23-06-2021, 11:20 AM
পর্ব ১১ ।
___________
নিশিকান্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে প্রথমেই সোজা চলে যায় তার বুলেট নিয়ে শহরের একদম মাঝখানে একটা বস্তির ভেতরে,সে ভালো করেই জানতো তাকে ঠিক কোন জায়গাতে যেতে হবে । তাই বস্তির পঙ্কিল রাস্তায় তার বুলেট একদম স্বাভাবিক ভাবেই নিজের লক্ষ্য স্থির হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো। নিশিকান্ত যতই সাধারন পোশাকে থাকুক তাকে দেখেই বস্তির লোকেরা আপনা আপনিই রাস্তা করে দিচ্ছিলো,সে কিন্তু কোনদিকে না তাকিয়েই সোজা নিজের মনেই এগিয়ে যাচ্ছিলো।তাঁর বুলেটটা যেখানে থামে সেটা বস্তির প্রায় একদম শেষ প্রান্তে একটা ভাঙা দালান বাড়ী, তবে সেই দালান বাড়ীর থেকে বস্তির বাকি টিনের চালের ঘর গুলোর অবস্থাও অনেকগুনে ভালো।
নিশিকান্ত ঘরের সামনে বুলেটটা রেখে সোজা গটগট করে হেটে ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরে চলে যায়। ঘরের ভেতরটা এই দুপুর বেলাতেও পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে ছিলো। তবে সে অভ্যাস্ত ছিল এই ঘরের প্রতিটা ইঞ্চি নিজের হাতের তালুর মতই চিনতো, তাই তার কোনও অসুবিধা হয়না। ঘরের ভেতর হয়ে নিশিকান্ত এবার ঘরের একদম পেছনে পৌঁছে যায়,সেখানে একটা আগাছাতে ভর্তি, ধবংস্তুপের চেহারার বাগানে একটি বুড়ো মানুষ কুঁজো হয়ে গাছের ছায়ায় বসে যেন নিশিকান্তর জন্যই অপেক্ষা করে যাছিলো। সে সোজা এগিয়ে গিয়ে সেই বুড়ো মানুষটির সামনে রাখা একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসে, তবে সেই বুড়ো মানুষটির কোনও ভাবান্তর হয়না নিশিকান্তকে বসতে দেখে।
নিশিকান্ত এবার নিজের থেকেই বলে '' রাজা আমি তোমার কাছে এটা নিয়ে চার বার আসছি, তবে তুমি আমাকে সাহায্য করছ না, তুমি কি এই বয়েসে আমার সঙ্গে শত্রুতা করতে চাইছো নাকি ? তুমি কি জানো না যে পুলিসের সঙ্গে অসহযোগিতার মানে কি?'' নিশিকান্তর কথা শেষ হলেও সেই বুড়ো মানুষটি শুধু একটু হেসে বলে
'' ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে সবাই ''রাজাবাবু'' বলে ডাকে, শুধু '' রাজা '' বলে নয়, আমার বয়েস হয়ে গেছে, আমার ক্ষমতা, পয়সা সব শেষ হয়ে গেলেও আমি ''রাজাবাবু'' ছিলাম আর তাই থাকবো, আমার যোগ্য সম্মানটা তো আমাকে দিতেই হবে '' বলে আবার সেই মৃদু হাসিটা তার মুখে ফুটে উঠে।
