23-06-2021, 05:05 PM
দেখতে দেখতে সময় বয়ে যায়। কলেজের পড়াও শেষ হয়ে যায়। আমি চারিদিকে একজন ভাল ছেলের খোঁজ করতে থাকি। দু’একজন দেখেও যায় ওকে। ও অনুযোগ করত আমার কাছে, “এত তাড়াতাড়ি এসবের কি দরকার, বাবা?” আমি বলতাম, “আর দু’বছরের মধ্যে রিটায়ার করব, মা। তার আগে তোর বিয়েটা দিয়ে দিই।” এরপর আর কোন কথা বলেনি ও। সবকিছুই ধীরলয়ে চলছিল। যেসব ছেলেরা আমার মেয়েটাকে দেখতে এসেছিল, তাদের কাউকেই আমার পছন্দ হয়নি। অবশেষে আমার এক আত্মীয় একটা সম্বন্ধ নিয়ে এল। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বাড়িতে দু’ভাই আর মা। ছোট ভাই কলেজে পড়াশোনা করছে। বাবা নেই। বছর কয়েক আগে স্ট্রোকে মারা গেছেন। আমাদের পালটি ঘর। কোনো অসুবিধা নেই। ছবি দেখে আমার আর আমার স্ত্রীর একপ্রকার পছন্দ হয়ে গেল ছেলেটাকে। মেয়েকেও ছবিটা দেখেছিলাম। হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি। শুধু বলেছিল, “আমি কিছু জানি না, তোমরা যা ভাল বুঝবে, করো।” তারপর একদিন ছেলের বাড়ি থেকে ওকে দেখতে এল। মেয়েকে দেখে ওদেরও পছন্দ হয়ে গেল। তারপর একদিন আশীর্বাদ এবং অবশেষে বিয়ে। ছেলের মা বলেছিল ওদের কিছুই লাগবে না। তবুও আমার সাধ্যমত সবকিছু দিয়ে আমার মেয়েটাকে সাজিয়ে তুলেছিলাম। বারবার চোখের সামনে ওর ছোট্টবেলার নানান স্মৃতি ঘোরাফেরা করছিল। আমার ছোট্ট রাজকুমারী আজ বিয়ে করে বুড়ো বাপকে একা করে অন্য বাড়ির বউ হয়ে চলে যাচ্ছে। বিয়ের পরেরদিন গাড়িতে ওঠার সময় আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “বাবা, আমাকে পর করে দিলে?” আমি ছোটবেলার মত ওর মাথায় হাত বোলাতে বলেছিলাম, “ছিঃ মা, এভাবে বলতে নেই। সব মেয়েকেই একদিন না একদিন বিয়ে করে পরের বাড়ি যেতে হয়।” বিয়ের পর থেকে সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু গণ্ডগোলটা শুরু হল এক বছর পর থেকে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম মেয়ে-জামাই দু’জনে একসঙ্গে আসত। কয়েকদিন থাকত, গল্পগুজব করত। আবার ফিরে যেত। লক্ষ্য করতাম মেয়েটা খুব সুখে আছে। আনন্দে আছে। ওর খুশী দেখে, ওর আনন্দ দেখে আমিও খুশী হয়ে উঠতাম। তার মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে সুখে আছে, এর থেকে আনন্দের কথা একজন বাবার কাছে আর কিছু হতে পারেনা। ওকে আড়ালে জিজ্ঞাসা করতাম, “তুই ওখানে সুখে আছিস তো মা?” ও বলত, “আমি খুব সুখে আছি, বাবা।” পরম শান্তিতে ওর মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। ও যখন ফিরে যেত, তখন মনটা একটু খারাপ হত ঠিকই। কিন্তু এটা ভেবে শান্তি পেতাম যে মেয়েটা ওখানে সুখেই আছে। কিন্তু এরপর থেকে আস্তে আস্তে জামাইয়ের আসা কমে গেল। তারপর একটা সময় একদম বন্ধই হয়ে গেল। মেয়েটা আমার অতদূর থেকে একলা একলা আসত। আমি বলতাম জামাই কি সঙ্গে আসতে পারেনা? ও বলত জামাইয়ের নাকি কাজের চাপ, তাই আসতে পারেনা। লক্ষ্য করতাম ওর শরীরটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেছে। চোখের তলায় কালিও পড়েছে দেখেছিলাম। জিজ্ঞাসা করলে বলত, “ও কিছু নয়, বাবা। তুমি চিন্তা কোরোনা। শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। ক’দিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।” ও মুখে বলত বটে কিন্তু লক্ষ্য করতাম আমার আগের সেই হাসিখুশী, প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ও যে ক’দিন থাকত, গুম হয়ে থাকত। জিজ্ঞাসা করলেও পাশ কাটিয়ে যেত। আমার মনে কেমন যেন শঙ্কার একটা ঝড় উঠতে শুরু করেছিল। শেষবার এসেছিল প্রায় মাস আষ্টেক আগে। তখন ওর চেহারা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম আমি। একি চেহারা হয়েছে ওর! মনে হচ্ছে যেন কোনো ভারী রোগ হয়েছে। বারবার জিজ্ঞাসা করতেও কিছু বলল না। বুঝলাম এভাবে হবেনা। যা চাপা স্বভাবের মেয়ে আমার। ওর মাকে বললাম, ও যেন কথায় কথায় যেন জেনে নেয় ব্যাপারটা কি। ওর মা জেনেছিল। আমাকেও জানিয়েছিল। সবকথা জানতে পেরে সমস্ত শরীর রাগে কাঁপতে শুরু করেছিল আমার। ছিঃ, কোনো মানুষ এতটা নীচে নামতে পারে! ও মাকে বলেছিল ইদানীং জামাইয়ের নাকি মতিগতি ঠিক নেই। কথায় কথায় রেগে যায়। গালিগালাজ করে। প্রতিদিন রাতে নাকি মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে।