বন্ধু জার্মানির লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্কের লেখা। পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রেমের উপন্যাস। এই গল্পটা শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের জার্মানিতে। তিনজন বন্ধু যারা কোনরকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে আর কিভাবে একটা মেয়ের সাথে মিলে যায় সেই নিয়ে এই গল্প।
রবার্ট লোকাম্প নিজের ভাষায় গল্পটা বলছে। রবার্ট ওর দুই বন্ধু অটো কেস্টার আর গটফ্রেড লেন্তস এর সাথে ওর জন্মদিন পালন করা দিয়ে গল্প শুরু। ওরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি আর যুদ্ধের পরের জীবন ধারনের জুদ্ধ নিয়ে জর্জরিত। রবার্টের শুধু মনে পরে যুদ্ধের সময়কার গোলাগুলি, গ্যাস অ্যাটাক, বোমার শব্দ, ওর যুদ্ধের সাথীদের মৃত্যু এইসব। আর যুদ্ধের পরের বেকারত্ব, দারিদ্র আর খেতে না পাওয়া নিয়েই চলছিল। শেষে অটো কেস্টার একটা গাড়ি রিপেয়ারের গ্যারাজ খুললে সেখানে রবার্ট আর লেন্তস কাজ করতে থাকে আর যুদ্ধের পরের ভীষণ কঠিন জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই চালাতে থাকে।
সকাল সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত পড়ে আর শুনে ওরা থামে। সুনিতা বলল, “দেখো এই বইটা পড়ার আগেই আমি বুঝে গেছি আমার তোমাকে কেন ভালো লাগে” আকাশ ওকে বসতে বলে ঘরে গিয়ে কিছু একটা নিয়ে সাথে সাথে চলে এলো। চেয়ারে বসে সুনিতাকে কাছে ডাকল। সুনিতা এলে ওকে ওর সামনে মাটিতে ওর দিকে পেছন করে বসতে বলল। তারপর ওর মাথাটা নিজের দুই হাঁটুর ওপর নিয়ে চোখ বন্ধ করতে বলল। সুনিতা নির্দ্বিধায় চোখ বন্ধ করে আকাশের ওপর শরীর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকল। আকাশ একটা কালো সুপার ফাইন ইঞ্জিনিয়ারিং পেন দিয়ে ওর ঠোঁটের তিলটাকে একটু বড় করে দিল। ঠিক তক্ষুনি লতা আর দিব্যা আসলো আর সুনিতাকে ওই ভাবে দেখে হই হই করে উঠল। সুনিতাও লাফিয়ে উঠে পড়ল। দিব্যা বলল সুনিতাকে বেশী সুন্দর দেখাচ্ছে কিছু একটা বদলে গিয়েছে। লতা বলল প্রেমিকের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকার পর সব মেয়েকেই বেশী সুন্দর লাগবে। দুদিন পড়ে সুনিতা আবার লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ওরা তিনজনেই মালয়ালমে কথা বলছিল ফলে আকাশ কিছু বুঝতে পারছিল না। তাই ও বেরসিকের মত দুটো নতুন মেয়ের পেট দেখছিল।
সুনিতা লতা আর দিব্যাকে হাত ধরে আকাশের সামনে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দিল। লতা আর দিব্যাকে দেখিয়ে বলল ওরা ওর সবসময়ের সাথী। পড়াশুনো, খেলা, হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ সব ওদের সাথেই। আর আকাশকে দেখিয়ে বলল ওর একমাত্র বন্ধু। ওকে ওর খুব ভালো লাগে। ওরা চারজনে কিছুক্ষন গল্প করার পড়ে আকাশ উঠে ঘরে গেল আর মেয়ে তিনটে নাচতে নাচতে ক্যানালের ধারে চলে গেল। ওর মা খেতে ডাকলে বলে গেল ওর খিদে পায়নি। ওর মা বললেন এইরকম সময়ে ওনারও ক্ষিদে পেত না।