নিশিকান্ত জানতো যে বুড়োটা মৃত্যুর দিকে পা বাড়িয়ে দিলেও এখনও তার সম্মান জ্ঞ্যানটা টনটনে আছে, তাই নিশিকান্ত তাকে বাধ্য হয়েই একটু খুচিয়ে তোলে তার মুখ খোলাবার জন্য। এবার নিশিকান্ত বুঝতে পারে যে ওষুধ অল্প হলেও ধরেছে, তাই নিশিকান্ত এবার ওষুধের মাত্রাটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে বলে '' আর রাজা ! তুমি এখন ভিখিরি, শহরে এখন এক সে এক রুস্তম ঘুরে বেরাচ্ছে, তোমার মত আদ্যিকালের মালের আর দাম নেই বুঝলে ''। তার কথা শুনে সেই বুড়োটার চোখগুলো এক পলকের জন্য জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল আর সেই মৃদু গলাতেই বুড়োটা নিশিকান্ত কে উদ্দস্য করে বলে '' যদি আমি ভিখিরিই হতাম তবে কি আর আপনি এত ব্যাস্ত মানুষ হয়েও নিজেই আমার কাছে বারেবারে ভিক্ষা চাইতে আসতেন ?'' কথাগুলো বলে বুড়োটার মুখে একটা হাল্কা হাসি ফুটতে দেখে নিশিকান্ত বুঝে যায় যে বুড়োটা তার খেলা ধরে ফেলেছে, অন্য সময় হলে হয়তো নিশিকান্ত এই খেলা খেলেই বুড়োটাকে মাত করার চেষ্টা চালিয়ে যেত তবে এখন তার হাতে সময় ছিলনা একদমই সময় ছিলনা, সে এবার সরাসরি বুড়োটাকে উদ্দস্য করে বলে '' শুনুন আপনার কাছে আমি একটা কারনেই এসেছি, একমাত্র আপনি আছেন যিনি এই শহর আর তার আশেপাশের সব থেকে পুরনো অপরাধ জগতের বেতাজ বাদশা ছিলেন। একমাত্র আপনিই হয়তো বলতে পারেন যে সেই চারটে মৃত্যু কীভাবে ঘটেছে, কারন আপনার সময়ে আপনি নিজেই এইরকম অদ্ভুত ভাবে মানুষ মারতেন, যদিও সেটা আজ অব্দি কেউই প্রমান করে উঠতে পারেনি ''।
বুড়ো মানুষটি এবারও সেই নির্মল হাসি হেসে বলে '' সে আমার বিরুদ্ধে অনেক কেসই হয়েছিলো একসময়ে তবে কেউ কিছু প্রমান করতে পারেনি, আর আইনে স্পষ্ট লেখা আছে যে বিনা প্রমানে কেউই অপরাধী প্রমানিত হয়না সেটা আপনিও জানেন,তবে আপনি আমার কাছে অনেক বারই এসেছেন, আর আপনাকে আমার ভালোও লাগে তাই আমি আজকে কিছু কথা বলবো, তারপরে আপনার যা বোঝার বুঝে নিতে পারেন ''
বলে মানুষটি একটু থেমে তার পায়ের কাছে রাখা একটা বোতল থেকে গলায় একটু জল ঢেলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে। মানুষটি বলে '' যখনই এই শহরে বা তার আশেপাশে কোনও অপরাধ সংগঠিত হলেই আমি খবর পেয়ে যায়,তবে সাধারন খুন, ডাকাতির ওপর আমি নজর দিতে পছন্দ করিনা।ওগুলো মোটা দাগের কাজ, আর রাজা বাদশারা মোটা দাগের চেয়ে সুক্ষ বুদ্ধির খেলা অনেক বেশী পছন্দ করে ।তবে যদি কোনও রহস্যময় ঘটনা ঘটে যেটা সাধারন মাথামোটা পুলিসদের বুঝতে অসুবিধা হয় তখনই আমি সেই ব্যাপার সম্বন্ধে একটু খোজখবর নিতে পছন্দ করি, তাই যখন আপনাদের বুদ্ধিমান ডিপার্টমেন্ট এই কেসটা নিয়ে নাকানি চোবানি খেয়ে যাচ্ছিলো,
আমি আমার মত করে কেসটা সম্বন্ধে আলাদা করে স্টাডি করতে আরম্ভ করে দি, তবে আমাকে আপনাদের ডিপার্টমেন্টের কিছু পুরনো মানুষও সাহায্য করেছিলেন সমস্ত ডাটা আর ফটো দিয়ে । সে সম্পর্ক আমার আজও আছে তাঁদের সঙ্গে, কেসটা সবটা স্টাডি করে, মৃত্যুর কারন, তাঁর প্রসেস, কে করতে পারে এই খুনগুলো আমি আমার যা মনে হয়েছে সেটা আমি এই ডাইরিতে লিখে রেখেছি''। বলে বুড়ো নিশিকান্তর হাতে একটা চামড়ার বাঁধানো পুরনো ডাইরি তুলে দিয়ে অল্প হেসে বলে '' তবে আমি যা লিখেছি প্রায় সেইরকম ভাবেই বছর তিরিশ আগে কয়েকটা মৃত্যু হয়েছিলো , কে করেছিলো বা কীভাবে ঘটেছিলো তা অবশ্য সেরকম কেউই জানেনা,
