25-06-2021, 10:54 AM
পর্ব ১৩। (অন্তিম পর্ব )
______________
শালিনী আগেই ভেবে রেখেছিলো যে নিশিকান্তর ব্যাবস্থা সে করবেই করবে, তাই সুমিতের সঙ্গেই সে আরও একটা অস্ত্রও রেডি করেই রেখেছিলো আর সুমিত ব্যর্থ হওয়ার পরে এবার শালিনী বাধ্য হয়েই তার মারনস্ত্রকে মাঠে নামাতে উদ্যগি হয়। নিশিকান্ত ততক্ষণে গাড়ীতে চেপে গেছিলো আর শালিনীর জন্যই অপেক্ষা করে যাচ্ছিলো,
শালিনী গাড়ীতে চাপতেই নিশিকান্ত ড্রাইভারের নজর এড়িয়ে শালিনীর হাতের ওপর নিজের হাত রাখে, শালিনীর বিরক্তিতে হাতটা সরিয়ে দিতে ইচ্ছা হলেও বাধ্য হয়েই মুখে একটা মাদকতা ফুটিয়ে তুলে নিশিকান্তর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি উপহার দেয়। নিশিকান্ত ওই সামান্য হাসিতেই একদম ছোট্ট ছেলের মত উৎফুল্ল হয়ে উঠে, এবার নিশিকান্ত গাড়ীর ড্রাইভারের কান এড়িয়ে ফিসফিস করে শালিনীকে বলে '' অনেক দিন তো হয়ে গেলো তাহলে আজকে যাবো ?'' শালিনী এবার একটু হেসে বলে '' না স্যার আজকে সিগন্যাল রেড হয়ে আছে, সবুজ হতে আরও দুদিন । তারপরেই নাহয় গাড়ী চালাবেন, ঠিক আছে '' । অফিসে পৌঁছেই শালিনী বেড়িয়ে যায়, নিশিকান্ত বসে পরে সুমিতের কেসের ব্যাপারে সমস্ত কাগজপত্র সাজাতে, কাজের ফাঁকে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো নিশিকান্ত তা বুঝতেও পারেনি। আচমকা তার ঘরে অনেক লোকের পায়ের আওয়াজ শুনে নিশিকান্ত চমকে তাকিয়ে দেখে যে সহায় সাহেব, শালিনী আর রীতার সঙ্গে আরও চারজন অফিসার এসে দাঁড়িয়েছে তার অফিসের মধ্য। নিশিকান্তর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে সহায় সাহেবই নিজের থেকে বলে '' নিশি তোমার বিরুদ্ধে একটা চার্জ এনেছে এই মেয়েটী'' বলে রীতার দিকে ইশারা করে।
নিশিকান্ত এবার অবাক হয়ে জিগ্যেস করে সহায় সাহেবকে '' স্যার কি বলছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা ''। সহায় সাহেব গম্ভীর গলাতে বলে '' এই কনস্টেবল মেয়েটি অভিযোগ করেছে যে তুমি ওকে রেপ করেছো আর মেয়েটি এই অভিযোগটি লিখিত ভাবে এস পি সাহেবকে আজই দিয়ে এসেছে, তাই যতদিন না এই কেসের তদন্ত হয় তুমি সাসপেন্ড হয়ে থাকবে '' বলেই সহায় সাহেব কোনও কথা না শুনেই হতভম্ব নিশিকান্ত কে পেছনে ফেলে রেখে বেড়িয়ে যায় । এবার শালিনী তার কাছে এগিয়ে এসে প্রবল ধিক্কারের সঙ্গে বলে '' ছিঃ তুমি এত নিচ !'' বলেই রীতার হাত ধরে তাকে টানতে টানতে নিশিকান্তর চোখের সামনে থেকে বেড়িয়ে যায়।
সেদিন থেকে নিশিকান্ত অফিসে আসা বন্ধ করে দেয়, চারিদিকে শুধু একটাই আলোচনা ছিল যে নিশিকান্ত এই কাজ করতে পারে কি না? । সেদিন ছিল কোর্টের রায়দান আর ভরা কোর্ট রুমে সহায় সাহেব থেকে শালিনী সবাই অবাক হয়েই দেখে যে নিশিকান্ত একটা সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে, যথারীতি রায়ে বিচারক বললেন যে সুমিতের বিকৃত মানসিকতা দেখে আর শয়তানী বুদ্ধি দেখে ওকে ফাঁসি দেওয়া হোক।
