28-06-2021, 03:05 PM
(This post was last modified: 01-01-2022, 11:37 AM by Bumba_1. Edited 9 times in total. Edited 9 times in total.)
মহালায়া .. দুর্গাপুজো .. এবং
লেখা এবং প্রচ্ছদ :- বুম্বা
আমার জন্মের পর থেকে প্রায় পঁচিশ'টা বছর কেটেছে বাবার অফিস সংলগ্ন কম্পাউন্ডে। ক্যাম্পাসটি আনুমানিক ২০ একর জমির উপর অবস্থিত। ওখানে একতলা দোতলা মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশটা বিভিন্ন পদাধিকারী অফিসার্সদের কোয়ার্টার তো ছিলোই। তার সঙ্গে কম্পাউন্ডের অন্য প্রান্তে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার, দারোয়ানদের কোয়ার্টার, বাগানের মালি এবং সুইপারদের কোয়ার্টার আলাদা করে ছিলো। এছাড়াও তিন কামরার একটি বড়সড় রিক্রিয়েশন ক্লাব, দুটি প্রমাণ সাইজের ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার মাঠ এবং বিস্তৃত ফল ও ফুলের বাগান ছিলো .. যেখান থেকে আমি বাতাবিলেবু চুরি করে খেতাম। আর সুইমিং পুলের কথা তো আগের কাহিনীতেই উল্লেখ করেছি। ওহো, ছিলো কেনো বলছি! এখনো সবকিছুই আছে, শুধু আমি আর সেখানে থাকি না।
অত বড় কম্পাউন্ডের এত সংখ্যক পরিবার, তাই ওখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকতো। যদিও ওখানকার পরিবার গুলোর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই অবাঙালি ছিলো। তবুও আমাদের কম্পাউন্ডের সেরা উৎসব ছিলো দুর্গাপুজো এবং হোলি।
দুর্গাপুজোর ওই চারটে দিনের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম আমরা কচিকাঁচারা এবং অবশ্যই বড়রাও। কোথা দিয়ে যে ওই চারটে দিন অতিবাহিত হয়ে যেতো আমরা বুঝতেই পারতাম না। ষষ্ঠীর দিন পুজোয় কেনা নতুন জামা-কাপড় পড়ে মাঞ্জা দেওয়া থেকে শুরু করে, অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি, ষষ্ঠী থেকে নবমী .. ওই চার দিন দুপুরে ও রাতে রিক্রিয়েশন ক্লাবে পাত পেড়ে মহাভোজ খাওয়া এবং সবশেষে দশমীর বিকেলে সিঁদুরখেলা। এইসব আনন্দ স্মৃতি থেকে কোনোদিনও বিলুপ্ত হওয়া সম্ভবপর নয়।
যেহেতু সাহেবি আমলের কোম্পানি এবং সেই সময়ও মালিকদের অর্থাৎ দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের একাংশ বিদেশি ছিলেন (এখনো আছেন হয়তো) তাই কুৎসিত হোক, কালো হোক, মোটা হোক, বেঁটে হোক - অধঃস্তন কর্মচারীরা সম্পূর্ণ স্বদেশী ঊর্দ্ধতন অফিসারদের 'সাহেব' এবং তাদের স্ত্রীদের 'মেমসাহেব' বলে সম্মোধন করতো .. এটাই ওখানকার রীতি রেওয়াজ ছিল।
যদিও আড়ালে-আবডালে বা সামনেও হয়তো কখনো কখনো এইসব খাঁটি দেশীয় 'সাহেব' এবং 'মেমসাহেব' দের বিশেষ করে 'মেমসাহেব' দের তাদের বাহ্যিক রূপের গঠন অনুযায়ী কিছু সাংকেতিক নামে ডাকা হতো। এই যেমন কালি মেম, নাটি মেম, মোটি মেম, চুড়েল মেম ... ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই হিসেবে রূপ এবং গায়ের রঙ অনুযায়ী আমার মাতৃদেবীকে ওরা 'গোরি মেম' (অর্থাৎ ফর্সা মেমসাহেব) বলে সম্মোধন করতো।
প্রতিমা বিসর্জনের আগে দশমীর দিন 'সিঁদুরখেলা' পর্বটি কম্পাউন্ডে উপস্থিত আমাদের সবার কাছে বিশেষ করে আমাদের থেকে বড়ো দাদারা এবং কম বয়সী আর বেশী বয়সী আঙ্কেলদের কাছে ছিল নয়নাভিরাম এবং আনন্দদায়ক একটি অনুষ্ঠান। বিদেশি বড়কর্তার আদেশসূচক অনুরোধে পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেলেও 'গোরি মেম' এর ওই 'সিঁদুরখেলায়' অংশগ্রহণ আবশ্যক ছিল। যাই হোক, তারপর দশমীর বিকেলে প্রতিমা বিসর্জনের পর থেকে শুরু হতো আমাদের সবার মন খারাপ .. আবার অপেক্ষা সামনের বছরের জন্য।
দুর্গাপুজোর দিন সাতেক আগে মহালায়া আর মহালায়া মানেই দেবীপক্ষের শুরু, রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ দিয়ে ঘুম ভাঙ্গা। মহালয়ার কথা বলতেই অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়, তার মধ্যে আজ একটা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।