শুধু একজন পুলিস অফিসার কিছু সন্দেহ করেছিলো আর সেই সন্দেহের বশেই উনি একটা ফাইল বানিয়েছিলেন আর আমাকে গ্রেফতারও করেছিলেন, তবে আদালতে উনি কিছুই প্রমান করতে পারেননি আর আমি আজও এই শহরের ''রাজাবাবু'' হয়েই বেঁচে আছি ''
উনি কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াতে গেলেন, নিশিকান্ত তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে উনাকে সাহায্য করতে গেলে উনি সবিনয়ে নিশিকান্তর উদ্যাত হাত কে সরিয়ে নিজেই একটু কষ্ট করে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে এগোতে লাগলেন, তবে ঠিক ঘরে ঢোকার মুখেই উনি যেন নিজের মনেই যেন বলে উঠেন ''মানুষের মধ্যই দানব আর মানুষের মধ্যই ঈশ্বর, এখানেই স্বর্গ আর এইখানেই নরক, বাবা সবই এখানে শোধ করতে হয় '' বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের অন্ধকার ঘরে ঢুকে গেলেন।
নিশিকান্ত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও যখন সেই বুড়ো মানুষটির আর দেখা পেল না সেও তড়িঘড়ি বেড়িয়ে যায়। তবে বাইরে গিয়ে তাঁর মুখে হাসি ফোটে কারন, সেই চারটে মৃত্যুর পর থেকেই নিশিকান্ত এই বুড়ো মানুষটির কাছে প্রায় হত্য দিয়েই পড়েছিলেন কোনও সুত্রের আশায়। কারন যখন তাঁর মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়
এই কেসটা নিয়ে, তখনই তার এক সিনিয়ার রিটায়ার্ড অফিসার একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে এই শহরের একসময়ের কিং, রাজাবাবুর কথা।
এখন বুড়ো, অথর্ব হয়ে এলেও একমাত্র তিনি তাকে এই কেসের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন, কারন বহুদিন আগে তিনি নিজেই একবার এই রকম তিনখানা অদ্ভুত, রহস্যময় মৃত্যুর জন্য গ্রেফতার হয়েছিলেন। তবে উনি বরাবরই খুব বুদ্ধিমান আর সাবধানী ছিলেন তাই সহজেই কেস থেকে রেহায় পেয়ে গেছিলেন আর তারপরে উনি নিজের অপরাধ জীবনেও দাড়ি টেনে দিয়েছিলেন। তবে তাঁর মানসিকতার আর বুদ্ধিমান কোনও অফিসার যদি এখনও কোন কেস নিয়ে বিপদে পরে , তবে উনি নিজের অপরাধী জীবনের বিরাট আর চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা দিয়ে তাকে সাহায্য করতে দ্বিধা বোধ করেননা।
নিশিকান্ত তাই নিজেই তার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন, কিন্তু কি জানি কেন উনি নিশিকান্তকে বারেবারেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ হটাৎ তার কি সুমতি হলো কে জানে যে যেচেই তাকে তার নিজের লেখা ডাইরি অব্দি দিয়ে দিলেন !