রায় দিতেই শালিনী দেখে যে নিশিকান্ত মুখে একটা বিজয়ীর হাসি নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসে আর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে '' ম্যাডাম আর সহায় সাহেব আমি চাকরি থেকে রিজাইন করে দিয়েছি, যা কেস চালাবার আপনারা চালাতে পারেন আমি গ্রামের বাড়ি চললাম, যখন দরকার তখন ডেকে নেবেন '' বলেই সহায় সাহেবের হাতে একটা সাদা খাম ধরিয়ে দেয়, এবার নিশিকান্ত শালিনীর দিকে এগিয়ে বলে '' ম্যাডাম আমি বরাবরের জন্যই চলে যাচ্ছি, আপনি কি আমাকে একটু সময় দেবেন ? কিছু কথা আছে যা না বলতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাবো না ''।
সেই দাপুটে নিশিকান্তর জায়গায় এই অবলা নিশিকান্তকে দেখে শালিনীর একটু মায়াই হয় আর সে বলে '' ঠিক আছে, বলো কি বলতে চাও''
নিশিকান্ত একটু স্লান হেসে বলে '' তুমি তো আমার দোষ বিচার না করেই আমাকে জীবন থেকে সরিয়ে দিলে, শেষ বারের মত একটু আমার কথা মত চলো, প্লিস ''। শালিনী জানতো যে নিশিকান্তকে সে মানসিক ভাবে একদম ভেঙ্গে দিয়েছিলো তাই আবার শালিনী আর আপত্তি না করেই তার সঙ্গে যেতে রাজী হয়ে যায়। তারা দুজনে কোর্ট থেকে বের হতেই নিশিকান্ত নিজের বুলেটটা নিয়ে আসে আর শালিনীও বিনা প্রশ্নে তাতে উঠে পরে। বুলেটটা যখন হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছিলো, শালিনী মনে বার দুয়েক কয়েকটা প্রশ্ন ভেসে এলেও সে কথা না বাড়িয়ে নিশিকান্তর সঙ্গে এগিয়ে যেতে থাকে। তবে যখন নিশিকান্ত লোকালয় ছেড়ে সেই নদীর পাড়ের দিকেই যেতে থাকে তখন শালিনী একবার কোমরে হাত দিয়ে তার পিস্তলের অস্তিত্ব অনুভব করে নিয়েই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। নদীর পারে পৌঁছে একটা গাছের ছায়ার নিচে নিশিকান্ত বসে, শালিনীও তার পাশে নিজের জায়গা করে নেয়।
নিশিকান্ত বসে পরেই প্রথমে নিজের পাঞ্জাবীর তলা থেকে একটা নতুন পিস্তল বার করে মাটিতে নামিয়ে রাখে আর শালিনীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে '' তুমিও পিস্তলটা বের করে রাখ, তাহলে গল্প করতে সুবিধা হয়''। শালিনী বাধ্য হয়েই এবার পিস্তলটা বের করে নিশিকান্তর মাটিতে নামানো পিস্তলের পাশেই নিজের পিস্তলটাও রেখে দেয়। নিশিকান্ত এবার গাছে হেলান দিয়ে বলে '' আমি এখন একটা গল্প শোনাবো, প্লিস একটু ধৈর্য ধরে শোনো ''
শালিনী একটু অবাক হয়েই বলে '' তুমি আমাকে কোর্ট থেকে এই গল্প শোনাতে নিয়ে এলে ?''
নিশিকান্ত একটু হেঁসেই বলে ''আরে শোনই না , সস্তা থ্রিলারের চেয়ে অনেক বেশীই মজা পাবে এই গল্পে ''
এবার সে বলতে শুরু করে '' আমার পুরো নাম নিশিকান্ত ঘোষ, সেটা নিশ্চয় জানো । আমি ছোট্ট থেকেই ডানপিটে ধরনের ছিলাম, তবে ভালো মানুষও ছিলাম সেই গ্রামে থাকতে থাকতেই আমার সঙ্গে অপর্ণার প্রেম '' এই কথাটা শুনেই শালিনী চমকে বলে '' অপর্ণা মানে? সেই আধপাগল মহিলা?''
নিশিকান্ত একটু হেসে বলে '' সেই আমার ছোট্ট বেলার প্রেমিকা। আমি তখন বারো বছরের তখন থেকে তাকে মনে মনে আমি স্ত্রী মেনে নিয়েছিলাম। ভগবানের দয়াতে পড়াশুনো শেষ করেই আমি পুলিসে জয়েন করি, অবশ্য চাকরি আমার প্রয়োজন ছিলো না,কারন আমার বাবা জমিদার মানুষ ছিলেন। সেই রক্তই আমার শরীরের বইছে, চাইলেই যখন কোন সুন্দরী কে আমি বিছানায় উঠাতে পারি, তাহলে কেন একটা মেয়ে কে রেপ করবো বলতো ? '' কথাটা শুনেই শালিনী চমকে যায়। সে বেশ বোঝে তাঁর সামনে বসে থাকা মানুষটাকে সে যতটা বোকা ভেবে এসেছে মানুষটা তাঁর চেয়ে অনেক বেশীই বুদ্ধিমান। নিশিকান্ত শালিনীর মুখের হতভম্ব ভাবটা দেখে বলে '' আরে কি ভাবছ এখন, গল্পটা শোন ''।
'' পুলিসের চাকরি আমি ছোট থেকেই পছন্দ করতাম তাই আমার ইচ্ছায় কেউ আর বাঁধা দেয়নি। অপর্ণার বাড়ীতেও সবাই আমাদের ব্যাপারটা জানতো তাই কম বয়েসেই আমাদের বিয়ে হয়ে যায়, তবে বিয়ের পরেও অপর্ণা নিজের পড়াশুনো শেষ করে। তার পড়াশোনার জন্যই আমি তাকে গ্রামের বাড়ীতে রেখে এসেছিলাম, তাই খুব সিনিয়ার কিছু অফিসার ছাড়া কেউই আমার বিয়ের ব্যাপারটা জানেন না। অপর্ণার এম এস সি শেষ হতে না হতেই আমাদের সন্তান অনীশ জন্মায়, তবে ও ঠিক স্বাভাবিক বাচ্চাদের মত ছিলো না। সে স্পেশাল চাইল্ড ছিল, এই সমাজের চোখে একটু পিছিয়ে পড়া বাচ্চা । আমরা বাবা মা হিসাবে কিন্তু ওকে নিয়ে খুশিই ছিলাম, অনীশকে আমরা ভগবানের দান হিসাবেই মেনে নিয়েছিলাম । আস্তে আস্তে অনীশ বড় হচ্ছিলো তবে স্বাভাবিক বাচ্চাদের থেকে বোধবুদ্ধিতে অনেক পিছিয়ে ছিলো, তবুও মা বাবা হিসাবে আমি আর অপর্ণা ওকে কলেজে পাঠায় । এটা আমাদের একটা আনন্দ ছিলো বলতে পারো । ততদিনে অপর্ণা আমার জেদে একটা কলেজে বাইলোজির টিচার হিসাবে জয়েনও করেছিলো। আমরা তিনজনেই খুব খুশী ছিলাম, অনীশ যেমনই হোক সে আমাদের ছেলে ছিলো । তার শুধু একটায় নেশা ছিলো, মিকি মাউসের কমিকস পড়া !