সাল'টা ঠিক মনে নেই তবে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার ঘটনা। তখন আমি খুব ছোটো .. সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়ি। কাকতালীয়ভাবে ঐদিন আবার আমার জন্মদিন পড়েছিল। সে বার মহালয়ার দিন সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছিলো। বৃষ্টির জলের ধারার সঙ্গে আমার চোখ দিয়েও অবিরাম জলের ধারা পড়ছিলো। ছোটোবেলা থেকে কোনোদিনই আমার সুখ বা দুঃখের বহিঃপ্রকাশ নেই, তাই কেউ দেখে ফেলবে এই ভেবে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিলাম। এই কান্নার পেছনে অবশ্য গুটিকয়েক কারণ ছিলো। সিরিয়াস কিছু নয় .. সবই শিশুসুলভ কারণ।
মহালয়ার কিছুদিন আগে থেকে শুরু করে পুজোর পঞ্চমী পর্যন্ত আমাদের কলেজের সেকেন্ডটার্মিনাল পরীক্ষা চলতো। আগের দিন অঙ্ক পরীক্ষা ছিলো, কোনো কারনে পরীক্ষা আশানুরূপ হয়নি .. তাই সেটা মন খারাপ আর কান্নার প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ'টা অবশ্য আরেকটু গুরুতর... প্রত্যেকবছর বাবা মহালয়ার দিন "পুজো বোনাস" পেতেন তারপর আমাদের পুজোর শপিং শুরু হতো।
যদিও অনেকেই হয়তো ভাববেন যে সেই সময় তো দোকানে সব ঝাড়াই-বাছাই মাল পাওয়া যায়, চোখে লাগা এবং পছন্দের জিনিসগুলো তো আগেই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু তবুও ওই সময়ে বাবা-মা'র সঙ্গে পুজোর বাজার করতে যাওয়ার আনন্দের স্মৃতি আমি আজও ভুলতে পারবোনা। খুব মিস করি সেই সব দিনগুলোকে।
যাই হোক, সেবার বাবার কারখানায় লক্-আউট চলছিলো। ঠিক করে প্রতি মাসে বেতন হচ্ছিলো না, 'বোনাস' তো দূরস্থ। "জন্মদিনের জামা তো হবেই না, বোধহয় পুজোর জামাও এবার আর হবেনা" এই ভেবে ভেবে দুই চোখ দিয়ে গঙ্গা-যমুনা বইয়ে দিচ্ছিলাম।
আমার মাতৃদেবী রূপবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এতটাই ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা ছিলেন উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছিলাম না। দুপুরবেলা গম্ভীর গলায় মা আমাকে খেতে ডাকলেন। মনে অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতে না পেরে চুপচাপ মাথা নিচু করে খেয়ে নিলাম।
জন্মদিনে মা আমার জন্য পায়েস বানিয়েছিলো। বললো "পায়েস'টা খেয়ে নিয়ে চুপচাপ গিয়ে পড়তে বসবে, কাল জীবন বিজ্ঞান পরীক্ষা, যদি পরীক্ষা খারাপ হয় পিঠের চামড়া তুলে নেবো।"
কি আর করা যাবে, মন খারাপ নিয়েই পড়তে বসতে হলো। কিন্তু পড়া কি আর হয়! শুধু একটাই ভাবনা - এবার আর হলো না।
বিকেল বেলা মাকে বললাম, "মা একটু খেলতে যাবো? এই সামনের মাঠটাতেই খেলবো,বেশি দূরে যাবো না।" অনেক সাধ্যসাধনার পর মা অনুমতি দিলেন।
তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা হবে.. অনেকক্ষণ ফিল্ডিং খাটার পর সবেমাত্র আমার ব্যাটিংয়ের চান্স এসেছে.. দেখি বাবা কখন যেনো মাঠের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে আর আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে।
পুজোতে এবার কিচ্ছু হবে না - এই ভেবে এমনিতেই বাবার উপর গিয়ে সব অভিমান জমে ছিল আমার। তার উপর সবে ব্যাটিং পেয়েছি আর বাবা ডাকছে.. আমি বললাম "কিছুতেই যাবো না আমি, এখন আমি খেলবো।"
মাঠের উল্টো দিকেই আমাদের একতলা কোয়ার্টার ছিলো। হঠাৎ দেখি.. মা দরজায় তালা লাগিয়ে বেরোচ্ছে আর পরনের নাইটিটা ছেড়ে বাইরে যাওয়ার শাড়ি পড়েছে। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম.. বাবার পরনেও অফিসের সাদা জামা আর সাদা প্যান্টের বদলে অন্য জামা-প্যান্ট।
আমার কি মনে হলো, আমি ব্যাট ফেলে বাড়ির দিকে দৌড় লাগালাম। আমার এক বন্ধু সৌমিক বললো "কিরে এতক্ষণ ফিল্ডিং দিলি, ব্যাটিংটা করে যা।"
আমি বললাম "আজ আমারটা তুই করে নে, কালকে আমাকে প্রথমে ব্যাটিং দিস তাহলেই হবে, এখন যাই।"
দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম "কি গো তোমরা কোথায় যাচ্ছ?"
বাবা বললো "অফিসের সব ঝামেলা মিটে গেছে রে .. কাল থেকেই ফ্যাক্টরি চালু হচ্ছে। আজ বোনাস পেলাম, তাই ভাবলাম পুজোর বাজারটা করে নি। তুই কি যাবি আমাদের সঙ্গে, না খেলবি এখন?"
"যাবো যাবো যাবো" এই বলে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
বাবা বললো "তাহলে ভালই হলো, রাতে এক্কেবারে বাইরে থেকে খাওয়া-দাওয়া করে ফেরা যাবে।"
মা তখন সব শুনে বললো "সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে এখন ছেলের আহ্লাদ দেখো!"
আমরা তিনজন বাজার অভিমুখে রওনা হলাম।।