সে সেই বস্তি থেকে বেড়িয়ে সোজা অফিসে চলে যায় আর শালিনীর চেম্বারে ঢুকে পরে,শালিনী তখন নিজের মনে কিছু কাগজ পরছিলো । তাঁর আচমকা আগমনে একটু যেন চমকে গিয়েই কাগজগুলো তাড়াতাড়ি ড্রয়ারে রেখে দিয়ে নিশিকান্তর দিকে একটা দুষ্ট হাসি হেসে বলে '' কি হলো তর সইছে না বুঝি?'' নিশিকান্ত মুখে কিছু না বলে তার হাতের ডাইরিটা শালিনীর টেবিলে ফেলে দিয়ে বলে '' তুমি এটা পরে দেখো, ততক্ষণে আমি সহায় সাহেবকেও ডেকে নি '' । নিশিকান্তকে তাড়াতাড়ি সহায় সাহেবকে ফোন লাগাতে দেখে শালিনী বুঝতে পারে যে নিশ্চয় কোন একটা সুত্র নিশিকান্তর হাতে এসে পড়েছে তাই সে এত উত্তেজিত, শালিনী ডাইরিটা খুলে দেখে একটা পুরনো বিবর্ণ ডাইরি, কোনও নাম, ঠিকানা ছাড়াই।
প্রথম পাতাতেই একটা যুবকের ছবি লাগানো আর তার সঙ্গে পুরো বিবরণ। ছেলেটির নাম পরে শালিনী চমকে যায়, ছেলেটি ছিলো অর্ণব, প্রথম যে ছেলেটি মারা যায়। ডাইরির পাতাতে তার মৃত্যুর পুরো বিবরণ, এমনকি মৃত্যুর সময়ে তার পরনের কাপড়, থেকে পকেটে পয়সা ভর্তি মানিব্যাগ সবকিছুরই উল্লেখ ছিল। পরের পাতাতে লেখা ছিলো অর্ণবের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারন ! সেই রহস্যময় ডাইরির পাতাতে লেখা ছিলো যে '' অর্ণব ( এখানে অবশ্য একনম্বর বলেই উল্লখ হয়েছিলো )মার্ডার হয়েছে এটা স্পষ্ট। কারন তার শরীরে কিছু স্পষ্ট লক্ষণ দেখা গেছিলো, যদিও পোস্টমর্টেম না করার কারনে এটা হয়তো ধরা পড়েনি, আমার যত দুর ধারণা তার শরীরে ইনজেকশনে Sodium Fluoroacetate (Compound 1080)ভরা হয়েছিলো। এই বিষটা এমনিতেই গন্ধহীন, তবে এটা কোনও প্রানি বা মানুষের শরীরে ঢোকার পরে তার এফেক্ট থাকে প্রায় একবছর। এই বিষের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো যে এটা অত্যান্ত যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু দিলেও মানুষটি এটার প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই কোমাতে চলে যায় আর মিনিট তিরিশের মধ্যই এটা মানুষটির হার্টফেল করিয়ে তাকে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করে। আমার এই মৃত্যুর ব্যাপারে সন্দেহ হওয়াতে অর্ণবের ভিসেরা পরীক্ষা করি আর এই ব্যাপারটা ধরা পরে যায় ''।
এইঅব্দি পরেই শালিনী হাত থেকে ডাইরিটা নামিয়ে দিয়ে বলে '' নিশি এটা কি? কোনও সস্তা বাংলা থ্রিলারের গল্প নাকি? আর এটার জন্যই তুমি অমন রাজত্ব পাওয়া মুখে আমার কাছে ছুটে এলে ? বলিহারি তোমায় !''। নিশিকান্ত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই বলে '' কেন কি হলো , এই ডাইরিতে তো ওই কেস নিয়ে সবই লেখা আছে, প্রতিটা মৃত্যু আর তার সম্ভাব্য কারন সবই মোটামোটী স্পষ্ট করেই লেখা আছে ''। নিশিকান্তর কথার মাঝেই শালিনী অধৈর্য ভাবে বলে উঠে '' কে এই ভদ্রলোক? যে ওনার লেখা ডাইরি পরে আমাকে আর সহায় সাহেবকে পড়ে পরে নাচতে হবে '' নিশিকান্ত ঠিক এই ব্যাবহার আশা করেনি শালিনীর কাছে তাই সে একটু অপ্রস্তুত হয়েই বলে '' শালিনী উনি এই জেলার সবচেয়ে পুরনো অপরাধী, উনি নিজেই এইধরনের বহু অপরাধ সংগঠিত করেছেন আর আমাদের মত বহু অফিসারকে উনি ওনার বিশাল অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করেছেন কেস শলভ করতে '' নিশিকান্তর কথার মাঝপথেই শালিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বিরক্তির সঙ্গেই বলে '' নিশি ওনার এই ডাইরি নিয়ে আমার কি লাভ বলো তো ? আমার রেজাল্ট চাই, আমি জানতে চাই যে কে কীভাবে আর কিজন্য এই মৃত্যুগুলো ঘটিয়েছে ? তার বাইরে কোনও দাগী অপরাধীর লেখা আষাঢ়ে গল্প শুনে আমার বিন্দুমাত্র লাভ নেই আর ইচ্ছাও নেই, সরি এই ডাইরি নাহয় তুমিই পড়ো। তবে একটা কথা মাথায় রেখো যে যদি সাতদিনের মধ্য কোনও রেজাল্ট না দিতে পারো তাহলে আমাকে তুমি হয়তো আর এই থানায় তোমার সান্নিধ্য পাবে না ''।