শালিনি আবার শকড হয় ! কীসের যেন একটা গন্ধ সে পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু নিশিকান্ত কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের গল্পটা বলে যাচ্ছিলো একঘেয়ে গলায়।
'' যদি কেউ তার বইয়ে হাত দিতো তবে আমার সেই অসুস্থ বাচ্চাটা শারীরিক ভাবে দুর্বল হলেও তার বইয়ের জন্য মারামারি করতেও রাজী ছিলো। আমি প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি ফেরার পথে আমার পুচু সোনার জন্য মিকি মাউসের কমিকস বই নিয়েই আসতাম। ক্লাস ফাইভ অব্দি কলেজ যাওয়ার পরে সে আর পড়াশোনা করতে সক্ষম ছিলো না, তবুও শুধু মাত্র অপর্ণার জন্যই ওকে আমি এই এলাকার একজন বড় টিচারের কাছে কোচিঙে ভর্তি করে দিয়েছিলাম । ওই টিচার কে আমি আর অপর্ণা নিজে যেয়ে পার্সোনাল ভাবে অণুরোধ করে এসেছিলাম যে ছেলেটা আসবে যাবে শুধু, সবার সঙ্গে তাঁকে বসার সুযোগটুকু দিতে শুধু । আমরা তো জানতাম যে তাঁর দ্বারা পড়াশোনা কেন কিছুই হবে না। সে ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়নি সে । তবুও সবার মত অনীশ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে যখন কোচিঙে যেত ওর নিস্পাপ মুখটাতে যেন একটা স্বর্গীয় আলো ফুটে উঠতো। যেদিন তার পড়তে যাবার দিন থাকতো সেদিন সকাল থেকেই তার উৎসাহ আর রেডি হবার ধুম দেখে আমি আর অপর্ণা আড়ালে হেসে গড়িয়ে যেতাম। আমার ছেলে অসুস্থ ছিলো, মানসিক রুগী ছিলো তবে সবার সঙ্গে পড়তে যেতে পেরে সে হয়তো নিজেকে স্বাভাবিক বলেই ভাবতো । তখন আমি এই থানার পাশের থানা যেটা আবার অন্য জেলা পরে, সেইখানে পোস্টিঙে ছিলাম। সেদিনটা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, পুচু সেদিনও সকাল থেকে ভৈরব বাবুর কাছে পড়তে যাবে বলে উৎসাহে ফুটছিলো '' শালিনীকে অবাক হতে দেখে নিশিকান্ত হেসে একটু থেমে বিষণ্ণ গলাতে বলে '' ভৈরব বাবুর নাম শুনেই চমকে গেলে ? অনেক কিছু এখনও আছে শোনার মত ''।
নিশিকান্ত আবার সেই বিষণ্ণ গলাতেই নিজের গল্প শুরু করে । '' সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিলো, আমি পুচুকে বার দুয়েক বারণও করি পড়তে না যাবার জন্য, তবে এটা শুনেই পুচুর চশমার ভেতরের চোখ দুটোকে জলে ভিজে যেতে দেখে আমি আর বারন করিনা। আমার সেদিন অফ থাকার কারনে আমিই তাকে বুলেটে চাপিয়ে ছাড়তে নিয়ে যায়, তখন বয়েসে কিশোর হলেও তার মন যে একদম শিশুর মতই ছিলো তা আমি জানতাম। সেদিন তার বেশীই একটু উৎসাহ দেখে আমার সন্দেহ হলেও কিছু না বলেই তাকে ভৈরব বাবুর বাড়ীর সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি চলে আসি । ছুটির দিন ছিল বলে আমি সেদিন বাড়িতেই ছিলাম অপর্ণার সঙ্গে রান্না করছিলাম, খুনসুটি করছিলাম, তাই আমি অনীশ কে আনতে যায়নি কোচিং থেকে । রাতে যখন সে আমার ড্রাইভারের সঙ্গে ফিরে আসে তখন তাকে দেখে মনে হয় যেন একটা ফুল কে কেউ কুচলে কুচলে ছিঁড়েছিল। তার নতুন জামার পকেট ছেড়া, চশমার দাঁটি ভাঙা, ঠোঁটের কোনে রক্তের শুকনো দাগ আর গালে কারুর হাতের স্পষ্ট দাগ।
ঘরে ঢুকেই আমার নিস্পাপ ছেলেটা ফুলে ফুলে বাচ্চা ছেলের মত কেঁদে তার মায়ের কোলে একটা অজানা ভয়ে যেন লুকিয়ে গেলো । প্রায় ঘণ্টা খানেক নানা ভাবে প্রশ্ন করার পরে সে যা বললো তার সারমর্ম হলো, ভৈরব বাবুর ওইখানে সে একটা মেয়েকে অনেক দিন ধরেই দেখে আর তার খুব ইচ্ছা ছিলো তার সঙ্গে কথা বলার,