নিশিকান্ত একদম হতাশ মুখে, হাতে ডাইরিটা তুলে নিয়ে চুপচাপ বেড়িয়ে যায়, তার সেই যাওয়া দেখে তাচ্ছিল্য শালিনীর মুখ বেঁকে যায় তবে সে ঘুরে না দেখে নিজের মনেই চুপচাপ বেড়িয়ে চলে যায়। তার পরের দুদিনে নিশিকান্তর আর কোনও খোজ খবর কিছুই নেই, শালিনী থেকে সহায় সাহেব দুজনে তার ফোনে পাগলের মত রিং করেই যায় তবে শুধু একটাই জবাব শুনতে পায় '' এই নম্বর বন্ধ আছে '' । তার বাড়ীতে সহায় সাহেব নিজে অন্তত বার দুয়েক গেলেও তার কোনও খোজ পাওয়া যায়না, শুধু তার পেয়ারের চাকর বলে '' বাবু দুদিন আগেই তার বুলেট গাড়ীতে চড়ে বেড়িয়ে গেছেন ''। এরই মধ্য থানায় একটা নতুন ঝামেলা, ভৈরব হাজরার ভাগ্নে সুমিতও নাকি দুদিন ধরে নিখোঁজ আর তার স্ত্রীও থানায় অভিযোগ লেখাতে এসেছেন। এই ঘটনা দুটিকে সবে শালিনী মেলাবার চেষ্টায় করছিলেন ঠিক তখনই তার রুমের বাইরে একটা বিরাট হইচইএর আওয়াজ শুনে শালিনী বাইরে বেরিয়েই একদম চমকে যায় ! শালিনী বাইরে এসেই দেখে যে একটা রীতিমত ভিড় জমে গেছে আর সেই ভিড়ের মধ্য সহায় সাহেবও আছেন,তবে সহায় সাহেব সেই ভিড়ে পার্শ্বচরিত্র হিসাবেই আছেন আর ভিড়ের মধ্যমণি হয়ে দুজন ছিলো এক সুমিত ভৈরব হাজরার ভাগ্নে আর দুই ক্লান্ত, বিধস্তব নিশিকান্ত।
শালিনী দুর থেকে যেটাকে ভিড় আর চিৎকার চেঁচামিচি ভেবেছিলো আদতে সেটা নিশিকান্তর একার শো ছিলো, সুমিতকে নিশিকান্ত রীতিমত ধস্তাধস্তি করেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছিলো আর সুমিত প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। তবে নিশিকান্তর শক্তির কাছে অবশেষে হার মেনে নেয়, এতক্ষণে নিশিকান্ত তাকে কব্জা করতেই সহায় সাহেব উত্তেজনায় চেচিয়ে বলে '' ওকে ধরে ভেতরে নিয়ে এসো, একদম ছাড়বে না ''। সহায় সাহেবের মুখের কথা খসতে খসতেই নিশিকান্ত বাকি পুলিসদের সাহায্য ততক্ষণে সুমিতকে সোজা শালিনীর চেম্বারে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। সহায় সাহেব ইতিমধ্যিই থানার বাইরে আর শালিনীর ঘরের বাইরে একটা কড়া পাহারা বসিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। হতভম্ব অবস্থায় শালিনী শুধু দেখে যেতে থাকে যে ঠিক কি হচ্ছে তার থানায় তারই চোখের সামনে, তবে সে কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না, একবার সে আর না পেরে জিজ্ঞেসও করতে যায় নিশিকান্তকে তবে সহায় সাহেব তাকে ইশারায় নিরস্ত্র করে দেয়।
নিশিকান্তর অবশ্য তখন কোনদিকে নজর না দিয়ে একমনে সুমিতের হাতে হাতকড়া পড়াতেই ব্যাস্ত ছিলো, একটা চেয়ারের সঙ্গে সুমিতকে বেঁধে নিয়ে তার কাজ সম্পন্ন করে তারপরে ঘর্মাক্ত অবস্থায় নিশিকান্ত এবার এতক্ষণে শালিনীর দিকে ফিরে তাকিয়ে একটা সুন্দর , বিজয়ীর হাসি উপহার দেয়।
শালিনী এতক্ষণ ধরে তার চেপে রাখা রাগ আর কৌতূহল আর চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলে ' কি অমন হনূমানের মতন দাঁত বার করে হাসছো ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা, আর সুমিতবাবুকেই বা তুমি কোথায় পেলে ? আর ওনাকে অমন ভাবে চেয়ারের সঙ্গে অপরাধীর মত বেধেই বা কেন রেখেছো?''
নিশিকান্ত শালিনীর এত প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সহায় সাহেব তার গম্ভীর গলায় বলে উঠেন '' শালিনী তোমার উচিত ওকে বাহবা দেওয়ার না কি তার বদলে তুমি ওকেই জেরা করতে শুরু করে দিলে ''
শালিনী ভাবতেও পারেনি যে সহায় সাহেব তাকে এইভাবে নিশিকান্তর সামনেই তার কথা কাটবেন, তবে শালিনী ভালো করে জানতো যে তারও সময় আসবে আর খুব তাড়াতাড়িই আসবে । তাই সাময়িক সে এই অপমানটা সহ্য করে চুপ করেই রইলো, কারন এখন তার প্রাথমিক কাজ ছিলো এই পুরো ব্যাপারটা জানা ভালো করে জানা। সহায় সাহেব ততক্ষণে নিশিকান্তকে প্যাম্পার করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলো, সহায় সাহেব ইতিমধ্যিই তার ফোন বের করে কাকে যেন তক্ষুনি একটা স্কচের বোতল আনতে বলে। শালিনী এটাও ভালো করে বুঝতে পারে যে এই অপারেশনের খবর নিশ্চয় নিশিকান্ত সহায় সাহেবকে অনেক আগেই দিয়েছিলো তাই সহায় সাহেবের এই আগাম আনন্দ। শালিনী এটাও ভালো করেই জানতো যে সেই বোতলটার প্রাপক কে হবে, শালিনীর এইবার এইসব মাতামাতি দেখে খুব বিরক্তি লাগছিলো তাই সে এবার চেয়ারে বেঁধে রাখা সুমিতের কাছে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে তার কাছে দাঁড়ায়, তবে শালিনী দেখে যে সুমিত এতক্ষণের ধস্তাধস্তিতে একদম ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় অপেক্ষায় বসে আছে যে কখন তার শমন এসে পৌঁছবে !
তবে শালিনী একান্ত ভাবে চাইছিলো সুমিতের মুখ থেকে সবকিছু বিস্তারিত ভাবে শুনতে, কারন শালিনীর নাকে এই ব্যাপারটায় যেন একটা আঁশটে গন্ধ ভেসে আসছিলো! ভগবান নিজেই যেন শালিনীর জন্য সেই সুযোগটা তৈরি করে দিলেন কারন সহায় সাহেবর অর্ডারে ইতিমধ্যিই একটা জনি ওয়াকারের বোতল এসে পৌঁছেছিলো,
নিশিকান্ত একটা আর্দালির হাতে সেই বোতলটা দেখে যেন ছোট্ট ছেলের মতই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, তবে সহায় সাহেব তাকে অত সহজে বোতলটা না দিয়ে ঘরের বাইরে আর থানায় উপস্থিত সমস্ত অফিসারদের ডেকে নেয় ঘরের ভেতরে আর সবার সামনে ঘোষণা করে বলে '' যে রহস্যময় কেসটা আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো সেটা আমাদের বেস্ট অফিসার নিশিকান্ত শলভ করে দিয়েছে,এই সমস্ত মৃত্যুর পেছনে ছিল নিহত প্রফেসার ভৈরব হাজরার ভাগ্নে সুমিত আর এই কেসের সমস্ত প্রমান থেকে স্বীকারোক্তি সবই নিশিকান্ত জোগাড় করে নিয়েছে, তাই কেসটা আমাদের কোর্টে প্রমান করতেও বেশী বেগ পেতে হবে না আর এই সাফ্যল্যর জন্য আমার তরফ থেকে নিশিকে একটা ছোট্ট গিফট '' বলেই সহায় সাহেব তার হাতের বোতলটা নিশিকান্তর হাতে ধরিয়ে দেয় আর অফিসে একটা হুল্লোড়ের আওয়াজ উঠে।