আজ সে সাহস করে সেই মেয়েটিকে একটা মিকি মাউসের বই আর একটা পেন দিয়ে বন্ধুত্ব করতে গিয়েছিলো, তখনই সেই মেয়েটির তিন বন্ধু মিলে তাকে মেরে তার বই কেড়ে নেয়, তার হাতের পেনটা ফেলে দেয়, সে নিজের বই বাঁচাতে গেলে তাকে ওই মেয়েটার তিন বন্ধু মিলে খুব মারে। যখন অনীশ মার খেয়ে কান্নাকাটি করছিলো তখন ভৈরব বাবু বেড়িয়ে আসেন আর উল্টে তাকেই পাগল বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। আমার একমাত্র অসুস্থ ছেলের কথা শুনে আমি তখনই যাচ্ছিলাম সেই মাস্টারের বাড়ি, কিন্তু অপর্ণার জন্য আমাকে থেমে যেতে হয়। পরেরদিন সকালে অপর্ণা অনীশকে নিয়েই ভৈরব বাবুর কাছে যান,তবে যখন তারা মা ব্যাটা ফিরে আসে আমার তখনই সন্দেহ হয়। অনীশকে কোনমতে খাবার খাইয়ে অপর্ণা আমার কাছে এসে প্রায় কেঁদে ফেলে বলে '' ভৈরব বাবু আমাকে স্পষ্ট বলে দিলেন যে পাগলকে পাগলা গারদে রাখতে আর ওই তিনটে ছেলের মধ্য একজন তার ভাগ্নেও ছিলো, সেই অসভ্য ছেলেগুলো আমার সামনেই অনীশকে তেড়ে মারতে আসে আর হুমকি দিয়ে বলে বেশী বাড়াবাড়ি করলে অনীশকে মেয়েটির শ্লীলতাহানি করার কেস দিয়ে জেলে ভরে দেবে। শুনেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলেও অপর্ণার দিব্যিতে আমাকে চুপ করে থাকতে হয়, সেদিনের পর থেকে অনীশকে আমরা আর পড়তে পাঠায় না, তবে অনীশও অনেকটা পাল্টে গেছিলো। সে সারাদিন চুপচাপ নিজের ঘরে বসে তার সেই ছোটবেলার মিকি মাউসের বইগুলোতে নানা রকম কথা লিখতো নিজের মনেই। এই ঘটনার প্রায় একমাস বাদেই আমাকে পুরুলিয়াতে বদলি করে দেওয়া হয়, তখন এত মোবাইল ফোনও ছিলনা আর নতুন জায়গায় কাজের চাপে আমি সাত আট দিন ঘরে ফোন করতে পারিনি,ছুটি পাওয়ার পরে যেদিন আমি ঘরে ফিরছিলাম সেদিন আমি খুব খুশিই ছিলাম। পুচুর জন্য তার আগের দিনেই আমি কলকাতা থেকে একডজন মিকি মাউসের বই আনিয়েছিলাম , মনে আনন্দ নিয়ে আমি যখন আমার বাড়ীতে আসছিলাম তখন দেখি বাড়ীর সামনে একটা ভিড়। আমার মনটা কুডাক ডেকে উঠে আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দেখি আমার একমাত্র ছেলের দেহটা মেঝেতে পরে আছে আর তার সামনে পাথরের মূর্তির মতন বসে আছে আমার স্ত্রী অপর্ণা। সেইদিন থেকেই আমার অপর্ণা পাল্টে গেছে, তাকে লোকে এখন পাগল বলেই জানে এমনকি সে আমাকেও চিনতে পারেনা, আমি জানতে পারি যে আমি পুরুলিয়া যাওয়ার পরে একদিন অনীশ আবার লুকিয়ে লুকিয়ে গেছিলো ভৈরব বাবুর বাড়ীতে। তার বইটা ওই ছেলে মেয়েগুলোর কাছ থেকে ফেরত আনতে, তবে সে নিজে যেমন সরল আর নিস্পাপ ছিলো , সে সবাইকে সেরকমই ভেবেছিলো।
সেদিন ওই তিনটে ছেলে, অর্ণব, নয়ন আর সুমিত আর মেয়েটা ঋতুপর্ণা সবাই মিলে বাকি তাঁকে ছাত্রদের সামনে তার জামাকাপড় খুলে নগ্ন করে দেয়, অনীশ তবুও অবুঝের মতই নিজের বইটা চেয়েছিলো তাতে ওই তিনজন মিলে তাকে বেধড়ক মারে। অপমানিত আর নগ্ন অবস্থায় অনীশ সেদিন ঘরে আর ফিরে আসেনি, আসার পথে একটা পুকুরে নেমে নিজের অপমানের জ্বালা জুড়োতে চেয়েছিলো। যখন তার দেহ তোলা হয় তখন তার হাতে ছিলো তার প্রিয় বইয়ের কয়েকটা পাতা, যা ওই ছেলেমেয়েগুলো হয়তো দয়া করে ফেরত দিয়েছিলো!
আমি তারপরে টানা তিন দিন জেগে কাটিয়েছিলাম, প্রথমে ভেবেছিলাম যে নিজের সার্ভিস রিভ্লবারের গুলিতেই শেষ করে দি ওদেরকে। তারপরেই আমার মাথায় ভাবনা আসে তাহলে আমার পাগল বউটাকে কে দেখবে ? তাই আমি সেদিনই আমার ছেলের ছবিতে আর তার মিকি মাউসের বইয়ে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করি যে তার ওপর নির্মম অত্যাচারের বদলা আমি নেবই নেব। প্রতিশোধের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে আমি এক থানা থেকে এক থানায় বদলি হতে থাকি, আর গ্রামের বাড়ি থেকে অপর্ণার মাকে এনে তার চিকিৎসার ব্যাবস্থাও করি আর তখনই আমি একদিন আমার থানার এক পুরনো অফিসারের কথায় রাজাবাবুর কথা জানতে পারি , উনি কিরকম অদ্ভুত ভাবে খুন করতো সে কথাও জানতে পারি।
আমি ওনার ফাইলটা জোগাড় করি আর এইভাবেও যে মানুষ মারা যায় সেটা জানতে পারি , সেদিন থেকেই আমি আমার পরিকল্পনা সাজাতে থাকি। দেখতে দেখতে দশ বছর পেরিয়ে যায় এই ঘটনার, সেই ছেলে মেয়েগুলোর হয়তো মনেই নেই একটা আধপাগলা ছেলের কি দশা তারা করেছিলো, আমি ততদিনে নিজের প্ল্যানের প্রথম ষ্টেজ পাড় করে নিয়েছিলাম । সুমিতের যে বন্ধুর গল্পটা আমি আপনাদের শুনিয়েছিলাম সেটা সত্যি তবে অর্ণব, ঋতুপর্ণা আর নয়নের সঙ্গে সুমিত দেখা করেনি বা তাদেরকে পয়সার টোপ দেয়নি, সেই কাজটা করেছিলো আমারই একজন লোক। তার নাম জানার কোনও দরকার নেই কারন সে যা করেছিলো তা আমারই কথামত। যেহেতু আমি ওই পাঁচজনের ওপরেই সবসময় নজর রাখতাম তাই আমি জানতাম যে সুমিতের আড্ডা ওই নদীর পারেই , তাই পরে আমার পক্ষে সহজেই প্রমান করা যেত সুমিতের মোবাইল টাওয়ার দেখিয়ে যে এই হত্য লিলা তারই কাজ। আর আমি সেটা প্রমাণও করে দিয়েছি।
নিশিকান্ত এতক্ষণ কথা বলে একটু থামে আর শালিনীর একদম ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা দেখে একটু বিষণ্ণ গলাতেই বলে '' ম্যাডাম ছেলেটা আমার জীবন ছিলো, আমার বউটাও ছেলের শোকে পাগল হয়ে গেলো আমার সবই গেল, তাই পুলিসের লোক হয়েও আমি আইনের সাহায্য না নিয়ে নিজের হাতেই শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম ওদেরকে, ওরা তো একটু সহানুভূতি দেখাতে পারতো আমার অসুস্থ ছেলেটাকে, '' বলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিশিকান্ত আবার শুরু করে ।
'' আমার ঠিক করা লোকটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার নামে যখন ওই তিনজনকে ফাঁসায় আমি তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে সুমিতকে আমি মারবো না, কারন সুমিত তখন ঋতুপর্ণার সঙ্গে প্রেম করছিল চুটিয়ে আর প্রেমিকার চোখে হিরো সাজার জন্য সেদিন সেই আমার ছেলের পরনের জামাকাপড় খুলে তাকে নগ্ন করেছিলো, তাই সুমিতের জন্যই আমি একটু স্পেশাল ব্যাবস্থা করেছিলাম। যাই হোক আমি জয়েন করার তিন দিনের মাথায় অসুস্থ অর্ণবকে আমার লোকটি ডাকে নদীর পারে , তার জায়গায় আমাকে দেখে অর্ণব একটু অবাক হয় বটে, তবে টাকার বাণ্ডিল দেখে আর কথা না বাড়িয়ে আমাকেও সেই রিসার্চের লোক ভেবেই নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয় ইঞ্জেক্সনের জন্য। সূচটা ফুটিয়েই আমার মনে হয় যেন আমার পুচু আকাশ থেকে হাসছে !