নিশিকান্ত একদম বিজয়ীর মতই হাতের বোতলটা মাথার ওপর তুলে ধরে মুখে একটা মৃদু হাসি ঝুলিয়ে, সবার ওপর চোখ বুলিয়ে শেষে শালিনীর মুখের ওপর স্থির হয়ে তাকিয়ে হাসিটা আরো একটু বাড়িয়ে একটা স্নেহের আর ভালবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। শালিনীকে মনেমনে একদম জ্বলে গেলেও মুখে বাধ্য হয়েই তাকে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হলো। সহায় সাহেব আর বাকি সবাই চলে গেলে উদ্যাত হতেই শালিনী এইবার মাঠে নামে, শালিনী এইবার একটু মৃদু অভিযোগের সুরেই সহায় সাহেবকে বলে '' স্যার পুরো কেসটার দায়িত্বে আমিই রিলাম কিন্তু কেসটা শলভ হলো কীভাবে সেটা জানলাম না, সুমিতই যে আসল খুনি যদি অবশ্য মৃত্যুগুলো খুনই হয় তবেই কি জন্য আর কীভাবে খুন হলো সেটাও জানতে পারলাম না , এটা তো স্যার ঠিক নয় বলুন ''।
সহায় সাহেব ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ না করলেও একরকম বাধ্য হয়েই নিশিকান্ত কে বলে '' নিশি তুমি যতই ক্লান্ত হও, ম্যাডাম ছাড়বেন না, চলো পুরো ব্যাপারটা বলেই ফেলো ''। নিশিকান্ত হাতের বোতলটার দিকে একবার করুন চোখে তাকিয়ে নিয়ে একটা চেয়ারে তার শ্রান্ত শরীরটা নিয়ে বসে পরে, আর সহায় সাহেবের ইশারায় বাকি সবাইও ঠিক জায়গা খুজে বসে পরে। শুধু শালিনী তীক্ষ্ণ চোখে নিশিকান্তকে দেখে যেতে থাকে, নিশিকান্ত ততক্ষণে তার ক্লান্ত গলায় ঘটনাটা বলতে শুরু করে দিয়েছিলো । এবার ঘটনাটা শোনা যাক নিশিকান্তর জবানিতে ।'' সেদিন যখন আমাকে শালিনী ম্যাডাম তার অফিসে আমাকে বলে দিলেন যে কেসটা শলভ করার ডেডলাইন আর মাত্র সাতদিন আমি সেইদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে যেমন ভাবেই হোক এই কেসটার রহস্য আমি ভেদ করবই। তাই আমি সেদিন আবার রাজাবাবুর কাছে যায় তার সাহায্যর জন্য তবে আগের কয়েকবারের মত এবার আর আমাকে খালি হাতে ফিরতে হয়না, এবার রাজাবাবু আমাকে একটা ডাইরি দেয় যাতে নাকি এই কেস সম্বন্ধে ওনার সমস্ত স্টাডি রিপোর্ট লেখা ছিলো,আমি শালিনী ম্যাডামকে এনে ডাইরিটা দিতে উনি একটু পরেই আমাকে ফেরত দিয়ে দেন কারন ওনার মনে হয়েছিলো যে ডাইরির লেখকের কোনও ধারনায় নেই এইসব কেস সম্বন্ধে। তারপর রাজাবাবু একজন পুরনো ক্রিমিনাল হওয়াতে ম্যাডামের বিরক্তি আরও বেড়ে গেছিলো, তবে আমি ম্যাডামকে দোষ দিইনা কারন উনি রাজাবাবু সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিলেন। যাই হোক আমি ওনার অফিস থেকে বেড়িয়ে সোজা আমার ঘরে পৌঁছে রাজাবাবুর ডাইরিটা ভালো করে পড়তে আরম্ভ করে দি আর আশ্চর্যের বিষয় হলো যে আমার ধারণা আর রাজাবাবুর লেখা দুটোই মোটামোটী ভাবে একই ছিল, আর আমি এই তদন্তের একদম প্রথম দিকেই একটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম যে হয়তো আমাদের বোকা বানানোর জন্যই এতগুলো মানুষকে মারা হয়েছে, আসল টার্গেট হয়তো শুধু একজন। রাজাবাবুর ডাইরিতে এই উল্লেখ পেতেই আমি সোজা সুমিতের পেছনে পরে যায় কারন প্রথম থেকেই আমার সুমিতের উপরেই সন্দেহ ছিলো আর পারিপার্শ্বিক সবই আমার সে সন্দেহের কথাকে সমর্থন করছিলো। আমি খোজ নিয়ে জানতে পারি যে সুমিত মাঝপথেই ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে একদম বখে যায় আর তার মামার সঙ্গে বনিবনার অভাব হতে লাগে, যেহেতু ভৈরববাবুর সুমিত ছাড়া কেউ ছিলো না তাই তার মামার বিপুল সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ সেই ছিলো আর সুমিত এইবার তার মামাকে চাপ দিয়ে পয়সা নিতে থাকে,ভৈরববাবু সব বুঝেও কিছু না করেই তাকে পয়সা দিয়ে যেতে থাকেন এই আশাতেই যদি তার মেধাবি ভাগ্নেটা আবার সুপথে ফিরে আসে, তবে সে আশায় জল ঢেলে সুমিত ইতিমধ্যিই নিজের পছন্দের একটি মেয়েকে বিয়েও করে ফেলে এবার তার মামা একদম রেগে আগুন হয়ে পয়সা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়,
পরে অবশ্য সুমিতের বউ ওনার পায়ে হাতে ধরে আবার কিছু পয়সার ব্যাবস্থা করে, তবে সুমিত যেরকম বাবুয়ানিতে অভ্যাস্ত হয়ে গেছিলো তাতে সে তার মামার এই সামান্য দানে সংসার চালাবে না নিজের বাবুয়ানি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না আর ভেতরে ভেতরে ফুঁসে যাচ্ছিলো ......''
এইটুকু বলতে না বলতেই শালিনী এবার নিশিকান্তকে মাঝপথে থামিয়ে জিগ্যেস করে '' এত খবর আপনি কিভাবে জানলেন? ''
নিশিকান্ত একটু হেসে বলে '' ম্যাডাম পুলিশে এতদিন তো আর ঘোড়ার ঘাস কাটিনি, তাই কীভাবে কথা বের করতে হয় সেটাতো আমাদের জানতেই হয় বলুন '' এতক্ষণ টানা কথা বলে নিশিকান্ত একটু হাঁপিয়ে গেছিলো তাই সে হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা নিতে নিতে নিজের মনেই যেন বলে উঠলো '' কি কপাল হাতে অমৃত থাকতেও জল গিলতে হবে!'' কথাটা শুনেই গোটা ঘরে একটা চাপা হাঁসির রোল উঠলো, সহায় সাহেবও কোনমতে হাসি চেপে বলে উঠে '' সাইলেন্স, সাইলেন্স ''।
সব চুপচাপ হয়ে গেলে নিশিকান্ত আবার শুরু করে '' তা সেদিন আমি আমার ঘরে বসেই ঠিক করে নি যেমন ভাবেই হোক আমি সুমিতকে একবার তুলবোই তুলবো ।রাত হতেই আমি আমার বুলেটটা নিয়ে সুমিতের সমস্ত ঠেকগুলো খুজতে আরম্ভ করে দি আর অবশেষে ওকে আমি সেই নদীর ধারে একটা ছোট্ট জঙ্গলের মধ্য থেকে ড্রাগস নেওয়া অবস্থায় ধরি,তবে সেই অবস্থায় সুমিত কিন্তু সমানে তড়পে যাচ্ছিলো। সে শুধু বলে যাচ্ছিলো তার প্রভাব আর পয়সার জোরে সে একদিনেই ছাড়া পেয়ে যাবে,আর সেই ভয়েই আমি ওকে থানায় না এনে একটা গোপন জায়গায় তুলে নিয়ে যেয়ে টানা চব্বিশ ঘণ্টা জেরা করে সমস্ত তথ্য উদ্ধার করে তা নথিবদ্ধ করে তবে ওকে নিয়ে এসেছি জনসমক্ষে। প্রথমে তো সুমিত কিছুতেই স্বীকার করে উঠছিলো না তার অপরাধ তবে একটু ''ওষুধ'' পড়তেই সব গড়গড় করে বলতে আরম্ভ করে দিলো, আমি সবটা শুনে একদম চমকে গেছিলাম, মানুষের যে এত শয়তানী বুদ্ধি হতে পারে সেটা ভেবে।
ধৃতরাষ্ট্র - দা বস !