আমি সুচ ফোটানো অবস্থাতেই তাকে অনীশের কথা জিগ্যেস করি আর আমার হাতের মিকি মাউসের ছবিটা দেখায়, তার সঙ্গে সঙ্গেই সব মনে পরে যায় তবে তখন আর কিছু করার ছিলো না। তার শরীরটা যখন আস্তে আস্তে বিষক্রিয়ায় কষ্ট পেয়ে পেয়ে মরছিল আমার মনে হচ্ছিলো যেন আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাচ্ছে। যেহেতু ওরা সবাই বাইরে পড়তো আর আমাকে অনীশের বাবা হিসাবে কেউই চিনতো না তাই খুব সহজেই আমি নয়ন আর ঋতুপর্ণা দুজনকেই একই ভাবে কষ্ট দিয়েই মেরে ফেলি নিজের হাতেই । এবার আমার শিকার ছিলো ভৈরব বাবু ''
এতক্ষণে শালিনী তার বিস্ময়ের ভাব কাটিয়ে জিগ্যেস করে '' কিন্তু ভৈরব বাবু কেন? উনি তো কিছু করেননি?''
নিশিকান্ত মুখে হাসি নিয়েই বলে '' ঠিকই বলেছেন উনি কিছুই করেননি, তার ভাগ্নের মোহে একটা অসুস্থ ছেলের পাশে দাঁড়ানি, আর শিক্ষক পিতার সমান তাই ওনার অনেক দায়িত্ব সেটা পালন না করার জন্যই তো ওনাকেও শাস্তি দিতে হতো, আর শাস্তি উনি পেলেন । আমি আমার লোক লাগিয়ে শহরে ওনার জলের ট্যাঙ্কে ভাইরাসটা মিশিয়ে দিয়েছিলাম যাতে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সুমিতকে নিতে আসেন ওনার সঙ্গে বাইরে যাবার জন্য, আমিই একদিন ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করে বললাম ওনার পেছনে কিছু মানুষ লেগেছেন ।আর তাদের ব্যাপারে জানাতেই ওনাকে সেই নদীর ধারেই ডাকলাম আর একটা অসুস্থ, বৃদ্ধ মানুষকে বিষাক্ত ইনজেকশনের সুচ ফোটাতে তো সময় লাগে না, আমার গল্প এইটুকুই তারপরে যা হয়েছে আপনার চোখের সামনেই '' ।
বলে নিশিকান্ত উঠে দাঁড়ায় আর পেছন ফিরে বলে '' আরেকটা কথাও বলার আছে, আমি কিন্তু বাধ্য হয়েই সেদিন আপনার ঘরে গেছিলাম কারন তখনো সুমিতকে ফাঁসাতে পারিনি আর আপনি যে আমার বিরুদ্ধে ঘুঁটি পাতছিলেন সেটাও আমি জানি , কিন্তু আপনি যতই চেষ্টা করুন সুমিত আমার বিরুদ্ধে মুখ খুলবে না কারন তার ছেলে আমার হেফাজতে ছিলো, তাই সে বাধ্য হয়েই আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করেছে '' কথা শেষ হতেই নিশিকান্ত নিজের বাইকে বসে পরে।
শালিনী তাড়াতাড়ি নিজের পিস্তল তুলতে গেলে নিশিকান্তর হাঁসির আওয়াজ পায় আর দেখে যে নিশিকান্তর হাতেই দুটো পিস্তল ছিলো। এবার নিশিকান্তর বুলেটটা শালিনীর চোখের সামনে দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে বেড়িয়ে যায়, তখনই শালিনীর ফোন বেজে উঠে ওপর প্রান্তে সহায় সাহেব ছিলেন।
ফোন ধরেই সহায় সাহেব বলেন '' শালিনী তুমি কোথায়, এখনি আমার সঙ্গে দেখা করো কারন রীতা নিশিকান্তর ওপর থেকে তার সমস্ত অভিযোগ লিখিত ভাবে তুলে নিলেও তোমার বিরুদ্ধে যৌন হায়রানির কেস করেছে!''
শালিনীর চোখের সামনে তখন নিশিকান্ত তার বুলেটে চড়ে ডুবতে থাকা সূর্যের সঙ্গে যেন দুর দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছিলো।
সমাপ্ত।
ধৃতরাষ্ট্র - দা বস !